মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, বাংলাদেশের কোচিং জগতে এক সফল নাম। জাতীয় দলের কোচিং স্টাফদের বাইরে তারকা ক্রিকেটারদের নেটে সবচেয়ে বেশি ডাক পড়ে তার। বিসিবি কাড়ি কাড়ি টাকা লগ্নি করে হাই প্রোফাইল কোচ রাখলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আস্থার আশ্রয় সালাউদ্দিন। ক্রিকেটারদের প্রয়োজনে সবসময় সাড়া দেন তিনি। জাতীয় দলের ক্যাম্পের বাইরে মিরপুরে হরহামেশাই ক্রিকেটারদের নিয়ে কাজ করতে দেখা যায় তাকে। উন্নতির চেষ্টা, খারাপ সময় কাটিয়ে উঠার চেষ্টায় সবসময় তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা তার মাঝেই স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পান।
মূলত সাকিব আল হাসানের ‘গুরু’ হিসেবে সালাউদ্দিনের পরিচিতি ক্রিকেটবিশ্ব জুড়ে। শুধু সাকিবই নন, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলের শীর্ষ ও তরুণ একঝাঁক ক্রিকেটারের অনেক নির্ভরতা তার উপর।
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও কোচ হিসেবে তিনি পরীক্ষিত। ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) শিরোপা জিতেছেন অনেকবার। বিপিএলে দুইবার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি প্রিয় শিষ্য সাকিবের আমন্ত্রণে ভারতের হায়দরাবাদে গিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের নেটে সাকিবের সঙ্গে কাজ করেছেন। অরেঞ্জ আর্মিদের টিম হোটেলে ১০ দিন ছিলেন বাংলাদেশের এই কোচ। দলটার অনুশীলন, ম্যাচ পরিকল্পনাসহ সবকিছু খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। গত ২২ এপ্রিল ঢাকায় ফিরেছেন সালাউদ্দিন। একান্ত আলাপে জাতীয় দলের সাবেক এই সহকারী কোচ সবিস্তারে জানিয়েছেন, তার আইপিএল অভিজ্ঞতা।
ওদের তো কোচিং স্টাফ মানে একটা সেটআপ আছে। তার মাঝে আপনি গিয়ে সাকিবের সঙ্গে কাজ করেছেন। ওরা কিভাবে বিষয়টা গ্রহণ করেছে?
ম্যাচ থাকলে পরের দিন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্রাম থাকে। বিশ্রামের দিনগুলোতেই আমি আর সাকিব কাজ করতাম। সকাল-বিকেল দুই বেলাই পারলে করতাম। প্র্যাকটিস উইকেটগুলো আসলে খুব ভালো মানের উইকেট ছিল। তাই প্র্যাকটিসটাও খুব ভালো হয়েছে। আর দলের সাথেও যেতাম। এরা দলের প্র্যাকটিস করতো, আমি দেখতাম বাইরে থেকে। যদি কিছু সাকিবকে বলা লাগতো, তাহলে হয়তো গিয়ে বলতে পারতাম। ওরা বিষয়টা খুব ভালোভাবেই নিয়েছে। এটা সাকিবের আগ্রহের কারণেই হয়েছে, অন্য কোনো কারণে না। এরা এটার প্রশংসা করেছে যে, একটা ছেলের উন্নতি করার ইচ্ছা আছে, এই কারণেই সে তার কোচকে এখানে নিয়ে আসছে। ওরা ভালোভাবেই নিয়েছে। আমার সাথে ওদের খুব ভালোভাবেই কথা হয়েছে।
বিপিএলে টানা পাঁচটা আসরে কাজ করেছেন। দুইবার চ্যাম্পিয়ন দলের কোচ ছিলেন। এখন দিন দশেক আইপিএলের আবহে কাটিয়ে আসলেন। এখানে আইপিএল নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতাটা শুনতে চাই…
এটা খুব ভালো হয়েছে যে, খুব কাছ থেকে ওদেরকে দেখার সুযোগ হয়েছে, ওরা আসলে কীভাবে কী করে। আমার মনে হয়েছে, অনেক পেশাদার ওরা। কাজও হয় তেমনই। সুযোগ-সুবিধা প্রচুর। আমাদের এখানে দেখা যায়, টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে সব দল এক মাঠে অনুশীলন শুরু করে একসাথে। ওদের তো এমন নয়। ওদের প্রত্যেকটা ভেন্যু আলাদা আলাদা, প্রত্যেকটা দলের আলাদা উইকেট আছে। যখন নেট করে দেখা যায়, একসাথে ৬-৭টা উইকেটে নেট করে।
আমরা ঢাকায় পাই দুইটা নেট। তাও দুই ঘন্টার জন্য। কাছ থেকে দেখলাম যে, উইলিয়ামসন কীভাবে প্রস্তুতি নেয়। আমি দেখলাম, কম না হলেও প্রায় তিন ঘন্টা নেট করলো। একবার এই নেটে, পরে স্পিনে, পরে থ্রো ডাউন, আবার পেস বোলিং, আবার স্পিনে, মানে বারবার নেটে ঘুরে ঘুরে ব্যাটিং করছে। ম্যাচের আগে সে কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেটা কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এতেই বুঝলাম, একটা প্লেয়ার কতটা প্রস্তুতি নিয়ে একটা ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে।
এই যে এতক্ষণ ধরে ব্যাটিং করার সুযোগটা পাচ্ছে সে, আমরা তো স্বাভাবিকভাবে ছেলেদের এমন সুযোগ দিতে পারি না।
আপনার কোচিং ক্যারিয়ারেও অনেক সাফল্য আছে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। এই সফরের অভিজ্ঞতা কোচ হিসেবে আপনাকে কতটা সমৃদ্ধ করল বা ভবিষ্যতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন?
আমার কাছে মনে হয়, আমি এখানে অনেক কিছু শিখতে পারছি। বিশেষ করে টম মুডিকে খুব কাছে থেকে দেখছি। ও কীভাবে খেলোয়াড়দের পরিচালনা করে, সবাইকে ম্যানেজ করে। আর প্রত্যেকটা কোচিং স্টাফের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের জাতীয় দলের কম্পিউটার অ্যানালিস্টও (শ্রী) ছিল। ওর সাথেও অনেক কথা বলছি। ভিভিএস লক্ষ্মণের সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ হয়েছে। ও সবসময় বলছে, তোমার কী লাগবে, তোমার কিছু লাগলে বলো আমাকে।
ওনাকে আমি কিছু প্রশ্নও করেছি। টম মুডিকেও আমি প্রশ্ন করেছি। তারা খুব সুন্দরভাবে আমাকে জিনিসগুলো বুঝিয়ে দিয়েছে। এবং প্রতিটা খেলোয়াড় কত সিরিয়াস! যারা ম্যাচ না খেলে, তারাও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়, সবাই মিলে দারুণ পরিবার। পরিবেশটা খুব ভালো। টম মুডি কীভাবে খেলোয়াড়দের ম্যানেজ করে, এটা খুব কাছে থেকে দেখাটা আমার জন্য খুব কাজে দিবে। প্রতিটা খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলে, ও দলের জন্য কিছু চাইলে ও কীভাবে চায়, এগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে। এই জিনিসগুলো ভবিষ্যতে আমাকে অনেক সাহায্য করবে। আমার মনে হয়, শেখার ছিল অনেক কিছু। এটা ভবিষ্যতে আমারও অনেক কাজে লাগবে।
ভিভিএস লক্ষ্মণ ও টম মুডির সঙ্গে কথা বলেছেন। এদের সঙ্গে আপনার আলাপ সম্পর্কে জানতে চাই। কী কী প্রশ্ন করেছেন তাদেরকে?
আমি যেমন লক্ষ্মণকে বলছি, আমাদের ছেলেরা তো এই পর্যায়ে আছে, পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার জন্য আমাদের কী করা উচিত, বা এদের কী করা উচিত? বলেছে, সাকিব আসলেই অনেক বড় প্লেয়ার। উন্নতির শেষ নাই। তবে সাকিবের এখন অনেক কিছু করে ফেলা সহজ নয়। সে এখন যে পর্যায়ে আছে, এই জায়গা থেকে ও নিজে নিজেই ধীরে ধীরে আরও উন্নতি করবে। এটা হয়ে যাবে খেলতে খেলতে। সবচেয়ে বড় কথা, এই ছেলেটা ১০-১১ বছর ধরে একটা পর্যায়ে খেলছে এবং ভালো করছে। প্রতিটি ম্যাচে তাকে অনেক কিছু সামলাতে হচ্ছে। নিজের পারফরম্যান্সের চাপ, দলের চাপ, ভক্তদের চাপ আছে। এসব চাপ নিয়েই খেলছে। আর এসব চাপের মধ্যে নিজেকে কতটা মোটিভেট করতে পারছে, এটাই হলো বড় ব্যাপার। এই জায়গা থেকে আরও সামনের দিকে যাওয়ার প্রেরণা, আগ্রহ থাকা এবং সামনের দিকে যাওয়া এত সহজও নয়। মোটিভেশন চাইলেই ধরে রাখা যায় না। এটা ধরে রাখতে তাকে আরও অনেক কিছু করতে হয়।
লক্ষ্মণ বলেন, তোমাকে যে সে এখানে নিয়ে আসছে, এটা তার ভেতর সেই মোটিভেশন আছে বলেই নিয়ে আসছে। তুমি ওর সাথে খুব বেশি কাজ করো না, অনেক কিছু করার সুযোগও নেই। ছোটখাটো কাজ করবা। সে যে কাজের প্রতি যত্নবান, নিজেকে আরও উপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য, উন্নতি করার জন্য তোমাকে নিয়ে আসছে, এটা আমরা খুবই অ্যাপ্রিশিয়েট করি।
টম মুডিও একইভাবে বলছে, মোটিভেশনটা ধরে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর টম মুডির সঙ্গে আমি অন্য আরও অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করেছি। আসলে ম্যাচ নিয়ে চিন্তাভাবনা, কোন জিনিসটা কীভাবে করে, আমি হয়তো একভাবে করি, ও কীভাবে একটা টুর্নামেন্টে দলটা চালায়। ও আমাকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। সবগুলো বিষয়। এ জিনিসগুলো আসলে ভবিষ্যতে আমার অনেক কাজে দিবে। এত সব তারকা ক্রিকেটার, বা সব ক্রিকেটারের সঙ্গে কোচের সম্পর্ক, কাজ আদায় করে নেয়া, দায়িত্বটা বুঝিয়ে দেয়া, এসবও সে কীভাবে হ্যান্ডেল করে জানতে চেয়েছি।
বিপিএল, আইপিএলের কিছু পার্থক্য তো আমরা দূর থেকেই দেখি। তারপরও আপনি যেহেতু খুব কাছে থেকে একটা দলকে দেখেছেন। আপনার চোখে কি কি পার্থক্য ধরা পড়েছে দুই টুর্নামেন্টের মাঝে?
আসলে আমার মনে হয় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আইপিএলে গোটা ভারত সম্পৃক্ত হয়ে যায়। দলগুলোর কাজ, প্রস্তুতি, মানুষের ম্যাচ দেখার জন্য যে আগ্রহ, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের আসলে ওই সুযোগ-সুবিধাটা অনেক কম। দলগুলোর অনুশীলনের যে সুযোগ-সুবিধা আছে, এইগুলো আমরা কখনও দিতে পারবো কি না, আমরা জানি না। এভাবে দেয়াটা আমাদের জন্য আসলেই খুব কঠিন। আমাদের এত মাঠও নেই।
তারপর তাদের প্রতিটি কাজে যে পেশাদারি মনোভাব, সবকিছু সময়মতো হয়, খুঁত রাখার মতো জিনিস না। প্রত্যেকটা লোক যে যেই কাজের, সবাই খুব পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে। এটা একটা বড় পার্থক্য।
আর প্রতিটা প্লেয়ারের যে ম্যাচিউরিটি এটা আমার খুব আশ্চর্য লেগেছে। এমনকি দলের ২২-২৩ নম্বর প্লেয়ারের যেই চিন্তা ধারা, এটা আসলে অনেক বড় পার্থক্য আছে আমাদের সাথে। আমাদের লোকাল প্লেয়ারদের সাথে ওদের লোকাল প্লেয়ারের। তারা কী কাজ করবে, তা তারা আগেই জানে, এবং ওখানে গিয়ে তারা লিস্টে দেখে নেয়, আজকে তারা কী কী কাজ করবে, সেগুলোই করে। কোচিং স্টাফ থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্ট, সবকিছুতেই অনেক পার্থক্য আছে। সংগঠকরাও দারুণ আয়োজন করে। সবকিছুই প্রস্তুত। সবাই যার যার কাজ করে। আমাদের এখানে যেমন সবকিছুই হয়তো বোর্ড করে দিচ্ছে। ওখানে কিন্তু এমন না। আলাদা একটা সংগঠন আছে। আইপিএল খেলাবে, চালাবে। তারা সব ঠিক করে রাখছে। সেইভাবেই চলছে।
আইপিএলে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ হয়। শেষ ওভারে ১৫-১৬, এমনকি ২০ রানও তুলে ফেলছে ব্যাটসম্যানরা। দলগুলোর অনুশীলনে কি পাওয়ার হিটিং আলাদা গুরুত্ব পায়?
যারাই আসলে ১৫-২০ রান তোলে, তাদের মধ্যে মহেন্দ্র সিং ধোনি আলাদা। ওর সাথে বর্তমান সময়ে ম্যাচের এমন মুহূর্তে ভারতের আর কোনো ব্যাটসম্যানের সঙ্গে তুলনা হবে না। ধোনি একটা অন্য জিনিস। ওর চিন্তাধারা, আমার মনে হয় যে, আমরা খেলার একটা মুহূর্ত যখন চিন্তা করি, ও মনে হয় ওই মুহূর্তটাই আরও ৫ ওভার আগে চিন্তা করে। ওর দলটাও এমন। ধোনি পুরো খেলাটা আসলে অনুভব করে, কখন সে কী করবে। এটা আসলে খেলতে খেলতে এমন কিছু রপ্ত করে ফেলছে। কীভাবে খেলাটাকে গোছাবে, এটা ভাবার মতো ওদের অনেক প্লেয়ারই আছে।
আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে এখানে। আমার মনে হয়, আমাদের টুর্নামেন্টে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা বাড়ে আরও ধীরে ধীরে, তখন হয়তো আমাদেরও কিছু প্লেয়ার এমন তৈরি হতে পারে।