উইম্বলডনের সবুজ ঘাসে ঘেরা দুর্গটা তার। টানা পাঁচ বছরের রাজত্বে খুঁটি গেঁড়েছিলেন সেখানে। তারপর জয় করেছেন আরো তিনবার। সর্বোচ্চ আটবার বিজয়মাল্য গলায় ঝুলিয়েছেন এই মঞ্চে। উন্মুক্ত যুগে তার টানা পাঁচবারই সর্বোচ্চ, চারবারের বেশি একটানা জিততে পারেনি আর কেউ। আর সবচেয়ে বেশি উইম্বলডন জেতার ক্ষেত্রে তো সর্বকালের সেরাই, সেখানে তার পেছনে পড়ে গেছেন গ্রেট ব্রিটেনের পক্ষ হয়ে খেলা উইলিয়াম রেনশ।
অথচ সেই মঞ্চেই কি না তার হাল হলো অমন বেহাল! নোভাক জোকোভিচ নামের ওই একরোখা তরুণের একগুঁয়ে আর জেদী মন্ত্রে বারবার বশ মানতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। এক-দুবার নয়, হেরেছেন তিন-তিনটি ফাইনাল সেই জোকোভিচের কাছে। আধুনিক টেনিসের রাজপুত্র থেকে রাজা হয়ে ওঠা তার উইম্বলডনের সবুজ মঞ্চেই, আর সেখানেই ‘রাজা’ রজার ফেদেরার অসহায়ত্বের শিকার হয়েছেন বারবার। ফেদেরারের উইম্বলডন রাজত্বের অসহায় চিত্র জুড়ে আছেন নোভাক জোকোভিচ। সেই চিত্রগুলো জোড়া দিতেই আমাদের আজকের আয়োজন।
জোকোভিচ-ফেদেরার দ্বৈরথ
৪৮ বারের সাক্ষাতে জোকোভিচেরই প্রাধান্য। ২৬ বারের বিপরীতে ফেদেরারের জয় ২২টি। গ্র্যান্ড স্ল্যামের ষোল লড়াইয়েও ১০-৬ এ পিছিয়ে আছেন টেনিসের রাজা।
গ্র্যান্ড স্ল্যামে গত ৭ বছর ধরেই ফেদেরারের বিপক্ষে অপরাজিত জোকোভিচ। ফাইনাল হেরেছেন কেবল একটি, সে-ও বহুকাল আগের কথা। জোকোভিচের সবে শুরু তখন, আর ফেদেরার পার করছেন রাজত্বের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা। সেই সময় টানা ১০টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালের সবক’টিতে ছিলেন, ফ্রেঞ্চ ওপেনের লাল মাটির দুর্গ-প্রধান রাফায়েল নাদালের কাছে পরাজয় ছাড়া এই সময়ে হারেননি আর একটিতেও! ঐ ১০ নাম্বার ফাইনালের প্রতিপক্ষই ছিলেন তরুণ জোকোভিচ। সেই একটিমাত্র গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল জয় ফেদেরারের, জোকোভিচের বিপক্ষে।
জোকোভিচের কাছেই প্রত্যেক গ্র্যান্ড স্ল্যামেই হারতে হয়েছে ফেদেরারকে। গত এক দশকে নাদাল-ফেদেরার দ্বৈরথ যতটা অনিয়মিত হয়েছে, ঠিক ততটাই নিয়মিত আর জৌলুসপূর্ণ হতে শুরু করে জোকোভিচ আর ফেদেরার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যেখানে জোকোভিচ কোটি মানুষের আশা আর ভালোবাসায় জল ঢেলে দিয়ে উল্লাসে মেতেছেন প্রায়ই।
উইম্বলডনে চারবারের সাক্ষাতে তিনবারই জয় জোকোভিচের। ফেদেরারের একমাত্র জয়, সেটিও ২০১২ সালে, সেমিফাইনালে। তিনবারের সর্বশেষটি এলো ২০১৯-এর উইম্বলডনে। ওয়েম্বলির দর্শকরা অবাক এক কাণ্ডই ঘটিয়ে দিয়েছেন সেখানে; ‘দুয়ো’ দিয়েছেন তারা জোকোভিচকে, আর ফেদেরারের জন্য হর্ষধ্বনি তুলেছেন নিত্য। তবুও আটকানো যায়নি জোকোভিচকে, যেমনটা যায়নি গত অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে। ষোলতম শিরোপা জয়ে জোকোভিচ পৌঁছেছেন নাদাল-ফেদেরারের আরেকটু কাছে।
ফাইনাল ২০১৪: ক্ল্যাসিক এক ফাইনাল শেষে জোকোভিচ যুগের শুরু
৬(৭)-৭(৯), ৬-৪, ৭(৭)-৬(৪), ৫-৭, ৬-৪; ৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট
ছয়টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেও তখনও ক্যারিয়ার স্ল্যাম পূর্ণ হয়নি জোকোভিচের। রাফায়েল নাদালের বিপক্ষে টানা চার ফাইনালের তিনটি জিতলেও হেরেছে ফ্রেঞ্চ ওপেন। জো উইলফ্রেড সোঙ্গা, অ্যান্ডি মারেদের মতো উঠতি তরুণের ভিড়ে আর ফেদেরার-নাদাল যুগে নিজের একটা অবস্থান তুলে ধরেছেন মাত্র। স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হননি তখনও। আর অন্যদিকে সর্বকালের সেরার আসনটা অলংকৃত করে ফেলেছেন রজার ফেদেরার, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষণ গণনা।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে প্রথম সেট গেল টাইব্রেকারে। সেখানে বাজিমাৎ ফেদেরারের, ৯-৭ এ জিতলেন তিনি। পরের সেট সরাসরি জিতলেও তৃতীয় সেট জিততে টাইব্রেকারের দরকার পড়ল জোকোভিচের। ম্যাচে দারুণ উত্তেজনা। উইম্বলডন রাজার ঘাম বেরিয়ে গেছে।
জোকোভিচ দ্বিতীয় উইম্বলডন জিতে ফেদেরারের রাজত্বের অধিকার চাইলেও সহজ নয় তা। সাত-সাতবারের রাজা তিনি, এতই সহজ রাজত্ব ছিনিয়ে নেয়া? পরের সেটে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প হলো ফেদেরারের। এই সেটও ধুন্ধুমার, ৭-৫ এ জিতলেন ফেদেরার, ২-২ সমতা। ম্যাচনির্ধারণী পঞ্চম সেটে গড়াল ম্যাচ। আর সেই সেট সরাসরি জিতে ফেদেরারের দুর্গে জোকোভিচের দখলদারিত্বের শুরু, যা চলছে এখনো। সেই থেকে ছয়বারের মধ্যে ওয়েম্বলির উইম্বলডনে চারবারই হেসেছেন জোকোভিচ, একবার মাত্র ফেদেরার।
সেই ম্যাচ শেষে দুইবারের উইম্বলডন বিজয়ী জিমি কনর্স বলেছিলেন- “দুজনই শুরু থেকে সবটা ঢেলে দিয়েছে। একরত্তি ছাড় দেয়নি কেউ কাউকে। আসলে এমন ম্যাচ দেখেই পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলতে ইচ্ছে হয়- আমি কতই না সুখী, এমন একটা ম্যাচের দর্শক হতে পেরেছি!”
“I loved this match because there was more to it than just tennis. For four hours neither player wanted to give an inch. Sometimes there’s a lull in matches that go five sets, but I didn’t think there was a lull today at all.
“Both players came out and gave it the punch right from the start. It was one of those days when you say, ‘I’m happy to be here just to see this’.”
জিমি কনর্সের জবানিটাই তুলে দেয়া হলো পাঠকের সুবিধার্থে।
ফাইনাল-২০১৫; জোকোভিচেরই নিরঙ্কুশ প্রাধান্য
৭(৭)-৬(১), ৬(১০)-৭(১২), ৬-৪, ৬-৩; ২ ঘন্টা ৫৬ মিনিট
উড়ন্ত এক সময় জোকোভিচের। তার জেতার চেয়ে হেরে যাওয়াটাই যেন বড় খবর। আর একের পর এক ব্যর্থ ফাইনাল প্রশ্ন বসিয়ে দিচ্ছে ফেদেরারের ক্যারিয়ারে। থামবেন কখন রাজা? রাজত্বে যতি চিহ্ন বসানোর সময় কি হয়নি? ২০১৫-তে আটটি ফাইনালের মধ্যে পাঁচবারই হাসলেন জোকোভিচ, দুটো আবার উইম্বলডন আর ইউএস ওপেন। উইম্বলডনেও সেবার দারুণ দাপট। প্রথম সেট টাইব্রেকারে গেলেও সেখানে আর ফেদেরারকে তেমন একটা দাঁড়াতে দেননি। দ্বিতীয় সেটও টাইব্রেকারে। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে সমতায় ফেরেন ফেদেরার। পরের দুটো সেট সরাসরি জিতে ‘এক নাম্বার’ র্যাংকিংয়ের স্বাক্ষর রাখেন জোকোভিচ।
ফেদেরার পর্যন্ত স্বীকার করেন, তার দিক থেকে মোটেও কমতি ছিল না। বরং ঐ প্রান্তের ভদ্রলোক অবিশ্বাস্য রকম ভালো খেলে ফেলেছেন! জোকোভিচের কন্ঠেও ঝরে বিনয়– স্বীকার করতেই হবে ফেদেরারের বিপক্ষে খেলাটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আমার জেনারেশনের অনেক খেলোয়াড়ই বেড়ে উঠেছে তাকে দেখে এবং তার খেলা অনুসরণ করে।
টেনিসে এই এক মজা। কোর্টে কেউ কাউকে তিল পরিমাণ ছাড় দেবেন না। কিন্তু খেলা শেষে সবাই বন্ধু। সেখানে কোনো কথার তোপ নেই, হম্বিতম্বি নেই, আগ্রাসন নেই। আগ্রাসন সব সযতনে তোলা থাকে কেবলমাত্র খেলার সময়টুকুর জন্য। প্রায় একই সময়ে টেনিসের তিন-তিনজন অলটাইম গ্রেট একসাথে খেললেও তাই তেমন কোনো বাগাড়ম্বর নেই। একে অপরের ভালো বন্ধু তারা।
ফাইনাল-২০১৯; উইম্বলডন অলটাইম ক্ল্যাসিক…
৭(৭)-৬(৫), ১-৬, ৭(৭)-৬(৪), ৪-৬, ১৩(৭)-১২(৩); ৪ ঘন্টা ৫৭ মিনিট
ঘটনাবহুল এক ম্যাচ। দীর্ঘতম এক ম্যাচ। প্রায় দেড় শতকের টেনিসের পথচলায় দুজন সুদক্ষ ও শ্রেষ্ঠ কুশীলবের ধ্রুপদী এক ম্যাচ। প্রায় পাঁচঘন্টার নান্দনিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষে বিজয়ের হাসি সেই জোকোভিচেরই।
প্রথম সেট ও তৃতীয় সেট টাইব্রেকারের জয় জোকোভিচের। দ্বিতীয় ও চতুর্থ সেট সরাসরি জয় ফেদেরারের। অল্পের জন্য মিস করে যাওয়া টাইব্রেকার। লিডে থেকেও হাতছাড়া হয়ে যাওয়া সেট। সবশেষে চূড়ান্ত সেটের রোমাঞ্চকর অধ্যায়ের সংযোজন। একবার এ এগিয়ে যায় তো আরেকবার ও। হাল ছাড়ার প্রশ্নই নেই। পঞ্চম সেট ১১-১১ থাকাকালীন ডিউস হতে থাকলো একের পর এক, একবার-দুবার-তিনবার-চারবার… গণনা ভুল হয়ে যায়, তবু গেম শেষ হয় না। শেষপর্যন্ত সেখানেও ১২-১২ হলে আবার টাইব্রেকার। জোকোভিচের সহজে উতরে যাওয়া সেখানটায়। ফেদেরার কি চাপে পড়ে গিয়েছিলেন? অন্তিম শটটার ব্যাখ্যা কী নইলে?
ঠিক এখানটাতেই বারবার জিতে যান জোকোভিচ। চাপ। অদম্য স্নায়ুটা দিয়েই সমস্ত পথ অতিক্রম করেন অনায়াস প্রচেষ্টায়। পাঁচটি উইম্বলডন জয়ে সাম্প্রাস-রেনশো আর ফেদেরারের আরো কাছে পৌঁছে গেছেন তিনি। ক্ল্যাসিক এক ম্যাচে আরো একবার দেখিয়েছেন তার ক্লাস, দর্শক ‘দুয়ো’ দিলেই বা কী আসে-যায় তাতে?
পরিশিষ্ট: জোকোভিচ ৩-০ ফেদেরার
টকাস, টকাস। টকাস, টকাস। টকাস, টকাস। হোওওওও, ওওহহহ, ওয়াওহহ… দর্শক সারি থেকে ভেসে আসা সুর। বল কোর্টের এপাশ-সেপাশ ছুটছে, প্লেয়ারদের বুটের তড়িৎ ছোটাছুটি, মাটির সঙ্গে ঘর্ষণে চিকচিক আওয়াজ, আর অবাক দর্শকদের আশ্চর্য্য অভিব্যক্তি! অতিশয় হলে যা করতালি হয়ে বেরিয়ে আসে কখনো।
ফেদেরার সর্বজনপ্রিয়। তিনি রাজা। রাজার জন্য জনমন উজার করে হৃদয়-সিংহাসন। জোকোভিচ নিতান্তই শ্রমিক শ্রেণীর। খেটে খাওয়া প্রকৃতির। বিরক্তিকর, একঘেঁয়ে। তাকে পছন্দ করার কারণ নেই কোনো। ফেদেরার আক্রমণ করেন, আগ্রাসী হন। হঠাৎ উঠে আসেন নেটের সম্মুখভাগে, লাফ দেন, জাদুকরি ফোরহ্যান্ডে মোহাবিষ্ট করেন, পায়ের নীচ দিয়ে অবাক শটে বিবশিত করেন প্রতিদ্বন্দ্বী আর দর্শকদের। ফেদেরার রাজা, রাজার মতোই সম্মোহিত করেন সবাইকে। অন্যদিকে জোকোভিচ ডিফেন্স করেন, কঠিন ডিফেন্স। রিটার্ন করেন, শক্ত রিটার্ন। মোহগ্রস্থ হওয়ার উপাদান নেই সেখানে। কিচ্ছু নেই। কিন্তু জোকোভিচ অবাক করেন, হতবাক করেন। শ্রদ্ধা কুড়ান। সম্ভ্রম জাগান। নিজের প্রতি অগাধ আস্থা আর হাল না ছাড়া মনোভাব তাকে সফল করে প্রতিবার।
ফেদেরার হারেন। তবুও হৃদয়ের মণিকোঠায় ঠিক অনড় ফেদেরার। জোকোভিচ জেতেন। দিনের পর দিন অবিশ্বাস্য দক্ষতার সুন্দরতম প্রদর্শনে জোকোভিচ অর্জন করেন সম্মান। হৃদয়ের মণিকোঠা তিনি পান না সত্যি, কিন্তু হয়ে ওঠেন অনুপ্রেরণার উজ্জ্বলতর উদাহারণ।