যদি বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল কোচের নাম কী? সাবেক শ্রীলঙ্কান কোচ চন্দিকা হাতুরুসিংহের চরম সাফল্যের পরও সবার আগে যার নাম আসবে, তিনি হলেন ডেভ হোয়াটমোর। কেন? কারণ চন্দিকা হাতুরুসিংহে খেলেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা দলটি নিয়ে, যা তার মিশন সফল করেছে সহজভাবে। কিন্তু হোয়াটমোরের কাছে সবকিছুই ছিল চ্যালেঞ্জিং। দলের ক্রিকেটারদের সাথে বোঝাপড়া, তাদেরকে নিয়ে যুদ্ধে নামা; সফল হওয়া। সবকিছু মিলিয়েই বাংলাদেশের আজকের অবস্থানের ভিত গড়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান হোয়াটমোর।
কোচের কথা থাক। যদি বলা হয়, সফলতম অধিনায়ক? নিঃসন্দেহে হাবিবুল বাশার সুমনের নামটি আসবে। সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মনে রাখার মতো অধিনায়ক ছিলেন তিনি। ‘মি: ফিফটি’ খ্যাত কুষ্টিয়ার এই ক্রিকেটার চোখের সামনে দেখেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থান-পতন। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলেছেন ১১১টি ওয়ানডে আর ৫০টি টেস্ট ম্যাচ। ব্যাট হাতে একদিনের ম্যাচে তুলেছেন ২,১৬৮ রান, সাথে ১৪টি হাফ সেঞ্চুরি। ৫০ ওয়ানডেতে ৩,০২৬ রান তুলতে গিয়ে তিনটি সেঞ্চুরি আর ২৪টি হাফ-সেঞ্চুরি তুলেছেন।
মাশরাফি বিন মুর্তজার পর হাবিবুল বাশার বাংলাদেশকে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ (৬৯) ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেখানে জয় এসেছে ২৯ ম্যাচে, হার ৪০ ম্যাচে। তবে হাবিবুল বাশারকে পরিসংখ্যান নয়, বরং সময় ও পরিস্থিতির কারণে সফলতম অধিনায়ক বলা হয়। বাংলাদেশ দলকে পরপর দুই বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেওয়া এই ক্রিকেটার (২০০৩ ও ২০০৭) নেতৃত্বগুণে বয়ে এনেছেন একাধিক সম্মান। তার অধীনেই ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারায়। সেবারের বিশ্বকাপ ২০১৫ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা বিশ্বকাপ বললে ভুল হবে না।
বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসেও হাবিবুল বাশারের নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। তার নেতৃত্বেই সাদা পোশাকে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ, প্রতিপক্ষ ছিল জিম্বাবুয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচক হিসেবে কর্মরত হাবিবুল বাশার এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছেন।
বাংলাদেশের আজকের অবস্থানে আসতে হোয়াটমোর-হাবিবুল বাশার জুটির অবদান অনস্বীকার্য। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বিশ্বকাপ নিয়ে তার চেয়ে পোড় খাওয়া লোক আর ক’জনই বা আছেন? তাই তো বিশ্বকাপে হাবিবুল বাশারের অভিজ্ঞতা মানেই বাড়তি কিছু! সম্প্রতি তার এক সাক্ষাৎকারে সেই প্রমাণ পাওয়া গেল আরও একবার!
২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আপনি। সেই বিশ্বকাপের কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের বলুন।
অধিনায়কত্ব সেই সময়ে আমার কাছে নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু বিশ্বকাপে নিজের দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া একেবারেই আলাদা জিনিস। আমি তো বলবো বিশ্বকাপে খেলতে পারাটাই বিশাল সম্মানের ব্যাপার। আর সেই বিশ্বকাপে পুরো একটা দলের অধিনায়ক হতে পারা আরও বড় সম্মানের। আমার ক্যারিয়ারে ২০০৭ বিশ্বকাপ ছিল সবচেয়ে বড় উপলক্ষ।
জাতীয় দলের নির্বাচক হওয়ার কারণে বছরের পর বছর তরুণ ক্রিকেটারদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে আপনার। সময়ের সাথে কীভাবে দল বদলে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
১৯৯২ সালে পাকিস্তান বিশ্বকাপ জিতল। এখনও মনে আছে, আমি আমার বন্ধুর বাড়িতে বসে আরও কিছু ক্রিকেটার বন্ধুদের সাথে ফাইনাল ম্যাচটি দেখেছিলাম। এমনকি তখনও আমরা ভাবতাম, বাংলাদেশ কোনোদিনও বিশ্বকাপের অংশ হতে পারবে না। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সুযোগ পাওয়া নিয়ে কখনো আলোচনাই করতাম না। তো, এগুলো নিয়ে না ভাবতে ভাবতেই আমরা ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ খেলতে যাই। যদিও তখন অংশগ্রহণটাই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া ছিল।
তারপর আমরা ২০০০ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিতে খেললাম, যেখানে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল ভারতের রাহুল দ্রাবিড়ের মতো ক্রিকেটার। তারপরই আমরা ভারতের সমান অবস্থানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকলাম (টেস্ট স্ট্যাটাস)। ক্রিকেটের বড় নাম হিসেবে পরিচিতি হতে চাইলাম। এখন বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ আজ সত্যিকার অর্থেই সেই স্থানে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ এখন অকুতোভয় হয়ে যেকোনো দলের বিপক্ষে লড়াই করবে। আমি খুবই খুশি যে, একটা সময়ে দলকে যে অবস্থানে দেখার স্বপ্ন দেখতাম, একজন নির্বাচক হিসেবে সেখানে দলকে পৌঁছে দিতে পেরেছি।
২০০৭ বিশ্বকাপের অর্জনগুলোর সাথে পাঁচ সিনিয়র ক্রিকেটার তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং সাকিব আল হাসানের সম্পৃক্ততা কীভাবে দেখেন?
সত্যি বলতে, মাশরাফি বিন মুর্তজা ২০০০ সালে খেলা শুরু করেছে। তখন থেকেই ও দলের অন্যতম সেরা বোলার। ২০০৭ বিশ্বকাপে সাকিব, তামিম, এবং মুশফিকরা ছিল দলের তরুণ মেধা। ওই সময়ে দলের জন্য এটাই প্রয়োজন ছিল। তবে যেটা হয়েছিল, তারা সেভাবে ওই সময়ে দলে নিয়মিত হতে পারেনি দু’টি কারণে। প্রথমত, ওরা তরুণ ছিল, পারফরম্যান্সেরও ঘাটতি ছিল। যদি কয়েকজন ক্রিকেটার লম্বা সময় ধরে একই সাথে একই দলে খেলতে থাকে, তাহলে সহজাতভাবেই তারা ভালো করে, ভালো খেলতে শুরু করে। আপনি যদি অস্ট্রেলিয়া দলের দিকে তাকান, তারা ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত প্রায় একই দল নিয়ে খেলেছে। খুব অল্প কিছু পরিবর্তন হয়তো ছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছে কেবল ওদের নিয়মিত পারফরম্যান্সের কারণে। তো আমাদের দলের এই পাঁচ ক্রিকেটার আসলে দীর্ঘদিন একসাথে খেলার কারণে ভালো করতে পেরেছে, বাংলদেশ দলে তাদের অনেক বড় প্রভাব রয়েছে। তাদের কারণেই বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন অবস্থানে।
আপনি বাংলাদেশের হয়ে ২০০৩ এবং ২০০৭; দু’টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। আপনার সেরা বিশ্বকাপ স্মৃতি কোনটা?
২০০৩ বিশ্বকাপ আমাদের জন্য খুব ভালো ছিল না। যখনই আমি ওই বিশ্বকাপের কথা মনে করি, আমি শুধুই খারাপ স্মৃতি খুঁজে পাই। তারপরও ২০০৭ বিশ্বকাপে অনেক অনেক ভালো স্মৃতি রয়েছে। শুরুটা হয়েছিল নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে অনুশীলন ম্যাচে জয় দিয়ে। এরপর তো ভারতের বিপক্ষে জয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডে জয়, সবকিছুই স্মৃতিকাতরতা। মনে আছে, সেই বিশ্বকাপে বেশিরভাগই ছিল বার্বাডোজে। সেখানকার উইকেট ছিল ‘ফাস্ট এন্ড বাউন্সি’ । এখন তো মনে হয়, আমাদের যদি অন্যান্য ভেন্যুতেও ম্যাচ পড়তো, আমরা আরো ভালো করতাম।
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী হতে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করছেন?
এবারের বিশ্বকাপে শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং প্রতিটি দল তাদের সেরা ক্রিকেট খেলার পণ নিয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছে। এই ফরম্যাটে প্রায় সবগুলো দলেরই সমান সুযোগ রয়েছে। এখন আপনি যদি সবগুলো দলের দিকে তাকান, তাহলে লক্ষ্য করবেন প্রতিটি দলের যোগ্যতায় বা সামর্থ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। এবারই হয়তো প্রথম অন্তত চার থেকে পাঁচটি দল ট্রফি জয়ের ক্ষমতা রাখছে। অন্যান্য দলগুলোও যে খুব পিছিয়ে আছে, সেটিও নয়। তারাও শক্তি আর সামর্থ্যে এগিয়ে আছে অনেকখানি। সেক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে যোগ্যতার পার্থক্য যখন কম থাকবে, প্রতিযোগিতার হারও বেড়ে যাবে অনেকগুণ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের সবাইকে একসাথে মিলে ভালো ক্রিকেট খেলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাঠে নিজেদের সেরাটা ঢেলে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই কেবল বাংলাদেশ ভালো করতে পারবে বলে আমি মনে করি।