বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের (বিসিএল) পঞ্চম রাউন্ডের খেলা চলছে। টানা দ্বিতীয় দিন (১৯ ডিসেম্বর) বৃষ্টি, কুয়াশার কারণে অলস সময় কাটছে ক্রিকেটারদের। মুঠোফোনের ঐ প্রান্তে তুষার ইমরানকেও পাওয়া গেল সহজেই। বগুড়ায় তখন তিনিও সতীর্থদের সঙ্গে আড্ডায় বসে।
কুশল বিনিময়ের পর ৩৫তম জন্মদিনের অগ্রীম শুভেচ্ছা (অফিসিয়ালি ২০ ডিসেম্বর জন্মদিন) জানাতেই জবাবটা এলো এমন,
‘ধন্যবাদ। তবে এটা আসলে প্রকৃত জন্মদিন নয়। আসল জন্মদিন হয়ে গেছে, নভেম্বরের ২০ তারিখ ছিল আসল জন্মদিন।’
অফিসিয়াল তারিখটা প্রকৃত জন্মদিন না হলেও তুষার ইমরানের সঙ্গে এদিন কথা হয়েছে তার ক্যারিয়ার, সমকালীন প্রসঙ্গ, ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎসহ অনেক বিষয়ে।
বাংলাদেশের জার্সিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫ টেস্ট এবং ৪১ ওয়ানডে খেলেছেন তিনি। বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১১ হাজার রান করা যশোরের ছেলে তুষার খেলাটা চালিয়ে যেতে চান আরও কয়েক বছর। ৩১ সেঞ্চুরির মালিকের চাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটে পরিবর্তন হোক বয়সের সংস্কৃতি। যেখানে বয়স নয়, মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পাবেন ক্রিকেটাররা।
৩৫ বসন্ত পার হয়ে গেল। জীবনে কোনো আক্ষেপ আছে?
আক্ষেপ আছে। এত কিছুর পরও জাতীয় দলে ঢুকতে পারলাম না, এত ভালো খেলেও। আক্ষেপ একটাই। এই বয়সে এসেও পারলাম না। এটাই আক্ষেপ।
গত কয়েক বছরে ২-১ ম্যাচ পরপরই সেঞ্চুরি করেছেন প্রায়। কিন্তু সর্বশেষ ছয় ম্যাচে আপনার কোনো সেঞ্চুরি নেই। একটু কি মোটিভেশনের অভাব বলা যায়?
প্রভাব পড়েছে, ডাক না পাওয়ায় (হাসি)। একটু আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি। এত কিছু করে যখন হলো না। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সেঞ্চুরির বিকল্প তো নাই। ভালো খেলার বিকল্প নাই। চেষ্টা করছি, হচ্ছে না আরকি। একটা বড় রান পেয়ে গেলে হয়তো আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।
রান, ফর্ম মিলিয়ে আপনার ক্যারিয়ারের সেরা সময়। তারপরও জাতীয় দলে ডাক না পাওয়ার কষ্টটা নিজের ভেতর কতটা কাজ করে?
কাজ তো অনেক করে। কষ্ট তো থাকেই। উদাহরণ হয়ে যেতাম যদি হয়তো বা ডাকতো। এত বছর পর কেউ হয়তো ডাক পায়নি, দেশের বা বাইরের ক্রিকেট বলেন। চেষ্টাটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এখন হয়তো আমার আগ্রহটাও একটু কমে গেছে। এখন আর জাতীয় দল নয়, শুধু নিজের জন্য খেলবো। নিজের ক্যারিয়ারের জন্য। জাতীয় দলে হয়তো আর ডাকবেও না। এত কিছুর পরও যেহেতু ডাকেনি, তাহলে আর ডাকবেও না। তাই সেটা নিয়ে আর চিন্তা করি না।
আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। আব্দুর রাজ্জাক ডাক পাওয়ার পর নিশ্চয়ই একটু মনে আশা জেগেছিল আপনার।
অবশ্যই। কারণ যে প্রেক্ষাপটে ডাকার কথা ছিল, ধরেন যে সাকিব নাই, তামিম নাই। ওদের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে সিনিয়র ক্রিকেটার ডাকলে হয়তো আমার সুযোগটা বেশি থাকতো। ওই হিসেব বিবেচনা করে আমি চিন্তা-ভাবনায়, আলোচনায় ছিলাম। কিন্তু ডাকেনি।
প্রধান নির্বাচক বা নির্বাচকদের সাথে কখনো কি কথা হয়েছে এই সময়ে?
আমি এসব পছন্দ করি না। আমি কাউকে ফোন দেই না। তাদের সাথে কোনো কথা হয়নি এ বিষয়ে।
বছরের শুরুতে ‘এ’ দলের হয়ে আপনি ভালো করতে পারেননি বলে পরে আর বিবেচনা করা হয়নি।
নির্বাচকদের জিজ্ঞাসা করবেন, কয় ইনিংস খেলেছিলাম। এক ইনিংসে ২ নট আউট, আরেক ইনিংসে ২৫। খেলা ছিল তিনটা ম্যাচ, খেললাম দুইটা। একটাতে নিয়ে গিয়ে ড্রপ দিয়েছিলো। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ১০ হাজার রান করার পর এই ফরম্যাটে প্রথম ড্রপ হলাম। এটাও উদাহরণ হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে বয়সের সংস্কৃতিটা (বয়স হয়ে গেলে আর বিবেচনা করা হয় না। ফর্ম, ফিটনেস থাকলেও) পরিবর্তন হওয়াটা কতটা জরুরি মনে করেন?
এখন জাতীয় দলে যে পাঁচজন আছে, এরা চলে গেলে বাংলাদেশের ক্রিকেট বুঝতে পারবে। আপনারাও বুঝতে পারবেন। যে পাঁচজন আছে- তামিম, সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ আর মাশরাফি। তখন আসলে সবাই অনুভব করবে। তরুণরা হয়তো বা অতদূর না-ও যেতে পারে। হয়তো বা আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতে পারে অনেকে। এরা কিন্তু অনেকদিন ধরে খেলছে। এরা সিনিয়রও হয়ে গেছে। বয়স ত্রিশ পার হয়েছে। এরা এতদিন ধরে জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে, এটাও পজিটিভ দিক। সিনিয়র ক্রিকেটার খুব দরকার, বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে। আপনি ক্রিকেটারকে পরিমাপ করবেন পারফরম্যান্স দিয়ে, বয়স দিয়ে নয়। আপনি যদি ৩৫-এও পারফর্ম করেন, তাহলে আপনাকে কেন নেবে না? এটা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে জুনিয়রদের সুযোগ বেশি, পারফর্ম না করলেও নজরে থাকে।
শুধু আমি নই, অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার আছে রান করেও ডাক পায় না। আমি হয়তো একটু বেশি ভালো করেছি, দুই-তিন মৌসুমে অনেক রান করেছি। আমাকে নিয়ে আলোচনাটাও বেশি হয়েছে। কিন্তু কম-বেশি কিন্তু অনেক ক্রিকেটার আছে, যারা রান করছে। যেমন নাঈম ইসলাম, শাহরিয়ার নাফিস আছে; এরাও কিন্তু সিনিয়র ক্রিকেটার। এরাও অনেক রান করে। এদের নিয়ে হয়তো আলোচনা কম। আমার কাছে মনে হয় বয়সের এই বিষয়টা পরিবর্তন হওয়া উচিত, রান করলে অবশ্যই মূল্যায়ন করা উচিত।
আপনার শুরুর সময়ে ২০০১ সালে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ও বর্তমান সময়ের তুলনা করলে কতটা পরিবর্তন দেখতে পান? এখনও কথা ওঠে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মানসম্পন্ন ক্রিকেট হয় না।
আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যারা এই কথাটা বলে যে, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট মানসম্পন্ন না, তারা সবাই সিনিয়র ক্রিকেটার। তাদের অবসর ভেঙে এসে খেলতে বলেন, তাহলে অনেক রেকর্ড করতে পারবে। এসে দেখেন আমরা কোন উইকেটে, কীভাবে খেলি। এখানে অনেক টাফ ক্রিকেট হয়। হ্যাঁ, হয়তো বা বোলার নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। আন্তর্জাতিকে যদি আমরা ১৪০-১৪৫ কিমি গতিতে খেলি, এখানে হয়তোবা ওরকম পেস আক্রমণ থাকে না। তাছাড়া সুযোগ-সুবিধা, উইকেট, মাঠ সবকিছু অন্যরকম এখানে। ঐ সময় থেকে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেক সময় ফ্ল্যাট উইকেট হয়। আমাদের এখানে এত ফ্ল্যাট উইকেট হয় না। রান করলেই যে মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, এটা ঠিক না।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৩১ সেঞ্চুরি, ১১ হাজার রান। ব্যাটসম্যান হিসেবে আর কত দূরে যেতে চান?
আমি ধাপে ধাপে এগোতে চাই। এখন ১১ হাজার, এরপর ১২ হাজার আছে। প্রত্যেক মৌসুমে তো এক হাজার, ১১০০, ১২০০ রান করতে পারবো না। যখনই সুযোগ পাবো, কাজে লাগানোর চেষ্টা করবো। দেখি কত দূর যাওয়া যায়।
বয়সও ৩৫’র ঘরে চলে গিয়েছে। আর কত মৌসুম খেলার ইচ্ছা আছে?
আমি ইনশাল্লাহ আরও তিন বছর খেলবো, সর্বোচ্চ হলে। যদি ফিট থাকি, রান করতে থাকি। রান না করলে খেলার এনার্জি চলে যায়। ফিট আছি। রান করাও একটা ফিটনেসের ব্যাপার। রান না করলে আপনি যতই ফিট থাকেন, তাতে খেলায় অনীহা চলে আসে।
দেশের বাইরের কন্ডিশনে আমাদের ক্রিকেটাররা এখনও সংগ্রাম করে। আপনি পাঁচটা টেস্ট খেলেছেন। সবগুলো বিদেশে। ৪১ ওয়ানডের অল্প কয়েকটা দেশের মাটিতে। নিজেকে দুর্ভাগা মনে হয় কি না যে, দেশের মাটিতে কম খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন?
আমি ওরকম মনে করি না। আমি মনে করি যে, আমার যে সামর্থ্য ছিল, ওই অনুযায়ী আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দিতে পারিনি।
ঠিক ঐ সময়ে তাকালে নিজের ভেতর কীসের অভাব ছিল বলে মনে করেন?
ঐ সময় আসলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা বুঝতাম না। এজন্য ভালো করেছিলাম শুরুতে। যখন বোঝা শুরু করেছি, যখন চাপটা এসেছে নিজের ভেতরে যে, আমাকে ঐ লেভেলটা মেইনটেইন করতে হবে, তখন থেকেই খারাপ করা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু যখন শুরু করেছিলাম, তখন আসলে বুঝতাম না। কোনো চিন্তা ছিল না, চাপ ছিল না।
এখন শুধু নিজে ব্যাটিংয়ে রান করেন তা নয়। যতটা জানি আপনি তরুণদেরও সাহায্য করেন অনেক সময় ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে জানতে চাই…
নিজের অভিজ্ঞতাটা শেয়ার করি, আর কিছু না। কীভাবে চারদিনের ম্যাচ খেলতে হয়। নিজে খেলে খেলে শিখেছি তো, ঐটাই শেয়ার করি। ওদেরকে যতটা পারি সাহায্য করার চেষ্টা করি।
ভবিষ্যতে কোচিংয়ে আসার ইচ্ছা আছে নাকি?
ইচ্ছা আছে। লেভেল-১ অনেক আগে করা আছে আমার, লেভেল-২ করবো। তারপর দেখি। আগে খেলাটা শেষ করি, তারপর এসব চিন্তা।
এখনকার তরুণদের মধ্যে কাদের মাঝে টেস্ট মেজাজের ব্যাটসম্যানশিপ দেখেন? সম্ভাবনাময়, দেশকে সার্ভিস দিতে পারবে এমন?
এভাবে নাম ধরে বলা আসলে কঠিন। অনেক খেলোয়াড় আছে ভালো। কম বয়সে অনেকগুলো প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে ফেলেছে। সেক্ষেত্রে অনেকেই আছে। হাতে গুণে, নির্দিষ্ট করে কয়েকজনের নাম বলা কঠিন। আমার মনে হয়, ওরা যত খেলবে, ততই শিখতে পারবে।