অস্ট্রেলিয়া দলে প্রথম যখন এসেছিলেন, সতীর্থরাই নাকি তার নামটা ভালভাবে উচ্চারণ করতে পারত না, সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন অপরিচিত একটা নাম। অনেকটা বাধ্য হয়েই ইউটিউবে একটা ভিডিও বানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তার নামের সত্যিকারের উচ্চারণ হল ‘মার্নাস ল্যাবুশেন’!
২০১৯ শেষে এসে সেই ল্যাবুশেনের নাম উচ্চারণ করতে আর কেউ কোনো ভুল করেন না। ভুল করার আর কোনো উপায় নেই। তিনি যে ক্রিকেট ইতিহাসে রীতিমতো বিপ্লবই ঘটিয়ে বসেছেন! ক্রিকেটের খবরের পাতায় তিনি এখন নিয়মিত মুখ। ২০১৯ সালে তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান, যিনি টেস্টে করেছেন এক হাজার রান। এর চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, ক্যারিয়ারের প্রথম ১২ টেস্ট খেলার পরই তিনি চলে এসেছেন ব্যাটসম্যানদের র্যাংকিংয়ের সেরা দশে! এই অর্জনটা আসলে চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।
মার্নাস ল্যাবুশেনের শুরুটা শুনলে সবার মুখ থেকেই একটা শব্দ বের হবে – দ্যেজা ভ্যু! কারণ, অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান স্টিভেন স্মিথের মতো তিনিও শুরুটা করেছিলেন লেগ স্পিনার হিসেবেই। স্মিথ কালক্রমে ব্যাটসম্যান বনে গিয়ে একগাদা রেকর্ডের মালিক বনে গেছেন। আর স্মিথেরই সতীর্থ আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ল্যাবুশেনও সেই পথেই আছেন এখন অবধি।
লেগ স্পিনার থেকে ব্যাটসম্যান হয়ে গিয়ে ল্যাবুশেন সাফল্য পেয়েছেন টেস্টের তিন নম্বর পজিশনে। এবার তিনি অপেক্ষায় আছেন ওয়ানডে অভিষেকের।
ল্যাবুশেন এখন তিনে খেললেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে গেল ২০১৪ সালে তার অভিষেকটা হয়েছিল ওপেনার হিসেবে। কুইন্সল্যান্ডের হয়ে প্রথম ম্যাচেই করেছিলেন ৮৩ রান। বোঝা গিয়েছিল, লেগ স্পিনার পরিচয়ের আড়ালে ব্যাটসম্যান হিসেবেও সক্ষমতা আছে ল্যাবুশেনের। কুইন্সল্যান্ডেই ব্যাটসম্যান হিসেবে তার বিকাশ হতে থাকে।
শেফিল্ড শিল্ড হলো অস্ট্রেলিয়ার প্রধান প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আসর। ২০১৭-১৮ মৌসুমে জমজমাট সেই আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন ল্যাবুশেন। তিনি সেবার ৪০ গড়ে করেছিলেন ৭৯৫ রান।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকের তাই চার বছরের মধ্যেই প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের ডাক পান ল্যাবুশেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০১৮ সালের অক্টোবরে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।
ব্যাটিং পজিশনটা যুতসই হয়নি ল্যাবুশেনের, খেলেছিলেন ছয় নম্বরে। দুই টেস্টে করেছিলেন মোটে ৮১ রান। যদিও হাল ছাড়েননি ল্যাবুশেন, শেফিল্ড শিল্ডে ফিরে আবারও সেই রানের বন্যায় ডুব দেন। এবার মাত্র নয় ম্যাচে করেন ৪১৬ রান।
সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ভারতের বিপক্ষে যখন খেলতে নেমেছিলেন, তখনও ব্যাটিং নৈপুণ্যের কিছু ঝলক দেখিয়েছিলেন। সেবারের গ্রীষ্মেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, ছড়িয়েছিলেন মুগ্ধতা।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি অবধিও ল্যাবুশেনের নামটা অপরিচিতই ছিল। তখনও তিনি বড় কোনো ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারেননি। অন্তত বিশ্বকাপের আগ অবধি বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে, তিনিই বছরের অন্যতম সেরা তারকা হয়ে উঠতে যাচ্ছেন।
বিশ্বকাপের ট্রফি পায় ইংল্যান্ড। এরপরই অস্ট্রেলিয়া দল আসে ইংল্যান্ডে, উদ্দেশ্য ১৮ বছর পর ইংল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে অ্যাশেজ জয়। এই অ্যাশেজেই বল টেম্পারিংয়ের নিষেধাজ্ঞা কাটানোর পর প্রথমবারের মতো টেস্টে ফেরেন স্টিভেন স্মিথ। দাপুটে এক প্রত্যাবর্তন দেখে ক্রিকেট বিশ্ব।
যদিও জোফরা আর্চারের এক বাউন্সারে মাথায় আঘাত পেয়ে গত আগস্টে টেস্টের মাঝপথেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যেতে হয় স্মিথকে। লর্ডসে তাই টেস্টের ১৪২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘কনকাশন সাবস্টিটিউট’ হিসেবে মাঠে নেমে যান মার্নাস ল্যাবুশেন। কে জানত, এত দারুণভাবে সুযোগটা কাজে লাগাবেন এই ডানহাতি!
চার টেস্টে তিনি করেন ৩৫৩ রান, ব্যাটিং গড় ছিল ৫০-এর ওপরে। এতে ল্যাবুশেন থিতু হয়ে যান ব্যাটিং অর্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পজিশন – তিন নম্বরে। আর নিজের তেমন একটা দোষ না থাকার পরও বাইরে চলে যেতে হয় উসমান খাজাকে। অস্ট্রেলিয়াও অ্যাশেজের ছাইভস্ম নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়।
যদিও ইংলিশ কন্ডিশনে ‘এলেন, দেখলেন, জয় করলেন’ জাতীয় কিছু ঘটেনি ল্যাবুশেনের সাথে। অ্যাশেজের আগে তিনি অল্প সময়ের জন্য ব্যস্ত ছিলেন কাউন্টি ক্রিকেটে। গ্ল্যামারগনের সাথে তার কাটানো সেই সময়টাই কাজে দিয়েছে অ্যাশেজের মঞ্চে। অ্যাশেজের ইতিহাসে এমন আগমনের ঘটনা খুব সামান্যই পাওয়া যায়।
অ্যাশেজের গোটা সময়টাতেই বাজে রকম অফ ফর্মের মধ্য দিয়ে গেছেন ডেভিড ওয়ার্নার। তবে, ল্যাবুশেন এতটাই ছন্দে ছিলেন যে, ওয়ার্নারের বাজে সময়ের প্রভাব অজিদের ব্যাটিংয়ে পড়েছে সামান্য। ল্যাবুশেন দলের ও ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে খেলেছেন।
প্রথম সেঞ্চুরির খুব কাছে চলে গিয়েও দলের প্রয়োজনে বড় শট খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন। যদিও সে আক্ষেপ মিটে গেছে অল্প ক’দিনের ব্যবধানেই। শুধু ২০১৯ সালেই তিনি তিনবার পৌঁছেছেন তিন অংকের ম্যাজিক্যাল ফিগারে।
দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে তিনি ছিলেন আরো বেশি দানবীয়, একাই করেছেন ৩৪৭ রান। এর মধ্যে ছিল দু’টি সেঞ্চুরি। পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণকে যেভাবে শাসন করেছেন, যেভাবে দায়িত্ব নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাট করেছেন, যেমন অবাধ স্বাধীনভাবে খেলেছেন, তাতে বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না যে, মাত্রই টেস্ট ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। পাকিস্তান ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয়।
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের শুরুতে আবারও সেই ল্যাবুশেনের জয়জয়কার। ট্রান্স-তাসমান প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি, সাথে একটা হাফ-সেঞ্চুরি। পার্থের প্রথম ম্যাচে সহজেই জিতে যায় অস্ট্রেলিয়া। পরের টেস্টও জিতে নিয়ে নিউ জিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার পথেই ছিল টিম পেইনের দল। ল্যাবুশেন তখন অবধি সিরিজে করেছিলেন ২৭৫ রান। তবে তৃতীয় ম্যাচে আরেকবার ছাড়িয়ে গেলেন নিজেকে, প্রথম ইনিংসে খেললেন ২১৫ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। পরে দ্বিতীয় ইনিংসেও ৫৯ রানের এক ইনিংস খেললে তিন ম্যাচের সিরিজে সাকুল্যে তার রান দাঁড়ায় ৫৪৯! ফলাফল, অনায়াসেই হোয়াইটওয়াশ নিউ জিল্যান্ড।
ল্যাবুশেন কেবল ২০১৯ সালেই টেস্টে সবার চেয়ে বেশি রান করেননি, তিনি ২০১৮ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সময়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও। বোঝাই যাচ্ছে, সাদা পোশাকে তার মতো দাপুটে ব্যাটসম্যান এই সময়ে আর খুব বেশি নেই!
তবে, এখানে এটা যোগ করলেই নয় যে, রঙিন পোশাকেও তিনি সমান পারদর্শী। অন্তত অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিজের সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। কুইন্সল্যান্ডের হয়ে মার্শ ওয়ানডে কাপে মাত্র ছয় ম্যাচেই ল্যাবুশেনের ব্যাট থেকে এসেছে ৩৬৪ রান, ব্যাটিং গড় ৬০.৬৬। সেই সুবাদে ওয়ানডে দলেও তাকে ডেকে পাঠিয়েছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) নির্বাচক কমিটি।
প্রথম ১৩ টেস্ট শেষে ল্যাবুশেনের রান ১,১৮৫। তিন সেঞ্চুরি আর সাত হাফ সেঞ্চুরি, গড় ৫৬.৪২। ব্যাপারটা এখন এমন যে, তিন নম্বর পজিশনে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেই নারাজ অস্ট্রেলিয়া দল।
ল্যাবুশেন নিজের সক্ষমতাকে এমন একটা স্তরে নিয়ে গেছেন যে, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট ইয়ান চ্যাপেল তার সাথে তুলনা করেছেন সাবেক দুই ক্রিকেটার রিকি পন্টিং ও মাইকেল ক্লার্কের। ফলে, বলে না দিলেই চলে যে, বড় কোনো অঘটন না ঘটলে নিজের তারকাখ্যাতিকে আরো বড় করেই ছাড়বেন ল্যাবুশেন। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। লাল বলের মতো এবার সাদা বলেও যদি নিজেকে মেলে ধরতে পারেন নিজেকে, তাহলে বলে দেওয়াই যায়, ক্রিকেটের জাদুর কাঠি হাতে নিয়েই আবির্ভাব হয়েছে ল্যাবুশেনের!