ক্লাস অফ নাইনটি টু
শিরোনামটা শুনে কি সিনেমার কোন বলে টাইটেল মনে হচ্ছে? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। তবে এই চলচ্চিত্রের নায়ক কারা সেটা শুনবেন না? তারা হলেন ডেভিড বেকহ্যাম, নিকি বাট, রায়ান গিগস, পল স্কোলস, ফিন নেভিল ও গ্রে নেভিল। উপরে যে শিরোনামটা দেখতে পাচ্ছেন, তার নিচে আরেকটা কথাও লেখা ছিল, “Players who inspired a generation”।
মূলত ২০১৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই ছয় কিংবদন্তির ‘৯০ এর দশকে খেলা ও অর্জন নিয়েই এই ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছিল। এই ছয়জন বাদেও মালদিনি-জিদানের মতো তারকার উপস্থিতিও ছিল ঐ ডকুমেন্টারিতে।
আজকে এই লেখার বিষয়বস্তু স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সেই বিখ্যাত খেলোয়াড়দের নিয়েই, যারা অজেয়কে জয় করেছিল, অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল, ফুটবল বিশ্বকে দেখিয়েছিল যে এই ফুটবলে অসম্ভব বলে কিছু নেই।
বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানা নেই, তবে উপরোক্ত এই ছ’জনের মধ্যে গিগস বাদে বাকি পাঁচজনই তখন সদ্য যুবদল থেকে মূল একাদশে স্থান পাওয়া টগবগে যুবক। আর তাদের নিয়েই স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন তৈরি করেছিলেন এক অনন্য একাদশ। তাদের হাত ধরেই ইউনাইটেড অর্জন করে একে একে সম্ভাব্য সকল প্রাপ্তি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৯৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়, আর সেই সাথে ফুটবলের অন্যতম কঠিন অর্জন ‘ট্রেবল’ জয় করা।
গেরি নেভিল এক সাক্ষাতকার বলেছিলেন,
আপনি সবসময়ই চাইবেন যে এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি হোক। কিন্তু এমন সময় কি আসলেই ফিরে পাওয়া যাবে যখন একসাথে ১২-১৩ বছর বয়স থেকে বেড়ে ওঠা কিছু তরুণ এসে ট্রেবল জিতে নেবে? আমি তেমন একটা নিশ্চিত না। আমার মনে হয় না এমনটা আবারও ঘটে পারে।
সত্যিই তো। আপনি কীভাবে এরকম আরেকদল টগবগে তরুণকে ধরে আনবেন, যারা ১২-১৩ বছর বয়স থেকে ফুটবলের ভক্ত, আর হৃদস্পন্দন শুধু ইউনাইটেডের জন্যই বাজে তাদের। স্যার অ্যালেক্স তাদেরই কাজে লাগিয়েছিলেন; সদ্ব্যবহার করেছিলেন তাদের তারুণ্য, মেধা, ক্ষিপ্রতা, দলের প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা আর আবেগের। এটা নিছক একটা নব্বই মিনিটের ম্যাচ ছিল না, ছিল একজন মানুষের দর্শন, ছিল একটি সাজানো মাস্টার প্ল্যান। এ যেন ছিল শতরঞ্জের এক সাদা-কালো কোর্ট, আর সেখানে উজির, নাজির, রাজা, ঘোড়া ছিলেন বেকহ্যাম, নেভিল, গিগস, স্কোলসরা।
১৯৬৬-৬৭ মৌসুমের পর প্রিমিয়ার লিগে ট্রফির মুখ দেখতে না পাওয়া সেই দলটা এই তরুণদের হাত ধরে এত বছরের ট্রফি খরা ভুলিয়ে এনে দেবে একের পর এক শিরোপা। ১৯৯২-৯৯ এর মধ্যবর্তী সময়ে ইউনাইটেড অর্জন করে ৫টি প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, ৩টি এফএ কাপ, ১টি লিগ কাপ, ৪টি কমিউনিটি শিল্ড, ১টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ১টি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ। এসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১৯৯৯ সালের ট্রেবল জয়, যেটা এসেছিল বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার মাধ্যমে।
আলোচিত এই ব্যাপ্তিকালে ইউনাইটেডের আরেক নক্ষত্র ছিলেন দ্য বেবি ফেইসড অ্যাসাসিন অর্থাৎ ইউনাইটেডের বর্তমান কোচ ওলে গানার সলশেয়ার। নরওয়ের এই কিংবদন্তি ইউনাইটেডের হয়ে ১৯৯৬-২০০৭ পর্যন্ত খেলেছিলেন মোট ৩৬৬ ম্যাচ, গোল করেছিলেন ১২৬টি। উল্লেখ্য, তিনি ফুটবলে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার আগে এক বছর যুক্ত ছিলেন নরওয়ের সেনাবাহিনীতে। তার হাত ধরেই ‘৯৯ এর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে এসেছিল সেই জয়সূচক গোলটি।
ক্লাস অফ নাইনটি টু শুধু একটি ফুটবল ক্লাবের সাফল্যের শীর্ষে ওঠার গল্প ছিল না, গল্পটি আজও আছে। আছে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে সেই ভালোবাসা। তারা আয়োজন করে বিভিন্ন চ্যারিটি ম্যাচ, একসাথে বুট পরে নেমে যান মাঠে, আড্ডা দিতে হাজির হন থিয়েটার অফ ড্রিম খ্যাত ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে, কিংবা কোনো রেস্তোরাঁ বা বারে।
আপনি বিবিসি, এমএসএন নিয়ে অনেক গল্প করেন, অনেক আড্ডায় সরব হয়ে যান তাদের কীর্তি নিয়ে আলোচনায়। তবে ‘৯০ এর দশকে ফুটবল ছিল অনেক ভিন্ন, অনেক প্রতিকূলতায় পরিপূর্ণ। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন সেই কঠিন সময়ে খুঁজে বের করেন এই ছয় হীরার টুকরা, যারা একেকজন বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একে অপরের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। ডেভিড বেকহ্যাম, যিনি কি না একজন গ্লোবাল আইকন, ফুটবলে স্টাইল যার হাত ধরে আসে। ছিলেন গিগস, যাকে বলা হতো দলের ‘আয়রন ম্যান’; গ্রে নেভিল ছিলেন ‘দ্য ওয়ার্ক ফোর্স অফ দ্য টিম’; তার ভাই ফিন নেভিল, যার ডাক নাম ছিল ‘দ্য মাস্টার অফ দ্য স্টেপ ওভার ড্রিবল’; বাটকে বলা হতো ‘দ্য টাফ কিড অফ দ্য ডজি পার্ট অফ দ্য টাউন’; সর্বশেষ পল স্কলস, ‘দ্য ম্যান উইথ নো ইন্টারেস্ট অফ বিং এ সেলিব্রিটি’।
এই ছয় অতি সাধারণ পরিবারের অসাধারণ তরুণকে দিয়েই স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন গড়ে তুলেছিলেন দ্য এক্সপেন্ডেবলস অফ ইউনাইটেড।
এরিক ক্যান্টোনা বলেছিলেন, “আমরা একসাথে অসাধারণ কিছু ছেলেকে পেয়েছিলাম যারা অর্থোপার্জনের পাশাপাশি ভালবেসেছিল এই খেলাটাকে।” এর সাথে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন যোগ করেছিলেন, “আর তারা এটা করেছিল একটি দলের অংশ হয়ে। এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা একসাথে এটা করেছিল।”
হ্যাঁ, এটাই ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা একসাথে খেলেছে, এক হয়ে খেলেছে, একটি দল হিসেবে খেলেছে। আর সব কিছুর চেয়ে তারা ভালোবেসেছে খেলাটিকে। আজ আপনি অনেক তারকাখচিত দল পাবেন, অনেক ক্লাবে অনেক একক তারকা পাবেন, তবে যা এই ছ’জন ‘৯০ এর দশকে করে গিয়েছিল, সেটা আপনি আজ কোথাও খুঁজে পাবেন না।
যদি জানতে চাওয়া হয়, কেন ইউনাইটেড সেরা? কেন স্যার অ্যালেক্সকে কেউ ভুলতে পারছে না আজও? কারণটা এখানেই, ‘দ্য ফার্গি ফিলোসফি’; ‘দ্য ফার্গি টাইম’; ‘দ্য ফার্গি ট্যাকটিক্স’!
দিন বদলাবে, নতুন কৌশল আসবে, খেলায় প্রতিযোগিতা বাড়বে, নতুন প্রযুক্তি আসবে; তবে ক্ল্যাসিকগুলো ক্ল্যাসিক হয়েই আপনার হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যাবে। যতবার শুনবেন “Glory Glory Manchester United…”, আপনার স্মৃতিতে ক্লাস অফ নাইনটি টু একবার হলেও ঢুঁ মেরে যাবে।