ফুটবল খেলার জন্য সবচেয়ে দরকারি জিনিসটা কী? এক কথায়, ওই ফুটবলটাই। আর কিছু থাকুক আর না থাকুক, শুধু ওই গোলমতো জিনিসটা থাকলেই খেলা যায় । অনেকে অবশ্য বোতল দিয়েও কাজ চালিয়ে নেয়। যাই হোক, ঐদিকে না যাই আমরা। আমরা আমাদের ওই ‘ফুটবল’ নামক জিনিসেই থাকি।
এখন আমরা যে ফুটবলটাকে দেখি, আগেও কি এরকম ছিল? স্বাভাবিক উত্তর, ‘না’। সময়ের সাথে অন্যান্য জিনিসের মতো পরিবর্তন হয়েছে এই ফুটবলেরও।
ফুটবলের বলের পরিবর্তনে প্রথম ভূমিকা রাখেন চার্লস গুডইয়ার। মূলত তার হাত ধরেই বলটা একটু সভ্য হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত ফুটবল নামে যা খেলা হতো, তা মূলত মানুষ বা অন্য প্রাণীর মাথা, পাকস্থলী বা সেলাই করা কাপড়ের গাট্টি দিয়ে তৈরি। চার্লস গুডইয়ার রাবারের তৈরি ব্লাডার বানানোর আগ পর্যন্ত তা চলতো শূকরের পাকস্থলী দিয়ে, সাথে ব্যবহৃত হতো গরুর পাকস্থলী। সেটিকে স্রেফ চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে খেলা শুরু করা হতো। ১৮৫৫ সালে আবিস্কৃত রাবারের তৈরি ব্লাডারটি সবার ব্যবহারে আসতে আসতে বিংশ শতাব্দী চলে আসে।
-
অবশ্যই পরিপূর্ণ গোল হতে হবে।
-
পরিধি ২৭-২৮ ইঞ্চি হতে হবে।
-
চামড়ার বা অন্য কোনো আরামদায়ক উপযুক্ত জিনিস দিয়ে মোড়ানো থাকতে হবে।
-
ওজন ১৪ থেকে ১৬ আউন্সের (৪১০-৪৫০ গ্রাম) মধ্যে হতে হবে।
-
ভিতরের বাতাসের চাপ ০.৬ থেকে ১.১ অ্যাটমোস্ফিয়ারের মধ্যে থাকতে হবে।
১৮৮৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে ফুটবল বানানো শুরু করে গ্লাসগোর Mitre আর Thomlinson’s নামের দুই কোম্পানি। ফুটবল বানানোর জন্য তখন সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হতো ফুটবলের নির্দিষ্ট আকৃতি ধরে রাখা। এর জন্য প্রয়োজন হত খুব মোটা ও ভারী চামড়া। সাধারণত গরুর লেজ থেকে তৈরি হত সবচেয়ে ভাল বলগুলি। আর ঘাড়ের চামড়া দিয়ে তৈরি হতো অপেক্ষাকৃত সস্তা বলগুলি। বলের এই আকার ও আকৃতি যে খেলায় কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে, তার একটা বড় উদাহরণ হল ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনাল। যেখানে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে দুই দলই তাদের দেশের তৈরি বলে খেলতে চায়। পরে টসের মাধ্যমে প্রথম অর্ধে খেলা হয় আর্জেন্টিনার বল দিয়ে, আর পরের অর্ধে উরুগুয়ের বল দিয়ে। প্রথমার্ধ শেষে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও পরে ৪-২ গোলে ম্যাচ হারে আর্জেন্টিনা। পরিচিত বলের জন্যই হয়তো বা এমন হয়।
এরপর শুরু হল বিংশ শতাব্দীতে বলের নতুন যাত্রা। এ যাত্রায় বলের ভিতরের যে রাবারের ব্লাডার ছিল, তা আরো দৃঢ়ভাবে তৈরি হয়। উপরে দেওয়া হয় চামড়ার আস্তরণ, যা ১৮টি খণ্ড একত্রে সেলাই করে লাগানো হয়। ১৮টি খণ্ড লাগানো হতো ৬টি প্লেটে। এই বলের সাধারণ একটি রঙ হয়ে দাঁড়ায় ঘন বাদামি । এই রঙের বলটি দর্শকদের জন্য মোটেও ভাল ছিল না, কারণ দূর থেকে তেমন দেখা যেত না। এছাড়া এই বলের আরেকটি সমস্যা ছিল যে, এর সুতার সেলাই আর চামড়া যথেষ্ট পরিমাণ পানি শুষে নিত। ফলে প্লেয়ারদের হেড করার অনুভূতি মোটেও সুখকর ছিল না। বৃষ্টিতে বল হয়ে যেত যথেষ্ট ভারী, আর তার প্রভাব পড়তো খেলায়।
বলের পরবর্তী দৃশ্যমান পরিবর্তনটা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। খেলা চলাকালীন যাতে বলের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে না যায়, এইজন্য বলের ব্লাডার আর উপরের আস্তরণের মাঝে পাতলা ধাতুর শীট দেওয়া হয়। এছাড়া রাতে খেলার সুবিধা আর দর্শকদের কথা বিবেচনা করে পরিবর্তন আসে বলের রঙে। সাদা রঙের চামড়ার আবরণ দেয়া হয় বলের উপরে, আর তুষারপাতের সময় হত কমলা। সিন্থেটিকের বলে খেলা শুরু করা হয় এসময় থেকেই, যদিও এর জনপ্রিয়তা পেতে বহুদিন লেগে যায়।
কিন্তু তখনও কোনো মীমাংসা হয়নি বলের আকার-আকৃতি-ওজন নিয়ে বিবাদের। ফিফা কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম বেঁধে না দেওয়ায় একেক দেশ একেক রকম বল নিয়ে খেলতে থাকে।
তখন আসেন রিচার্ড বাকমিন্সটার ফুলার, জৈবযৌগ ফুলারিন নিয়ে যিনি কাজ করেন, সেই ফুলারিনের স্ট্রাকচারের মত করে বানানো হয় ‘Buckminster Ball’। এই বলটির সার্ফেস তৈরি হয় ২০টি ষড়ভুজাকৃতির ও ১২টি পঞ্চভুজাকৃতির চামড়ার প্লেট দিয়ে।এই ৩২টি প্লেট এত ভালভাবে সাজানো গিয়েছিল যে বলগুলি একদম পারফেক্ট গোলাকৃতি পায়। আমরা যে DEER বল দিয়ে খেলতাম, তার পূর্বসূরী এটি। তবে এটি ছিল পুরোপুরি সাদা। ১৯৭০ বিশ্বকাপে এটির আদলে তবে এর থেকে কিছুটা উন্নত মানের বল নিয়ে আসে অ্যাডিডাস, যা বিশ্বে পরিচিতি পায় Adidas Telstar নামে। আমাদের DEER বলগুলোকে দেখতে এদের মতোই লাগে। এই টেলস্টারের বৈশিষ্ট্য ছিল যে, এর পাশাপাশি দু’টি পাতের রঙ এক ছিল না। একটা সাদা হলে আরেকটা কালো। এর ফলে সুবিধা হয় প্লেয়ারদের বলের গতি সম্পর্কে বুঝতে। এছাড়া গতিপথ পরিবর্তনও বুঝা যায়। ১৯৬০ সালে যে সিন্থেটিকের বল এসেছিল, তা সবার কাছে পৌছে যায় এই সময়। ১৯৮০ সালের দিকে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি দেশই বলে ব্যবহার করছে সিন্থেটিক চামড়া।
১৯৮২ সালে এই বলের উপরে দেওয়া হয় রাবারের পাতলা আবরণ, যা বলের ভেতরে পানি ঢোকা আর তা চুইয়ে পড়া আটকায়। চার বছর পর, অর্থাৎ পরের বিশ্বকাপে আসে আরো উন্নত পলিইউরিথিনে আস্তরিত বল।
ফুটবলের আকার-আকৃতি-ওজন ইত্যাদি নিয়ে ফিফা সর্বপ্রথম নিয়ম বেঁধে দেয় ১৯৯৬ সালে। তার আগ পর্যন্ত অফিসিয়াল কোনো মাপজোখ ছাড়াই খেলা হয় সব বিশ্বকাপ। ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথম পরিপূর্ণ অফিসিয়ালিটির ছোঁয়া নিয়ে আসে একটি বলে। মূলত সেটি ছিল Telstar-এরই মডিফাইড ভার্সন। শুধু এই বলে কালোর জায়গা দেয়া হয় নীলকে, আর সামান্য লাল রঙ থাকে, যা শুধু যেন দৃশ্যমান লাল হয় ওই অভিপ্রায় দেওয়া। এই ৩টি রঙ প্রতিনিধিত্ব করে ফ্রান্সের পতাকাকে।
এরপর বলের আরো একটি বড় পরিবর্তন আসে ২০০২ সালের জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপে। ঐতিহ্যবাহী কালো-সাদার বদলে যুক্ত হয় সোনালী রঙ। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপে, যেখানে এডিডাস নিয়ে আসে নতুন Teamgiest বল। পুরোনো ৩২টি ছোট প্লেটের বদলে এর পৃষ্ঠে ছিল ১৪টি প্লেট, যা খেলোয়ারডের সাহায্য করে বলটিকে আরো নিজেদের কন্ট্রোলে নিয়ে আসতে। এছাড়া এই সময়েই বলটি সবচেয়ে ভালোভাবে গোলাকৃতি পায়। এই সময়ে প্লেটগুলো না সেলাই করে বরং দৃঢ়ভাবে আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। এই নতুন প্রসেসের আরো আপডেটেড ভার্সন হিসেবে ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে আসে জাবুলানি। এর পৃষ্ঠে ছিল কেবল ৮টি প্লেট। বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বল এটি। এর মুভমেন্ট, গতি যথেষ্ট ভোগায় প্লেয়ারদের।
এই সমস্যা দূর করে ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে আসে ব্রাজুকা। ছয়টি পলিইউরিথিন প্লেটের আবরণের এই বলের খেলা যথেষ্ট উপভোগ্য ছিল। এই বলের ভিতরেই বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম লাগানো হয় গোল লাইন টেকনোলজির সেন্সর। আর ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে টেলস্টার ফিরে আসে তার একদম নতুন রূপ নিয়ে। ঐতিহ্যবাহী সাদা-কালো রঙ থাকলেও ডিজাইনটা ছিল একদম ব্যাতিক্রম। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো বলের তকমা পেয়েছিল এটি, যদিও বেশ কয়েকবার খেলা চলাকালীন বল ছিদ্র হয়ে যায়।
ফুটবলের যাত্রা হয়েছিল প্রাণীর মাথা-পাকস্থলী থেকে, সেটি চামড়া-সিন্থেটিকের যুগ পার করে এসেছে পলিইউরিথিনের যুগে। তবে যাত্রা থেমে থাকবে না, এখনো চেষ্টা চালানো হচ্ছে এই জিনিসটিকে আরো কত বেশি উন্নত করা যায়। কিংবা বলতে পারেন, আরো ‘গোল’ করা যায় কি না!