“আচ্ছা, ভুরুজোড়া দেখতে কেমন হবে? লেজ আর শ্বদন্ত? নাকি বাদ যাবে এগুলোর সবই? উমমম, নাক কি থাকবে? আর চোখ, চোখের ব্যাপারে কী হবে? নাক মনে হয় না প্রয়োজন আছে, বাদ দেয়া যেতে পারে। চোখটা গোল গোল হোক আর তার সাথে গুগোলিং, মানে চারদিক ঘুরে দেখতে পারে এমন, এরপর তাতে একটা একটা করে রঙ বসিয়ে দেখা যাক কোনটা বেশি ফোটে, কী বল? যেটা বেশি দর্শনীয় হবে আর সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে হবে পুরো মানানসই, সেটাই বেছে নেয়া হোক। ওহ হো, মুখের কথা তো একেবারেই খেয়ালে ছিল না। মুখ কীরকম হতে পারে? উপরের সারির দাঁত দিয়ে নিচের সারি আড়াল করা থাকবে, নাকি সবসময় হাসিখুশি এমন?”
এতক্ষণ এতটুকু পড়ে মনে হয় বোঝা যাচ্ছে যে, কোনো একটা কস্টিউমের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা চলছে এখানে। ঠিক তা-ই, কথা হচ্ছে ‘গ্রিটি’ নিয়ে। এ পর্যায়ে এসে একরকম নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এ লেখার ৯০ শতাংশেরও বেশি পাঠক ‘গ্রিটি’ নামটা শোনেননি; তবে আপনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বরফ হকির একজন নিয়মিত দর্শক হয়ে থাকেন, তবে আশা করা যায় এ নামটি আপনার জন্য অশ্রুতপূর্ব নয়। এ পর্যন্ত এসে লেখাটি বরফ হকি সংক্রান্ত মনে করে প্রস্থান করার দরকার নেই; এটি মোটেও তা নয়। এটি ইন্টারনেটভিত্তিক একটি ঝোঁকের গল্প, একটি উচ্ছ্বাসের গল্প, একটি বিপণীকরণের গল্প, সর্বোপরি একটি মস্তিষ্কস্ফুরণের গল্প।
গ্রিটি কী
গ্রিটি বলতে যাকে বা যেটিকে বোঝানো হচ্ছে, তা আর কিছুই নয়, একটি মাসকটের নাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হকি লিগের একটি দল ফিলাডেলফিয়া ফ্লায়ার্সের মাসকট এটি। যাদের মাসকট ব্যাপারটির সাথে পরিচয় নেই তাদের জন্য, মাসকট যেকোনো কিছুকে চোখে পড়ানোর জন্য, কোনো একটা উৎসব বা আয়োজনের উৎকর্ষ বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। যেমনটা আমরা বিশেষত ফুটবল বিশ্বকাপে দেখে থাকি। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ ফুটবল বিশ্বকাপের মাসকট ছিল ফুলেকো।
মাসকটের কাজ হলো উৎসব বা আয়োজনের রঙ বৃদ্ধি করা, বিভিন্ন মজাদার কাজকর্মের মাধ্যমে দর্শকদের আনন্দ দান করা, দর্শকদের মনোরঞ্জন করা।
এক নজরে গ্রিটি
- গায়ের রঙ: কমলা
- উচ্চতা: ৭ ফুট (২.১ মিটার)
- ওজন: ৯ পাউন্ড
- চো: বৃত্তাকার চোখের মণি, চারদিকে ঘুরতে পারে
- ট্রাউজার: হকি ট্রাউজার্স
- দেহসৌষ্ঠব: বিশালদেহী পেটমোটা
গ্রিটি কেন
ফিলাডেলফিয়ার এই বরফ হকির দলটি পেশাদার পর্যায়ে খেলা শুরু করে ১৯৬৭ সাল থেকে। তখন থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র ১৯৭৬ সালেই তাদের একটি মাসকট ছিল, নাম স্ল্যাপশট। এটাও টেকেনি এক বছরের বেশি। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হকি লিগের মাসকটবিহীন অল্প কিছু দলের একটি ছিল ফ্লায়ার্স।
২০১৬ সালে হকি লিগের তারকাসমৃদ্ধ একটি ম্যাচ দেখতে যান প্রধান কার্যপরিচালক শন টিলজার। এতে মাসকট হকির একটি অ্যানটিক খেলা দেখে তার ছেলে দারুণ আকৃষ্ট হয়ে বাবাকে প্রশ্ন করে বসে, ফ্লায়ার্সের কোনো মাসকট নেই কেন। উল্লেখ্য, কোনো মাসকট না থাকার দরুণ ফ্লায়ার্সসহ হকি লিগের আরও দুটো দলও সেই খেলাতে অংশ নিতে পারেনি। আবার ২০১৮ সালে রাগবি দল ফিলাডেলফিয়া ঈগলস সুপার বোল জেতার পর নিজেদের রাজ্যে ফিরতে গেলে বিমানবন্দরে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে নিজস্ব মাসকট ঈগলস সুপের পাশাপাশি আসে ফিলাডেলফিয়া ফিলিজ বেজবল দলের মাসকট ফিলাডেলফিয়া ফ্যানাটিক এবং ফিলাডেলফিয়া সেভেন্টি সিক্সার্স বাস্কেটবল দলের মাসকট সেভেন্টি সিক্সার্স ফ্র্যাংকলিন। এ থেকেই একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল যে, ফ্লায়ার্সের মাসকট না থাকার কারণে তারা অনেক প্রচারণামূলক সুযোগ হারাচ্ছে। তাছাড়া নিজেদের রাজ্যের জনসাধারণের নিকট আরও বেশি পৌঁছাতে গেলেও মাসকট একরকম অপরিহার্যই।
তাহলে নেমে পড়া যাক মাঠে
যেই ভাবা, সেই কাজ। অচিরেই কার্যপরিচালনা প্রধান টিলজার, বিপণন বিভাগের সহসভাপতি জো হেলার এবং বিপণন পরিচালক সারাহ শোয়াবের নেতৃত্বে একটা দল গঠন করা হল মাসকট বানানোর জন্য। সার্বিক অলঙ্করণে ১০০টিরও বেশি নকশা থেকে শেষ পর্যন্ত বেছে নেয়া হয় পেনসিলভ্যানিয়া ভিত্তিক নকশাকারী প্রতিষ্ঠান ফ্লাইল্যান্ড ডিজাইনসের ব্রায়ান অ্যালেনের নকশা।
তবে গ্রিটির চেহারা আর আকার থেকে শুরু করে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে তবেই চূড়ান্ত করা হয় নকশা। কারণ, মাসকটের দায়িত্বে থাকা দলটি ফ্লায়ার্সের উড়ন্ত ভাবধারার আশ্রয় নিতে আগ্রহী তো ছিলই না, সেই সাথে তারা চাচ্ছিল তাদের ডাকনাম “Broad Street Bullies” এর থেকে একেবারেই আলাদা কোনো স্বরূপ ফুটিয়ে তুলতে। আর এটি করতে গিয়েই জন্ম হয়েছে প্রথম দর্শনেই অদ্ভুতুড়ে মনে হওয়া কমলা রঙের এই ফারবলের।
গ্রিটির নকশার কাজ ছিল মাথা নষ্ট হওয়ার মতো। দলের সদস্যদের ভাষ্যমতে, “দেখা গেল, আমরা হয়ত অন্য কোনো আলাপে ব্যস্ত, কিন্তু ঠিকই কোন ফাঁকে যেন বিষয়বস্তু ঘুরে ফিরে সেই গ্রিটিতেই ফিরে যেত।” তবে এই সবকিছু সম্ভব করার ব্যাপারটা যে মোটেই সহজ ছিল না তা বোঝা যায় ১ম অনুচ্ছেদ পড়লেই। তাছাড়া, একটি কিছু নকশা করা যতটুকু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাকে বাস্তব রূপদান করা তদপেক্ষা কম জটিল নয়। গ্রিটির দানবাকৃতি ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটাও যে ছিল মুখ্য। কারণ, তাকে যে আর দশটা মাসকট থেকে খুব আলাদা হতে হবে। আর, গ্রিটির জাতটা যে অন্যদের থেকে একেবারেই পৃথক তা-ও কি সে বোঝায়নি? তা নইলে কী উন্মোচনের একদিনের মধ্যেই ইন্টারনেটে এরকম ঝড় তুলে ফেলতে পারে কেউ?
ইন্টারনেটের গ্রিটি, গ্রিটির ইন্টারনেট
গ্রিটির আবির্ভাব ঘটে গেল গত সেপ্টেম্বর মাসেই, সঠিকভাবে বললে সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ। ঐ একই দিনে গ্রিটি ইন্টারনেটেও তার উপস্থিতি জানান দেয়; কিন্তু দুই জায়গায় প্রতিক্রিয়া হয় দুই রকম। বাস্তবে, যখন তাকে প্লিজ টাচ মিউজিয়ামে প্রথম আনা হয় শিশু-কিশোর ভর্তি দর্শকদের সামনে, তখন প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে তারা তাকে বরণ করে নেয়। কিন্তু, রাতে যখন এই পশমদানব তার প্রথম টুইটার পোস্ট দেয়, প্রবল বিপরীতমুখী স্রোতের সম্মুখীন হয় সে। তবে এর পেছনে প্রধানত দায়ী ছবির রঙ নির্বাচনগত সিদ্ধান্তই। কমলার পেছনে কালো পটভূমিতে গ্রিটি তার চতুর্ঘূর্ণি চোখ নিয়ে হয়ে উঠেছিল ভয়ানক। পেছনে তাকিয়ে এই সিদ্ধান্তের জন্য হেলারের অনুশোচনাই হচ্ছিল। তবে তা কিন্তু আটকাতে পারেনি তার সাফল্যযাত্রা।
তাদের পাশের রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হকি দল পিটসবার্গ পেঙ্গুইনস যখন টিটকারি মেরে ছবিটার রি-টুইটে লিখলো, “হা হা হা। দেখলাম।”, গ্রিটি এটার জবাব দিতে মোটেও সময় নেয়নি। “আজ রাতে ঘুমানোর সময় একটা চোখ খোলা রেখো, পাখি”, এই ছিল গ্রিটির স্বভাবসুলভ হুমকি, যা বর্তমানে তার নিজস্ব ধরনে পরিণত হয়েছে। ৪,৬০০ বারেরও বেশি রি-টুইট হয়েছে এই পোস্টটি। এটি একটি ব্যাপার যে, ফিলিরা তাদের কাউকে নিয়ে নিজেদের মতো করে মতামত দিচ্ছে, কিন্তু বহিরাগত কেউ তাকে নিয়ে কটুক্তি করবে, তা কেন মেনে নেবে তারা? এরপর আর পেছনে তাকানো লাগেনি তাকে; গ্রিটি এরপর হয়ে গেল ফিলিদেরই একজন।
পরবর্তী ১২ ঘণ্টায় একের পর এক শিরোনাম হতে লাগলো প্রথম দর্শনে ভয়াল মনে হওয়া এই মাসকট। ইন্টারনেট যেন একটু একটু করে আক্রান্ত হতে থাকলো গ্রিটি ঝড়ে। তবে সারাহ শোয়াবের মতে, গ্রিটির পরিচিতি ব্যাপকতা পায় নামকরা মার্কিন মডেল কিম কারদাশিয়ানের অনুকরণে দেয়া টুইটে। এরপর যেন ইন্টারনেট ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে গ্রিটি। অথচ ফিলি ফ্যানাটিকের কিংবদন্তী মাসকটকুশলী ডেভ রেমন্ডের ভাষ্য অনুযায়ী, জো হেলার প্রস্তুতও ছিলেন দুই সপ্তাহ থেকে দুই মাসব্যাপী প্রবল বিমুখী প্রতিক্রিয়ার জন্যই। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে এত সমর্থনসূচক প্রতিক্রিয়া আর প্রশংসার তোড়ে গ্রিটি যেন প্রমাণ করে, তার নামকরণের মতো সে-ও দৃঢ়চরিত্রের নামান্তর। এই নামকরণের পেছনেও আবার আছে আরেকটা অণুগল্প।
নামকরণের জন্য দলের সভাপতি পল হোমগ্রেন একটি বৈঠক ডাকেন। সবাইকে আহ্বান করেন এমন একটি নামের জন্য, যা দলের সাথে মানিয়ে যাবে। সেখানেই এটা সেটা নামের ফাঁকে তিনি কিছুটা মজা করেই এ নামের প্রস্তাব দেন। কিন্তু, নামটা সবার মনে এতটাই গেঁথে যায় যে, আরও বেশ কতগুলো নাম প্রস্তাব করা হলেও কোনোটাই এর সমকক্ষ বা এর থেকে জোরালো মনে হচ্ছিলো না কারো কাছেই। তাই শেষতক এটিই গৃহীত হয়ে যায়।
গ্রিটির আরেকটি মজার টুইট দিয়ে এই লেখা শেষ করা যাক। সময়টা নভেম্বরের শেষভাগ, চলে এসেছে টাইম ম্যাগাজিনের ‘বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব’ ঘোষণা করার দিনক্ষণ। ফ্লায়ার্সের ডিজিটাল মিডিয়া সমন্বয়ক লরেন রবিন্স হুট করেই খেয়াল করেন, টাইম শব্দের I আর T অদলবদল করলেই হচ্ছে, “IT ME”, যা ছিল গ্রিটির একেবারে প্রথম টুইটই! টাইমের প্রচ্ছদের মতো করেই একটা জিফ ছবি সম্পাদনা করে টুইট করলেন, যা এখনতক ২১,০০০ বারের বেশি রি-টুইট হয়েছে এবং হচ্ছে।
গ্রিটি এখন হকির গন্ডি ছাড়িয়ে মার্কিন গৃহস্থালিতেও হয়ে উঠেছে পরিচিত এক নাম। এভাবেই বেড়ে চলছে গ্রিটি ঝড়ের মাত্রা। কিন্তু একটা প্রশ্ন রয়েই যায়, “গ্রিটির এমনতক চরিত্রের আড়ালে তার ধরনটা আসলে কী?”
শোয়াবের সংক্ষিপ্ত উত্তর, “সে তো গ্রিটিই।”