দাবার সাথে আর্ট তথা শিল্পের এক গভীর সংযোগ রয়েছে। দাবাবোর্ডের প্রতিটি চাল যেন শিল্পীর তুলিতে এক একটি আঁচড়। মার্সেল ডুশাম্প যেমনটা বলেছেন,
“আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, সকল শিল্পীই দাবাড়ু না হলেও অন্তত সব দাবাড়ুই একেকজন শিল্পী!”
শিল্পের ছোঁয়া নিরন্তর ফুটে ওঠে চৌষট্টি খোপের মগজ-শাণ দেয়া এই খেলায়। আর বিজ্ঞানের কারিকুরিও তো কম দেখা যায় না, এজন্যেই ক্লাসিক্যাল দাবার ১২তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আনাতোলি ইউভগেনেভিচ কারপভ বলেন,
“দাবায় আপনি সব একসাথে পাবেন ― শিল্প, বিজ্ঞান ও খেলাধুলা।”
কেমন হয় যদি এই হাজার বছর ধরে চলা গেমটির বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়? ঠিক এই কাজটিই করেছেন অস্ট্রেলীয় দাবা-কোচ ব্র্যাড অ্যাশলক।
ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে (যখন থেকে কি না অফিশিয়ালভাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নির্বাচন শুরু হয়) আজ অবধি দাবা-দুনিয়া ২০ জন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পেয়েছে, ১৬ জন ক্লাসিক্যাল দাবায়, আর ৪ জন ফিদে দাবা টুর্নামেন্টে। খুব ব্যতিক্রম ছাড়া এই ক্লাসিক্যাল চ্যাম্পিয়নশিপগুলো প্রায় সবগুলোই নির্ধারিত হয়েছে চ্যাম্পিয়ন এবং চ্যালেঞ্জারের মধ্যকার মুখোমুখি লড়াইয়ের দ্বারা। ব্র্যাড অ্যাশলক এই ক্লাসিক্যাল দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ১৬ জনকেই এঁকেছেন।
আজকালকার অনেক উঠতি বয়সী টিনেজ দাবাড়ুদেরই দেখা যায়, কাপাব্লাঙ্কাদের চেনে না, স্মিস্লভ-পেত্রশিয়ান এরা আবার কারা? আলফা জিরো, হুডিনি, স্টকফিশ এদের যুগে এসে কাপাব্লাঙ্কা-অ্যালিয়েইখিনদের না চেনা যদিও দাবা পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, তবে এদের না চেনা দাবার সমৃদ্ধ অতীত আর দাবা-সংস্কৃতির পরিপন্থী। তাই অ্যাশলক আশা করেন, তার এই চিত্রকর্মগুলো থেকে কিছু হলেও যেন নব্য দাবাড়ুগণ তাদের পূর্বসূরিদের চিনতে শেখে এবং জানতে আরও আগ্রহী হয়।
১. উইলহেম স্টাইনিজ (১৮৮৬-৯৪)
দ্য ফাদার অফ পজিশনাল চেস উইলহেম স্টাইনিজ প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ১৮৮৬ সালে জোহানেস জুকারটর্টকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন। স্টাইনিজই প্রথম বুঝতে শিখেছিলেন যে, দাবা জটিল খেলা হলেও এরও কিছু না কিছু নিয়মকানুন বেধে দেয়া সম্ভব। স্টাইনিজের আগে দাবা শুধুই একটা খেলা ছিল, তিনিই প্রথম একে স্টাডি করেছেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত এক্সপেরিমেন্টর। তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন যে, দাবাও অনুশীলনের এবং গবেষণার বিষয়, চাইলে এখানেও কিছু প্যাটার্ন খুঁজে বের করা সম্ভব। স্টাইনিজ ছিলেন ভিশনারি, চিত্রে তার কপালের গোলাপি ফোঁটা দিয়ে অ্যাশলক যেন বুঝাতে চেয়েছেন, স্টাইনিজের আইডিয়াগুলো আজও উজ্জলভাবে পরিদৃষ্ট হচ্ছে!
২. ইম্যানুয়েল ল্যাসকার (১৮৯৪-১৯২১)
ল্যাসকার ছিলেন ইতিহাসে সর্বোচ্চ সময় ধরে দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। স্টাইনিজের থেকে মুকুট নেয়ার পর তিনি ফ্রাঙ্ক মার্শাল, সিগবার্ট তারাশ-এর মতো দাবাড়ুদের বিরুদ্ধে টাইটেল ডিফেন্ড করেছেন, শেষে কাপাব্লাঙ্কার কাছে হেরে যান। ল্যাসকারকে আধুনিক দাবার আবিষ্কারক মনে করেন ক্রামনিক। স্টাইনিজের খেলায় কিছুটা ঊনবিংশ শতাব্দীর ধাঁচ পাওয়া যায়, যা কিছুটা সেকেলে। পক্ষান্তরে ইম্যানুয়েল ল্যাসকারের কিছু খেলা এমনও আছে যা দেখে একদম হাল জমানার স্বাদ পাওয়া যায়।
দাবার ইতিহাসে ইম্যানুয়েল ল্যাসকার আসলেই একজন বড়সড় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনিই প্রথম দাবায় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব অনুধাবন করেন, এবং প্রতিপক্ষভেদে আলাদা আলাদা খেলার স্টাইলের ধারণাও তিনিই সামনে আনেন। তার খেলা কোনো ক্যাটাগরিতে ফেলা যেত না, তিনিই দাবা ইতিহাসের প্রথম আনক্যাটাগরিক্যাল দাবাড়ু! এরকম খেললে ভালো আর এরকম খেললে খারাপ– এমন প্রথাগত চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসা শিখিয়েছিলেন ল্যাসকার।
যেসময় ল্যাসকার স্টাইনিজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন, তিনি সমকালীন বাকিদের এমনভাবে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন যে, এমন বোধহয় আর কখনোই সম্ভব নয়। অ্যাশলকের দৃষ্টিতে ল্যাসকার যেন ছিলেন এক ধূর্ত শেয়াল!
৩. হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কা (১৯২১-২৭)
হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কা ছিলেন জিনিয়াস, ছিলেন এক প্রডিজি। এন্ডগেমে ধারণাতীত দখল ছিল তার। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী এক দাবাড়ু যিনি কি না পল চার্লস মরফির মতো, যেকোনো শতাব্দীতেই এমন প্রতিভা আবির্ভূত হতে পারে একটাই। ১৯১৬-২৪ সাল এই সময়ব্যাপ্তিতে কাপাব্লাঙ্কা টুর্নামেন্টগুলোতে ৪০ জয় এবং ২৩ ড্র-তে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়েন। হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কাকে আমরা তুলনা করতে পারি মোৎসার্টের সাথে, যার মিউজিক নিজেই একটা বিশেষণ। কাপাব্লাঙ্কা একদম স্পেশাল ছিলেন। দাবাবোর্ডে তার খেলা ছিল মেশিনের মতো যান্ত্রিকতা এবং রোমান্টিকতার মিশেল। কাপাব্লাঙ্কার ছবিটি দেখে আসতে পারেন এখান থেকে।
৪. অ্যালেকজান্ডার অ্যালিয়েইখিন (১৯২৭-৩৫, ১৯৩৭-৪৬)
একমাত্র বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হিসেবে টাইটেল হোল্ড করতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন অ্যালেকজান্ডার আলেকজান্দ্রভিচ অ্যালিয়েইখিন। অ্যাটাকিং খেলার জন্য সুপরিচিত অ্যালিয়েইখিন বিশ আর ত্রিশের দশক বলতে গেলে একা হাতেই শাসন করেছেন। মাঝের দু’বছর বিরতি ছাড়া আমৃত্যু টানা প্রায় দুই দশক চ্যাম্পিয়নের মুকুট ধরে রেখেছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত পরিশ্রমী। তার স্ট্র্যাটেজিগত ট্যালেন্ট যেমন ছিল, তেমনি ছিল পজিশনাল অ্যাডভান্টেজ সংক্রান্ত জ্ঞান। অ্যালিয়েইখিনের অ্যাটাকের সাথে-সাথেই সমার্থক হয়ে ওঠে অ্যালিয়েইখিন’স গান টার্মটি।
৫. ম্যাক্স ইউয়ে (১৯৩৫-৩৭)
মাহিলিস ম্যাক্স ইউয়ে বা সংক্ষেপে ম্যাক্স উ ছিলেন দারুণ এক খেলোয়াড়। অনেকেই বলে থাকে মডার্ন চেস প্রিপারেশনের জনক বৎভিনিক, তবে ভ্লাদিমির ক্রামনিক মনে করেন ম্যাক্স উ-ই এর দাবিদার। ম্যাক্স ওপেনিংয়ের গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাই প্রস্তুতিতে জোর দিতেন বেশি। এবং ওপেনিং আইডিয়াতে কীভাবে ভ্যারিয়েশন এনে উন্নত করতে হয়, সেটাও তিনি বুঝতেন। অ্যালিয়েইখিন যথেষ্ট পরিশ্রম করতেন বটে, তবে মাঝেমধ্যেই কিছুটা অদ্ভুত খেলতেন। অপরপক্ষে, ম্যাক্সের ওপেনিং হতো বরাবরই খুব সলিড এবং যৌক্তিক। অ্যালিয়েইখিনকে হারাতে প্রয়োজন ছিল এক সুপারম্যানের, ম্যাক্স উ সেই সুপারম্যান হিসেবেই আবির্ভূত হন।
৬. মিখাইল বৎভিনিক (১৯৪৮-৫৭, ১৯৫৮-৬০, ১৯৬১-৬৩)
Soviet Silhouette-এর পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন মিখাইল ময়সেভিচ বৎভিনিক, প্রথম সোভিয়েত হিসেবে শক্তহাতে সিংহাসন ধরে রাখেন। তিনি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের মাধ্যমে, অ্যালিয়েইখিনের মৃত্যুর পর চ্যাম্পিয়ন নির্বাচনের জন্য যেটির আয়োজন করা হয়েছিল। বৎভিনিক নতুন এক যুগের কর্ণধার ছিলেন, তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন যে খেলার ফলাফল শুধু চেস প্রিপারেশনের উপর নির্ভর করে না।
বৎভিনিক ছিলেন প্রথম প্রকৃত পেশাদার দাবাড়ু। তিনি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোর আগে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিতেন। শুধু দাবার ওপেনিংই নয়, পরিমিত ঘুম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস আর শারীরিক ব্যায়ামও যে প্রস্তুতির অংশ, সেটি দাবার দুনিয়াকে হাতে-কলমে শিখিয়েছেন।
বর্তমান খেলোয়াড়দের কাছে অ্যালেখাইন-উ ম্যাচগুলোর অবস্থা শুনলে হাস্যকর ঠেকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন কোনো ম্যাচ পিছিয়ে দেয়া হলো। তারপর একজন দেখা গেল দেদারসে মদ্যপান করে চলেছেন, অন্যজনের হয়তো জরুরি কোনো বিজনেস মিটিং পড়ে গেল পরের গেমের ঠিক আগমুহূর্তে! কিন্তু এমন কিছু বৎভিনিকের সাথে ঘটা অসম্ভব ছিল, কারণ তিনি প্রকৃত পেশাদারিত্বের চর্চা শুরু করেছিলেন!
৭. ভাসিলি স্মিস্লভ (১৯৫৭-৫৮)
ভাসিলি ভাসিলিয়েভিচ স্মিস্লভ ছিলেন বলতে গেলে, দ্য ট্রুথ অফ চেস। ভাসিলি খুব সহজাতভাবেই সঠিক দাবা খেলতেন। তার খেলা কিন্তু মোটেই কাপাব্লাঙ্কা বা তালের মতো মোহনীয় ছিল না। স্মিস্লভের ম্যাচে তাদের খেলার মতো জাদুকরী ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হতো না বটে, তবে তা কার্যকরী ছিল। তিনি কোনোমতেই চেস আর্টিস্ট ছিলেন না, তার খেলা তেমন মন্ত্রমুগ্ধকারী ছিল না; তবে দরকারি সবকিছুই তাতে উপস্থিত ছিল। নবীনদের স্মিস্লভের খেলা থেকে শেখা উচিত, কেননা তিনি যখন যেমন প্রয়োজন, তেমন খেলতেন। প্রতিটি চালে সবচেয়ে শক্তিশালী দানটাই দিতেন। এই বিচারে তিনি যে কাউকে টেক্কা দিতে পারঙ্গম। পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে, ভাসিলি আসলেই অবমূল্যায়িত হয়েছেন। স্মিস্লভ অপেরার গানও করতেন। তার খেলা ছিল তার অপেরা সঙ্গীতের মতোই তাল-লয়ের সমাহার!
৮. মিখাইল তাল (১৯৬০-৬১)
মিখাইল নেখমেভিচ তাল একজন তারকা ছিলেন, ছিলেন এক প্রকৃত দাবা-প্রতিভা। তার দাবা ক্যারিয়ারে কোনো উচ্চাশা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, তিনি খেলাটাকে শুধুই উপভোগ করে গেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি অপেশাদার ঠেকতে পারে, কিন্তু তার ট্যালেন্ট এতটাই মায়ার ইন্দ্রজাল সৃষ্টিকারী ছিল যে তার অ্যামেচার অ্যাপ্রোচেই তিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে যান। আর যখন তিনি মসনদ দখল করেন, সেটা হয়ে যায় বিশ্বরেকর্ড – মাত্র ২৩ বছর বয়সে সে সময়ের নিরিখে সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে বিশ্ববিজেতার মুকুট পরেন তাল!
তালের খেলার ধাঁচ ছিল শক্তিশালী, দাবা বোর্ডে কিছু ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতেন, তারপর সেই থেকে আক্রমণ। তার ছিল চমৎকার সৃজনক্ষমতা। তিনি ছিলেন এক জ্বলজ্বলে দ্যুতি, যার দ্রুতই উদয় ঘটেছে এবং দ্রুতই পতনও ঘটেছে। উপমা দিয়ে বলতে গেলে, তারাটি এত উজ্জল হয়ে জ্বলেছিল যে, সেটি দীর্ঘসময় নিজেকে জ্বালিয়ে রাখতে পারেনি, একবারে পুড়ে গেছে।
১৪তম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্রামনিক তালের মূল্যায়নে বলেন,
“তালের ব্যাপারে কিছু বলা কঠিন, কারণ তিনি ছিলেন খুবই প্রতিভাবান, তাকে শুধুই ন্যাচারাল ফেনমেনন বলাই মানায়। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, যদি তিনি দাবায় না আসতেন তবে অন্য যেদিকে ফোকাস করতেন, সেখানেই সেরা হতেন। যদি তিনি বিজ্ঞানী হতেন, তবে সম্ভবত নোবেল পুরস্কার পেতেন। তার বৈশিষ্ট্য ছিল জাগতিক গুণাবলীর বাইরে। যারা তাকে ব্যক্তিগতভাব চিনতেন, তাদের অনেকেই বলেছেন, তার মধ্যে হোমো-স্যাপিয়েন্স এর কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না। তিনি ছিলেন এলিয়েন। তার দাবা নিয়ে আলোচনা করা হলো ঈশ্বর কেমন দেখতে সেটা নিয়ে আলোচনা করার মতো।”
ধারণাতীত আক্রমণ আর স্যাক্রিফাইস-এর সমন্বয়ে এক জাদুকরী আর সম্মোহনী দাবা খেলতেন তাল, এ বাবদ অনেক উপাধিতেও ভূষিত করেছে তাকে দাবাকুল – দ্য ম্যাজিশিয়ান ফ্রম রিগা, দ্য পাইরেট অফ লাতভিয়া, দ্য ফরচুন’স ফেবারিট, দ্য হিপনোটিস্ট, দ্য এলিয়েন ইত্যাদি যার গুটিকয়েক উদাহরণ।
আজকের পর্বে আমরা প্রথম ৮ জন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের চিত্রকর্ম দেখলাম, আগামীতে আমরা বাকি ৮ জন সম্পর্কে জানবো।