আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনার পা নিয়ে রাজ্যের গবেষণা হয়েছে। এত ভালো ফুটবল কিভাবে খেলেন তিনি? ক্রিকেটে এই গবেষণাটা সবচেয়ে বেশিবার বোধ হয় মুত্তিয়া মুরালিধরনকে নিয়ে হয়েছে। শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি এই ডানহাতি স্পিনারের ক্যারিয়ার জুড়ে পরতে পরতে ছিলো রোমাঞ্চ আর আলোচনা। হাতের কব্জি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মোচড় দিতে পারতেন মুরালিধরন। তার বিরুদ্ধে চাকিংয়ের অভিযোগও উঠেছিলো! কিন্তু মুরালিধরন নিজেকে প্রমাণ করে বের হয়ে এসেছিলেন সব বিতর্ক থেকে। ১৯৯২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত লঙ্কান দলের হয়ে খেলতে গিয়ে নামের পাশে লিখেছেন গাদাখানেক রেকর্ড। কখনও নিজের রেকর্ডই নিজে ভেঙেছেন। ছাপিয়ে গেছেন আরও অনেক কিংবদন্তিকে।
জাতীয় দলের হয়ে ১৩৩ ম্যাচে নিয়েছেন ৮০০ উইকেট। ৩৫০ ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন, উইকেট নিয়েছেন ৫৩৪ উইকেট। টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ১২ ম্যাচে, উইকেট ১৩টি।
অবসরের পর কোচিংয়ে চলে আসেন মুরালিধরন। ৪৬ বছর বয়সী এই সাবেক ক্রিকেটার এই মুহূর্তে কাজ করছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বোলিং কোচ হিসেবে। অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গেও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা নিয়ে হতাশ এই কিংবদন্তি সব দায় দিচ্ছেন দেশের ক্রিকেট বোর্ডকে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট (এসএলসি), আইপিএল, নিজের কোচিং ভাবনা আর আইপিএলে বাংলাদেশি অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে কথা বলেছেন মুরালিধরন। সেই সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের আসলে কী সমস্যা হয়েছে?
সনাৎ জয়সুরিয়া, কুলারত্না, অরবিন্দ ডি সিলভা আর অর্জুনা রানাতুঙ্গা থেকে শুরু করে আজপর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে সমুদ্রের সমান পরিবর্তন এসেছে। খুব বেশি পিছনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ২০১৪ সালে আমরা ঢাকায় ভারতের বিপক্ষে জয় তুলে নিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শিরোপা জিতি। তার আগে ২০১১ সালে ভারতে ৫০ ওভারের ওয়ানডে বিশ্বকাপে ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমরা যেটা দেখছি এটা সাম্প্রতিক উন্নয়ন। সত্যি কথা বলতে, শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট এখন জগাখিচুড়ির মতো পাকিয়ে গেছে।
রাজনীতিবিদরা খেলাটির দায়িত্ব নিয়েছে। তারা খুব অল্প জ্ঞানে, বলা যায় কোনো জ্ঞানই নেই তাদের ক্রিকেটের ব্যাপারে, তাদের অধীনে ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিন একটু একটু করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেট হলো আত্মবিশ্বাসের খেলা। ক্রিকেটারদেরকে পারফর্ম করার আত্মবিশ্বাস দিতে হবে। তাদেরকে শ্রীলঙ্কার জার্সিতে গর্বিত বোধ করতে দিতে হবে। আমি একদিনে চ্যাম্পিয়ন বোলার হইনি। প্রায় ৪-৫ বছর ধরে অর্জুনা (রানাতুঙ্গা) আমাকে কেবল আত্মবিশ্বাসই দিয়ে গেছে। যে কারণে আমি আজকের অবস্থায় আসতে পেরেছি।
এখন অবস্থাটা এমন হয়েছে যে ব্যাটসম্যানকে মাঠে নামার আগেই বলে দেওয়া হচ্ছে, তোমাকে রান করতেই হবে, না পারলে বসিয়ে দেওয়া হবে। বোলারদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। গেল এক বছরে শ্রীলঙ্কার হয়ে তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটে মাঠে নেমেছে অন্তত ৬০ জন ক্রিকেটার! এটা এককথায় অযৌক্তিক। এর মাধ্যমেই টের পাওয়া যায় তাদের কোনো ভিশন নেই, তারা জানে না খেলাটাকে তারা কোথায় নিতে চায়। দলে এমন ঘন ঘন পরিবর্তন আনলে দলটাকে এককথায় ধংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু ক্রিকেটাররা কি প্রাপ্ত সুযোগের সুবিচার করতে পারছে বলে মনে করেন?
আচ্ছা। আপনি কেবলমাত্র কুশল মেন্ডিসের ব্যাপারটাই ধরুন না। আমরা সবাই ভেবেছিলাম সে অনেক মেধাবী ক্রিকেটার। তার মধ্যে সেই আগুন দেখতে পেয়েছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটকে সে অনেক দিন সার্ভিস দেবে। শুরুটাও সে করেছিল অসাধারণভাবে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে দলের বাইরে বের করে দেওয়া হলো! একটা খারাপ সিরিজ খেলল, বাদ পড়ে গেল। এমন ব্যাপারগুলো ক্রিকেটারদের মধ্যে খুব একটা অনুপ্রেরণা দিতে পারে না।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক। ইদানিং বিদেশ সফরে দেখা যায়, ভারতীয় দলে স্পিনার নির্বাচনে পরিবর্তন আসছে। রবিচন্দ্রন আশ্বিন কিংবা রবীন্দ্র জাদেজার মতো ডানহাতি স্পিনারদের রেখে জায়গা পাচ্ছে কুলদ্বীপ যাদবের মতো বাঁহাতি কিংবা যুবেন্দ্র চাহালের মতো লেগস্পিনার। আপনি কি এর পক্ষে?
যারা কব্জিতে বল ঘোরায়, সেই স্পিনাররা সবসময়ই অপরিচিত কন্ডিশনে বেশি সুবিধা পায়। আরও ভালো করে বললে ব্যাটিং কন্ডিশনে ভালো সুবিধা পায়। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এই অবস্থায় তারা বেশি উইকেট তুলে নেবে, এটাই ভাবা হয় সবসময়। আমি পরিষ্কারভাবেই এখন টের পাচ্ছি কেন ভারতীয় নির্বাচকরা এই কাজগুলো করে। আমি জানি না আশ্বিন কিংবা জাদেজাকে না নেওয়ার কারণ এটা কিনা। তাছাড়া কুলদ্বীপ ও চাহাল তাদের জায়গা থেকে ভালো করছে এবং নিজেদের প্রমাণও করেছে।
তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন এ যুগের সব সফল স্পিনারদের বলে রহস্য থাকতে হবে?
কথাটা যদিও সত্য, বিশেষ করে যখন আপনি একেবারে নতুন একজন বোলার হিসেবে আসছেন। আমি সবসময় অফস্পিনে জোর দিয়েছি। আগে অফস্পিন, তারপর বাকি জিনিস। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক দুসরার কথা। এই জিনিস অফস্পিনে অনেক প্রভাব ফেলতে পারে। অতীতে এটা হয়েছেও। আধুনিক যুগে স্পিনারদের এটা মাথায় রাখতে হবে।
এবার আসা যাক আইপিএলের প্রসঙ্গ নিয়ে। খুব ভালো শুরু করেছে আপনার দল…
এটা তো একটা ম্যারাথনের মতো। দৌড়টা কেবল শুরু হয়েছে। আমরা সত্যিই খুব ভালো ব্যালান্সড একটা দল তৈরি করেছি। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে কেন আমরা ঋদ্ধিমান সাহাকে নিয়েছি। এটা একেবারেই আমাদের কৌশলগত ভাবনা ছিল। শেষ বছরে আমরা স্পিন আক্রমণে খুব ভালো করতে পারিনি কেবল রশীদ খান ছাড়া। এ বছর আমরা করছি। বাঁহাতি স্পিনারের ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দতেই আমরা সাকিব আল হাসানকে টেনেছি। যখন আপনার দলে ভালো স্পিন বোলার থাকবে তখন আপনার ভালো উইকেটরক্ষক নিতেই হবে। এবার হয়তো সবাই বুঝতে পারবে কেন ঋদ্ধিমান সাহাকে নেওয়া। আমাদের পরিকল্পনা এখন কতটা আশানুরূপ ফল দেয়, সেটার নিয়েই অপেক্ষা করছি আমরা এখন।
দলে নিয়মিত অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার নেই। তাকে হয়তো মিস করছেন?
তার জায়গাটা পূরণ করা খুব কঠিন। সে যেকোনো দলের হয়েই খেলুক না কেন, এক্সেপশনাল একজন ক্রিকেটার। কিন্তু যেটা হয়েছে তা নিয়ে আমাদের খুব অল্পই বলার আছে। আমরা চেষ্টা করছি। এটা বলতেই হবে যে নতুন অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন দলকে খুব ভালোভাবেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওয়ার্নারের এই অনুপস্থিতিতে। কেন উইলিয়ামসেরও সেই অভিজ্ঞতা আছে, যে কারণে সে দলকে ভালোই এগিয়ে নিতে পারছে, ড্রেসিংরুমও সুন্দরভাবে সামলে নিতে পারছে।
এক নজরে মুত্তিয়া মুরালিধরনের কিছু রেকর্ড –
- সর্বোচ্চ টেস্ট উইকেটশিকারি (৮০০)
- ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি (৫৩৪)
- সবচেয়ে বেশিবার টেস্টের এক ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়া বোলার মুরালিধরন (৬৭ বার)
- এক টেস্টে ১০ উইকেট নিয়েছেন সর্বোচ্চ ২২ বার। শুধু তা-ই নয়, তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার যার সবগুলো টেস্টখেলুড়ে দেশের বিপক্ষে এক টেস্টে ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড রয়েছে।
- একমাত্র বোলার, যার প্রতিটি টেস্টখেলুড়ে দেশের বিপক্ষে অন্তত ৫০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড আছে।
- টেস্টে সবচেয়ে বেশিবার ম্যাচ অব দ্য সিরিজ পুরস্কার জিতেছেন (১১ বার)।
- ব্যাট হাতে খুব ভালো ছিলেন না। এত ‘সু’ রেকর্ডের মধ্যে বাজে রেকর্ডও আছে তার। ব্যাট হাতে তিন ফরম্যাটে মোট ৫৯ বার ডাক (শূন্য) মেরেছেন তিনি।
ফিচার ইমেজ- ESPN