এক, দুই, তিন, চার.. চতুর্থবারে গিয়ে আমিলা আপনসোর ক্যাচ তালুবন্দী করে দলের জয় নিশ্চিত করেন অতিরিক্ত ফিল্ডার নাজমুল হাসান শান্ত। ব্যাট হাতে শূন্য রানে আউট হওয়া সাকিব আল হাসান বল হাতেও প্রথম নয় ওভারে উইকেটশূন্য ছিলেন। শেষপর্যন্ত শ্রীলঙ্কা দলের শেষ উইকেট তুলে নেন তিনি। শ্রীলঙ্কা মাত্র ১২৪ রানে গুটিয়ে গেলে বাংলাদেশ এশিয়া কাপের মিশন জয় দিয়ে শুরু করেছে।
বাংলাদেশের দেওয়া ২৬২ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাশরাফির দ্বিতীয় বলেই ছয় হাঁকান উপুল থারাঙ্গা। সদ্য সমাপ্ত শ্রীলঙ্কা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগে ১০৩.৫০ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৭১.০৭ স্ট্রাইক রেইটে ৪১৪ রান করা থারাঙ্গা নিজের ইনিংস শুরু করেছিলেন টি-টোয়েন্টি মেজাজে। তিনি হয়তো ভুলেই গেছেন যে এটা ৫০ ওভারের ম্যাচ। এখানে শুরুর দিকে ভালো বলকে সমীহ করে খেলতে হয়। তাইতো তার ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে ২৭ রানে। দলীয় ২৮ রানের দলের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সাজঘরে ফেরার আগে ১৬ বলে চারটি চার এবং একটি ছয়ের মারে ২৭ রান করেছিলেন তিনি। এই নিয়ে থারাঙ্গা ওয়ানডেতে মাশরাফির বলে ষষ্ঠবার আউট হলেন।
শ্রীলঙ্কার কফিনে প্রথম পেরেক গাঁথেন মুস্তাফিজুর রহমান। নিজের প্রথম ওভারের শেষ বলে কুশাল মেন্ডিসের উইকেট তুলে নেন তিনি। আম্পায়ার প্রথমে নট আউট দিলে অধিনায়ক মাশরাফির সফল রিভিউতে কুশাল মেন্ডিসকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন মুস্তাফিজ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে প্রথম বলেই সাজঘরে ফেরেন তিনি।
এরপর ধনাঞ্জয়া ডি সিলভাও রানের খাতা খুলতে পারেননি। মাশরাফির বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরেন তিনি। নিজের প্রথম ওভারে ১৩ রান দেওয়া মাশরাফি তার প্রথম স্পেলে ছয় ওভার বল মাত্র ২৫ রানের বিনিময়ে দুই উইকেট শিকার করেছিলেন।
৩২ রানে তিন উইকেট হারানোর পর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। পেসারদের পর স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজও শ্রীলঙ্কাকে চাপে রাখেন। তিনি দুই পেরেরার উইকেট তুলে নেন মাত্র ২১ রান খরচায়। দলের তৃতীয় পেসার রুবেল হোসেন ম্যাথিউসের উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের জয় সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়। শুরু থেকে উইকেটে নড়বড়ে থাকা ম্যাথিউস ৩৪ বলে ১৬ রান করে যখন সাজঘরের পথ ধরেছিলেন, তখন শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ছিলো ছয় উইকেটে ৬৩ রান।
শেষদিকে সুরাঙ্গা লাকমালের ২০ রান এবং দিলরুয়ান পেরেরার ২৯ রানের উপর ভর করে দলীয় সংগ্রহ ১০০ পার করতে সক্ষম হয় শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের হয়ে মাশরাফি, মেহেদি এবং মুস্তাফিজ দুটি করে উইকেট শিকার করলে শ্রীলঙ্কা ৩৫.২ ওভারে ১২৪ রানে গুটিয়ে যায়। তামিম এবং মুশফিকের অমন সবটুকু উজাড় করে দেওয়া খেলার দিনে বাংলাদেশ জয় পাওয়ার ব্যাপারে উজ্জীবিত ছিলো। কিন্তু এত সহজে জয় আসবে যে সেটা অনেকেই কল্পনা করেনি। কারণ শুরুটা যে হয়েছিলো মালিঙ্গার বিধ্বংসী বোলিং দিয়ে।
টস ভাগ্য এবং দুই দলের ইনজুরি ভোগান্তি
দুবাইয়ের অসহনীয় গরমে বর্তমান বাংলাদেশ দলের কোনো ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা নেই। শেষ যখন বাংলাদেশ দুবাইতে খেলেছিলো, তখন জন্মই হয়নি বর্তমান দলের অনেক তরুণ ক্রিকেটারের। প্রায় ২৩বছর পর দুবাইতে খেলার সুযোগ পেয়ে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেন মাশরাফি বিন মর্তুজা।
দুবাইয়ের তাপমাত্রা এবং দ্বিতীয় ইনিংসে বোলারদের বাড়তি সুবিধার কথা মাথায় রেখে দুই অধিনায়কই প্রথমে ব্যাট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু টসে ভাগ্যে জয়ী হলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা, দুই দলেই ইনজুরির সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের তিন সিনিয়র ক্রিকেটার তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান এবং মুশফিকুর রহিম সম্পূর্ণ সুস্থ না থেকেও আজকের ম্যাচে মাঠে নামেন। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার দিনেশ চান্দিমাল এবং দানুশকা গুনাতিলাকা ইনজুরির কারণে এশিয়া কাপ থেকেই ছিটকে পড়েছেন এবং লিমিটেড ওভারের ক্রিকেটের তাদের প্রথম স্পিনার আকিলা ধনাঞ্জয়া সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ মিস করেছেন।
লাসিথ মালিঙ্গার রাজসিক প্রত্যাবর্তন এবং সাকিবের দুর্লভ ‘গোল্ডেন ডাক’
লাসিথ মালিঙ্গা নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিলেন গতবছরের সেপ্টেম্বরে। এরপর দল থেকে বাদ পড়ার পর আইপিএলেও পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অনেকেই ধরে নিয়েছিল লাসিথ মালিঙ্গার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ। কিন্তু এশিয়া কাপে হঠাৎ করেই ডাক পেলেন তিনি। এক বছরের বেশি সময় পর দলে ফিরে নিজের ৫ম বলে লিটন দাসকে খালি হাতেই সাজঘরে ফেরান মালিঙ্গা। এরপর একই ওভারের শেষ বলে তিনে ব্যাট করতে নামা সাকিব আল হাসানকে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে বোল্ড করেন তিনি।
নিজের ফিরতি ম্যাচের প্রথম স্পেলে চার ওভার বল করে মাত্র আট রান দিয়ে দুই উইকেট শিকার করেন মালিঙ্গা। মালিঙ্গার ধ্বংসাত্মক স্পেলের সাথে তামিমের ইনজুরি। ম্যাচের প্রথম আধঘণ্টাতেই কোণঠাসা বাংলাদেশ। ব্যাটিং বিপর্যয় সামাল দিয়ে তৃতীয় উইকেট জুটিতে মোহাম্মদ মিঠুন এবং মুশফিকুর রহিম ১৩১ রান যোগ করেছিলেন। তাদের জুটিও ভাঙ্গেন মালিঙ্গা। নিজের দ্বিতীয় স্পেলে এসে পরপর দুই ওভারে মিঠুন ও সৈকতের উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের রানের চাকা আবারও আটকে দেন তিনি। শেষপর্যন্ত নিজের ফিরতি ম্যাচে দশ ওভার বল করে ২৩ রানের বিনিময়ে চার উইকেট তুলে নিয়েছেন মালিঙ্গা।
বছরের শুরুতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ফিল্ডিং করতে গিয়ে বাঁহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে চোট পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। তা এখনও বয়ে বেড়ানো সাকিব আজকে ব্যাট প্রথম বলেই বোল্ড হন।
ওয়ানডেতে সাকিব শেষবারের মতো গোল্ডেন ডাক মেরেছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১৪ সালের ২৩শে নভেম্বর। একই সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে শেষবারের মতো ডাক মেরেছিলেন তিনি।
মিঠুন, মুশফিকের প্রতিরোধ
মুশফিকুর রহিম এবং দীর্ঘদিন পর দলে ফেরা মোহাম্মদ মিঠুন যখন জুটি বাঁধেন, তখন বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে রান ছিলো দুই ওভারে দুই উইকেটে দুই রান। মূলত তিন উইকেট! কারণ দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে পুল করতে গিয়ে আঙ্গুলে ব্যথা পেয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন তামিম ইকবাল।
তারা দুইজন শ্রীলঙ্কার পেসারদের দেখেশুনে খেলে স্পিনারদের উপর চড়াও হন। প্রথম দশ ওভারে ২৪ রান সংগ্রহ করা বাংলাদেশের ২০ ওভার শেষে রান সংখ্যা ছিলো দুই উইকেটে ১০২ রান।
দীর্ঘদিন পর জাতীয় দলে ফেরা মিঠুন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক তুলে নেন ৫২ বলে। ২০১৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর এখন পর্যন্ত মাত্র চারটি ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেয়েছেন মিঠুন। আজকে দলের বিপর্যয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করার পথে শ্রীলংকান ফিল্ডারদেরও সহায়তা পেয়েছিলেন তিনি। মিঠুনের ৬৮ বলে পাঁচটি চার এবং দুটি ছয়ের মারে সাজানো ৬৩ রানের ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে মালিঙ্গার বলে কুশাল পেরেরার হাতে ক্যাচ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। মিঠুন ফিরে গেলে মুশফিক ও মিঠুনের ১৩১ রানের জুটি ভাঙ্গে।
এই জুটি ভাঙ্গার পর রিয়াদ এবং সৈকত দ্রুতই ফিরেই যান। রিয়াদ চার বলে এক রান করে এবং সৈকত পাঁচ বলে এক রান করে সাজঘরে ফেরেন। যার ফলে দুই উইকেটে ১৩৪ রান থেকে ১৪২ রানে পাঁচ উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
মুশফিকুর রহিমের অতিমানবীয় ইনিংস
পাঁজরের ব্যথার কারণে মুশফিক আজকের ম্যাচে খেলবেন কি না, এ নিয়েই সন্দিহান ছিলো সবাই। অতঃপর তিনি শুধু খেললেনই না, দলকে খাদের কিনারা থেকে তুলে নিয়ে দারুণ এক জয় পেতে সাহায্য করলেন। প্রথমে মিঠুনের সাথে ১৩১ রান যোগ করে শুরুর ধাক্কা সামাল দিয়েছিলেন। এরপর মিঠুন সহ দুই স্বীকৃত ব্যাটসম্যান রিয়াদ এবং সৈকত সাজঘরে ফিরে গেলে লোয়ার অর্ডারদেরকে নিয়ে একাই লড়াই চালিয়ে যান মুশফিক।
তিনি মেহেদি হাসান মিরাজকে (১৫) নিয়ে ৩৩ রান। মাশরাফিকে (১১) নিয়ে ২০ রান যোগ করে নিজে শতকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে মেহেদি ও মাশরাফির বিদায়ের পর ইনজুরি অনেকক্ষণ ব্যাটিং করা মুশফিক ভুলেই গিয়েছিলেন রুবলকে পুরো ওভার খেলতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ৪৩তম ওভারের প্রথম বলে সিঙ্গলে নিয়ে তিনি রুবেলকে স্ট্রাইক দেন, তখন তিনি সেঞ্চুরির চেয়ে চার রান দূরে ছিলেন । ডি সিলভার করা ওভারটির বাকি পাঁচটি বল মোকাবেলা করতে হতো রুবেলকে। কিন্তু ওভারের চতুর্থ বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফেরেন। মুস্তাফিজ নেমেও প্রথম বলে আউট হতে হতে বেঁচে যান।
এর পরের ওভারের প্রথম বলেও মুশফিক এক রান নিয়ে মুস্তাফিজকে স্ট্রাইক দেন। ফিজ আস্থার প্রতিদান দিয়ে এক রান নিয়ে মুশফিককে স্ট্রাইক দেন এবং তিনি কিপারের বাঁপাশে চার হাঁকিয়ে কাঙ্ক্ষিত শতক তুলে নেন। এটি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ শতরানের ইনিংস ছিলো। ৪৬.৫ ওভারের সময় মুস্তাফিজ ১০ রান করে রান আউট হয়ে গেলে সবাই যখন ধরে নিয়েছে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ। তখনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাহাড় সমান সাহস বুকে নিয়ে একহাত দিয়েই ব্যাট করতে নেমে যান তামিম ইকবাল। নিজে এক বল মোকাবেলা করে মুশফিককে আরও ১৫ বল খেলার সুযোগ করে দেন তিনি। ঐ ১৫ বলে মুশফিক ৩২ রান সংগ্রহ করে দলকে ২৬১ রানের লড়াকু পুঁজি এনে দেন।
মুশফিকুর রহিমের ১৫০ বলে ১১টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ১৪৪ রানের অতিমানবীয় ইনিংসের কল্যাণেই শেষপর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সহজ জয় পায় বাংলাদেশ। মুশফিকের ইনিংসটি ওয়ানডেতে বাংলাদেশি কোনো ব্যাটসম্যানের দ্বিতীয় সর্বাধিক রান। পরবর্তী ম্যাচে মূল একাদশে মুশফিক থাকবেন কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। তবে ইনজুরি নিয়েও যে সাহসী ব্যাটিং করেছেন, তা অনেকদিন মনে গেঁথে থাকবে ক্রিকেট অনুরাগীদের। এই ম্যাচের আগে ম্যাথিউসের নেতৃতে শ্রীলঙ্কা ৪৯টি ওয়ানডেতে জয় পেয়েছিলো এবং ৪৯টি ম্যাচে পরাজিত হয়েছিলো। এই ম্যাচে বাংলাদেশ জয় তুলে নিয়ে ম্যাথিউসকে প্রথমে পরাজয়ের ফিফটি পূর্ণ করতে সহায়তা করেন।
ফিচার ইমেজ- Icc-Cricket.com