ক্রিকেটে ব্যাটিং অর্ডার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারা ওপেনিংয়ে আসছে, কে আসছে ওয়ান ডাউনে, কে স্লগিং করতে যাচ্ছে, কে ইনিংস বিল্ড-আপের কাজটা করতে যাচ্ছে, ইনিংসের অ্যাঙ্কর হিসেবে কে কাজ করতে যাচ্ছে, গোটা ব্যাপারটাই নিশ্চিত হয় এই ব্যাটিং অর্ডারের মাধ্যমেই। কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটা পালন করতে হয় টপ অর্ডারকেই, আরো একটু নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে প্রথম তিনজন ব্যাটসম্যানকে। কিন্তু কার কাজটা বেশি শক্ত, কিংবা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? দুই ওপেনার, নাকি প্রথম উইকেট পতনের পর সদ্য ক্রিজে আসা ব্যাটসম্যানের?
সেটা বুঝতে হলে শুরুতেই কিছুটা আলোচনায় আসতে হবে, ওপেনিং ব্যাটসম্যানদের জন্য মূল কাজটা কী হতে পারে এবং নাম্বার-থ্রি ব্যাটসম্যানের জন্য ভূমিকাটা কি হওয়া উচিত। আস্তে আস্তে বিশদ আলোচনার দিকে যাওয়া যাক।
ওপেনিং পজিশন
টেস্ট হোক, ওয়ানডে হোক, কিংবা টি-টোয়েন্টি, ক্রিকেটের যে কোনো ফরম্যাটেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ পজিশন হিসেবে ধারণা করা হয় ওপেনিং পজিশনকেই। এর পিছনে মূল কারণ হিসেবে যেগুলো কাজ করে তা হচ্ছেঃ
(১) একটি ইনিংসের শুরুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে খেলে যদি প্রথম ওভারেই একটা বা দুটো উইকেট খুঁইয়ে চলে আসেন, তবে উইকেট পতনের পর দল নিশ্চিতভাবেই অকূল পাথারে পড়বে।
(২) ওপেনিং পজিশনে যারা খেলেন, অবধারিতভাবেই তাঁকে মোকাবেলা করতে হবে নতুন বলের। আর সেটা যে নেহায়েত সহজ কোনো কাজ নয়, তা ক্রিকেট ভক্তমাত্রই জানেন।
(৩) স্টার্টিংয়ের উপর অনেকটাই নির্ভর করে ইনিংসটি কোন গতিতে এগোতে যাচ্ছে। যদি ওপেনাররা শ্লথগতির ব্যাটিং শুরু করেন, তবে ইনিংসও চলতে শুরু করবে ঢিমেতালে; আর সেটা পরবর্তী ব্যাটসম্যানদের উপর সৃষ্টি করতে পারে পর্বতসমান চাপ। আর যদি ঝড় দিয়ে শুরু হয়, তাহলে সেটা দলকেও মানসিকভাবে বেশ চাঙ্গা করে দিতে পারে।
মোদ্দা কথা, একজন ওপেনার দলের একজন ‘মায়েস্ত্রো’র মতো দায়িত্ব পালন করেন, যিনি অনায়াসেই ঠিক করে দিতে পারেন ম্যাচের গতিবিধি। ওপেনিং পজিশনটা তাই যেকোনো দলের জন্যই দারুণ গুরুত্বপূর্ণ।
পজিশন নাম্বার থ্রি/ ওয়ান-ডাউন পজিশন
এবার দেখা যাক যেকোনো ফরম্যাটেই নাম্বার থ্রি পজিশনটা কেন গুরুত্বপুর্ণ। এখানেও আমি কিছু পয়েন্টে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করবো এই পজিশনের কাজ এবং গুরুত্বকে, যদিও এটা নেহায়েত খেলো একটা কাজ বলে মনে হতে পারে।
(১) ওপেনারদের কেউ যদি ইনিংসের শুরুতেই আউট হয়ে ফিরে যান, সেই চাপটিকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সেই মুহূর্তে ব্যাটিং করতে নামতে হয় এই পজিশনের ব্যাটসম্যানকে। আর এরপর দলের হাল ধরে নিশ্চিত করতে হয়, যেন দলটি ব্যাটিং বিপর্যয়ে না পড়ে। বলাই বাহুল্য, যেকোনো মুহূর্তে ব্যাটসম্যানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি।
একই সাথে এটাও বলে ফেলা উচিত, যদি দুর্দান্ত সূচনা পেয়ে যায় দল, সেক্ষেত্রে সেই সূচনাটিকে ধরে রেখেই গোটা ইনিংসকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সেই গতিতেই। বলতেই হবে, কাজটা নেহায়েত সহজ কিছু নয়।
(২) আবার একটু প্রথম পয়েন্টেই ফিরে যাই। যেহেতু যে কোনো ম্যাচে এই পজিশনের ব্যাটসম্যানকে প্রথম ওভারেই নেমে যেতে হতে পারে, সুতরাং তাঁকে নিশ্চিতভাবেই মোকাবেলা করতে হবে নতুন বলের। পেস অ্যাটাকের বিপক্ষে তাঁকে হতে হবে স্বচ্ছন্দ্য এবং সাবলীল।
(৩) ওপেনিং ব্যাটসম্যানদের স্টার্টিংয়ের উপর নির্ভর করে তাঁকে যেকোনো মুহুর্তে দলের হাল ধরতে হয়। স্টার্টিং যদি আসে কিছুটা ধীরলয়ের, তবে তাঁকে মনোযোগ দিতে হয় একই সাথে আগ্রাসন এবং উইকেট না হারানোর দিকে। আর যদি আসে ঝড়ো একটি ওপেনিং, সেক্ষেত্রে দলকে নিরাপদে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্বটা তাঁর উপরেই আরোপিত হয়।
(৪) শুধু কি নতুন বলটাই এই পজিশনের চ্যালেঞ্জ? নাহ, বরং ঠিক তার উল্টোটা। একটু পিছনে ফিরে গিয়ে মনে করুন বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের মধ্যকার সিরিজে তামিম-সৌম্য’র সেই অসাধারণ জুটির কথা। সেটা স্থায়ী হয়েছিলো গোটা ইনিংসের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি। এমন সময়ে যদি হঠাৎ দুজনের যে কেউ আউট হয়ে যান, সেক্ষেত্রে ওয়ান ডাউনে নামতে হবে একজন ব্যাটসম্যানকে এবং তাঁকে নিশ্চিতভাবেই মোকাবেলা করতে হবে পুরোনো বলের, আর স্বাভাবিকভাবেই তাঁর বিপরীতে বোলিং করতে থাকবেন একজন (কিংবা একাধিক) স্পিনার। এমন কোনো পরিস্থিতিতে যদি সেই ব্যাটসম্যান ফ্ল্যাশি স্টাইলে ব্যাটিং করে কোনো রকম ফুটওয়ার্ক কিংবা স্কিল ছাড়াই স্পিন বোলিং খেলতে যান, দলকে উল্টো বিপদে ফেলে দিয়ে আসার সম্ভাবনা বরং আরও কিছুটা বেড়ে যায়। ফলে তাঁকে স্পিন অ্যাটাকের বিপক্ষেও হতে হয় সমান কার্যকর।
নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, গোটা ব্যাটিং অর্ডারের ‘ফালক্রাম’ হিসেবে কাজ করে এই নাম্বার থ্রি পজিশনটি। তাঁকে যেমন ইনিংস গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হয়, একইসাথে সময়মতো গিয়ার পরিবর্তন করে দলকে সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টাও করতে হয়। পুরো দলের অ্যাঙ্কর হয়ে উঠতে হয় তাঁকে, হতে হয় একজন নেতা।
আমাদের প্রশ্নটা ছিলো, কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানঃ ওপেনিং, নাকি ওয়ান-ডাউন? আলোচনা শেষে আপাতত আমাদের সিদ্ধান্ত দাঁড়াচ্ছে, খুব সম্ভবত ওয়ান-ডাউন পজিশন। আর এই পজিশনের জন্য প্রায় সবসময়ই বেছে নেওয়া হয় দলের সেরা ব্যাটসম্যানটিকে, এমন কেউ যে কিনা ধীরস্থিরভাবে দলের হাল ধরতে পারে, সব ধরণের বোলিং অ্যাটাকের বিপক্ষেই সমান সাবলীল এবং যেকোনো সময় সহজেই গিয়ার পরিবর্তন করতে সক্ষম।
এই পজিশনে খেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, রিকি পন্টিংরা। এখানে খেলেই গ্রেট ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন স্যার ভিভ রিচার্ডস, রাহুল দ্রাবিড় কিংবা হালের কুমার সাঙ্গাকারা। এই পজিশনেই ব্যাটিং করে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের রেকর্ড গড়েছেন ব্রায়ান লারা কিংবা গ্যারি সোবার্স। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন দারুণ প্রতিভাবান, পরিশ্রমী এবং দুর্দান্ত টেম্পারামেন্টের ব্যাটসম্যান। তাঁরা সময়মতো চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটাতে পারতেন, আবার সময়মতো প্রান্তবদল করে রানের চাকা সচল রাখতেও জানতেন। দলের উপর চাপ যেন কোনোমতেই না আসে, সেটার জন্য যেকোনোভাবেই খাপ খাইয়ে নেওয়ার সামর্থ্য তাঁদের ছিলো।
ওয়ান-ডাউন ব্যাটসম্যান হিসেবে সেরা ব্যাটসম্যানকে খেলানোর যে ঐতিহ্য, সেটা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান বিলি মারডক, ১৮৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করেই প্রথম উপলব্ধি করান এই পজিশনের মাহাত্ম্য। এরপর এটাকে লিজেন্ডারি পর্যায়ে তুলে নেন স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান, তিনি যেটা করেছেন, সেটা বিশেষ বলারও আর প্রয়োজন দেখি না। তাঁর কীর্তি এতটাই সুচর্চিত, আমরা মুখে মুখেই বলে দিতে পারি তাঁর সেঞ্চুরি সংখ্যা কিংবা ‘কিংবদন্তীতুল্য’ ব্যাটিং গড়। এরপর এই পজিশনেই আরো খেলেছেন অনেকেই, যার মধ্যে রয়েছেন জর্জ হ্যাডলি, স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস, স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স, রাহুল দ্রাবিড়, রিকি পন্টিং কিংবা ব্রায়ান লারার মতো ব্যাটসম্যান।
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১০৪ ইনিংসে রিকি পন্টিং ২৬টি সেঞ্চুরি করেছিলেন, সবগুলোই তিন নম্বর পজিশনে খেলে। গড়টা ছিলো বিস্ময়কর, ৭৫.২১! আর নিশ্চিতভাবেই এই অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের সুবাদে অস্ট্রেলিয়াও তখন ছিলো রীতিমত অপরাজেয় এক দল।
অন্যদিকে ২০০৬ থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল অবধি কুমার সাঙ্গাকারা রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন শ্রীলংকার হয়ে, ৭০ টেস্টে ১২১ ইনিংস ব্যাটিং করে ৭০.১৬ গড়ে ২৮ সেঞ্চুরিসহ করেছেন ৭৬৪৮ রান। এই সময়কালে শ্রীলংকার পারফরম্যান্সও ছিলো চোখে পড়ার মতো, যার কিছুটা আলো এসে পড়েছে ওয়ানডেতেও।
এবার কিছুটা বর্তমান ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যানদের দিকে তাকানো যাক।
এই প্রজন্মের সেরা চার প্রতিভা হিসেবে দেখা হয় বিরাট কোহলি, জো রুট, কেন উইলিয়ামসন এবং স্টিভেন স্মিথকে। চারজনই এই মুহূর্তে দলের সেরা ব্যাটসম্যান, আর প্রত্যেকেই নিজ দলে খেলছেন ওয়ান-ডাউন পজিশনে। এতে করে যেটা হচ্ছে, দল সর্বোচ্চ সার্ভিস পাচ্ছে তাঁদের সেরা ব্যাটসম্যানটি থেকে আর ব্যাটিং অর্ডারে দারুণ ফ্লেক্সিবিলিটিও আসছে। সেরা ব্যাটসম্যানটি থেকে সর্বোচ্চ অবদান পাওয়ার সুযোগ থাকায় দলের অন্যান্যরা চাপমুক্ত থেকে খেলার সুবিধা পাচ্ছেন এবং এর ফলে দলও দারুণ পারফর্ম করে চলেছে।
বাংলাদেশ এখানে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল খেলেন ওপেনিংয়েই। আগের খামখেয়ালি ব্যাটিং স্টাইল থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়ে তামিম এখন দারুণ সংবেদনশীল ব্যাটিং করেন, একইসাথে দলের ইনিংস গড়ে তোলা এবং রানের চাকা সচল রাখার কাজটা দারুণভাবেই করেন তিনি। তবে একইসাথে ব্যাটিং অর্ডার সাজানোতেও বাংলাদেশকে সাম্প্রতিককালে পড়তে হয়েছে বেশ সমস্যায়, ওয়ান-ডাউন ব্যাটসম্যান হিসেবে সেভাবে কাউকে বাংলাদেশ খুঁজে পায়নি কখনও।
একটা সময় ছিলো, যখন এই পজিশনে ব্যাটিং করেছেন হাবিবুল বাশার কিংবা আফতাব আহমেদরা, আর এটা নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথাও ছিলো না। বাংলাদেশ তখন কদাচিৎ দু-একটা ম্যাচ জেতে, তবে উন্নতির লক্ষণটি ছিলো স্পষ্ট। সেই উন্নতির চক্রটি প্রথমবারের মতো পূর্ণতা পেতে শুরু করে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে, যখন বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের সুপার এইটে ওঠে। তবে আফতাব আহমেদ এবং হাবিবুল বাশার আইসিএলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই হঠাৎ জাতীয় দলে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তখন থেকেই বাংলাদেশ স্পেশালিস্ট নাম্বার থ্রি ব্যাটসম্যান খুঁজে ফিরছে।
গত পাঁচ বছরে বেশ কয়েকজনকে চেষ্টা করে দেখা হয়েছে এই পজিশনে, যার মধ্যে রয়েছেন মমিনুল হক, লিটন দাস, সৌম্য সরকার, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, ইমরুল কায়েস, মোহাম্মদ মিথুন এবং জহুরুল ইসলাম। তবে দৃশ্যত তাঁদের কেউই টিম ম্যানেজমেন্টকে সেভাবে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। নাম্বার থ্রি-তে অন্তত ১০ ওয়ানডে খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ গড় মমিনুল হকের, ২৮.০৬। নাম্বার থ্রি ব্যাটসম্যান হিসেবে সেটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর গড় নয় বলে বর্তমান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে একটি ফাটকা খেললেন সাব্বির রহমানকে দিয়ে, বরাবরই দেশের অন্যতম সেরা হার্ড হিটার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসা এই ব্যাটসম্যান তখন দারুণ সময় পার করছেন ব্যাট হাতে। ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে কোচের গুডবুকে অনায়াসেই ঢুকে গিয়েছিলেন তিনি, যার ফলশ্রুতিতেই এই পদোন্নতি।
তবে অতি সাম্প্রতিককালে তাঁর নিয়মিত ব্যর্থতা হঠাৎ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এই পজিশনে তাঁর কার্যকারিতা নিয়ে। অদ্ভুত ব্যাপারটা হচ্ছে, এই ব্যাপারে তাঁর কার্যকারিতার পক্ষেও বিশেষ স্ট্যাটিস্টিক্যাল ভিত্তি নেই। এখন পর্যন্ত যেটা দেখা যাচ্ছে, নাম্বার থ্রি পজিশনে উঠে আসার পর তিনি ১৪ ইনিংসে মাত্র তিনটি ফিফটিসহ ২৬.৭১ গড়ে করেছেন মাত্র ৩৭৪ রান। তাছাড়া এই পজিশনে খেলতে গেলে বাউন্ডারির তুলনায় নিয়মিত প্রান্তবদলের দিকে অনেকটাই জোর দিতে হয়, যেদিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছেন সাব্বির।
এবার বৈশ্বিক দিক থেকে কিছুটা তুলনামূলক বিচারে আসা যাক। আমি এই বিশ্লেষণটাকে মূলত দুটো অংশে ভাগ করেছি, যেখানে আমি বিবেচনায় নেবো মাত্র সাত-আটজন ওয়ান-ডাউন ব্যাটসম্যানকে, যারা সাম্প্রতিক সময়ে দারুণ পারফর্ম করে চলেছেন।
‘ইংল্যান্ডের যুবরাজ’ বলে অধুনা পরিচিত জো রুট ওয়ান ডাউন পজিশনে এখন পর্যন্ত খেলেছেন ৪০ ইনিংস, যাতে ৬ হান্ড্রেড এবং ১৪ ফিফটিসহ ৫৭.৮৯ গড়ে করেছেন ২০২৬ রান।
নিউ জিল্যান্ডের কেন উইলিয়ামসন এখন পর্যন্ত ওয়ান ডাউন পজিশনে খেলেছেন ৮১ ইনিংস, যাতে ৭ সেঞ্চুরি এবং ২৮টি ফিফটিসহ ৫১.৩৯ গড়ে করেছেন ৩৮৫৪ রান।
ভারতের বিরাট কোহলি এখন পর্যন্ত ওয়ান ডাউন পজিশনে খেলেছেন ১২৪ ইনিংস, যাতে ২০ সেঞ্চুরি এবং ৩২টি ফিফটিসহ ৫৬.৩৭ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৫৯১৯ রান।
অস্ট্রেলিয়ার স্টিভেন স্মিথ ওয়ান ডাউন পজিশনে এখন পর্যন্ত ৪৭ ইনিংসে ৭ হান্ড্রেড এবং ১৩টি ফিফটিসহ ৫৫.৯০ গড়ে করেছেন ২২৯২ রান।
এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞ সেনানী এবং নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ফ্যাফ ডু প্লেসিসও এখন পর্যন্ত ৬৬ ইনিংস এই পজিশনে খেলেছেন, যাতে তাঁর সেঞ্চুরি সংখ্যা ৮ এবং গড় ৫১.৫৫!
উপরোক্ত পাঁচজনই নিজ নিজ দলের, ইন ফ্যাক্ট, এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বেই অন্যতম সেরা পাঁচজন ব্যাটসম্যান। আমি তাঁদের পরিসংখ্যানটিকে দেখিয়েছি স্রেফ বর্তমান বিশ্বে এই পজিশনে পারফর্ম করার একটি স্ট্যান্ডার্ড দেখানোর চেষ্টা করবো বলে। নাহ্, সাব্বিরকে আমি তাঁদের সঙ্গে আদৌ তুলনা করতে যাচ্ছি না। টেকনিক, টেম্পারামেন্ট, পারফরম্যান্স, সলিডিটি কিংবা খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, যেকোনো দিক থেকেই তাঁরা অন্য ব্যাটসম্যানদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। সেই পর্যায়ে সাব্বিরের পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত বরং আমি তুলনা করতে চলেছি তাঁর কাছাকাছি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কয়েকজন ওয়ান-ডাউন ক্রিকেটারদের মধ্যে, যারা এই মুহুর্তে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলছেন।
শ্রীলংকার তরুণ ব্যাটসম্যান কুশল মেন্ডিস এখন পর্যন্ত তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশনে খেলেছেন ২২ ইনিংস, যাতে এক সেঞ্চুরি এবং আট ফিফটিতে ৩৬.২৩ গড়ে তিনি করেছেন ৭৯৭ রান।
পাকিস্তানের নতুন ব্যাটিং সেনসেশন বাবর আজম এই পজিশনে এখন পর্যন্ত ভয়াবহ ধারাবাহিকতা দেখিয়ে চলেছেন। ১৪ ইনিংসে এই পজিশনে ব্যাটিং করেই তিনি করে ফেলেছেন পাঁচটি হান্ড্রেড এবং একটি ফিফটি, যেখানে গড় ৭৮.৯১! এমনকি তাঁর টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরির কীর্তিও রয়েছে।
আফগানিস্তানের তরুণ ব্যাটসম্যান রহমত শাহ এই মুহূর্তে তাঁদের সবচেয়ে বড় অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি। তিনি এই পজিশনে ২২ ইনিংসে এক সেঞ্চুরি ও চার ফিফটিসহ ৩১ গড়ে করেছেন ৬৫১ রান।
এতগুলো পরিসংখ্যান ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিশ্চয়ই মাথা ধরে গিয়েছে? তবে এতগুলো সংখ্যা ঘেঁটে ঘেঁটে আমরা অন্তত এতটুকু জানতে পেরেছি, অন্য সবগুলো দলের ওয়ান-ডাউন ব্যাটসম্যানদের তুলনায় সাব্বিরের পারফরম্যান্স যথেষ্টই নড়বড়ে। যদি তিনি এই পজিশনেই নিয়মিত খেলে যেতে থাকেন, তবে এই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো বাঞ্ছনীয়। একজন ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান এখন পর্যন্ত এই পজিশনে খেলে সর্বোচ্চ রান ৬৫, এখন পর্যন্ত কোনো হান্ড্রেড করতে পারেননি, ফিফটিও করেছেন মাত্র তিনটি; অথচ সমান সংখ্যক ম্যাচেই বাবর আজম করে ফেলেছেন পাঁচটি হান্ড্রেড! শুধু সেটাই নয়, বারবার দৃষ্টিকটুভাবে সেট হওয়ার পর উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে এসেছেন বাজেভাবে। ভালো শুরু করছেন প্রায় প্রতি ম্যাচেই, তবে ২০-২২ রানের বেশি সেটা আর এগিয়ে নিতে পারছেন না। আর সেটার প্রভাব পড়েছে দলের পারফরম্যান্সেও, প্রায় প্রতি ম্যাচেই প্রথম দশ ওভারের মধ্যেই বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলছে অন্তত দুটো উইকেট!
নাহ, এটা আমি কোনোমতেই বলতে চাইছি না যে সাব্বির রহমান ভালো মানের ব্যাটসম্যান নন। তিনি একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান এবং ইতিমধ্যেই তিনি নিজেকে ডাউন অর্ডারে প্রমাণ করেছেন। স্লগ ওভার স্পেশালিস্ট হিসেবে দলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলার পর হঠাৎ তিন নম্বরে পদোন্নতি পেয়ে হয়তো নিজেও সেভাবে মানিয়ে নিতে পারেননি, যার ফলে পারফরম্যান্সটাতে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে সেটার। অথচ তাঁর ব্যাটিং স্টাইলের সঙ্গে ছয় কিংবা সাত নম্বর পজিশনটি খুব দারুণভাবেই মানিয়ে যায়, এমনকি এই পজিশনে তাঁর পারফরম্যান্সও দুর্দান্ত! আর বাংলাদেশও সাম্প্রতিককালে শেষ দশ ওভারে রানের জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে, যেটা খুব সহজেই সমাধান করে ফেলা যায় সাব্বির রহমানকে এই জায়গাটাতে যথাযথভাবে ব্যবহার করে। সেটা যে তিনি খুব ভালোভাবেই পারবেন, সেটাও ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন তিনি।
তবে তাঁর জন্য এই মুহুর্তে সুবিধার (নাকি সমস্যার?) ব্যাপারটা হচ্ছে, কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তাঁর সম্পর্কে দারুণরকম আশাবাদী। আর তাই নিয়মিতভাবেই এই পজিশনে তাঁকে খেলিয়ে যাচ্ছেন, আর সাব্বিরও দারুণ ‘ধারাবাহিকতা’র সাথে ব্যর্থ হয়ে চলেছেন। এভাবে চলতে থাকলে সাব্বির হয়তো আত্মবিশ্বাস হারিয়ে দলের বাইরেই চলে যাবেন, পারফর্ম করতে না থাকলে এই বাংলাদেশ দলে টিকে থাকা খুব কঠিন। আর যে সাব্বিরকে ভাবা হয়ে থাকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অন্যতম কাণ্ডারি, সেখানে তাঁকে এভাবে তাঁর কমফোর্ট জোনের বাইরে খেলিয়ে আত্মবিশ্বাস খোঁয়ানোর ঝুঁকি বাংলাদেশ নিতে চায় কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন।
এবার একদমই অপ্রাসঙ্গিক, কিংবা অতি প্রাসঙ্গিক একটি তথ্য। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের যমজ নন, এমন ভ্রাতৃদ্বয়ের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ইয়ান চ্যাপেল এবং গ্রেগ চ্যাপেল। বলা হয়ে থাকে, অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের ছোট্ট তালিকাতে ঢুকে যাওয়ার মতো প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। অন্যদিকে, ইয়ান চ্যাপেল গ্রেগ চ্যাপেলের মতো অমিত প্রতিভাবান না হলেও দারুণ ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনিও। ইয়ান চ্যাপেল তিন নম্বর পজিশনে খেলেছেন ৯১ ম্যাচে, যেখানে তাঁর গড় ৫০.৯৪; অথচ অন্যান্য পজিশনে তাঁর গড় মাত্র ২৫.৩৮। আবার অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে অগ্রজ ইয়ান চ্যাপেল থেকে ভালো ব্যাটসম্যান বলে স্বীকৃত গ্রেগ চ্যাপেলের তিন নম্বরে ব্যাটিং গড় ৪৩.৩৯, অথচ অন্যান্য পজিশনে সেটা ৫৮.০৯!
সুতরাং, তিন নম্বরে সেরা ব্যাটসম্যানকেই ব্যাটিং করতে হবে, সেটাই একমাত্র উপায় নয়। বরং এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে, যে কিনা সেই পজিশনের সাথে সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত এমন কোনো ব্যাটসম্যানকে খুঁজে পায়নি, আর তাই আমাদেরকে নিজেদের মতো করেই প্রস্তুত করে নিতে হবে কোনো একজন ব্যাটসম্যানকে। আর সেটা করতে হবে খুব দ্রুত, ২০১৯ বিশ্বকাপের যে আর খুব বেশিদিন বাকি নেই!