আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৯। আর মাত্র তিনমাস পরেই ইংল্যান্ডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর ‘আইসিসি বিশ্বকাপ ২০১৯’ এর পর্দা উঠবে। এটি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ১২তম আসর। এবারের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করবে আইসিসির ১০টি পূর্ণাঙ্গ সদস্য দল।
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই প্রতিটি দেশ তাদের দল গোছাতে ব্যস্ত। প্রতিটি দলই চাইবে বিগত দিনের সব ভুল ত্রুটি শুধরে এবারের বিশ্বকাপে নিজেদের সেরাটা দিতে। সেদিক থেকে নিউজিল্যান্ডের কথা না বললেই নয়। বিশ্বকাপের শুরু থেকে গত বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত ৬টি সেমি ফাইনাল খেলেও ফাইনালে দেখা মেলেনি তাদের। অবশেষে গতবার ফাইনালে উঠলেও বিশ্বকাপ ট্রফি ছোঁয়ার সৌভাগ্য হয়নি ব্ল্যাক ক্যাপসদের। আজ নিউজিল্যান্ডের হেরে যাওয়া সেই সেমি ফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচগুলো সম্পর্কেই আলোচনা করা হবে।
বিশ্বকাপ ১৯৭৫, নিউজিল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ
আইসিসি বিশ্বকাপ, ১৯৭৫। ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ আসর এটি। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম বিশ্বকাপ আসরে বিশ্ব ক্রিকেটের আটটি দল অংশগ্রহণ করে।
গ্লেন টার্নারের নেতৃত্বে প্রথম বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে নিউজিল্যান্ড। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে পূর্ব আফ্রিকাকে ১৮১ রানের ব্যবধানে হারায় তারা। দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে ৮০ রানে হেরে গেলেও গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ভারতকে ৪ উইকেটে হারিয়ে সেমি ফাইনালে উত্তীর্ণ হয় ব্ল্যাক ক্যাপসরা।
সেমিফাইনালে লন্ডনের কেনিংটন ওভাল স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয় নিউজিল্যান্ড। টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড। ব্যাট করতে নেমে প্রথমেই নিউজিল্যান্ডের উদ্বোধনী জুটি ভেঙে গেলে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে গ্লেন টার্নার ও জিওফ হাওয়ার্থ অনবদ্য এক জুটি গড়েন। দলীয় ৯৮ রানের মাথায় অ্যান্ডি রবার্টসের বলে গ্লেন টার্নার ৩৬ রান করে আউট হন। এরপর জিওফ হাওয়ার্থ আউট হয়ে গেলে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা আর কোনো ভালো জুটি গড়তে পারেনি। নিয়মিত উইকেট পতনের ফলে ৫২.২ ওভারে ১৫৮ রানে অলআউট হয় নিউজিল্যান্ড। তাদের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫১ রান করেছিলেন হাওয়ার্থ।
সহজ টার্গেটে খেলতে নেমে গর্ডন গ্রিনিজ ও আলভিন কালিচরণের জোড়া হাফ সেঞ্চুরিতে ৪০.১ ওভারেই ৫ উইকেট হাতে রেখে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় ক্যারিবীয়রা।
বিশ্বকাপ ১৯৭৯, নিউজিল্যান্ড বনাম ইংল্যান্ড
১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় বিশ্বকাপটিও অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডে। প্রথমবারের মতো এবারও নিউজিল্যান্ড সহ মোট আটটি দল অংশগ্রহণ করে। মার্ক বার্জেসের নেতৃত্বে গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ৯ উইকেটে ও দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতকে ৮ উইকেটে হারায় নিউজিল্যান্ড। তৃতীয় ম্যাচটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে হেরেও সেমি ফাইনালে উঠতে সক্ষম হয় নিউজিল্যান্ড।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে মুখোমুখি হয় নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। টসে জিতে ইংল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক মার্ক বার্জেস। ব্যাট করতে নেমে প্রথমেই বিপর্যয়ে পড়লে তৃতীয় উইকেট জুটিতে অধিনায়ক মাইক ব্রেয়ারলি ও গ্রাহাম গুচের জোড়া হাফ সেঞ্চুরি এবং শেষে ডেরেক র্যানডালের অপরাজিত ৪২ রানের সুবাদে নির্ধারিত ৬০ ওভার শেষে ৮ উইকেট হারিয়ে ২২১ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড।
২২২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে জন রাইট ও ব্রুস ইজারের উদ্বোধনী জুটিতে শুভসূচনা করলেও পরে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়তে থাকে। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান জন রাইটের ৬৯ ও গ্লেম টার্নারের ৩০ রান ব্যতীত আর কোনো ব্যাটসম্যানই বড় স্কোর করতে পারেনি। ফলে ৬০ ওভার শেষে ৯ উইকেট হারিয়ে ২১২ রান করতে সক্ষম হয় নিউজিল্যান্ড। জয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও ৯ রানের হার নিয়ে সেবারের বিশ্বকাপ আসর শেষ হয় নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের।
বিশ্বকাপ ১৯৯২, নিউজিল্যান্ড বনাম পাকিস্তান
১৯৯২ সালের পঞ্চম বিশ্বকাপটি আয়োজন করে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এ বিশ্বকাপে নয়টি দল অংশগ্রহণ করে এবং গ্রুপপর্বে প্রতিটি দল একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে। নিজেদের মাঠে মার্টিন ক্রোর নেতৃত্বে নিউজিল্যান্ড ছিল অপ্রতিরোধ্য। গ্রুপপর্বে আটটি ম্যাচের মধ্যে সাতটিতেই জয় (অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৩৭ রানে, শ্রীলঙ্কার সাথে ৬ উইকেটে, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ৭ উইকেটে, জিম্বাবুয়ের সাথে ৪৮ রানে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ৫ উইকেটে, ভারতের সাথে ৪ উইকেটে এবং ইংল্যান্ডের সাথে ৭ উইকেটে) পায় নিউজিল্যান্ড। তবে শেষ ম্যাচে পাকিস্তানের সাথে ৭ উইকেটে হেরে যায় তারা।
সেমি ফাইনালে এসে আবারও সেই পাকিস্তানের মুখোমুখি হতে হয় নিউজিল্যান্ডকে। অকল্যান্ডের ইডেন পার্ক স্টেডিয়ামে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামে নিউজিল্যান্ড। মার্টিন ক্রোর ৮৩ বলে ৯১ রানের অনবদ্য এক ইনিংস এবং কেন রাদারফোর্ডের ৫০ রানের সুবাদে ৫০ ওভার শেষে ৭ উইকেটে ২৬২ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড়া করে নিউজিল্যান্ড।
বিশাল টার্গেটে খেলতে নেমে প্রথম থেকেই একটু মন্থর গতিতে এগোতে থাকে পাকিস্তান। এতে হাতে উইকেট থাকলেও শেষে এসে বেশ চাপে পড়ে যায় তারা। পরে ইনজামাম-উল-হকের ৩৭ বলে ৬০ রানের ইনিংসটিই পাকিস্তানকে জয় এনে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ৪ উইকেটের জয় পায় পাকিস্তান। ফলস্বরুপ স্বদেশের মাটিতেও বিশ্বকাপ ছোঁয়া হলো না নিউজিল্যান্ডের।
বিশ্বকাপ ১৯৯৯, নিউজিল্যান্ড বনাম পাকিস্তান
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে ১২টি দল অংশগ্রহণ করে। স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের নেতৃত্বে গ্রুপ পর্বের পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতে জয় (বাংলাদেশের সাথে ৬ উইকেটে, অস্ট্রেলিয়ার সাথে ৫ উইকেটে এবং স্কটল্যান্ডের সাথে ৬ উইকেটে) এবং দুটিতে (ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ৭ উইকেটে এবং পাকিস্তানের সাথে ৬২ রানে) হার নিয়ে সুপার সিক্সে উত্তীর্ণ হয় নিউজিল্যান্ড।
এরপর সুপার সিক্সে নিজেদের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আলো স্বল্পতার কারণে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয় দুই দল। দ্বিতীয় ম্যাচে হেরে গেলেও শেষ ম্যাচে ভারতের সাথে ৫ উইকেটে জয় পেয়ে সেমি-ফাইনালে উঠে যায় নিউজিল্যান্ড।
সেমি ফাইনালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে প্রথমেই দুই উইকেট হারায় নিউজিল্যান্ড। এরপর মিডল অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা ছোট ছোট কয়েকটি জুটি গড়লেও বড় কোনো স্কোর গড়তে পারেননি কোনো ব্যাটসম্যান। স্টেফেন ফ্লেমিংয়ের ৪১, রজার টুজের ৪৬ ও ক্রিস কেয়ার্নসের অপরাজিত ৪৪ রানের সুবাদে ৭ উইকেট হারিয়ে ২৪১ রান সংগ্রহ করে নিউজিল্যান্ড।
২৪২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে উদ্বোধনী দুই ব্যাটসম্যান সাঈদ আনোয়ার ও ওয়াজাহাতুল্লাহ ওয়াজতির ১৯৪ রানের জুটি গড়েন। ৮৪ রানে ওয়াজাহাতুল্লাহ আউট হলে সাঈদ আনোয়ারের অপরাজিত ১১৪ রান ও আইজাজ আহমেদের ২৮ রানের উপর ভর করে ৯ উইকেট হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পোঁছে যায় পাকিস্তান।
বিশ্বকাপ ২০০৭, নিউজিল্যান্ড বনাম শ্রীলঙ্কা
দক্ষিণ আফ্রিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে আইসিসির পূর্ণাঙ্গ ও সহযোগী সদস্যের মোট ১৬টি দল অংশগ্রহণ করে। এবারও নিউজিল্যান্ড দলের নেতৃত্ব দেন স্টিফেন ফ্লেমিং। গ্রুপপর্বে ইল্যান্ড, কেনিয়া ও কানাডাকে হারিয়ে সুপার এইটে উঠে নিউজিল্যান্ড। সুপার এইটে ছয় ম্যাচের মধ্যে চারটিতে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ, আয়াল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা) জিতে সেমি ফাইনালে পা রাখে তারা।
সুপার এইটে হেরে যাওয়া শ্রীলঙ্কার সাথে দ্বিতীয়বারের মতো সেমি ফাইনালেও লড়তে হয় নিউজিল্যান্ডকে। টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নামে শ্রীলঙ্কা। ওপেনার ব্যাটসম্যান উপুল থারাঙ্গার ৭৩ রান ও মাহেলা জয়বর্ধনের অপরাজিত ১১৫ রানের উপর ভর করে ২৯০ রানের লড়াকু টার্গেট ছুড়ে দেয় নিউজিল্যান্ডকে।
জবাবে ওপেনার পিটার ফুল্টনের ৪৬ রান ব্যতীত আর কোনো ব্যাটসম্যানই ভালো সংগ্রহ করতে পারেনি। শেষে ৪১.৪ ওভারে সবক’টি উইকেট হারিয়ে ২০৮ রান সংগ্রহ করে নিউজিল্যান্ড। ফলে ৮১ রানের হার নিয়ে পঞ্চমবারের মতো সেমি ফাইনাল খেলেও ফাইনালে যেতে পারেনি তারা।
বিশ্বকাপ ২০১১, নিউজিল্যান্ড বনাম শ্রীলঙ্কা
বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ড্যানিয়েল ভেট্টোরির নেতৃত্বে অংশ নেয় নিউজিল্যান্ড। গ্রুপ পর্বে ছয়টি ম্যাচের মধ্যে চারটিতে (কেনিয়া, জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান ও কানাডা) জিতে এবং অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কার সাথে হেরে কোয়াটার ফাইনালে ওঠে নিউজিল্যান্ড। এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেমি ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে।
শ্রীলঙ্কার কলোম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেমি ফাইনালে আবারো শ্রীলঙ্কার সাথে দেখা হয় নিউজিল্যান্ডের। টসে জিতে প্রথম ব্যাট করতে নেমে বড় কোনো জুটিই গড়তে পারেনি নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা। শেষে স্কট স্টাইরিশের ৫৭ রানের উপর ভর করে সবক’টি উইকেট হারিয়ে ২১৭ রান করতে সক্ষম হয় নিউজিল্যান্ড।
জবাবে ৪০ রানে প্রথম উইকেটের পতন হলেও দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে তিলকরত্নে দিলশান ও কুমার সাঙ্গাকারা ১২০ রান যোগ করলে জয় ছিনিয়ে নিতে আর বেশি বেগ পেতে হয়নি লঙ্কানদের। ১৩ বল হাতে রেখে ৫ উইকেটের জয় পায় শ্রীলঙ্কা।
বিশ্বকাপ ফাইনাল ২০১৫, অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড
অবশেষে ২০১৫ সালে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নেতৃত্বে নিজেদের মাটিতে ফাইনালের দেখা পায় নিউজিল্যান্ড। গ্রুপপর্বের সবকটি ম্যাচে জিতে কোয়াটার ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সেমি ফাইনালে ওঠে তারা। সেমি ফাইনালে শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারায় তারা।
বহু প্রতিক্ষার ফাইনালে মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় নিউজিল্যান্ড। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৩৯ রানেই টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে হারায় নিউজিল্যান্ড। এরপর চতুর্থ উইকেট জুটিতে গ্র্যান্ট ইলিওট ও রস টেলরের শত রানের জুটি দলকে কিছুটা স্বস্তিতে ফেরায়। তবে দলীয় ১৫০ রানের মাথায় টেলর আউট হবার পর আবারো ধস নামে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং শিবিরে। শেষ ৩৩ রানে ৭টি উইকেট হারালে মাত্র ১৮৩ রানেই গুটিয়ে যায় নিউজিল্যান্ডের ইনিংস।
সহজ টার্গেটে খেলতে নেমে স্টিভেন স্মিথ ও মাইকেল ক্লার্কের জোড়া হাফ সেঞ্চুরিতে ১০১ বল হাতে রেখে ৭ উইকেটের বড় জয় পায় অস্ট্রেলিয়া।