আর্বিভাবেই বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) বাজিমাত করেছিলো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। ২০১৫ সালে নিজেদের প্রথম আসরে মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে একটি মাঝারি মানের দল নিয়েও শিরোপা জিতেছিলো। কুমিল্লার আগে বিপিএলে অভিষেকেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ডটা শুধু বিলুপ্ত হওয়া ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সেরই ছিল।
সম্প্রতি শেষ হওয়া বিপিএলের ষষ্ঠ আসরে শেষ হাসি হেসেছিলো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। ফাইনালে তামিম ইকবালের বিস্ফোরক সেঞ্চুরিতে ঢাকা ডায়নামাইটসকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার ট্রফি জিতে দলটি। ফাইনালে নিজেদের শতভাগ জয়ের রেকর্ড অক্ষুন্ন রাখলো কুমিল্লা। প্রথমবার ফাইনাল খেলেই শিরোপার স্বাদ পেলেন তামিম।
দলটার মতো কুমিল্লার কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনেরও এটি দ্বিতীয় ট্রফি। দুইবারই তার অধীনে কুমিল্লা ফাইনাল খেলেছে, জিতেছে দুইবারই। বিপিএলের সবচেয়ে সফল কোচের নাম হিসেবে সালাউদ্দিনের কথা বললে, একটুও অত্যুক্তি হবে না। কোচদের তালিকায় দুইবার করে বিপিএল ট্রফি জিতেছেন ইয়ান পন্ট ও সালাউদ্দিন। ইয়ান পন্ট ছিলেন ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের কোচ।
তবে কুমিল্লার এবার শিরোপা জয়ের অনেক ঘটনা, চড়াই-উৎরাইয়ের বিষয়। বাহ্যিক প্রকাশ সেভাবে না থাকলেও দলটির অন্দরমহলে বেশ ঝড় বয়ে ছিল বিপিএলে। এই দিক থেকে দলটা আবার বাহবা পেতেই পারে। সব ধরনের চাপ-বিতর্ক ধারণ করেই টুর্নামেন্টে এগিয়েছে দলটি, যার শেষটা হয়েছে ট্রফি জয়ের অতুলনীয় রোমাঞ্চ দিয়ে।
বিপিএলে কুমিল্লা শিবিরকে সবচেয়ে বেশি কাঁপিয়েছে ‘ক্যাপ্টেন্সি’ বিতর্ক। একটা সময় ডুবতে বসেছিলো দলের বিপিএল মিশন। কোচ সালাউদ্দিনের ভাষায়, পরিবেশটা অনেক ভারি হওয়ার আগেই এগিয়ে এসেছেন একজন তামিম, উড়িয়ে দিয়েছেন সবকিছু, করেছেন অনেক বড় ত্যাগ। ট্রফি জেতার নেশায় ছুটেছেন রূদ্ধশ্বাসে। সেটাই ছিল কুমিল্লার শিরোপা জেতার মূল রসদ।
বিপিএল শেষে সম্প্রতি কুমিল্লার ক্যাপ্টেন্সি বিতর্ক নিয়ে কথা বলেছেন সালাউদ্দিন। পঞ্চম আসরে দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তামিম। কোয়ালিফায়ার থেকে বাদ পড়েছিলো কুমিল্লা। ষষ্ঠ আসরের আগেও সালাউদ্দিন-তামিমের যুগলবন্দি সাজিয়েছে কুমিল্লার দলটি। শহীদ আফ্রিদি, শোয়েব মালিক, থিসারা পেরেরা, এভিন লুইসদের নিয়ে দলটাও ছিল দুর্দান্ত। স্থানীয়দের মাঝে তামিম, বিজয়, ইমরুল, আবু হায়দার রনি, মেহেদী হাসান, শামসুর রহমান শুভরা ছিলেন।
প্লেয়ার্স ড্রাফটের পর কুমিল্লা দলে স্টিভ স্মিথের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বলা বাহুল্য, যা দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলো। সেখানেও ছিল নাটক। স্মিথকে খেলতে একবার অনুমতি দিয়ে কিছুদিন পরই তা আবার তুলে নিয়েছিল বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল। মজার বিষয়, এক সপ্তাহ পরই বদলে যায় দৃশ্যপট। কুমিল্লার হয়ে অস্ট্রেলিয়ান এই সাবেক অধিনায়কের খেলা নিশ্চিত হয়ে যায়।
তারপরই আসলে বিতর্কের যাত্রা শুরু। কুমিল্লার অধিনায়ক হিসেবে তামিমের নামটাই সবার জানা ছিল। কিন্তু হুট করেই বিপিএল মাঠে গড়ানোর আগে নেতৃত্বে তামিমকে নিয়ে আলোচনায় ভিন্ন সুর চলে আসে। অনুশীলনে অধিনায়ক প্রসঙ্গই এড়িয়ে যায় দলটি। ততক্ষণে বাতাসের গুঞ্জন পোক্ত হয়ে যায়, স্মিথই হচ্ছেন কুমিল্লার অধিনায়ক।
ব্যতিক্রম হয়নি বিপিএলের প্রথম ম্যাচে। স্মিথই ছিলেন দলটির অধিনায়ক। দুর্ভাগ্যক্রমে দুই ম্যাচ খেলেই চোটাক্রান্ত স্মিথ ফিরে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। এবার আর তামিম নেতৃত্বের ভার নেননি। বাধ্য হয়ে ইমরুল কায়েসের কাঁধে সেই ভার তুলে দিয়েছিলো কুমিল্লা। টুর্নামেন্টের শেষ পর্যন্ত ইমরুল দায়িত্ব পালন করেছেন, কুমিল্লাও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বিপিএলে।
কুমিল্লার কোচ সালাউদ্দিন বিপিএল শেষে ক্যাপ্টেন্সি বিতর্ক নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন। কীভাবে ঘটনার সূত্রপাত তা জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, স্মিথের অধিনায়ক হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অন্ধকারে ছিলেন সালাউদ্দিন ও তামিম। সালাউদ্দিন বলেছেন,
‘অনেকগুলো কথা আছে, যেগুলো আমরা প্রকাশ্যে বলি নাই। একটা দলের মোরাল ডাউন জন্য আমাদের অনেকগুলো ঘটনাই ঘটছিল। যেগুলো আসলে আমরা প্রকাশ্যে কখনোও বলি নাই। বিশেষ করে পুরো দলটা গঠন করার পেছনে হয়তো বা তামিম আর আমি অনেক বেশি জড়িত ছিলাম। প্রথম থেকেই, ৬-৭ মাস ধরেই দলটা করার পেছনে, কোন খেলোয়াড় খেলবে না খেলবে সবকিছুই। স্মিথকে যখন আমরা দলে নেই, তামিমের মাধ্যমেই কিন্তু আমরা স্মিথকে অন্তর্ভুক্ত করি। এবং তামিমের কারণেই স্মিথের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটা অনেক ভালো হয়েছিলো। আমরা সবাই জানি যে, তামিমই অধিনায়ক আমাদের দলে। এবং এটা আমিও জানি।
কিন্তু হঠাৎ স্মিথকে যখন নেয়া হয়েছে, তখন তামিম এজেন্টের মাধ্যমে জানতে পারছে যে, স্মিথকে অধিনায়ক করা হয়েছে। এটা তামিমের কাছে অনেক খারাপ লাগছে। এটা যে কেউ, আমি হলেও খারাপ লাগতো। যেকোনো খেলোয়াড়ের কাছেই খারাপ লাগতো। স্মিথও জানে যে, তামিম অধিনায়ক। স্মিথও তামিমকে জিজ্ঞাসা করছে যে, ‘আমাকে অধিনায়কের অফার দিছে। এখন এটা তুমি যদি বলো তাহলে ওকে।’ বেসিক্যালি তামিম কিন্তু অধিনায়কত্ব নিয়ে অমন হা-হুতাশ করে না। ও কিন্তু লিগের আগেও আমাকে অনেকবার বলছে, স্যার আমারে অধিনায়কত্ব দিয়েন না। যদি স্মিথ আসে, স্মিথকে অধিনায়কত্ব দিয়েন।’
স্মিথকে অধিনায়ক করার বিষয়টি সরাসরি তামিমকে বলা উচিত ছিল বলেও মনে করেন সালাউদ্দিন, যেটি আসলে দলের পক্ষ থেকে করা হয়নি। সালাউদ্দিন বলেন,
‘কিন্তু জিনিসটা আমার মনে হয় একটু ভালোভাবে হলে, মানে এটা তামিমকে সরাসরি বসে আমরা বলতে পারতাম, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা আরও ভালো হতো। প্রথম দিকে তামিমের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ার পেছনে আমার মনে হয় যে এটাও একটা বড় কারণ। আমার কাছে মনে হয়, তাকে এটা একটা, কি বলবো… সে হয়তো এটা খারাপভাবেই নিতে পারতো। তারপরও পুরো টুর্নামেন্টে সে দলের প্রতি যেমন নিবেদিত ছিল, আমি বলবো তামিমের এটা অনেক বড় স্যাক্রিফাইস, এবং সে তার ইগোটা ফেলেই করেছে। কারণ এটা আমি হলে, বা যেকোনো মানুষ হলেও এটা তার বড় ইগোতে লাগতো। কিন্তু সে এটা পুরোটা কাটিয়ে উঠছে দলের স্বার্থে। তারপর মাঠের ভেতর আপনারা সবাই দেখছেন, তামিমের দলের প্রতি কতটা দরদ ছিল, বা মাঠে ভেতর কিন্তু অনেক সিদ্ধান্ত ইমরুলের সাথে মিলে করেছে। এ কারণে আমি বলবো যে, তামিমের এটা অনেক বড় স্যাক্রিফাইস। এবং এ জিনিসটা আরও ভালো হলে মনে হয় যে, এটা ভালো হতো।’
তাই তো পরে আর অধিনায়কের দায়িত্বটাই নেননি তামিম, ইমরুলকে দেয়া হয়েছিলো নেতৃত্ব। সালাউদ্দিন বলেছেন,
‘আমি বলবো যে, তামিমের এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। এটা অন্য কেউ হলেও একই সিদ্ধান্ত নিতো আমার মনে হয়। এবং তামিমের এটা খুবই সঠিক সিদ্ধান্ত। এই কারণেই আমরা ইমরুলকে অধিনায়কত্ব দিয়েছি। এছাড়া অধিনায়কত্ব করার মতো আর কেউ ছিল না।’
দেশীয় খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সই কুমিল্লার শিরোপা জয়ের বড় অস্ত্র ছিল। দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে সালাউদ্দিন বলেছেন,
‘প্রথম বছর অনেক বেশি অনুভূতি ছিল। প্রথম বছর যখন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, তখন খুবই ভালো লাগছে। এই বছর আসলে ওইভাবে অনুভূতিটা আমি পাইনি, আমি জানি না কেন। আমার কাছে মনে হয় যে, এটা একটা ভালো অর্জন। আমরা যেমন দল করেছিলাম আসলে, মনে হয় না আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো দল ছিলাম। কারণ আমাদের চেয়ে অনেক ভালো দল ছিল। কিন্তু পুরো কৃতিত্ব আমি দিব আমাদের খেলোয়াড়দের। খেলোয়াড়দের কারণে এবং দেশীয় খেলোয়াড়রা খুব ভালো খেলার কারণেই হয়তো আমরা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে পারছি।’
নানামুখী ঘটনাপ্রবাহ জন্ম দিলেও স্মিথের অন্তর্ভুক্তি বিপিএলের মানটা বাড়িয়েছে। সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়দের একজন তিনি। কাছ থেকে স্মিথকে দেখার অভিজ্ঞতায় সালাউদ্দিন বলেছেন,
‘খেলোয়াড় হিসেবে সে তো সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বের ১-২টা খেলোয়াড়ের মধ্যে একজন। আর অধিনায়ক হিসেবে আমরাও দেখতে পারছি, সে আসলে মাঠের ভিতরে কী করতে পারে। সে আসার আগেই কিন্তু আমার কাছ থেকে অনেক তথ্য নিয়েছে যে, আসলে দেশীয় খেলোয়াড়রা কে কী করে। কারণ আন্তর্জাতিক সব খেলোয়াড় সম্পর্কে তার ধারণা আছে। দেশীয় খেলোয়াড় সম্পর্কে তার যেহেতু ধারণা নেই। এবং এটা খুবই ভালো লাগছে যে, সে আসার আগে আমার কাছ থেকে সব তথ্য জানার চেষ্টা করছে। প্রথম দিন মিটিংয়ে আসার পরেই সে কিন্তু এক ঘন্টা আগে এসে প্রত্যেকটা বোলারের ভিডিও দেখছে, আমাদের বোলাররা কে কী করে, সবকিছু সম্পর্কে সে একটা ধারণা নিয়েছে। তার আগে আমি তার কাছে একটা লিখিত রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম, আমাদের দেশীয় ক্রিকেটারদের কার মানসিকতা কেমন, সে এগুলো সব জানতে চেয়েছে। তার মানে বোঝা যায়, সে দলের প্রতি অনেক সিরিয়াস ছিল।’
স্মিথ চলে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই কুমিল্লার ব্যাটিং লাইনে বিশেষ করে মিডল অর্ডারে বড় শূন্যতা তৈরি হয়, শামসুর রহমান যেখানে সমাধান হয়ে ধরা দিয়েছেন। ডানহাতি এই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান কুমিল্লার ট্রফি জয়ের মিশনের আনসাং হিরো। কোচ সালাউদ্দিনের কথায় সেটিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মিডল অর্ডারের ঘাটতি পূরণে শামসুরের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেছেন,
‘স্মিথ চলে যাওযার পর কিন্তু আমাদের পুরো মিডল অর্ডারটা ভেঙে গেছিলো। আমি এটার পুরো কৃতিত্ব দিব তামিমকে। তামিমের কারণে কিন্তু আমি শামসুর রহমানকে দলে নিয়েছিলাম। তামিম যদি না বলতো, তাহলে হয়তো আমরা শামসুর রহমানকে নিতাম না। কারণ আগের বছর সে কিন্তু কোনো ম্যাচ খেলতে পারেনি। তবে সে যে ভূমিকাটা পালন করছে, এবং তারে আমরা সব জায়গায় খেলাতে পারছি। তাকে আমরা তিনে, চারে, পাঁচে খেলাইছি। সে সব জায়গায় খেলার জন্য প্রস্তুত ছিল। এবং সে এমন কিছু ইনিংস খেলছে, যা দলের ছন্দটা ঘুরিয়ে দিয়েছে। তার স্ট্রাইক রেটটা অনেক ভালো ছিল। এই অবস্থান এমন একটা লোকাল ছেলে, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা পালন করবে, আমি আসলে… আমরা আসলে কেউ এতটা চিন্তা করি নাই, সে এত ভালো খেলবে। তার ভূমিকাটা আমাদের দলে অনেক ভারসাম্য নিয়ে এসেছে। কারণ আমাদের টপ অর্ডার ছিল, মিডল অর্ডার কিছুই ছিল না। শামসুর রহমানের পরে আফ্রিদি, থিসারা পেরেরা আসবে, আমাদের পেছন দিকে মারার ব্যাটসম্যান ছিল, বা সাইফউদ্দিন আছে। তারা মারতে পারতো। উপরের দিকে (মিডল অর্ডার) কেউ একজন যে ধরে খেলবে, বড় ইনিংস খেলবে, এমন কেউ ছিল না। কারণ আমার বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই ওপেনার। লুইস, তামিম, বিজয়, ইমরুল। দলটা করতেই কিন্তু আমাদের অনেক কষ্ট হয়েছে, বা দলের ভারসাম্য নিয়ে আসতে। কারণ সবাই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। মিডল অর্ডারে কেউ ছিল না। শামসুর রহমান এখানে খুবই ভালো একটা দায়িত্ব পালন করেছে। এ কারণে দলটা ভালো সেটআপে আসছে।’
অভ্যন্তরীণ অর্ন্তকলহ পেরিয়েও বিপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে কুমিল্লা। দলের মাঝে এমন অস্বস্তিকর পরিবেশ নিয়ে টুর্নামেন্ট জেতা বিরাট সৌভাগ্য বটে। তবে দলকে সঠিক কক্ষপথে রাখতে মালিকপক্ষকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ তামিমের মতো ত্যাগ স্বীকার করে দলের জন্য লড়াই করা ক্রিকেটার সহজে পাবে না কুমিল্লা।