১.
ব্যাটসম্যান ব্র্যাডম্যানকে আমরা মোটামুটি সবাই-ই চিনি। বিস্তর লেখালেখি হয়েছে তাকে নিয়ে, রচিত হয়েছে অনেক মহাকাব্য। ৫২ টেস্টে ২৯ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ৬,৯৯৬। ৯৯.৯৪ গড়টাকে অতিমানবিক বললেও কম বলা হয়। সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান তকমাটা তো আর এমনি এমনি লাগেনি তার গায়ে।
ব্যাটসম্যান ব্র্যাডম্যানের কথা তাই বাদ দিয়ে অধিনায়ক ব্র্যাডম্যানের কথা বলা যাক। কেমন ছিলেন তিনি অধিনায়ক হিসেবে? দুর্দান্ত, নাকি গড়পড়তা? প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কি তার ম্যাচ বের করে আনার ক্ষমতা ছিল? নাকি ‘একজন অধিনায়ক ততটাই ভালো, যতটা ভালো তার দল’ এই রকম একজন অধিনায়ক ছিলেন তিনি?
সকল প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদেরকে ফিরতে হবে ১৯৩৭ সালের অ্যাশেজ সিরিজে। সেই সিরিজেই অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হয়েছিল স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের।
২.
সময়টা ভালো যাচ্ছিল না তখন ব্র্যাডম্যানের। নিজের মাটিতে অ্যাশেজ, অথচ সেই অ্যাশেজে পিছিয়ে পড়েছেন ২-০ ব্যবধানে। হাতে আছে মাত্র আর ৩ টেস্ট। এই ৩ টেস্টে জিততে না পারলে অ্যাশেজ তো যাবেই, সেই সাথে যাবে অধিনায়কত্বও। ব্যর্থ অধিনায়কদের একদম বরদাস্ত করে না অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড।
প্রথম টেস্ট ছিল ব্রিসবেনে। চতুর্থ ইনিংসে ৩৮১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামল অস্ট্রেলিয়া, নেমেই পড়ল প্রকৃতির তোপের মুখে। সে সময় বৃষ্টি হলে পিচ ঢাকার বালাই ছিল না, খোলা পড়ে থাকত পিচ। এই পিচকে বলা হতো স্টিকি উইকেট। বৃষ্টির পর স্টিকি উইকেট হয়ে উঠত ব্যাটসম্যানদের জন্য মারণফাঁদ।
সেই ফাঁদে পড়ে অস্ট্রেলিয়া অলআউট হয়ে গেল মাত্র ৫৮ রানে। এই অবস্থায় যার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা, সেই ব্র্যাডম্যান করলেন শূন্য।
এর নয়দিন পর সিডনিতে শুরু হলো দ্বিতীয় টেস্ট। প্রথম টেস্টের মতো এই টেস্টেও টসে জিতলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক গ্যাবি অ্যালেন, জিতে ব্যাটিং নিলেন। আকাশ তখন ঝকমক করছে। প্রায় দুইদিন ব্যাট করল ইংল্যান্ড, ব্র্যাডম্যানের চোখের সামনে ডাবল সেঞ্চুরি করলেন ওয়ালি হ্যামন্ড। এরপরই বৃষ্টি নামল। তড়িঘড়ি করে ৪২৬ রানেই ইনিংস ঘোষণা করে দিলেন গ্যাবি।
ব্যাটিংয়ে নেমেই খাবি খেতে শুরু করল অস্ট্রেলিয়া, অলআউট হলো মাত্র ৮০ রানে। ব্র্যাডম্যানের অবস্থা এবার আরও খারাপ। প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট হলেন তিনি, গোল্ডেন ডাক যাকে বলে!
ফলোঅনে পড়ে আবার ব্যাট করতে নামল অস্ট্রেলিয়া। এবার ব্র্যাডম্যান করলেন ৮২ রান। ম্যাককেব আর ফিঙ্গলটনের ব্যাট থেকে এলো দুটো হাফ সেঞ্চুরি। তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩২৪ রানে যখন অলআউট হলো, ইনিংস পরাজয় এড়াতে তখনও লাগে ২২ রান।
অ্যাশেজে তখন অস্ট্রেলিয়া ০ – ২ ইংল্যান্ড।
৩.
এবার প্রবল সমালোচনার মুখে পড়লেন ব্র্যাডম্যান। সংবাদপত্র আর সাবেক ক্রিকেটাররা ধুয়ে দিলেন তাকে। এদের মধ্যে বিল উডফুলের কথা বলা যায়। দলের আর তার অধিনায়কের পারফরম্যান্সে তিতিবিরক্ত হয়ে সাবেক এই অধিনায়ক বলে বসলেন, ব্র্যাডম্যান নয়, অধিনায়ক হিসেবে তার পছন্দ ছিলেন স্ট্যানলি ম্যাককেব।
সকল সমালোচনার জবাব হতে পারত একটাই। মঞ্চ প্রস্তুতও ছিল। অতি আকাঙ্ক্ষিত টস এবার জিতলেন ব্র্যাডম্যান, জিতেই ব্যাটিং নিলেন। দলের রান যখন ৩৩ আর নিজের ১৩, সেই সময়ে ভ্যারিটির বলে শর্ট লেগে ধরা পড়লেন তিনি। গ্যাবি অ্যালেনের মতে, অ্যাশেজ তখন ইংল্যান্ডের হাতে প্রায় এসেই গেছে।
নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়তে লাগল, ধুঁকে ধুঁকে রান জোগাড় করতে লাগল অস্ট্রেলিয়া। এক দিকে ম্যাককেব টিকে যাওয়ায় তা-ও কিছুটা বাঁচোয়া। তিনি করলেন ইনিংসের সর্বোচ্চ ৬৪ রান।
ঘড়িতে সময় তখন বিকেল পাঁচটা, স্কোর তখন ১৮১/৬। ঠিক তখনই বৃষ্টি নামল মুষলধারে, সেদিনের মতো খেলা বন্ধ করতে বাধ্য হলেন আম্পায়াররা।
বৃষ্টি চলল সারারাত, সেই বৃষ্টিতে মাঠের অবস্থা হলো যাচ্ছেতাই। যার কারণে পরদিন সকালে মাঠ দেখে ব্র্যাডম্যান বললেন,
‘মাঠের এত বাজে অবস্থা আমি আমার সারা জীবনে দেখিনি।’
মাঠের কারণে খেলা শুরু হলো লাঞ্চের পর। আধাঘণ্টা খেলা হলো, স্কোরবোর্ডে যোগ হলো আরও ১৯ রান, ২০০ ছুঁয়ে ফেলল অস্ট্রেলিয়া।
আর ঠিক সেই সময়ে আস্তিন থেকে প্রথম তাসটা বের করলেন ব্র্যাডম্যান, দুর্দান্ত এক মাইন্ড গেম খেললেন তিনি। ২০০/৯, এই অবস্থাতেই ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিলেন!
কারণটা বোঝা কঠিন কিছু নয়। আগের দুই টেস্ট তো বটেই, এমনকি এই টেস্টেও স্টিকি উইকেটে ব্যাট করতে হয়েছে তার দলকে। সেই ওষুধ এবার প্রতিপক্ষকেও খাওয়ানো যাক!
ব্যাটিংয়ে নামল ইংল্যান্ড। বল হাতে নিলেন ম্যাককেব, নিয়েই ফেরালেন ওপেনার স্ট্যান ওর্থিংটনকে। এরপরই জ্বলে উঠলেন মরিস সিভার্স, একাই পাঁচ উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে ধ্বসিয়ে দিলেন তিনি। বলের কোনো আগামাথা ছিল না, কার্ভ এবং অ্যাঙ্গেল যত রকম হতে পারে, হচ্ছিল। বিখ্যাত ক্রিকেট সমালোচক নেভিল কার্ডাসের ভাষায়,
‘Ball was here, there, everywhere!’
এক পর্যায়ে ইংল্যান্ডের স্কোর দাঁড়াল ৭৬/৭। আর তখনই ভয় পেলেন ব্র্যাডম্যান! কারণ, দিনের খেলা শেষ হতে তখনও এক ঘণ্টা বাকি। এর মাঝে যদি ইংল্যান্ড অলআউট হয়ে যায়, তবে এই উইকেটে আবার ব্যাট করতে হবে নিজের দলকে।
বোলারের কাছে দৌড়ে গেলেন ব্র্যাডম্যান, সকল ফিল্ডারদেরকে বাউন্ডারিতে সরিয়ে দিলেন। বাগে পেয়েও প্রতিপক্ষকে আউট না করার সে কী প্রাণান্ত প্রচেষ্টা তার!
এদিকে ড্রেসিংরুমে বসে থাকা গ্যাবি অ্যালেনের মাথাতেও চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। দলের রান যখন ৬৮, তখন আউট হয়ে যান ওয়ালি হ্যামন্ড। হ্যামন্ড আউট হওয়ার পরই ইনিংস ডিক্লেয়ার করার জন্য তাকে ধরে বসেন বাকি সতীর্থরা। পরদিন ছিল রবিবার, বিশ্রাম দিবস। টাইমলেস টেস্টের সময় ছিল সেটা, খেলার মাঝখানে দুই দলের খেলোয়াড়রা মিলে বিশ্রাম নিতেন একটা দিন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই দিনটা হতো রবিবার। এই বিশ্রাম দিবসের কারণেই ডিক্লেয়ার করতে দ্বিধা করছিলেন তিনি। কারণ, মাঝের একদিনে আবহাওয়ার অবস্থা কী হবে, তা কে বলতে পারে! আবার ধরা যাক, তিনি ডিক্লেয়ার করলেন। তখন ব্র্যাডম্যান দ্বিতীয় ইনিংসে একটা বল না খেলেও যদি ডিক্লেয়ার করে তবে তো আজই ইংল্যান্ডকে আবার ব্যাটিংয়ে নামতে হবে, তাই না?
এসব চিন্তা করতে গিয়ে কিছুক্ষণ দেরি হয়ে গেল তার। শেষ পর্যন্ত যখন ডিক্লেয়ার করলেন, তখন পার হয়েছে পনেরো মিনিট, স্কোরবোর্ডে আর এক রান যোগ না করেও বিদায় নিয়েছেন আরও দুই ব্যাটসম্যান। স্কোর ৭৬/৯।
১২৪ রানে পিছিয়ে থেকেও দলের ইনিংস ঘোষণা করলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক গ্যাবি অ্যালেন! টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রথম ইনিংস ঘোষণা করল উভয় দল।
এই পর্যায়ে আবার একটা মাইন্ড গেম খেললেন ব্র্যাডম্যান। গ্যাবি অ্যালেন আসলেই ডিক্লেয়ার করেছেন কি না, সন্দেহ প্রকাশ করলেন সে বিষয়ে। তার আত্মবিশ্বাস দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন আম্পায়ারদ্বয়। সন্দেহ নিরসনে ড্রেসিংরুমে গিয়ে গ্যাবির কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন তারা, তিনি কি আসলেই ডিক্লেয়ার করেছেন?
ব্র্যাডম্যান যে ইচ্ছে করে সময় নষ্ট করছেন, তা বুঝতে গ্যাবির আর বাকি রইলো না।
‘অবশ্যই আমি ডিক্লেয়ার করেছি। বদমাশটা ভেবেছে কী?’
বদমাশ আর কেউ নন, ডন।
আরও পাঁচ মিনিট গেল। তখনও চল্লিশ মিনিট বাকি দিনের খেলার। নেভিল কার্ডাস বলেছিলেন,
‘মাঠের ওই অবস্থায় কোনো অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান দশ মিনিটও টিকতে পারত না।’
তবে উপায়?
এই অবস্থায় ডন যে সিদ্ধান্তটা নিলেন, ক্রিকেটে তা সর্বকালের সেরা কৌশল কি না, সে বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়ে গেছে। বাকি সময়টা কাটানোর জন্য তিনি ইনিংস ওপেন করালেন দুই টেলএন্ডার বিল ও’রিলি আর চাক ফ্লিটউড স্মিথকে দিয়ে! স্বাভাবিক সময়ে এই দু’জন নামতেন যথাক্রমে আট এবং দশ নাম্বারে। দশ নাম্বারে নামা চাক ছিলেন ভয়াবহ বাজে ব্যাটসম্যান, তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন,
‘দশ নাম্বারে ব্যাট করতে নামা একটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো।’
শোনা যায়, তাকে ওপেন করতে নামতে হবে শুনে চাক জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি কেন?’ ব্র্যাডম্যান জবাব দিয়েছিলেন,
‘এই উইকেটে আউট হওয়ার একটাই উপায়, বল ব্যাটে লাগাতে হবে। যেটা তোমার পক্ষে অসম্ভব।’
ও’রিলি আর চাক মাঠে নামতেই হাসির ফোয়ারা ছুটল। শেষ পর্যন্ত এরা! ভালো ব্যাটসম্যানরাই খাবি খাচ্ছে এই উইকেটে, এরা যে কী করবে, তা বোঝাই যাচ্ছে।
বিল ভোসের প্রথম বলেই আউট হয়ে গেলেন বিল ও’রিলি। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ব্র্যাডম্যান নামালেন নাম্বার নাইন ফ্রাঙ্ক ওয়ার্ডকে।
ফ্রাঙ্ক ওয়ার্ড নামার পরে শুরু হলো আরেক মজা। আলোর স্বল্পতায় বল দেখা যাচ্ছে না বলে বারবার অনুযোগ করতে লাগলেন দুই ব্যাটসম্যান। একটা করে বল হয়, একবার করে অভিযোগ করেন ব্যাটসম্যানেরা। বিরক্ত হয়ে তিন ওভারের মাথাতেই দিনের খেলা শেষ বলে ঘোষণা করলেন আম্পায়ার। আর সেই চাক ফ্লিটউড স্মিথ খেললেন পাকা ছয়টি বল, ব্যাট লাগাতে পারলেন না একটিতেও। ফলে সেদিনের মতো অপরাজিতই থেকে গেলেন তিনি।
৪.
একদিন বিরতি দিয়ে সোমবার সকালে খেলা শুরু হলো আবার। প্রচুর দর্শক হলো সেদিন। বৃষ্টির বেগ কমে গিয়েছিল অনেকটাই, সূর্যও মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল মেঘের ফাঁক দিয়ে। পিচও বিশ্রাম পেয়েছিল একদিনের। সব মিলিয়ে শনিবারের তুলনায় উইকেটের অবস্থা উন্নতির দিকে, তবে আদর্শ ব্যাটিং পিচ হওয়ার তখনও দেরি। ততক্ষণ পর্যন্ত যদি ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে থাকা যায়, তবে…
বিল ভোসের করা বলে প্রথমবারের মতো ব্যাট লাগাতে পারলেন চাক, এবং সেই বলেই তিনি আউট! দেখাই যাচ্ছে, ব্র্যাডম্যান খুব ভুল কিছু বলেননি।
চাক আউট হওয়ার পরে স্কোরকার্ডে ব্র্যাডম্যানের নাম দেখার জন্য উৎসুক হয়ে থাকল দর্শকেরা। কিন্তু এবার মাঠে নামলেন একজন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান, কিথ রিগ। প্রথম ইনিংসেও তিনি চার নাম্বারেই নেমেছিলেন। তার উপরে ব্র্যাডম্যানের পরিষ্কার নির্দেশ থাকল, ‘রান চাই না, উইকেট আগলে পড়ে থাকো।’
অধিনায়কের নির্দেশ পালন করলেন রিগ। ওয়ার্ডকে সাথে নিয়ে কাটিয়ে দিলেন এক ঘণ্টা, দলীয় ৩৮ রানে আউট হলেন ওয়ার্ড। এবার ব্র্যাডম্যান নামালেন ওপেনার বিল ব্রাউনকে। একই নির্দেশ ছিল তার উপরেও, কোনো অবস্থাতেই আউট হওয়া যাবে না।
দলের রান যখন ৭৪, এই সময়ে আউট হয়ে গেলেন ব্রাউন। ক্রিজে এলেন আরেক ওপেনার জ্যাক ফিঙ্গলটন, রিগকে সাথে নিয়ে দলকে নিয়ে গেলেন ৯৭ পর্যন্ত। তারপরই এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে পড়ে শেষ হলো রিগের সংগ্রাম।
পঞ্চম উইকেট পড়ার পর মাঠে নামলেন ডন ব্র্যাডম্যান। নেভিল কার্ডাসের ভাষায়,
‘খেলার তখন ক্রাইসিস মোমেন্ট। কী ঘটবে, তার সবটুকুই নির্ভর করছে ব্র্যাডম্যানের উপরে।’
পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এই ক্রাইসিস মোমেন্ট? কারণ ব্র্যাডম্যান যখন নেমেছেন, তখন তার দলের লিড ২২১ রানের। চতুর্থ ইনিংসে রান তাড়া করা সবসময়ই কঠিন, তাই তিনি ব্যর্থ হলেও ইংল্যান্ড যে জিতবে, এমন তো কোনো কথা নেই।
ব্যাপারটা আসলে এত সহজ ছিল না। লিড ২২১ রানের ছিল, এটা যেমন ঠিক, সাথে এটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন, উইকেট খুব দ্রুত শুকাচ্ছিল। বিপক্ষ দলে ছিলেন হ্যামন্ড, লেল্যান্ডের মতো ব্যাটসম্যানেরা। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ব্র্যাডম্যানের নিজের ক্যারিয়ারই তখন ঝুঁকির মুখে। আগের পাঁচ ইনিংসে একটা হাফ সেঞ্চুরি ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই রান না পাওয়ার পরও এই টেস্ট যদি জিতে যান, তাহলেও হয়তো অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবে। হয়তো চিরদিনের জন্যই!
এই ম্যাচের পর ব্র্যাডম্যানের ব্যাপক সমালোচনা করেছিলেন সমালোচকেরা, ব্যাটিং অর্ডার উল্টো করে দেয়ার জন্য কাপুরুষ বলেও অভিহিত করেছিলেন। ব্র্যাডম্যান তা শুনে বলেছিলেন, তিনি যা করেছেন, দলের কথা ভেবেই করেছেন। নিয়মের মধ্যে থেকেই নিয়ম ভেঙেছেন। আপাতত সে কথা থাক, আমরা আবার মেলবোর্নে ফিরি।
ষষ্ঠ উইকেটে জ্যাক ফিঙ্গলটনের সাথে জুটি বাঁধলেন ব্র্যাডম্যান, খুব সাবধানে খেলতে লাগলেন। অফ ড্রাইভ খেললেনই না, বল বাতাসে ভাসিয়ে মারলেন না। প্রতিটা শট মেপে খেলতে লাগলেন, মাটি কামড়ানো ছাড়া আর উপায় থাকল না বলের। দিন শেষ করলেন দলীয় ১৯৪ রানে, নিজের রান তখন ৫৬, ফিঙ্গলটনের ৩৯।
৫.
পরদিন পুরোপুরি হেসে উঠল সূর্য। আকাশের মেঘ তো কাটিয়ে নিয়ে গেলই, সেই সাথে নিয়ে গেল ব্র্যাডম্যানের মনের মেঘও। আত্মবিশ্বাসের সাথে খেলতে লাগলেন তিনি, ৫৬ রান পরিণত হলো সেঞ্চুরিতে। ১০০ থেকে ১৫০, ১৫০ থেকে ২০০, ২০০ থেকে ২৫০’তে গেলেন লাফিয়ে লাফিয়ে। এর মাঝেই ফিঙ্গলটনের সাথে গড়ে ফেললেন ৩৪৬ রানের জুটি। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ষষ্ঠ উইকেটে আজও রেকর্ড হয়ে আছে এই রান।
ফিঙ্গলটন আউট হলেন ব্যক্তিগত ১৩৬ রানে, দলের রান তখন ৪৪৩। তিনি যাওয়ার পর এলেন ম্যাককেব, তাকে নিয়ে ব্র্যাডম্যান যোগ করলেন ৬৮। নবম উইকেট হিসেবে তিনি যখন আউট হলেন, দলীয় রান তখন ৫৪৯। রানের পাহাড়ে উঠে গেছে অস্ট্রেলিয়া। আর ব্র্যাডম্যানের নিজের সংগ্রহ ২৭০। আগের দিন শেষ করেছিলেন ২৪৮ রান নিয়ে, পরের দিন আর ২২ রান যোগ করেই ভ্যারিটির বলে ধরা পড়েন অ্যালেনের হাতে। শেষ হয় ৭ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট দীর্ঘ ইনিংসটি। অনেক চিন্তাভাবনার পর এই ইনিংসটিকে উইজডেন সর্বকালের সেরা ইনিংসের মর্যাদা দেয়।
ব্র্যাডম্যান আউট হন দলীয় ৫৪৯ রানে, অস্ট্রেলিয়া অলআউট হয় ৫৬৪-তে। আগের ১২৪ রানের ফলে লিড দাঁড়ায় ৬৮৮, জিততে হলে ইংল্যান্ডকে করতে হতো ৬৮৯ রান।
এই রান তাড়া করতে হলে অতিমানবীয় কিছু করতে হতো ইংল্যান্ডকে। ঠাণ্ডা এমনই কাবু করে ফেলেছিল ব্র্যাডম্যানকে যে, তিনি আর মাঠেই নামেননি। কিন্তু তিনি না থাকলেও তার ওই ইনিংস ইংলিশ ক্রিকেটারদের চোখ এমনই ধাঁধিয়ে দিয়েছিল যে, তারা অলআউট হয় মাত্র ৩২৩ রানে। মরিস লেল্যান্ডের সেঞ্চুরি, সাথে হ্যামন্ড আর রবিন্সের দুটো হাফ সেঞ্চুরি পরাজয়ের ব্যবধান কমানো ছাড়া আর কোনো ভূমিকাই রাখেনি।
প্রবল প্রতিকূল অবস্থা থেকেও সিরিজে ফিরে এলো অস্ট্রেলিয়া, সিরিজ হলো ২ – ১। এই টেস্ট থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস পরের টেস্টগুলোতেও টেনে নিয়ে গেলেন ব্র্যাডম্যান। পরের টেস্ট ছিল অ্যাডিলেইডে, সেখানে তিনি করলেন ২১২। অস্ট্রেলিয়া টেস্ট জিতল ১৪৮ রানে। পঞ্চম ও শেষ টেস্ট ছিল আবার সেই মেলবোর্নে, ব্র্যাডম্যান এবার করলেন ১৬৯। দল জিতল ইনিংস ও ২০০ রানের ব্যবধানে।
২ – ০ তে পিছিয়ে পড়েও ৩ – ২ এ সিরিজ জেতা একমাত্র ক্যাপ্টেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান!
১৯৩৬-৩৭ মৌসুমের অ্যাশেজের তৃতীয় টেস্ট যে টেস্ট ক্রিকেটকে কীভাবে পাল্টে দিয়েছে, তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়, তবুও একটা চেষ্টা করা যেতেই পারে। এই টেস্টে ব্যাটিং অর্ডার উল্টে না দিলে অস্ট্রেলিয়া জিতত না, সেক্ষেত্রে ব্র্যাডম্যান রান পেলেও লাভ হতো না কোনো। অধিনায়কত্ব হারাতেন ব্র্যাডম্যান, দল থেকে বাদ পড়াও অস্বাভাবিক ছিল না। তাহলে সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানকে আজ আমরা পেতাম কোথায়? এই ঘটনার বছর দশেক পরে ইংল্যান্ডে রাজত্ব করেছিল ‘দ্য ইনভিন্সিবল’ নামের যে দলটি, তারাই বা আসত কোথা থেকে?
ক্রিকেটানুরাগীদের কাছ থেকে একটা কৃতজ্ঞতা বোধহয় পাওনা হয়েই আছে ডন ব্র্যাডম্যানের!