২০১৬ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের মঞ্চ, মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে নিজেদের প্রতি দেশের বোর্ডের অবহেলার কথা অকপটে স্বীকার করলেন তিনি। শচীন টেন্ডুলকারের শেষ টেস্ট ম্যাচ, শচীনের ৭৪ রানের সময় হঠাৎ ওঠা ক্যাচ তালুবন্দী করেই কিংবদন্তীর বিদায়ের মুহূর্তে বিমর্ষ চেহারায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন তিনি। বিপিএলের ম্যাচ, বিপক্ষ দলের কোনো ব্যাটসম্যানকে আউট করে মোবাইল ছাড়াই সেলফি তোলার ভঙ্গিতে উদযাপনের এক ভঙ্গি আবিষ্কার করলেন তিনি। সবকিছু মিলিয়ে খেলার মাঠে সাধারণ রূপে অসাধারণ এক ব্যক্তিই তো ড্যারেন স্যামি।
“বোর্ড থেকে আমরা খেলার কোনো সামগ্রী পাইনি। আমাদের ম্যানেজার এগুলো কলকাতা থেকে নিয়েছেন। আজ রাতের আনন্দ আমি আমাদের কোচিং স্টাফ এবং ১৫ জন খেলোয়াড়ের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। জানি না এর পর আমরা একসাথে মিলিত হব কিনা। বোর্ড আমাদের ওডিআই দলে সুযোগ দেয় না। টি-টুয়েন্টি দলে আমরা সুযোগ না-ও পেতে পারি। এ জয় আমি ক্যারিবিয়ান ভক্তদের উৎসর্গ করতে চাই।”
গত টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের মাটিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ৪ উইকেটে হারিয়ে স্যামির নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতে ক্যারিবিয়ানরা। পুরস্কারের মঞ্চে আবেগপ্রবণ হয়ে এই কথাগুলো বলেন স্যামি।
১৯৮৩ সালের ২০ ডিসেম্বর, উইলসন স্যামি ও ক্লারা স্যামি দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক শিশু, যার নাম রাখা হয় ড্যারেন। পুরো নাম ড্যারেন জুলিয়াস গার্ভে স্যামি। শৈশব থেকেই তার মধ্যে অমায়িক ও মার্জিত আচরণ লক্ষ্য করা যেত বলে জানান তার বাবা-মা।
স্যামি হয়ে ওঠার গল্প
সাল ২০০১, স্যামির বয়স তখন ১৮ ছুঁইছুঁই। এই বয়সে অনেকেরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়, তবে স্যামির বেলায় তেমনটা হয়নি। জ্যামাইকার বিপক্ষে নর্দার্ন উইন্ডওয়ার্ডের হয়ে লিস্ট-এ ক্যারিয়ার দিয়ে সবেমাত্র ক্রিকেটে তার পদচারণা শুরু। সে টুর্নামেন্টে দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেন স্যামি। পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাওয়া। নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সেই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কাছে হেরে যায় স্যামিদের দল। সেসময় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ডোয়াইন ব্রাভো, লেন্ড সিমন্স, রবি রামপল এর মতো খেলোয়াড়রাও ছিল, যাদের সাথে পরবর্তীতে জাতীয় দলে স্যামির দেখা হয়।
নিউজিল্যান্ড থেকে ফিরে পরের বছরই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক। দল এবারও সেই উইন্ডওয়ার্ড। তবে সেবার প্রতিপক্ষ বার্বাডোস। কিন্তু এবারও ব্যর্থ স্যামি। প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে শূন্য রান, বল হাতে নেই কোনো উইকেট। পরের ম্যাচের প্রথম ইনিংসেও শূন্য রান। অবশ্য দ্বিতীয় ইনিংসে আর ভুল করেননি স্যামি। ঠিকই তুলে নিয়েছেন অর্ধশত। পুরো টুর্নামেন্ট শেষে স্যামির ঝুলিতে ২২ উইকেট ও ২৬১ রান সবাইকে খানিকটা ইঙ্গিত তখনই দিয়েছিল, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে আসছে এক নতুন অলরাউন্ডার।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পদার্পণ
ঠিক পরের বছরই ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নিউজিল্যান্ড-ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজে ১৫ সদস্যের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ডাক পান স্যামি। এর আগে ইংল্যান্ডের মিডলসেক্স প্রিমিয়ার লিগে বার্নেস ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলেন তিনি। মূলত ইংল্যান্ডের পরিবেশে খেলার অভিজ্ঞতাই ছিল দলে তার সুযোগ পাওয়ার মূল কারণ। ২০০৪ সালের ৮ জুলাই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে এক দিনের ক্রিকেটে পদার্পণ তার। দুর্ভাগ্যবশত সেই ম্যাচ বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়। পরে অবশ্য সেই সিরিজে কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি স্যামি। সেপ্টেম্বরে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দলে সুযোগ পান আবার। সেই টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৭ সালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক হয় স্যামির। অভিষেক ম্যাচে তিনি ৫৬ রান দিয়ে তুলে নেন ৭ উইকেট।
অধিনায়ক স্যামি
ক্রিস গেইলকে সরিয়ে ২০১০ সালের ১৭ই অক্টোবর স্যামিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। পরের বছর স্যামির নেতৃত্বে বাংলাদেশে খেলতে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম টেস্ট বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হলেও দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশকে হারিয়ে সিরিজ ১-০ তে জিতে নেয় স্যামিরা। দ্বিতীয় টেস্টে সাকিব আল হাসানের উইকেটটি ছিল স্যামির ক্যারিয়ারের ৫০ তম টেস্ট উইকেট। সে বছরই ট্রেন্ট ব্রিজে ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট সেঞ্চুরি। স্যামুয়েলসকে সাথে নিয়ে গড়েন ২০৪ রানের জুটি, যা ছিল সপ্তম উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ।
২০১৪ সালে ব্যর্থতার দায়ে তাকে টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলে সে বছরই স্যামি আন্তর্জাতিক টেস্ট থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) এর চতুর্থ পর্বে রাজশাহী কিংসের নেতৃত্ব দেন স্যামি। দলকে তুলে নেন ফাইনাল পর্যন্ত। ফাইনালে ঢাকা ডায়নামাইটস এর কাছে হেরে গেলেও পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে স্যামির নেতৃত্ব ছিল প্রশংসনীয়। সে বছর পুরো দলকে নিয়ে মোবাইল ছাড়াই স্যামির সেলফি তোলার উদযাপনটি ছিল টুর্নামেন্টের অন্যতম আকর্ষণ। পরের মৌসুমে রাজশাহী কিংস এর হয়ে খুব একটা সুবিধা করতে না পারলেও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের বিপক্ষে ১৪ বলে ৪৭ রানের এক ঝলমলে ইনিংস খেলেন স্যামি।
ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে নিজ শহরের দল সেন্ট লুসিয়া স্টারসের নেতৃত্ব দেন স্যামি। ৪৪ ম্যাচে স্যামির সংগ্রহ ছিল ৭০২ রান ও ২২ উইকেট।
পিএসএলে স্যামি নেতৃত্ব দেন পেশোয়ার জালমির, যে দলে স্যামির সঙ্গী ছিলেন তামিম ইকবাল এবং সাকিব আল হাসান। ২০১৭ সালে টুর্নামেন্টটির ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয় লাহোরের কর্নেল গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। নিরাপত্তাজনিত কারণে দলের অনান্য বিদেশি খেলোয়াড়রা পাকিস্তানে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করলেও স্যামির নেতৃত্বে লাহোরে কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটরসের বিপক্ষে ৫৮ রানের দুর্দান্ত জয় পায় পেশোয়ার জালমি।
বিপিএল, সিপিএল, পিএসএল ছাড়াও এর আগে বিগ ব্যাশে হোবার্ট হ্যারিকেনের হয়ে খেলেছেন স্যামি। এছাড়াও ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) রয়েল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরু, সানরাইজার্স হায়দারাবাদ এবং গত মৌসুমে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে খেলেছেন তিনি।
২০১০ সালে ছোটবেলার বান্ধবী ক্যাথি ড্যানিয়েলকে বিয়ে করেন স্যামি। সম্প্রতি তৃতীয়বারের মতো বাবা হয়েছেন। স্কাই এবং ড্যারেন স্যামি জুনিয়র নামের আরো দুই সন্তান রয়েছে স্যামির।
ড্যারেন স্যামি স্টেডিয়াম
২০১২ সালে টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলংকাকে হারিয়ে প্রথম শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০১৬ সালে ঘরের মাটিতে ভারতকে হারিয়ে স্যামির নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা ঘরে তোলে ক্যারিবিয়ানরা। স্যামির সম্মানার্থে স্যামির নিজ শহর সেন্ট লুসিয়ার বোসেজের ক্রিকেট গ্রাউন্ডের নাম পরিবর্তন করে ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ড রাখা হয়। এখনও খেলে যাচ্ছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে স্যামিই একমাত্র, যার নামে স্টেডিয়াম রয়েছে।
যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে দু’বার টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা এনে দিয়েছেন স্যামি, সেই স্যামিকেই ২০১৬ সালের ৫ আগস্ট টি-টুয়েন্টি দলের অধিনায়কত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বোর্ডের প্রতি এক চাপা অভিমান থাকলেও সব হাসি মুখে বরণ করে নিয়ে প্রতিনিয়তই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটকে নিজের শতভাগ উজাড় করে দিয়ে যাচ্ছেন ড্যারেন জুলিয়াস গার্ভে স্যামি।
ফিচার ইমেজ- Zimbio.com