বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে জনপ্রিয় ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ আসর। ক্রিকেটপ্রেমী সব দর্শকের চোখ থাকে এই আসরে। প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে শিরোপা উঁচিয়ে ধরার। এখন পর্যন্ত প্রচুর সংখ্যক ক্রিকেটারের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার মধ্যে অল্প সংখ্যক ক্রিকেটারই শিরোপা ছুঁয়ে দেখতে পেরেছেন। ব্যাট হাতে সবকিছু জয় করা শচীন টেন্ডুলকারেরও বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরার স্বপ্ন অধরা ছিলো নিজের খেলা প্রথম চারটি বিশ্বকাপে। ২০১১ সালে ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। এত অর্জনের মধ্যে এটিই ছিলো তার সেরা অর্জন। এমনও অনেক ক্রিকেটার আছেন, যারা আন্তর্জাতিক অঙ্গন দাপিয়ে বেড়ালেও কখনও নিজ দেশের হয়ে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাননি। ভারতের অলরাউন্ডার ইরফান পাঠান ২০০৭ সালে ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে তিন উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন। ১২০টি ওডিআইতে ১৭৩ উইকেট শিকার করা ইরফান পাঠান কখনও ভারতের হয়ে ৫০-ওভারের বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাননি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পরিচিত পাঁচ মুখ, যারা কখনও বিশ্বকাপ ক্রিকেটে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাননি, তাদের নিয়েই কথা হয়ে যাক আজ।
৫. জাস্টিন ল্যাঙ্গার (অস্ট্রেলিয়া)
জাস্টিন ল্যাঙ্গার অস্ট্রেলিয়া অন্যতম সেরা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিংদের অপরাজেয় দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ম্যাথিউ হেইডেনের সাথে প্রায়শই শুভসূচনা এনে দিতেন। টেস্ট ক্রিকেটে ম্যাথিউ হেইডেন এবং জাস্টিন ল্যাঙ্গার উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে ১২২ ইনিংসে ৫১.৫৩ গড়ে ৬,০৮১ রান যোগ করেছিলেন।
তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ১০৫টি টেস্ট ম্যাচে ২৩টি শতক এবং ৩০টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৫.২৭ ব্যাটিং গড়ে ৭,৬৯৬ রান করেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে ১৯৯৩-২০০৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৪ বছর নিজের দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করেছিলেন। সাদা পোশাকের টেস্ট ক্রিকেটের তুলনায় রঙিন পোশাকের ওডিআইতে তাকে কম দেখা গিয়েছে। এই ফরম্যাটে ম্যাথিউ হেইডেনের সাথে প্রতিপক্ষের বোলারদের তুলোধুনো করতেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। অস্ট্রেলিয়ার সোনালি যুগের সফল ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিই বিশ্বকাপের শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারেননি। তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার চলাকালীন অস্ট্রেলিয়া তিনবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো। ১৯৯৭ সালে শেষবারের মতো ওডিআই খেলা জাস্টিন ল্যাঙ্গার একটিতেও দলে ছিলেন না। এই ফরম্যাটে মাত্র আট ম্যাচ খেলে ৩২.০০ ব্যাটিং গড়ে ১৬০ রান করেছিলেন তিনি।
৪. ম্যাথিউ হগার্ড (ইংল্যান্ড)
ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ৬৭টি টেস্টে ২৪৮ উইকেট শিকার করেছিলেন ম্যাথিউ হগার্ড। টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের নবম সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনি। ম্যাচে পাঁচ উইকেট সাতবার এবং দশ উইকেট শিকার করেছেন একবার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জোহানসবার্গ টেস্টে ২০৫ রানের বিনিময়ে ১২ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে এটি তার সেরা বোলিং ফিগার।
ম্যাথিউ হগার্ড ২০০৫ সালের ঐতিহাসিক অ্যাশেজ সিরিজে ইংল্যান্ডের বোলিং লাইনআপের অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন। ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে তিনি বেশ কার্যকরী। টেস্ট ক্রিকেটে তার সময়কার অন্যতম সেরা বোলার হলেও ওডিআইতে ছিলেন গড়পড়তা বোলার। ২৬টি ওডিআইতে ৩২ উইকেট শিকার করেছেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৪৯ রান খরচায় পাঁচ উইকেট শিকার করেছিলেন। রঙিন পোশাকে এটি তার সেরা বোলিং ফিগার। ওডিআইতে দলে আসা-যাওয়ার মধ্যে থেকে ২৬টি ম্যাচ খেলেছিলেন ম্যাথিউ হগার্ড। কিন্তু ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাননি। ২০০৩ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ দলের প্রাথমিক দলে থাকলেও মূল একাদশে সুযোগ পাননি হগার্ড। তিনি ২০০৬ সালে ভারতের বিপক্ষে নিজের শেষ ওডিআই ম্যাচ খেলেছিলেন।
৩. ক্রিস মার্টিন (নিউ জিল্যান্ড)
বল হাতে অসাধারণ, ব্যাট হাতে বেশ নড়বড়ে, রান করা খুবই কঠিন কাজ- এটা ক্রিস মার্টিনের ব্যাটিং দেখালে যে কেউ বিশ্বাস করবে। মার্টিন ৭১টি টেস্টে ২৩৩টি উইকেট শিকার করেছেন, ব্যাট হাতে মাত্র ১২৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তার মূল কাজ ছিলো বল হাতে। এই কাজ তিনি বেশ ভালোভাবেই পালন করতেন। প্রতিভার পাশাপাশি কঠোর পরিশ্রম করে নিউ জিল্যান্ডের সর্বকালের সেরা উইকেট শিকারীদের তালিকায় ‘স্যার’ রিচার্ড হ্যাডলি এবং ড্যানিয়েল ভেট্টোরির পরেই অবস্থান করছেন তিনি।
টেস্ট ক্রিকেটে দলের প্রধান বোলার থাকলেও ওডিআইতে নিজের জায়গা থিতু করতে পারেননি। ২০০১-০৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ২০টি ওডিআই খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের পর পুরোপুরিভাবে টেস্ট ক্রিকেটে মনোযোগ দেওয়ার পর তার আর ওডিআই খেলা হয়নি। ২০টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১৮ উইকেট শিকার করা ক্রিস মার্টিন বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাননি। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে মূল একাদশের খুব কাছে গিয়েও তার খেলা হয়নি। পেসার ড্যারেল টাফির ইনজুরির দরুন তিনি ডাক পেয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি তিনি।
২. অ্যালিস্টার কুক (ইংল্যান্ড)
নামকরা ক্রিকেটার হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলতে না পারা পাঁচজন ক্রিকেটারদের তালিকায় অ্যালিস্টার কুকই একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। তবে কুকেরও আর বিশ্বকাপ খেলা হবে না। তিনি নিজের সর্বশেষ ওডিআই ম্যাচ খেলেছিলেন ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ২০০৬ সালের ২৮ জুন একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে অ্যালিস্টার কুকের। আট বছরের ওডিআই ক্যারিয়ারে ৯২ ম্যাচে পাঁচটি শতক এবং ১৯টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৬.৪০ ব্যাটিং গড়ে ৩,২০৪ রান করেছেন এই বাঁহাতি ওপেনার। ওডিআই ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় ১৪ তম স্থানে অবস্থান করা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ আসরে তাকে দেখা যায়নি।
টেস্ট ক্রিকেটে এখনও দাপটের সাথে খেলে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডের সর্বকালের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক অ্যালিস্টার কুক। এখন পর্যন্ত ১৪৮টি টেস্ট ম্যাচে ৩১টি শতক এবং ৫৫টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৪৬.০০ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ১১,৬৩৮ রান। ৩২ বছর বয়সী অ্যালিস্টার কুক আরও বেশ কিছুদিন টেস্ট ক্রিকেট চালিয়ে যেতে পারেন। তবে ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপ আসরে তাকে আর দেখা যাবে না। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগে ইংল্যান্ডকে ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ওঠানো অ্যালিস্টার কুককে অধিনায়কের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ইয়োন মরগানকে অধিনায়ক হিসাবে নির্বাচিত করে ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড।
১. ভিভিএস লক্ষণ (ভারত)
ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন, অজয় জাদেজা, হ্যান্সি ক্রনিয়েদের মতো ক্রিকেটার যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন, তখন ক্রিকেট বিশ্ব উত্তাল ছিলো। বিশেষ করে ভারতীয় ক্রিকেট দর্শকরা। সে সময় ভারত জয়লাভ করলে দর্শকরা বলতো প্রতিপক্ষকে টাকা দিয়ে জিতেছে। আর পরাজিত হলে বলতো ম্যাচ পাতিয়ে পরাজিত হয়েছে। বেশ নাজুক অবস্থা ছিলো তখন। দরকার ছিলো দর্শকদের মন জয় করা। তাই অস্ট্রেলিয়াকে নিজ দেশে আমন্ত্রণ জানায় ভারত। সিরিজের প্রথম টেস্টে ভারতকে দশ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে নিজেদের জয়ের ধারা বজায় রেখেছিলো অস্ট্রেলিয়া। ইডেন গার্ডেনে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিন শেষেও চালকের আসনে ছিলো সফরকারীরা। এমতাবস্থায় ভিভিএস লক্ষণ ২৮১ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে ভারতকে শুধুমাত্র পরাজয়ের হাত থেকেই রক্ষা করেননি, এনে দিয়েছিলেন নাটকীয় জয়। এই ম্যাচের মাধ্যমে দর্শকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল ভারত। এরপর ২০০২ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যৌথভাবে শিরোপা জয়ের পর ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে রানার্স আপ হয়েছিলো ভারত। ভারতীয় ক্রিকেটে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার নায়ক ভিভিএস লক্ষণ নিজের বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপ আসরে খেলার সুযোগ পাননি। ভারতের ক্রিকেট চার স্তম্ভ সৌরভ, শচীন, দ্রাবিড় এবং লক্ষণের মধ্যে শুধুমাত্র লক্ষণই বিশ্বকাপে খেলার গৌরব অর্জন করতে পারেননি। ১৩৪ টেস্টে ১৭টি শতক এবং ৫৬টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৫.৯৭ ব্যাটিং গড়ে ৮,৭৮১ রান করেছেন তিনি। ওডিআই ক্রিকেটেও তিনি ব্যাট হাতে ভারতের বহু জয়ে অবদান রেখেছিলেন।
৮৬টি ওডিআইতে ছয়টি শতক হাঁকিয়েছিলেন, যার মধ্যে চারটি শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ক্যারিয়ারের গড় যেখানে ৩০.৭৬ সেখানে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪৬.১৮। চাপের মুখে দলের হাল ধরতে পারতেন বলেই তিনি ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’। এই কিংবদন্তী ক্রিকেটারের বিশ্বকাপে নিজ দলকে প্রতিনিধিত্ব করতে না পারার আক্ষেপ থেকেই যাবে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে দলে জায়গা পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী থাকলেও শেষপর্যন্ত তার বদল দীনেশ মঙ্গিয়াকে দলে নেওয়া হয়।