আয়াক্স।
নামটি শুনলে প্রথমে মনে আসবে কিংবদন্তি কিছু খেলোয়াড়ের নাম, যারা ‘বিখ্যাত’ হবার আগে তাদের গড়ে তুলেছিলো আয়াক্সের অ্যাকাডেমি। আয়াক্স যেন কিংবদন্তি তৈরির কারখানা। আর একধাপ এগিয়ে চিন্তা করলে আসবে একজন ডাচ শিল্পীর নাম, যিনি তার ফুটবল প্রতিভা ও দর্শন দিয়ে বদলে দিয়েছিলেন আয়াক্স ও স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনাকে। যার নাম, ইয়োহান ক্রুইফ।
কিন্তু আমরা আসলে ভুলে যাই আয়াক্স নামক ক্লাবটির ইতিহাস, অর্জন ও তাদের সোনালি সময়কে। ইউরোপের অন্যান্য সকল ক্লাবের তুলনায় আয়াক্স কিন্তু খুব পিছিয়ে নেই। ফুটবলে ‘ট্রেবল’ জেতার অর্জন আছে ৬ টি ক্লাবের। আয়াক্স সেই ছয় ক্লাবের ভেতর অন্যতম। চ্যাম্পিয়নস লিগ নামকরণের আগে ক্রুইফের আয়াক্স ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছে পরপর ৩ বার। ১৯৯৫ সালে আরও একবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলে তাদের মোট ৪ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের সুযোগ হয়।
আয়াক্স যে কারণে বেশি পরিচিত, তা হলো তাদের তরুণ প্রতিভাদের বিশ্বমঞ্চের সামনে উপহার দেওয়া। এ ক্লাবটির আর্দশ হলো, প্রতিভাবান খেলোয়াড় এখানে জন্ম নেয় এবং তারা পরবর্তীতে নিজেদের নিয়ে যায় বিশ্বসেরার স্থানে। তবে নব্বইয়ের দশকে লুইস ভন হালের আয়াক্সের পর দলটা ইউরোপের প্রতিযোগিতায় যেন একটু পিছিয়ে। তার পেছনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ্য। তবে অন্যতম প্রধান কারণ হলো, দলের উঠতি খেলোয়াড়গুলোকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ধরে না রাখতে পারা এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বেতন দিতে না পারা, যেখানে লোভনীয় সব প্রস্তাব দেয় ইউরোপের নামকরা ক্লাবগুলো। তাই বর্তমান সময়ে আয়াক্সের সেই মর্যাদা ছাপিয়ে তারা শিরোনামে থাকে তাদের তরুণ তুর্কিদের নিয়ে। আর প্রায় এক যুগ ধরে তারা এই কাজ বেশ আগ্রহের সাথে পালন করছে। তাদের যুব অ্যাকাডেমি খেলোয়াড় তৈরি করছে, ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর কাছে বিক্রি করে বিক্রিত অর্থ ব্যবহার করছে তাদের যুব অ্যাকাডেমিতে। তাই বাকি সব ক্লাবের সাফল্য থেকে এক ধাপ পিছিয়ে গেলেও খেলোয়াড় তৈরিতে তারা কখনোই পিছিয়ে ছিল না।
এই আয়াক্স কয়েক বছর আগে ইউরোপা লিগে ফাইনালে পৌঁছে তাক লাগিয়ে দেবার সময় বোঝা গিয়েছিলো, সম্পূর্ণ তরুণদের নিয়ে গড়া এই ক্লাবটি আবার পরিণত হচ্ছে। যার সাম্প্রতিক ফলাফল, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে রিয়াল মাদ্রিদকে ১-৪ গোলে বিধ্বস্ত করে দীর্ঘ ১৭ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটে জায়গা করে নিয়েছে। তবে বাস্তবতা চিন্তা করলে, বর্তমান এই বিস্ময়কর আয়াক্স দলকে উপভোগ করার মেয়াদ আর মাত্র কিছু মাস পর্যন্ত। আগামী মৌসুমেই অনেক ক্লাব আয়াক্সের বর্তমান তরুণ প্রতিভাদের চড়া দামে কেনার জন্য তৈরি। আয়াক্সও বিক্রি করতে হয়তো দু’বার ভাববে না। এ দলটি আবার ভাঙবে, আবার গড়বে – এমনটাই তো হয়ে আসছে গত এক যুগ ধরে।
আগামী মৌসুমের প্রথমে আয়াক্সকে বিদায় জানাবেন মিডফিল্ডার ফ্র্যাঙ্কি ডি ইয়ং, যিনি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে নিজের জাত চিনিয়েছেন। সেদিন যেন ব্যালন ডি’অর জয়ী ফুটবলার লুক মদ্রিচও হারিয়ে গিয়েছিলেন ডি ইয়ংয়ের মধ্যমাঠ শাসন করার দক্ষতার কাছে। গত শীতকালীন দলবদল মৌসুমেই ৭৫ মিলিয়ন দিয়ে এই ডাচ মিডফিল্ডারকে কিনে নেয় বার্সেলোনা। তবে দলবদলের চুক্তি হয়ে গেলেও আয়াক্স ডি ইয়ংকে ধরে রাখতে পেরেছে এ মৌসুমের বাকি অংশ।
ফুটবল বিষয়ক ডাচ পত্রিকা ফুটবল ‘ওরাঞ্জি’র প্রতিষ্ঠাতা মিচেল বেল বলেছেন,
‘আয়াক্স সমর্থকরা জানে, মৌসুম শেষে তাদের বিশেষ কিছু খেলোয়াড় বিদায় নেবে। সেজন্য ডি ইয়ং এর বার্সেলোনা যাওয়া নিয়ে তারা গর্বিত। মাথিয়াস ডি লিটও যদি একই পথ অনুসরণ করে, তবে তাতে তাদের গর্বের মাত্রা বৃদ্ধিই পাবে। আয়াক্সে গড়ে ওঠা খেলোয়াড় মূল দলে কয়েক বছর থাকবে, এবং সে কয়েক বছরে তাদের সেরাটা দিয়ে দলকে বিরাট অঙ্ক প্রদান করে বিদায় নেবে। এটাই যেন তাদের নিয়তি। সমর্থকেরা এতেই তাদের প্রতি খুশি।’
তাহলে ফ্র্যাঙ্কি ডি ইয়ংয়ের পর আর কোন কোন খেলোয়াড়েরা আগামী মৌসুমে আয়াক্স ছেড়ে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোতে পাড়ি জমানোর সমীকরণে এগিয়ে?
গোলরক্ষক থেকে শুরু করা যাক। বর্তমান আয়াক্স দলে প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হলেন আন্দ্রে অনানা। তার বয়স মাত্র ২২, বর্তমান ফুটবলের উঠতি তারকা গোলরক্ষকদের একজন। তিনি যে দিন দিন পরিণত একজন ফুটবলার হয়ে উঠছেন, রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচই তা প্রমাণ করে। তবে অনেকে জানেন না, অনানার সাথে বার্সেলোনার সূক্ষ্ম একটি সম্পর্ক আছে। ক্যারিয়ারের একদম প্রথম দিকে ছিলেন ‘লা মাসিয়া’তে। পরে ২০১৫ সালে আয়াক্স তাকে কিনে নেয়। তাই বার্সেলোনার প্রতি ভালোবাসা এখনও অক্ষুণ্ণ। তিনি নিজেই বলেছেন, বার্সেলোনা যদি তাকে চায়, অবশ্যই সে ডাকে তিনি সাড়া দেবেন। ওদিকে বার্সেলোনায় দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক ইয়াসপার সিলেসেনের বয়সও হয়ে গেছে। বাতাসে কানাঘুষা, আগামী মৌসুমে বার্সেলোনা ছাড়তে পারেন তিনি। আর বার্সেলোনার সাথে আয়াক্সের সম্পর্ক ক্রুইফের আমল থেকেই ভালো। তাই অনানাকে বার্সেলোনা কিনলেও কিনতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো বার্সেলোনাকে গুনতে হবে সর্বোচ্চ ৩০ মিলিয়ন ইউরো। অথচ আয়াক্স তাকে নিজেদের অ্যাকাডেমিতে এনেছিলো মাত্র ১৫০ হাজার ইউরোর বিনিময়ে।
বর্তমান ফুটবলের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান ডিফেন্ডারের নাম মাথিয়াস ডি লিট। গত মৌসুম থেকেই তাকে নিয়ে বিশ্বে তোলপাড় চলছে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে আয়াক্সের দলনেতার দায়িত্ব তার কাঁধে। তবে তাকে কেনার দৌড়ে বার্সেলোনা এগিয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। ডি লিটের প্রিয় বন্ধু ডি ইয়ং বার্সেলোনাতে পাড়ি জমানোর পর তা আরও বেড়েছে। তবে বার্সেলোনা আগ্রহী জেনেও তাকে কিনতে চায় নগর প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ। বর্তমানে শোনা যাচ্ছে, লিভারপুল ৭৫ মিলিয়ন ইউরো নিয়ে তৈরি তাকে কেনার জন্য। অনেকের ধারণা, ভ্যান ডাইকের পাশে খেলার এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না ডি লিট। তবে ডি লিটের আয়াক্স ছাড়া একরকম নিশ্চিত। পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত যে, তার জন্য বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ আয় করতে যাচ্ছে আয়াক্স।
আর্জেন্টাইন লেফটব্যাক নিকোলাস তালিয়াফিকোকে নেবার আগ্রহ দেখিয়েছে বেশ কিছু ক্লাব। সম্প্রতি সে তালিকায় যোগ হয়েছে আর্সেনাল। তবে লুকাস হার্নান্দেজ যদি বায়ার্ন মিউনিখে চলে যায়, সেক্ষেত্রে তার অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদে পাড়ি জমানোর সম্ভাবনা বেশি। তবে এটা নিশ্চিত, চলতি মৌসুম শেষে তালিয়াফিকো আয়াক্স ছাড়ছেন।
আয়াক্সের আরেক তরুণ মিডফিল্ডার ভন দি বিক সেভাবে শিরোনাম না হলেও রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি নজর কেড়েছেন। এজন্যই এভারটনের চোখে পড়ে গেছেন তিনি। এই এভারটন ২০১৭ সালে আয়াক্স থেকে ডেভি ক্লাসেনকে কিনেছিলো। আয়াক্স তাকে কেনার প্রস্তাব পেয়েছে সিরি আ থেকেও। এসি মিলানের মতো ক্লাব কিনতে প্রস্তুত দি বিককে। মরোক্কান উইঙ্গার হাকিম জিয়েচকে নেবার জন্য গত মৌসুমে চেষ্টা করেছিলো লেস্টার সিটি। তবে ট্রান্সফার ফি এর বনিবনা না হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত জিয়েচকে নিতে পারেনি লেস্টার সিটি। তবে লিভারপুল, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ও রোমার স্কাউটের সদস্যরা তাকে নজরে রাখছেন। জিয়েচও যেভাবে খেলে যাচ্ছেন, অন্য কোনো বড় দল নতুন করে তার প্রতি আগ্রহ দেখাতে পারে। তাই বলা যায়, তারও ক্লাব ছাড়ার সময় নিকটবর্তী।
ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের ইনজুরিতে ডেভিড নেরেস ব্রাজিল জাতীয় দলে ডাক পেয়ে গেছেন। মাদ্রিদের বিপক্ষে তার খেলার ধরণও মুগ্ধ করেছে সবাইকে। তাই আগামী বছর না হলেও কয়েক মৌসুমের ভেতর ইউরোপের বড় কোনো ক্লাব থেকে তার ডাক চলে আসবে। একই যুক্তি খাটে ক্যাসপার ডলবার্গের ক্ষেত্রেও।
ডাচ ফুটবল বিশ্লেষক জেমস রো আবার আয়াক্সের নীতি ও বর্তমান দলকে নিয়ে একটু অন্যভাবে তার যুক্তি সাজিয়েছেন। তিনি ব্লিচার রিপোর্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
‘আয়াক্স সব সময় তাদের খেলোয়াড়দের মূল দলে খেলে উন্নতি করার জন্য উৎসাহিত করে, যা তাদের এনে দেয় অল্প বয়সে একজন প্রতিষ্ঠিত ফুটবলারদের মতো ভাবার ক্ষমতা। এই পদ্ধতি তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের পথও সুগম করে। কিন্তু এটা সত্য যে, আয়াক্স তাদের খেলোয়াড়দের ধরে রাখতে পারে না। ক্রুইফকে তারা রাখতে পারেনি, পারেনি এডউইন ভ্যান ডার সার, ডি বোর ভ্রাতৃদ্বয়, সিডর্ফ, রাইকার্ড ও ওভারমার্সদের। কিন্তু সম্প্রতি ইতিহাসে তাদের খেলোয়াড়দের খুব সহজে ছেড়ে দিচ্ছে না তারা। এজন্য এ বছরের জানুয়ারিতে মোনাকো ও ডর্টমুন্ডের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। তারা তাদের চাহিদামতো সর্বোচ্চ অর্থের প্রস্তাব পেলেই তাদের খেলোয়াড় বিক্রি করতে রাজি হয়।’
কিন্তু জেমস রো একটু ঘুরিয়ে তার বক্তব্য জানালেও মূল কথা কিন্তু একই। আয়াক্সের বর্তমান দলটির অধিকাংশ তরুণেরা খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে যাবে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবে। ডি লিট, ডি ইয়ং, জিয়েচরা চলে যাবেন, তাদের স্থানে আসবেন নতুন মুখ। তাদের সঙ্গ দিতে প্রস্তুত থাকবে ব্লাইন্ড-তাদিচরা। ডি লিট বা ইয়ংরা যেমন বর্তমান আয়াক্সকে জায়গামতো স্থানে বসিয়ে বিদায় নিচ্ছেন, তারাও হয়তো একই কাজ করে আয়াক্সকে ছেড়ে যাবেন। স্বয়ং জেমস রো স্বীকার করেছেন, বর্তমান আয়াক্সের অ্যাকাডেমিতে ডি ইয়ং বা ডি লিটের মতো প্রতিভা আছে, যারা ভবিষ্যৎ আয়াক্সের হাল ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তাই আলো ছড়ানো তরুণদের হয়তো অভাব হবে না আয়াক্সের জন্য। একদিকে প্রতিভা তৈরির কারখানা, অন্যদিকে লাভ লোকসানের ব্যবসা। এভাবেই টিকে থাকে আয়াক্স, টিকে আছে বহুদিন। এটাই তাদের নীতি, এটাই তাদের দর্শন।