রনি তালুকদার।
২০০৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে আসার পর ২০০৮-০৯ মৌসুমে বরিশাল বিভাগের হয়ে জাতীয় ক্রিকেট লিগে ধারাবাহিকভাবে রান করেছেন। আবাহনীর হয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তিনশো’র বেশি রান করেছেন। কিন্তু লিগের মাঝপথে হাত চোট পেয়ে ছিটকে পড়েন। ঠিক তখনই রনি তালুকদারের মারকুটে ব্যাটিংয়ের খবর চাউর হয়েছিলো বাংলাদেশের ক্রিকেটে।
তারপর জোয়ার-ভাটার মতোই রনির ব্যাটে রান এসেছে, তবে ধারাবাহিক নয়। ২০১৪-২০১৫ সালে আবার রান মিছিলে যোগ দেয় এই ডানহাতি ওপেনারের ব্যাট। ঘরোয়া ক্রিকেটে, বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রানের ফল্গুধারা বইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেসময় তো পত্রিকায় শিরোনামও হয়েছিলো ‘২২ গজে রনির তালুকদারি’।
কিন্তু ওই সময় দুই বছরে আড়াই হাজারের বেশি রানেও জাতীয় দলের দরজা খোলেনি তার জন্য। নির্বাচকদের কাজটা কঠিন করে দিয়েছিলেন রনি, এটুকু নিশ্চিত। তামিম ইকবাল, এনামুল হক বিজয়, ইমরুল কায়েসের সঙ্গে সৌম্য সরকারকে ২০১৫ বিশ্বকাপে নিয়েছিলো বাংলাদেশ, যেখানে জায়গা হয়নি রনির।
বিশ্বকাপের পর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন নারায়নগঞ্জের এই ক্রিকেটার। তারপরই বাদ পড়েছিলেন।
চলমান ২০১৮-১৯ মৌসুমটাও দুর্দান্ত কাটছে রনির। পাদ-প্রদীপের আলোটা অবশ্য তার উপর পড়লো সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ষষ্ঠ আসরে। ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করলেও খুব আলোচনায় ছিলেন না। বিপিএলে যেন নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন রনি। মারকুটে ব্যাটিংয়ে সবাইকে বিস্মিত করেছেন। রানার্সআপ হওয়া ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে তার ব্যাটিং অনেকের মুখ থেকেই বারবার বের করেছে, ‘ওয়াও, সুপার শট!’
আক্রমণই ছিল রনির ব্যাটিংয়ের ভাষা। ১৫ ম্যাচে তিন হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩১৭ রান করেছেন ২৮ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান। বিপিএলের ষষ্ঠ সেরা রানসংগ্রাহক, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে তিনি। বিপিএলে তার স্ট্রাইক রেটও ছিল আকর্ষণীয়, ১৪০.২৬। আর তারকাবহুল ঢাকা দলের সেরা ব্যাটসম্যান তিনি। ঢাকা শিরোপা না জিতলেও রনি তালুকদার এবারের বিপিএলের ‘আনসাং হিরো’। সবার নজরের বাইরে থেকে এসে রনি ঢাকার হয়ে নীরবে মাতিয়ে গেছেন বিপিএল।
ঘরোয়া ক্রিকেটে ২০১৮-১৯ মৌসুমে জাতীয় ক্রিকেট লিগে (এনসিএল) চার ম্যাচে ৪২৬ রান করে পঞ্চম স্থানে ছিলেন রনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগেও (বিসিএল) ছয় ম্যাচে ৪৬০ রান করে চতুর্থ সেরা তিনি। বিপিএল তার ব্যাটিংয়ের ধারাবাহিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করলো।
একান্ত আলাপে বিপিএল মিশনসহ নিজের ক্যারিয়ারের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন রনি তালুকদার।
এবার বিপিএলের আপনার পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন কিভাবে করবেন?
পারফর্ম করতে পারাটা সত্যিই এক আনন্দের বিষয়। এই সময়ে পারফর্ম করাটা খুবই দরকার ছিল আমার। কারণ গত বছর অনুশীলন ভালো ছিল। আমি অনেক কঠোর পরিশ্রম করেছি। এই পারফরম্যান্স অবশ্যই সামনে আমাকে ভালো খেলতে সাহায্য করবে। আমার জন্য ভালো, দরকার ছিল।
এটাই কি আপনার ক্যারিয়ারের সেরা বিপিএল?
সেটা তো অবশ্যই। কারণ এবার বিপিএল এমন দলে খেলেছি, যে দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য দল গড়ে। চ্যাম্পিয়ন হতে লড়াই করে। আমারও ইচ্ছা ছিল কিছুটা অবদান রাখার। সেটা করতে পেরে অবশ্যই ভালো লাগছে। যদি চ্যাম্পিয়ন হতাম, তাহলে আরও ভালো লাগতো।
ঢাকার দলে অনেক তারকা ছিল। তারপরও সবচেয়ে বেশি রান আপনার। ব্যাটসম্যান হিসেবে এটা কতটা আনন্দের?
এটা ভালো লাগছে। চ্যাম্পিয়ন হলে আরও ভালো লাগতো। দলে অনেক বড় বড় খেলোয়াড় ছিল। সাকিব ভাই, পোলার্ড, রাসেল, নারিন, রুবেল… এদের সাথে খেলতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। ওদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। সাকিব ভাই, সুজন ভাই আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছে। কীভাবে খেলতে হবে, বিভিন্ন টেকনিক্যাল দিক থেকে অনেক সাহায্য করেছে।
প্রতি ম্যাচেই দেখা গেছে, আপনি তিন নম্বরে এসেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেছেন। দল থেকে কি এই দায়িত্বই দেয়া ছিল?
বিপিএলে এবার আমরা খুব বেশি অনুশীলনের সুযোগ পাইনি। অল্প কিছুদিন অনুশীলন করেছি। সময় ছিল না হাতে। সুজন ভাই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে নিয়ে বলেছে, তুই যেকোনো জায়গায় ব্যাটিং করতে পারিস। ওপেন, ওয়ানডাউন, ৬-৭ নম্বরেও হতে পারে। এটা নিয়ে তুই চিন্তা করবি না। তুই যখন যেখানেই খেলবি, তুই শুধু চিন্তামুক্ত হয়ে খেলবি। একটু বুদ্ধি করে খেলবি, কখন কী করতে হয়, এটা খেয়াল করবি। সত্যি বলতে, আমাকে উনি ওইভাবেই অনুশীলন করিয়েছেন। সুজন ভাই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে বুঝিয়েছে, এখন কী করতে হবে, কী করা যাবে না, এসব নিয়ে ম্যাচের আগে প্রতিদিনই কথা হতো সুজন ভাইয়ের সাথে।
অনেক ম্যাচেই ব্যাটিংয়ে দলের চাহিদা পূরণ করেছেন। পরে ড্রেসিংরুমে সবার মন্তব্য কেমন ছিল?
অনেকগুলো ম্যাচে কিন্তু আমি উনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফরম্যান্স দিতেও পারি নাই। কিছু কিছু ম্যাচে দিতে পেরেছি। উনারা বলছে, ‘তুই যেভাবে খেলতেছিস, তোর ব্যাটে বল লাগতেছে, সবকিছু ভালো হচ্ছে। তুই শুধু আরো একটু মনোযোগ দে। আরো একটু বুুদ্ধি করে খেল। তাহলে আরও ভালো হবে।’ কারণ আমি এমন একটা জায়গায় ব্যাটিং করছি, তিন নম্বর পজিশনে। এ জায়গা থেকে যদি একটু বড় রান হয়, তাহলে দলেরও একটা ভালো অবস্থান তৈরি হয়। ওনারা আমারে এই জিনিসটাই বুঝাতো।
তামিমের সেঞ্চুরির পরও ফাইনালে আপনার ব্যাটিংয়ে বদলে যাচ্ছিলো ম্যাচের গতিপথ। রান আউট হয়ে ম্যাচ শেষ করতে না পারার আক্ষেপ নিশ্চয়ই আছে?
সত্যিই, অনেক বড় হতাশা আমার জন্য। কারণ আমি এর আগের ম্যাচেও রানআউট হয়েছিলাম, ফাইনালেও। তামিম অসাধারণ ব্যাটিং করেছে। একটা সময় মনে হয়েছে, আমরাও ভালো অবস্থায় আছি। ম্যাচটা আমাদের হাতেও আছে। ওই জায়গা থেকে আমি যদি আরও ২-৩টা ওভার খেলতে পারতাম , তাহলে মনে হয় ম্যাচটা আমাদের দিকেই আসতো। খেলাটা অন্যরকম হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, হয়নি। পরে এটা সাকিব ভাইও বলেছে যে, ‘যখন এই ম্যাচগুলো তুই শেষ করতে পারবি, তখন বড় প্লেয়ার হতে পারবি।’
এমন আক্রমণাত্মক ব্যাটিংই কি আপনার পছন্দ?
আমি সবসময় অ্যাটাকিং খেলতেই পছন্দ করি। এটা আমি সবসময় বলে আসছি। আর আমার খেলার ধরনটাই এরকম। আপনার যখন টেকনিক ভালো থাকবে, আপনি যদি ভালো প্রস্তুতি নেন, আপনার মাইন্ড ক্লিয়ার থাকে, ভালো ফোকাস থাকে, আপনি সব জায়গাতে রান করতে পারবেন। সবই তো এক, বল-ব্যাটের খেলা। আপনি চারদিনের ম্যাচে, টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডেতেও ওই বলটাই খেলবেন। এখানে বিষয় হলো, কীভাবে খেলতে হবে, এটা যত দ্রুত মানিয়ে নেয়া যায়, সেটাই ভালো।
সব ফরম্যাটেই, নাকি এমন ব্যাটিং শর্টার ফরম্যাটের সঙ্গে বেশি মানায়?
এটা অবশ্যই। এটা বলতে পারেন, শর্টার ফরম্যাটের সঙ্গে বেশি যায়। আবার বলতে পারেন, চারদিনের ম্যাচের সঙ্গেও যায়। শেবাগ খেলতো না? টেস্টে ওর স্ট্রাইক রেট দেখেন। অনেক ভালো, প্রায় ৮০ প্লাস। ওয়ার্নার খেলতেছে। আপনি এত কিছু চিন্তা না করে, আমি কোথায় খেলছি, ওয়ানডে, চারদিন কি টি-টোয়েন্টি খেলছি, এসব না ভেবে, আমি চেষ্টা করি শুধু বলটাকে খেলবো। বাজে বলকে মারবো, ভালো বলকে সম্মান দিব।
আর এখনই তো সময় ভালো খেলার। এতদিন তো পরিণতিবোধ আসেনি। এখন আমি অনুভব করছি, আমার মাঝে পরিণতিবোধ এসেছে, পরিণত হয়েছি ব্যাটসম্যান হিসেবে। এখন ভালো খেলবো মনে হয়।
জাতীয় দল বিবেচনায় এবারের বিপিএলের পারফরম্যান্স কি মনের মাঝে কোনো আশা তৈরি করে?
সেটা তো অবশ্যই। চেষ্টা তো আমি করছি। এখন আমার বয়স ২৮। এই বয়সেই একটা খেলোয়াড় তার সম্পূর্ণটা দিতে পারে, আমি মনে করি। কারণ আগে আমারই ভুল ছিল, আমার ঘাটতি ছিল। এজন্য আমি মানিয়ে নিতে পারিনি। এখন আমি মনে করি, আমি আগের চেয়ে ভালো কিছু দিতে পারবো।
টেকনিক্যালি আপনার ব্যাটিংয়ে কোনো পরিবর্তন কি হয়েছে?
হ্যাঁ, একটু পরিবর্তন হয়েছে। যদি আপনি একটা জায়গায় ব্যর্থ হতে থাকেন, তাহলে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। এক্ষেত্রে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে সৌরভ (মুমিনুল হক)। গত বিসিএলে এক দলে (ইসলামী ব্যাংক পূর্বাঞ্চল) ছিলাম, একসঙ্গে খেলেছি আমরা। আমি বলবো, মুমিনুল বাংলাদেশের গ্রেট ব্যাটসম্যান। তখন ব্যাটিং নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতাম যে, কী করা যায়। ও এটা নিয়ে আমাকে অনেক কিছু বলছে, বুঝাইছে আমারে। সৌরভের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখছি। সুজন ভাইও আমাকে নিয়ে বিপিএল অনেক কাজ করছে।
নির্দিষ্ট করে কি বলা যায়, কাজ করার পর কোন জায়গায় উন্নতি হয়েছে?
আমি আগে বলের লেন্থটা জাজ করতে পারতাম কম। কোনটা অফ স্ট্যাম্পে, কোনটা মিডল স্ট্যাম্পে, এখানে আমার ঘাটতি ছিল। এখন সেটা আমি বলের লেন্থ বুঝতে পারি ডেলিভারির পর, এটা কোন জায়গায় আছে। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে, নাকি ভিতরে। এটা অনেক বড় জিনিস, আমি মনে করি, যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য।
শিগগিরই শুরু হবে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। সেখানেও নিশ্চয়ই এমন ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাইবেন?
এই মৌসুমে আমি ভালো করেছি। প্রতিটি টুর্নামেন্ট খেলেছি। জাতীয় লিগে আমি পাঁচ নম্বর ছিলাম, বিসিএলেও মনে হয় চারে, বিপিএলে দেশীদের মধ্যে আমি মনে হয় তিন নম্বরে। প্রিমিয়ার লিগেও চেষ্টা থাকবে এক থেকে তিনের মধ্যে থাকার। এজন্য আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আরও বেশি বেশি অনুশীলন করতে হবে। পরিশ্রমের হারটা আরও বাড়িয়ে দিতে হবে।
জাতীয় দলের ফেরার স্বপ্ন দেখেন এখনও?
স্বপ্ন দেখি এখনও। দেখবো, কারণ আমি মনে করি এটাই সময় দলকে কিছু দেয়ার। এখন অবশ্য আমার টার্গেট জাতীয় দল নয়, আমার টার্গেট প্রিমিয়ার লিগ। এখানে যদি আমি ভালো খেলতে পারি, বাকিটা আমাদের নির্বাচকরা আছেন, ওনারা দেখবেন। এখন পর্যন্ত ভালোই যাচ্ছে এই মৌসুম। প্রিমিয়ার লিগ ভালো হলেই ভালো। আমি বলবো, আমি আগের চেয়ে পরিণত হয়েছি।