১৯৬৫ সাল থেকে শুরু করে প্রায় বছর বিশেক ব্রাজিল স্বৈরশাসনের কবলে ছিল। সেই স্বৈরশাসন যখন প্রথম শুরু হলো, ব্রাজিলের পারা নামক স্থানে রেইমান্ডো নামের একজন লোক তার অতি কষ্টে গড়ে তোলা বাসার লাইব্রেরিটি নিজেই পুড়িয়ে দিলেন। গ্রিক দার্শনিকদের একনিষ্ঠ ভক্ত ও পাঠক রেইমান্ডো জান্তার রোষানলে পড়ার ভয়ে মুক্তচিন্তার বই সমৃদ্ধ লাইব্রেরিটি জ্বালিয়েই দিলেন। তার দশ বছরের ছেলে তাকিয়ে দেখল তার বাবা কিভাবে সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি পুড়িয়ে দিচ্ছেন। রেইমান্ডো তার ছেলের নাম রেখেছিলেন সক্রেটিস, বিখ্যাত সেই দার্শনিকের সাথে মিলিয়ে। একসময় সেই ছেলেটিই হয়ে দাঁড়ালো সেই জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের এক মহীরুহ। এই লেখাটি তাকে নিয়েই।
সক্রেটিস মূলতএকজন মেডিকেলের ছাত্র। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা সাধারণত ১৪-১৫ বয়সে খেলা শুরু করে ১৮ বছরের মধ্যেই সিনিয়র টিমে এসে যায়। তিনি বোটাফোগোতে যোগ দেন ২১ বছর বয়সে, সমসাময়িকদের চেয়ে বেশ পরে। খেলার পাশাপাশি ডাক্তারি পড়াও ছাড়েননি। খুব দ্রুতই তাঁর খেলার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর ব্রাজিলে দুটো ধারা এসে যায়, একদল চিরাচরিত ল্যাটিন সুন্দর ফুটবল খেলে, জয় পরাজয় যা-ই হোক; অপর দল ইউরোপীয় ঘরানার খেলা খেলে। সক্রেটিস চিরাচরিত ব্রাজিলিয়ান সাম্বা ফুটবলের ভক্ত। পজিশন ছিল এটাকিং মিডফিল্ডার, তবে গোল করায় অসম্ভব দক্ষ। পুরো দলের খেলা একাই চালনা করতেন মিডফিল্ড থেকে। সিল্কি স্কিল, ফ্লুইড খেলা আর অসম্ভব সব পায়ের কারুকাজের জন্য খুব দ্রুতই ব্রাজিল ফুটবলের আইকন হয়ে যান তিনি। ঝাকড়া চুল আর স্টাইলিশ দাড়ি সহ লুকের জন্য তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন সেনসেশন। বোটাফোগোয় তাঁর দাপট চলতে থাকে, সেই সাথে ব্রাজিল জাতীয় দলেও। মিডফিল্ডার হয়েও ১০১ গোল করে ক্লাব ছাড়েন তিনি, যান আরেক ক্লাব করিন্থিয়ান্সে, যেখানে তাঁর আসল মহিমা প্রকাশ পায়। জিকো, ফ্যাল্কাওদের সেই যুগে, যে প্রজন্মকে ব্রাজিল ইতিহাসেরই সেরা প্রজন্ম বলা হয়, সেই প্রজন্মেরই মুখ হয়ে উঠেন ‘কুল সেনসেশন’ সক্রেটিস।
১৯৭৯ সালে সক্রেটিস আসেন করিন্থিয়ান্সে। ঐতিহাসিকভাবে করিন্থিয়ান্স শ্রমিক ঘরানার লোকদের ক্লাব। ডিরেক্টর মন্টেইরো সোশ্যালিস্ট, গণতন্ত্রকামী লোক। সক্রেটিস ক্লাব সতীর্থ বিখ্যাত প্লেয়ার পালিনহা, ক্যাসাগ্রান্দেদের সাথে একসাথে রব তোলেন ক্লাবেই যেন গণতন্ত্র চালু করা হয়। পুরো ব্রাজিলে তখন রাজনৈতিক কোনো নির্বাচন হয় না। ডিরেক্টর সম্মতি দিলেন। করিন্থিয়ান্স চালু করলো ভোটভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেবার সংস্কৃতি। ক্লাবের মোটামুটি গুরুত্ববহ যেকোনো সিদ্ধান্তেই ভোটাভুটি হত। এতে বোর্ড মেম্বার থেকে প্লেয়ার, ক্লাব ডাক্তার থেকে কর্মচারী সবার ভোট সমান গুরুত্ব পেত। এর নাম হয়ে গেল ‘করিন্থিয়ান্স ডেমোক্রেসি’। একটি ফুটবল ক্লাব বুক চেতিয়ে দাঁড়ালো এক জান্তার বিরুদ্ধে।
করিন্থিয়ান্স ক্লাবেই সক্রেটিস কাটান তাঁর জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ সময়। পাঁচ বছরের এই ক্লাব ক্যারিয়ারে মিডফিল্ডার হয়েও ১৭২ গোল করেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বোটাফোগোর সক্রেটিস করিন্থিয়ান্সে এসে সবদিকে পূর্ণতা পান। বিশ্বব্যাপী তাঁর খেলার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সুনামের পরিণামটা অতটা সুখকর ছিল না। ১৯৮২ সালে স্পেন বিশ্বকাপে ব্রাজিল যায় তাঁর ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল নিয়ে, বলা যায় ব্রাজিলের সবচেয়ে সেরা দলই ছিল এটা। এডার, ফ্যালকাও, জিকোদের নিয়ে দলটা ছিল এককথায় বেস্ট। সক্রেটিস সেই দলেই ক্যাপ্টেন। স্পেন বিশ্বকাপে ব্রাজিল দেখালো অনিন্দ্যসুন্দর ফুটবল প্রদর্শনী। এই দলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে। সক্রেটিসরা খেলত আনন্দের জন্যে, ঠিক জেতার উদ্দেশ্যে না। গোলগুলোর সব বিল্ডআপ প্লে ছিলো শৈল্পিক। সেই বিশ্বকাপে সক্রেটিসের করা গোলগুলো সব ছিলো লংশ্যুটে। ঝামেলা লাগলো ইতালির সাথে ম্যাচে এসে, নকআউট এই ম্যাচে শুরুতেই দু’গোল করে বসে ব্রাজিল, ইতালি সেই বিশ্বকাপে ফেভারিট কেউ না। পুরো বিশ্ব যখন ইতালির পরাজয়ের মাত্রা কষছে, তখন সদ্য কারামুক্ত স্ট্রাইকার পাওলো রসি দ্বিতীয়ার্ধে হ্যাটট্রিক করে বসেন। ২-২ থাকা অবস্থায়ও ব্রাজিল অলআউট অ্যাটাকে গেছে, অথচ হালের মরিনহো বা কন্তেরা ডিফেন্সিভ খেলে ঠিকই ২-০ লিডকে জয়ে রূপ দিয়ে দেয়। কিন্তু সেই ব্রাজিল যে শুধু জেতার জন্য খেলত না, খেলত আনন্দের জন্য। সেই আনন্দ আর ব্রাজিলবাসী পায়নি। ব্রাজিলের ইতিহাসে এই দলটা খেতাব পেয়ে যায় ‘The Best Brazil Team Not to Win World Cup’।
মারাকানার পর ব্রাজিল আরেকটি ট্র্যাজেডির শিকার হয় যার রেশ কাটেনি পরবর্তী ১২ বছরেও। তবে ইতিহাসের অন্যতম সেরাদের কাতারে ঠিকই ঠাই করে নেয় এই দলটি। আর সক্রেটিস? একটা দল তত সুন্দর যত সুন্দর তাঁর মিডফিল্ড। ব্রাজিল মিডফিল্ডের প্রাণভোমরা সক্রেটিসের খেলার কথা আর বিশেষ করে বলতে হয় না। স্প্যানিশ মিডিয়া তাকে আখ্যা দিয়েছিল ‘Not Athlete, Just Artist’ বলে।
এদিকে করিন্থিয়ান্সে তাঁর গণতন্ত্রের আন্দোলন চলছিলোই। ১৯৮২ সালে এক কাপ ফাইনালে তাঁরই জোরাজুরিতে দল যে জার্সিতে খেলতে নামে সেখানে ‘Democracia’ শব্দটি প্রিন্ট করা ছিল, পুরো ব্রাজিলে আলোড়ন বয়ে যায়। স্টাইলিশ দাড়ি আর লম্বা চুলের ‘কুল সেনসেশন’ হয়ে দাঁড়ায় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এক জাতীয় প্রতীক। মাঠে ব্রাজিলের সেরা মিডফিল্ডার আর মাঠের বাইরে জান্তাবিরোধী মুখ- এভাবেই কাটছিল সময়।
১৯৮৪ সালে ‘ডাইরেটাস জা’ নামে ব্রাজিলে একটি বিশাল গণ-আন্দোলন হয়, এর উদ্দেশ্য ছিল মুক্ত নির্বাচন আয়োজন। ঠিক সেই সময়টাতে ইতালিয়ান জায়ান্ট দল ফিওরেন্টিনা তাকে দলে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো। সেই গণ-আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ক্যাথেড্রাল স্কয়ারে প্রায় আড়াই মিলিয়ন মানুষের সামনে ‘করিন্থিয়ান্স ডেমোক্রেসি’র প্রতীক সক্রেটিস ভাষণ দেন। খুব কড়া ভাষায় জান্তা সরকারকে তুলাধুনা করে নিজের জীবনকে ঝুঁকিতেই ফেলে দেন। বক্তব্যের শেষে তিনি বলেন, এই আন্দোলন যদি সরকার মেনে নেন তবে ব্রাজিল ছেড়ে তিনি ইতালিতে খেলতে যাবেন না। পুরো ক্যাথেড্রাল স্কয়ার সোল্লাসে ফেটে পড়ে। বলে রাখা ভালো, তখন ব্রাজিলিয়ানরা সহজে ইউরোপে যেতে চাইতো না, ব্রাজিল লীগই দারুণ শক্তিশালী ছিল।
কিন্তু জান্তা সরকার আন্দোলনে সায় দিল না, সক্রেটিস করিন্থিয়ান্স ছেড়ে চলে গেলেন ফিওরেন্টিনায়। সক্রেটিস আসার পরে ফিওরেন্টিনার মাঠে দর্শক সংখ্যাই বেড়ে গেল। তবে ইতালিয়ান লীগ বরাবরই আল্ট্রা-ডিফেন্সিভ লীগ, ম্যান মার্ক আর টাফ ট্যাকেলের লীগে সৌন্দর্যের এত ছোয়া ছিল না। সক্রেটিস এত ভালো করতে পারলেন না। এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মাজ্জোলা না রিভেরো (সেই আমলে ইতালির দুই সেরা প্লেয়ার) কে তাঁর বেশী পছন্দের? তাঁর জবাব ছিল, “আমি তাদের খেলা দেখার সময় পাই না, নিজের খেলা বাদ দিয়ে বাকি সময়টা ইতালির শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে পড়াশোনা করি।”
১৯৮৬ সালে সেই আগের দলটা গেলেও প্লেয়ারদের বয়স হয়ে যাওয়াও সেই ধার আর ছিল না। গ্রুপ পর্বে এক খেলায় জায়গায় দাঁড়িয়ে সক্রেটিস একটি পেনাল্টি নিয়ে গোল করেছিলেন। মিডিয়ায় ব্যাপক প্রশংসা পায় এটা। নকআউট পর্বে ফ্রান্সের সাথে টাইব্রেকারে এমন করেই পেনাল্টি নিতে গিয়ে মিস করেন, বাদ পড়ে যায় ব্রাজিল। ইতিহাসে অন্যতম এক মিডফিল্ডার জাতীয় দল ক্যারিয়ার শেষ করলেন কোনো বিশ্বকাপ ছাড়াই। ওদিকে ফিওরেন্টিনাতেও এক বছরের বেশী টেকেননি ইতালিয়ান লীগের ডিফেন্সিভ স্টাইলের জন্য। দেশে ফিরে ফ্ল্যামেঙ্গো, সান্তোসে খেললেও আগের সেই সক্রেটিসকে আর পাওয়া যায়নি।
অবসরের পর কয়েকটি ক্লাবে কোচিং করান তিনি, তবে আহামরি সফল হননি। এরপর মেডিকেল প্র্যাকটিস করতে থাকেন, গরীবদের ফ্রিতে চিকিৎসা সেবা দিতেন। ফিফা তাকে বিশেষ দূত করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন, দুর্নীতির টাকায় বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধী ছিলেন তিনি। লিবিয়ার নেতা কর্নেল গাদ্দাফি নিজে তাকে বলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে। প্রচন্ড জনপ্রিয়তা নিয়েও তিনি দাঁড়াননি। তিনি কোনো দলের কন্ঠ হতে চাননি, হতে চেয়েছেন পুরো দেশের কন্ঠ, যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কলম সোচ্চার হয়েছে সবসময়।
ফুটবল বিশ্বে তিনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার, ব্রাজিলের গণতন্ত্রকামীদের কাছে তিনি আইকন, জীবিতাবস্থায় সমাজের কাছে ছিলেন বুদ্ধিজীবী। একজন ফুটবলার, যার আইডল কোনো ফুটবলার নন, বরং জন লেনন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো আর চে গুয়েভারা, এতেই বোঝা যায় তিনি ফুটবলারের চেয়েও বড় কিছু। তাঁর ইচ্ছা ছিলো তিনি মারা যাবেন প্রিয় ক্লাব করিন্থিয়ান্সের লীগ জয় দেখে দেখে। ২০১১ সালে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে অতিরিক্ত ধূমপানের কারণে তিনি যেদিন মারা যান, তার কয়েকদিন আগেই লীগ জয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলে করিন্থিয়ান্স। যে সন্ধ্যায় তিনি মারা যান, তার পরের দিনই লীগ ট্রফি হাতে নেয় তাঁর প্রিয় ক্লাব। এভাবেই দশ বছর বয়সে বাবার লাইব্রেরী পুড়তে দেখা ছেলেটি হয়ে দাঁড়ায় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মহীরুহ।