ভারতের একটা সময় অবধি সেরা অধিনায়ক ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। তার রেকর্ড ও স্বীকৃতি কিছুটা কেড়ে নিয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। এখন ভারতের অধিনয়ক বিরাট কোহলি। কোহলির অধিনায়কত্ব এবং আধুনিক যুগের বোলিং ও ব্যাটিং নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন সৌরভ গাঙ্গুলি।
এখনকার কোন খেলোয়াড় আপনাকে বেশি রোমাঞ্চিত করে?
এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিরাট কোহলি আছে- সবাই ওর সম্পর্কে জানে। কিন্তু লোকেশ রাহুল আমাকে রোমাঞ্চিত করে। সে সত্যিই একজন ভালো খেলোয়াড়। এমন একজন খেলেয়াড়, যে সব ফরম্যাটে রান করবে। সে আমাকে রোমাঞ্চিত করে। এবং কুলদীপ যাদব। সে অসাধারণ। কুলদীপের মধ্যে সেই যোগ্যতা আছে যে, ও দেশের বাইরে আপনাকে টেস্ট জিতিয়ে দিতে পারে। আমার মনে হয়, এটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি সত্যিই চাই রাহানে ভালো করুন। কারণ ও একজন ভালো ক্রিকেটার। ও একটু নিজের জায়গাটা হারিয়েছে। ওর একটু সমর্থন দরকার। আমি দেখছি ও দল থেকে বের হচ্ছে, আবার ঢুকছে। এই জায়গাটায় বিরাট কোহলির অধিনায়কত্ব দেখাতে হবে। ওর যোগ্যতা বিবেচনা করে ওকে কিছুদিন সমর্থন দিতে হবে। চার মাস, পাঁচ মাস, ছয় মাস; তাহলে ওকে পথে ফিরিয়ে আনা যাবে।
রাহুলের কোন ব্যাপারটা আপনাকে মুগ্ধ করে?
ও শট খেলতে যে সময়টা নেয়, বিশেষ করে ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ও যে ইনিংসটা খেলেছে, সেটা অবিশ্বাস্য। রোহিত শর্মা অন্য প্রান্তে ব্যাট করছিল। আমি ওদের তুলনা করছি না। রোহিত তো ছোট দৈর্ঘের ম্যাচে রেকর্ডের জন্যই পরিচিত। এটা সম্ভবত এমন একটা দিন, যখন ও (রোহিত) ফিল্ডিংয়ের ফাঁক খুজে পাচ্ছিল না। কিন্তু রাহুলকে একবারও নড়বড়ে মনে হয়নি। ও বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা কোহলিকে নিয়ে কথা বলেছি। সে দেখিয়েছে, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট কীভাবে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খেলতে হয়।
যখন ইংল্যান্ড ব্যাট করে, তখন আপনি দেখবেন বাটলার এসে রিভার্স ফ্লিক করছে, ল্যাপ শট করছে; বইয়ের সব শট করভে। এরপর লোকেশ রাহুলকে দেখবেন এসে মিড অফের ওপর দিয়ে মারছে, প্যাডল করভে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে; সব ক্রিকেটীয় শট। আশা করি, ভারতীয় ক্রিকেট ওকে দেখে শুনে রাখবে। কারণ, এরকম প্রতিভা আপনি রোজ রোজ পাবেন না।
বিরাট কোহলির অধিনায়কত্ব কেমন?
ওকে খেলোয়াড় বাছাই করার চোখ তৈরী করতে হবে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য কোনো তৈরী করা নিয়ম নেই। আপনি একজন খেলোয়াড় দেখলেন এবং ভাবলেন, ও আমার জন্য কী করতে পারে। এরপর তাকে সমর্থন দিয়ে গেলেন। বিরাটও তার খেলোয়াড়দের সমর্থন দেয়। এটা ভারতীয় ক্রিকেটের একটা রীতি এখন। সম্ভবত এটা আমার সময় থেকে শুরু হয়েছে। এরপর ধোনি এটা করেছে, বিরাট করছে। এখন স্রেফ ভালো খেলোয়াড় চেনার চোখটা দরকার। আমার ধারণা ও খুবই আবেগী। সেও অন্য অধিনায়কের মতো চায় যে, তার দল ভালো করুক। আমি তার ভেতর ভারতীয় ক্রিকেটর ভালোই দেখতে পাই। হ্যাঁ, তাদের দেশের বাইরে টেস্ট সিরিজ জিততে হবে। তাদের টেস্ট ক্রিকেটে আরও ভালো করতে হবে। ওটাই একটা ভালো দলের চিহ্ন।
ভারতীয় ক্রিকেটে গ্রেট খেলোয়াড় অনেক ছিল। আমি সুনীল গাভাস্কারকে তার শেষ দিকে দেখেছি। আমি দ্রাবিড়, টেন্ডুলকার, শেবাগকে দেখেছি। আমি লক্ষণকে দেখেছি। আবার অনিল কুম্বলেকে এদের অধিনায়কত্ব করতে দেখেছি। ৬০০ উইকেট, ৪০০ উইকেট, ১৫ হাজার রান; অনেক গ্রেট খেলোয়াড় ছিল স্কোয়াডে। সে (কোহলিও) তার প্রজন্সের সেরা খেলোয়াড়।
কিন্তু বিরাট কোহলি কত রান করল, সেটা দিয়ে তাকে মাপা হবে না। এটা থাকবে। সে যেহেতু অনেক বড় খেলোয়াড়, সে শেষ অবদি রান করে যাবে। কিন্তু আমার জন্য বিরাট কোহলিকে মাপার উপায় হবে, ভারতীয় ক্রিকেটকে সে কতদূর নিয়ে যেতে পারল তা। সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, তার চারপাশে সঠিক লোকেরা আছে। যারা তাকে জীবনটা আরেকটু সহজ করে তোলার পথ দেখাতে পারবে। কারণ, তার পথ চলা খুব কঠিন হতে যাচ্ছে। যতদিন সে অধিনায়ক আছে, বিদেশ সফরে ব্যাপারটা কঠিন হবে; কারণ তার ফর্ম কখনো ভালো থাকবে, কখনো খারাপ হবে। এটাই তার পরিচিতি হবে যে, সে ভারত দলটাকে অধিনায়ক হিসেবে কোথায় রেখে যেতে পারলো।
সত্যি কথা বলি, ১৯৮৬ সালে আমরা দেশের বাইরে ভাল করেছিলাম। এরপর অনেকদিন ভাল করিনি। আমরা ২০০০ থেকে ২০০৮ অবধি ভাল করেছি। আমার অধিনায়কত্বে, রাহুলের অধিনায়কত্বে এবং ধোনির নিউজিল্যান্ড সফরে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল অবধি আমাদের খুব গর্ব করে বলার মতো কিছু নেই। আমরা ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে টেস্ট সিরিজ জিততে পারিনি। আমার ধারণা, ও (কোহলি) ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করবে।
আজকের দিনে কি ব্যাটিংটা সহজ হয়ে গেছে?
আমি মনে করি, বোলাররা আজকাল একটু বেশি চেষ্টা করে ভিন্ন কিছু করতে। তারা অনেক কিছু করে; ব্যাপারটা সরল রাখে না। আমি গ্লেন ম্যাকগ্রা, পোলক, ওয়াসিম, ওয়াকার, ডোনাল্ড, ব্রেট লি, গিলেস্পির মতো গ্রেটদের বিপক্ষে খেলেছি। একজনের পর একজন এসেছে। এরা সবাই যেটা করতো, সঠিক জায়গায় বল করা। এখন আমি দেখছি, অনেক কিছু করা হচ্ছে। স্লোয়ার বাউন্সার, ফুল লেন্থ ডেলিভারি, শর্ট ডেলিভারি; এসব করতে গিয়ে আসল লেন্থটাই ভুলে যাচ্ছে সবাই। আমার ধারণা, এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। আমার বাবা ২৫ বছর আগে যেটা পরতেন, সেটা এখন আবার ফ্যাশন হয়েছে। ফলে ক্রিকেট আবার সেই একই অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তারা উপলব্ধি করবে যে, বোলিংটা সরল রাখা এবং সঠিক লাইনে বল করাটাই সবচেয়ে ভালো। আমি বোলিং মানে অনেক বেশি বদল দেখতে পাচ্ছি। এর ফলে ব্যাটসম্যানরা অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করছে।
সব ধরনের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও শেষ অবধি বোলাররা মার খাচ্ছে। আপনি ল্যাপ শট খেলেন আর রিভার্স শট খেলেন, বোলার পিটুনি খাচ্ছে। ফলে বোলারদের ভাবতে সহবে, ‘ওকে, এরপরও তারা আমাকে মারছে। তাহলে সেরা সমাধাণটা কী?’ সেরা সমাধান হলো খুব বেশি ভেবে খুব বেশি কিছু না করা। সঠিন জায়গায় বল করা এবং সঠিক লেন্থে বল ফেলা। বলকে দিয়ে সামান্য কিছু করানো।
একজন সুইং বোলারের জন্য রান আটকানোর সেরা উপায় সুইং করানো। একজন স্পিনারের জন্য উইকেট নেওয়ার সেরা উপায় বল স্পিন করানো। ফলে সরল জিনেসে মন দাও। আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেই এই জিনিসটা বেশি ঘটছে। কুলদীপ কী করছে? স্রেফ ধীর গতির বলটা সঠিক জায়গায় ফেলছে। সে স্রেফ লেগস্পিন আর গুগলি চেষ্টা করে যাচ্ছে। খুব বেশি কিছু না। কিন্তু সে এই দিয়েই এখন টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বের অন্যতম সফল বোলার হয়ে গেছে।
অশ্বিনের মতো ফিঙ্গার স্পিনারদের ব্যাপারে কী বলবেন?
ওকে হারিয়ে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ ৩০০ উইকেট কোনো রসিকতার বিষয় নয়। আমরা সবসময় মনে করি, যে খেলছে না, সে-ই বোধহয় ভালো। কিন্তু সবসময় এটা হওয়া ঠিক নয়। অশ্বিনের দলে একটা জায়গা থাকতেই হবে। সে নিজেকে আরো ভালো করবে। কারণ সে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
Featured Image: Ashoka News