১
সময়টা ১৯৯২/৯৩ সাল। অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল। অ্যালান বোর্ডারের সেই অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিততে মরিয়া ছিল। আর হবেই বা না কেন? মাঝে সর্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টানা ৭টি সিরিজের কোনোটাই যে জেতা হয়নি। সময়ের হিসেবে সর্বশেষ সিরিজ জয়ের বয়স ১৭ বছর হয়ে গিয়েছে।
তাছাড়া, এই সিরিজে অবসরজনিত কারণে ভিভ রিচার্ডস অনুপস্থিত থাকায় হয়তো মানসিক ভাবেও অস্ট্রেলিয়া কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। তারই প্রতিফলন দেখা গেল প্রথম দুই টেস্টে। প্রথম টেস্ট ড্র করলেও দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জয় পায় ১৩৯ রানের ব্যবধানে। ১-০ তে এগিয়ে থেকে ৩য় টেস্টের প্রথম ইনিংসে করলো ৫০৩ রানের একটা বড় স্কোর।
ব্যাটিং এ নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাত্র ৩১ রানেই ২ টি উইকেট পড়ে গেল। ফলো-অনের আশঙ্কা মাথায় নিয়ে মাঠে নামলো ৪ টেস্টের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একটা ব্যাটসম্যান যার কিনা সিরিজের আগের দুই টেস্টের গড় মাত্র ২৮.৫০। কিন্তু নামার পরেই বিশ্ব যেন নতুন একজন ব্যাটসম্যানকে দেখতে পেল। অস্ট্রেলিয়া দলে তখন খেলছেন মার্ভ হিউজ, ম্যাকডরমেটের মতো বোলার, এমনকি আগের টেস্টেই ৮ উইকেট পাওয়া শেন ওয়ার্ন। কিন্তু এসব বোলারকে পাড়ার বোলার বানিয়ে ২৭৭ রানের একটা দুর্দান্ত ইনিংস খেলে ম্যাচটাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ফিরিয়ে নিয়ে আসলেন সেই তরুণ ছেলেটি। এতোটাই সাবলীল ছিলেন যে ম্যাচের ধারাভাষ্যকাররা বলছিলেন,
“এই ব্যাটসম্যানকে আজ আউট করা সম্ভব না। একমাত্র রান আউটই পারে তাকে আউট করতে।”
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সেদিন তিনি রান আউটই হয়েছিলেন। সেই ম্যাচটা পরে ড্র হয়েছিল কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে জিনিসটা প্রয়োজন ছিল সেটা ততদিনে পেয়ে গিয়েছিল, আর তা হলো মনোবল। পরের টেস্টটা কার্টলি অ্যামব্রোসের কৃতিত্বে মাত্র ১ রানে জিতে সিরিজে ফেরত আসলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শেষ ম্যাচেতো হতবিহবল অস্ট্রেলিয়া হারলো ইনিংস ব্যবধানে।
যার হাত ধরে প্রত্যাবর্তনটা করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই যাদুকরের নাম ব্রায়ান চার্লস লারা। ভালোবেসে ভক্তরা যাকে প্রিন্স অফ ত্রিনিদাদ বলে ডাকেন।
২
আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেকে চেনাতে একটু সময় নিলেও সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় হিসেবে সবার নজরেই ছিলেন তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই স্কুলবয়েজ লীগে ১২৬.১৬ গড়ে ৭৪৫ রান করেন। তার এই কীর্তি তাকে ত্রিনিদাদের অনূর্ধ্ব ১৬ দলে জায়গা পাইয়ে দেয়। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দেন।
১৯৮৭ সালটা ছিল লারার জন্য সাফল্যের অন্যতম একটা বছর। সেবছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি আগের বছরে কার্ল হুপারের ৪৮০ রানের রেকর্ড ভেঙ্গে ৪৯৮ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন। সেই টুর্নামেন্টে ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো তার নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয়, যেখানে লারা ম্যাচ উইনিং ১১৬ রানের একটা ইনিংস খেলেন।
১৯৮৮ সালে লারার প্রথম শ্রেণীতে অভিষেক হয় ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর পক্ষে। সেখানে দ্বিতীয় ম্যাচেই তিনি দুই গতিদানব জোয়েল গার্নার আর ম্যালকম মার্শালের বিপক্ষে ৯২ রানের একটা ইনিংস খেলে সবাইকে চমকে দেন। সেবছর শেষের দিকেই তিনি অনূর্ধ্ব ২৩ দলের হয়ে ১৮২ রানের একটা অধিনায়কোচিত ইনিংস খেলেন, যা কিনা তাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল দলে জায়গা পাইয়ে দেয়। সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলতেন ভিভ রিচার্ডস এবং ডেসমন্ড হেইন্সের মতো কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান। কিন্তু আচমকা তার বাবা হার্ট এটাকে মারা যাওয়ায় তিনি নিজেকে দল থেকে সরিয়ে নেন।
পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে তার টেস্ট অভিষেক হলেও তিনি নিজেকে চেনান সেই অস্ট্রেলিয়া সফরের ২৭৭ রানের ইনিংসের মাধ্যমেই। সিডনিতে খেলা সেই ইনিংসটা তার কাছে এতটাই প্রিয় ছিল যে, পরবর্তীতে লারা তার মেয়ের নাম রাখেন সিডনি।
মূলত ১৯৯৩/৯৪ সাল থেকে শুরু হয় ব্রায়ান লারার রাজত্ব। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৭৫ রানের একটা ইনিংস খেলে ভেঙ্গে ফেলেন টেস্টের সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড। এর আগের রেকর্ড ছিল অপরাজিত ৩৬৫ রানের, যার অধিকারী ছিলেন স্যার গ্যারিফিল্ড সোবার্স। রেকর্ডটি টিকে ছিল ২৬ বছর। এরপর লারা খেলতে যান কাউন্টি ক্রিকেটে। সেখানে ওয়ারউইকশায়ার এর হয়ে এমন খেলা খেললেন যা কিনা আগে কখনো দেখেনি ক্রিকেট বিশ্ব। ৭ ইনিংসে করলেন ৬ টি সেঞ্চুরি, যার সর্বশেষটি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের সর্বোচ্চ অপরাজিত ৫০১ রানের স্কোর। এই ইনিংস খেলতে তিনি বল খরচ করেছিলেন ৪২৭ টি।
অথচ এই ইনিংসটা নাও খেলতে পারতেন ব্রায়ান লারা। লাঞ্চের সময় লারা ওয়ারউইকশায়ারের তৎকালীন কোচ বব উলমারের কাছে জানতে চান, ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের বিশ্বরেকর্ডটা কত? উলমার বিস্মিত হয়ে জানালেন, ৪৯৯। উলমারের বিস্মিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল। লারার তখন রান মাত্র ২৮৫। তাছাড়া তখন কোচ আর অধিনায়কের ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেবার কথা ছিল। কিন্তু লারার এই কথা শুনে উলমার ভাবলেন অন্তত ওয়ারউইকশায়ারের রেকর্ড ৩০৫ রান ভাঙ্গার সুযোগটা লারাকে দেওয়া হোক। হুট করে মত পালটে উলমার বললেন, ‘ঠিক আছে, ও যদি পারে তাহলে করুক বিশ্ব রেকর্ড’। লারা করতে পেরেছিলেন। সেই ইনিংসে ফ্রন্ট ফুটে পুল করে একটা ছক্কা মারার ছবিতে সাইন করে উপহার দিয়েছিলেন উলমারকে। তাতে লেখা ছিল, ‘পারলে এটি কাউকে শেখান তো কোচ’। ছবিটি উলমার তার বাড়ির দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখেছিলেন।
৩
ফার্স্ট ক্লাস আর টেস্টের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভাঙ্গার পর বাকি থাকে ওয়ানডের সর্বোচ্চ রান। সেই সময়ে খুব কম মানুষই ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন না যে, রেকর্ডটি লারাই ভাঙবেন। শারজায় শ্রীলংকার বিপক্ষে লারা সেটা প্রায় করেও ফেলেছিলেন। শ্রীলংকার বিপক্ষে ১৬৯ রানের সেই ইনিংস খেলতে বল খেলেছিলেন মাত্র ১২৯ টি। ২০১৭ সালের টি-টুয়েন্টি যুগে রান আর বলের পার্থক্যটা খুব সামান্য মনে হলেও ১৯৯৫ সালের প্রেক্ষাপটে সেটা অস্বাভাবিক ছিল। যদিও বর্তমান যুগেও ১২৯ বলে ১৬৯ রানের ইনিংস ক্লাসিক্যাল বলেই গণ্য হয়। ধর্মসেনার একটা নিরীহ দর্শন বলে যখন আউট হন তখন বল বাকি আছে ৩৩ টি। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলে তৎকালীন ১৮৯ রানের রেকর্ডটা যে তিনি নিজের করে নিতেন সেটা নিয়ে কারো মনে এখন পর্যন্ত কোন দ্বিধা নেই। এর পরপরই তিনি খেলতে যান ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ।
এর আগেও তার একটি বিশ্বকাপ খেলা হয়েছে। সেখানে ৪৭.৫৭ গড় আর ৮১.৬২ স্ট্রাইক রেটে ৩৩৩ রান কিংবা ৮ ইনিংসে ৪টি ফিফটি খুব খারাপ পারফর্মেন্স নয়। কিন্তু সেটি মোটেও লারা সুলভ ছিল না, তাই এই বিশ্বকাপটা লারার জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জের ছিল। তবে সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল শক্তির দিক থেকে বেশ দুর্বল। এছাড়া অধিনায়কত্ব নিয়ে রিচি রিচার্ডসনের সাথে লারার দ্বন্দ্ব অনেকটাই সামনে এসে পড়েছে। প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৩১ বলে অপরাজিত ৪৩ রানের ইনিংস খেললেও পরের দুই ম্যাচে ভারত আর কেনিয়ার বিপক্ষে করলেন মাত্র ২ আর ৮ রান। দলও হেরে খাদের কিনারায় চলে গেল। শ্রীলংকার মাটিতে নিরাপত্তার জন্য খেলতে না যাওয়ায় গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ার শঙ্কায় পড়লো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গ্রুপের শেষ ম্যাচ ফেভারিট অস্ট্রেলিয়ার সাথে। সেই ম্যাচে ৭০ বলে ৬০ রানের একটা অসাধারণ ইনিংস খেললেন লারা। দল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলো তবে সামনে পড়লো সেই বিশ্বকাপের সবচেয়ে দুর্দান্ত খেলা দক্ষিণ আফ্রিকা।
দক্ষিণ আফ্রিকা সেই বিশ্বকাপে শুধু অপরাজিত থেকেই গ্রুপ থেকে উঠে আসেনি, বরং প্রতিপক্ষকে সামান্য সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাই তারা ছিল নিরঙ্কুশ ফেভারিট। সেই ম্যাচে লারা করলেন ম্যাজিকাল ১১১ রান, সেটাও মাত্র ৯৪ বলে। সিমকক্সের এক ওভারে ৫ টি চার মেরে দক্ষিণ আফ্রিকানদের চোখ ধাঁধিয়ে দিলেন। মোটামুটি একা হাতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে গেলেন পরের পর্বে।
সেমিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেললেন ৪৫ বলে ৪৫ রানের একটা ইনিংস। যতোক্ষণ ক্রিজে ছিলেন ততোক্ষণ একবারের জন্যেও মনে হয়নি যে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারতে পারে। শেষ পর্যন্ত আউট হলে স্টিভ ওয়াহর একটা অসাধারণ আউট সুইং এ, বেইলস পড়ার জন্য ঠিক যতটুকু স্পর্শ প্রয়োজন ততটুকুই পেল। লারা আউট হবার পর অস্ট্রেলিয়াকে মাত্র ৫ রানে ম্যাচটা জেতালেন আরেক গ্রেট শেন ওয়ার্ন। মোটামুটি সেই বিশ্বকাপের পর থেকেই লারার পতনের শুরু। বোর্ডের সাথে ঝগড়া করে নিজেকে সরিয়ে নিলেন দল থেকে। পরে ফেরত আসলেও মাঝের তিনটি বছর খেলে গেলেন অ্যাভারেজ খেলোয়াড়ের মতো। কিন্তু নিজেকে আবার ফিরে পেলেন ১৯৯৯ সালে সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটা সিরিজে।
৪
অস্ট্রেলিয়া তখন টেস্টে সর্বজয়ী দল। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবস্থা ভাঙ্গাচোরার চেয়েও খারাপ। প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জিতলো ৩১২ রানের বিশাল ব্যবধানে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংসে আউট হলো মাত্র ৫১ রানে, লারা প্রথম ইনিংসে ৬২ রান করলেও দ্বিতীয় ইনিংসে করলেন মাত্র ৩ রান। দ্বিতীয় টেস্ট লারার ২১৩ রানের উপর ভিত্তি করেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেন মনোবল ফিরে পেল। নাহলে মাত্র ৫ রানেই ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফেরত আসার মতো দল অন্তত সেই সময়ে ছিল না। সেই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতে ১০ উইকেটে। এর পরের ম্যাচেও ব্রায়ান লারার দুর্দান্ত ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আরেকটা অসাধারণ জয় পায়। ৩১১ রানের টার্গেটে নেমে ১০৮ রানেই ৫ উইকেট পড়ে যাবার পরেও লারার অপরাজিত ১৫৩ রানের ইনিংসের সুবাদে ১ উইকেটের জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
৪র্থ টেস্টে ৮২ বলে ১০০ রানের একটা ইনিংস খেলার পরেও অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরে যায়। তবে মোটামুটি একা হাতেই সেই শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ ড্র করায় ব্রায়ান লারা। অথচ সেই সিরিজেই ম্যাকগ্রার মতো বোলার পেয়েছেন ৩০ টি উইকেট। রানতো অনেক ব্যাটসম্যানই করতে পারে, কিন্তু প্রতিপক্ষ বোলার উইকেটে আগুন জড়াচ্ছে, আর একটা উইকেট পড়লেই বিপদ, আস্কিং রান রেটের চাপও প্রচুর– এমন অবস্থাতেও অনেক ব্যাটসম্যানই রান করেছেন। কিন্তু রান করে জিতিয়েছেন এমন ক্ষণজন্মা ব্যাটসম্যানদের মাঝে ব্রায়ান লারা একজন। বিপক্ষ দলের সবাই জানতো লারাকে আউট করার অর্থ হচ্ছে ৮০% ম্যাচ জিতে যাওয়া। অথচ লারা একটু খামখেয়ালী ধরণের ছিলেন। এমনও হয়েছে ব্যাটিং এ নেমে লারা সন্ধ্যায় হাসপাতালে, সেখান থেকে রিলিজ নিয়ে গভীর রাতে আবার নাইট ক্লাবে, পরের দিন মাঠে নেমে সেঞ্চুরি। জিনিয়াস বলেই হয়তো এমটি সম্ভব। তবে যতই জিনিয়াস হোক একজনের পক্ষে প্রতিদিন একা দলকে জেতানো সম্ভব নয়। এমনকি নিজে কিছু দানবীয় ইনিংস খেললেও না।
৫
ব্রায়ান লারা যুগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল পুরোপুরি তার উপর নির্ভর ছিল। একজন ব্যাটসম্যান একটা দলের কতটা সমার্থক হতে পারে? প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি সেটি বুঝবেন কিভাবে?
ব্যাপারটা অনেক ভাবেই বুঝা যায়। এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যে, ব্রায়ান লারার সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট রানের ২০% তার করা। এই ক্ষেত্রে তার উপরে আছেন মাত্র দুজন। একজন ব্র্যাডম্যান (২৩%) এবং অন্যজন হলেন ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান খ্যাত জর্জ হেডলি (২১%)। ব্র্যাডম্যান আর জর্জ হেডলি ছিলেন ব্যতিক্রম। তারা এতোটাই রান করতেন যে দলের বাকি ব্যাটসম্যানরা হয়তো সুযোগই পেতেন না। কিন্তু ব্রায়ান লারার সময়ে উইন্ডিজ দলে সত্যিকার অর্থেই ব্যাটসম্যান আর বোলারের আকাল পড়ে গিয়েছিল। এর মূল কারণ ধরা হয়, তখনকার বেশিরভাগ তরুণেরাই আকৃষ্ট হতো বাস্কেটবলে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ টেস্টের একটা সিরিজে দলের মোট রানের ৪২% ছিল তার করা, যা কিনা একটি রেকর্ড। ৩ টেস্টে রান করেছিলেন ৬৮৮ রান। সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে মুরালিধরন আনপ্লেয়েবল হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম টেস্টে নিলেন ১১ উইকেট, ২য় টেস্টে ১০ উইকেট। উইন্ডিজ ব্যাটসম্যানরা তার বল বুঝতেই পারছিলেন না। কিন্তু এর মাঝেও ব্যতিক্রম ছিলেন ব্রায়ান লারা।
সেই সিরিজের একটা ঘটনা। রামনরেশ সারওয়ান কিছুতেই মুরালির দুসরা বুঝতে পারছিলেন না। কিভাবে দুসরা পিক করতে হবে সেটা ব্রায়ান লারা বার বার বুঝিয়ে বলার পরেও কোন কাজ হচ্ছিল না। পরের ওভারে ছক্কা মারার পর সারওয়ানকে ঢেকে বললেন ‘ওটা ছিল দুসরা’। সেই সিরিজে মুরালির বিপক্ষে লারার রুদ্রমূর্তি দেখে হোয়াটমোর বলেছিলেন, “ও যেভাবে স্পিনের বিপক্ষে ড্রাইভ করছে, সুইপ করছে, এক কথায় তা অবিশ্বাস্য। সাপের মতো স্পিনিং ট্র্যাকে টার্নের বিপক্ষে অমন শট খেলতে আমি আর কাউকে দেখিনি।”
প্রথম দুই ম্যাচে যদি মুরালিধরন তাণ্ডবলীলা ঘটিয়ে থাকেন তাহলে তৃতীয় টেস্টটা ছিল চামিন্দা ভাসের। দুই ইনিংস মিলিয়ে ভাস পেয়েছিলেন ১৪ টি উইকেট, প্রতি ইনিংসে ৭ টি করে। সেই টেস্টে লারা করেছিলেন দলের মোট রানের ৫৩.৮৩ শতাংশ, যা কিনা দলীয় মোট রানের মাঝে একজন ইন্ডিভিজুয়ালের সর্বোচ্চ অবদান। দুই ইনিংসে করেছিলেন যথাক্রমে ২২১ আর ১৩০। তবে সেই ম্যাচের ফলাফল ছিল প্রায় আঁতকে উঠার মতো, কারণ ম্যাচটা উইন্ডিজ হেরেছিল ১০ উইকেটে। পুরো সিরিজে একটি ডাবল সেঞ্জুরিসহ ৩টি সেঞ্চুরি আর ১ টি ফিফটি সহকারে ১১৪.৬৭ গড়ে রান করেছিলেন ৬৮৮। সিরিজের ফলাফল শ্রীলঙ্কা ৩, উইন্ডিজ ০। এই সিরিজের পর দুঃখ করে লয়েড বলেছিলেন, ‘ উইন্ডিজ ক্রিকেটের ক্ষয়িঞ্চু সময়ে জন্মানটা লারার দুর্ভাগ্য। একজন খেলোয়াড় এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারেন?’
মাঝে হেইডেন তার সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ডটা ভেঙ্গে ফেলেন। কিন্তু সেটার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৬ মাস। ৬ মাস পরেই লারা রেকর্ডটাকে আবার নিজের করে নিলেন। রেকর্ডটা শুধু ভাঙ্গলেনই না, সাথে ৪০০ রান করে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে গেলেন। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এর আগে কেউ ৪০০ রান করতে পারেননি, এছাড়া ৩৫০+ রানের দুটো ইনিংসও কেউ খেলতে পারেন নি। রেকর্ডের বরপুত্র নামে পরিচিত ব্রায়ান লারার আরেকটা রেকর্ড হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটের এক ওভারে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। রেকর্ডটা মাত্র ২৮ রানের। এছাড়া এক ওভারে ২৬ রানের আরেকটা রেকর্ড আছে লারার।
৬
লারার তুলনা করা হতো সমসাময়িক ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকারের সাথে। অথচ সেসময়ের বেশীর ভাগ খেলোয়াড় কিংবা বোলাররা তাকে সবসময়েই শচীনের চেয়ে এগিয়ে রাখতেন। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে শচীন যতখানি সাহায্য পেয়েছেন, উইন্ডিজ বোর্ড থেকে তার সামান্যটুকুও পাননি ব্রায়ান লারা। জীবনের শেষ টেস্ট সিরিজেও ৮৯.৬০ গড়ে করেছিলেন ৪৪৮ রান। তাতে একটা ডাবল সেঞ্চুরিও ছিল। কথা ছিল, ২০০৭ বিশ্বকাপের পরে উইন্ডিজের হয়ে শুধু টেস্ট ক্রিকেট খেলবেন। কিন্তু বিশ্বকাপের পরপরই সব ধরণের ক্রিকেট থেকেই অবসর নিয়ে নেন। বিগ ম্যাচ পারফর্মার হিসেবে সবসময়েই পরিচিত ছিলেন ব্রায়ান লারা। অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ একা হাতে জিতিয়েছেন। টেন্ডুলকার থেকে লারাকে এগিয়ে রাখার মূল কারণই এই ম্যাচ জয়ের ক্ষমতা। তবে বাকি ফ্যাক্টরগুলোতে শচীন অনেক খানিই এগিয়ে। এই সম্পর্কে পন্টিং এর কথাটা শুনতে পারেন,
‘পরদিন টেন্ডুলকার ব্যাটিং করবে জানলে আমার রাতের ঘুমে সমস্যা হতো। কিন্তু ব্যাটসম্যানের নাম লারা হলে রাতটা বিনিদ্রই কাটতো। চাইলে টেন্ডুলকারকে আটকে রাখার একটা পথ বের করা সম্ভব ছিল, কিন্তু লারা আধঘণ্টার মধ্যে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারতো। আমার কাছে সেঞ্চুরির চেয়ে ম্যাচ বা সিরিজ জেতানোটাই সব সময় বেশী মূল্য পেয়ে এসেছে।’
তবে এই কাজটা যে সবসময় লারা করতে পেরেছেন তা কিন্তু নয়। ক্যারিয়ারের কিছু সময় পেরেছেন, কিছু সময় পারেননি। কিন্তু যেদিন পেরেছেন সেদিন সেরা ফর্মের ম্যাকগ্রাকেও নিস্তার দেননি। এই কারণেই গত শতাব্দীর সেরা ১০০ টি টেস্ট ইনিংসের তালিকায় লারার ৩টি ইনিংস জায়গা পায় (২, ১০ আর ১৪ নম্বরে)। কিন্তু টেন্ডুলকারের যেন সেখানে প্রবেশাধিকারই নেই। ওয়ানডেতেও সেরা ১৫ তে লারার তিনটা ইনিংস। শচীনের একটিও নেই।
৭
একজন খেলোয়াড় তার ক্যারিয়ারের প্রতিটি ম্যাচেই পিক ফর্মে থাকতে পারেন না। যেদিন থাকেন সেদিন প্রতিপক্ষকে কাঁদিয়ে ছাড়েন। ব্যাটসম্যানদের জীবনে মাঝে মাঝে এমন দিন আসে, যেদিন সে যা ইচ্ছে করতে পারে। ইয়র্কার বলকে অবলীলায় ছয় মারে, মিডেল স্ট্যাম্পের বলকেও কাভার ড্রাইভ করার সাহস পায়, গুড লেন্থের বল অনায়াসে গ্যালারীতে পাঠিয়ে দেয়। তবে এসব দিনে যদি ব্যাটসম্যানের রানটা বড় না হয়, খুব ভালো খেলেও করতে পারলো মাত্র ৪০ রান তাহলে সেই দিন দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু এমনও ব্যাটসম্যান আছেন যারা এই সব দিনে তাদের রানটাকে বড়ও করতে পারেন। ব্যাটসম্যানদের জন্য এই দিনগুলোকে বলা যায় সর্বোচ্চ পিক টাইমের দিন। এই দিনটিতে তারা কিছুটা অমানবীয় হয়ে যান। কোন বোলারকেই সেদিন বোলার মনে হয় না। বোলাররাও শুধু প্রার্থনা করতে থাকেন যেন ব্যাটসম্যান কোন ভুল করেন। এছাড়া মাফ পাওয়ার আর কোন উপায় নেই।
একইভাবে বোলারদের ক্যারিয়ারেও এমন দিন আসে যেদিন তারা সম্পূর্ণভাবে আনপ্লেয়েবল হয়ে যান। সেদিন ব্যাটসম্যানদের কোন সুযোগই থাকে না রান বের করার। রান বের করা দূরে থাক, সেদিন টিকে থাকাই কষ্ট হয়ে যায়। এরকম দিনে অনেক সময় ভালো বল করেও ভাগ্যের কারণে বোলাররা উইকেট পায় না। তবে এরকম বল করে ৬/৭ উইকেট পাওয়া বোলারের সংখ্যাও কম নয়। বোলারদের জন্য এই দিনগুলোকে বলা যায় সর্বোচ্চ পিক টাইমের দিন।
সচরাচর দেখা যায় যেদিন কোন ব্যাটসম্যানের পিক টাইম যায় সেদিন কোন বোলার ডমিনেট করতে পারে না। ব্যাটসম্যানের পিক টাইমে কোন রকম ভাবে মানসম্মান নিয়ে বল করতে পারলেই বোলার খুশি। আবার যেদিন বোলারের পিক টাইম যায় সেদিন কোন ব্যাটসম্যান পাত্তা পায় না। সেই দিনে সংগ্রাম করে রান করতে পারলেই খুশি। কিন্তু খুব কম দিনই আছে, যেদিন কোন ব্যাটসম্যান আর কোন বোলারের পিক টাইমটা একই দিনে আসে। সেদিনই লড়াইটা দেখতে সবচেয়ে মজা। ওয়াসিম আকরামের খারাপ দিনে শচীন টেন্ডুলকার তাকে মাঠ ছাড়া করতেই পারেন কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের অফ ফর্মের দিন ওয়াসিম তার মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিতেই পারেন। It’s a part of the game. কিন্তু ওয়াসিমের বেষ্ট ফর্মের দিন শচীন কিভাবে ম্যাচ বের করে নিয়ে যায় অথবা শচীনের বেষ্ট ফর্মের দিন ওয়াসিম কিভাবে পরিস্থিতি ট্যাকেল দেয় সেটা দেখার একটা আলাদা মজা আছে। এবং সত্যিকারের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এই লড়াইটাই সবসময় উপভোগ্য হয়। তবে আপনি এই ধরণের লড়াই সবসময় দেখতে পাবেন না। একটা ম্যাচে কোন বোলার হয়তো ৭/৮ উইকেট পেল ঠিক সেই ম্যাচেই আরেক ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করে ম্যাচ বাঁচিয়েছে কিংবা নিজের সাধ্যমত মতো চেষ্টা করেছেন এমন ইনিংসের পরিমাণ খুবই কম। যদিও কয়েকজন খেলোয়াড় এমনটা খেলেছেন তবুও ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ২/৩ বার হয়তো করেছেন। কিন্তু কোন ব্যাটসম্যান যদি ক্যারিয়ারে অসংখ্য বার এমন ইনিংস খেলে থাকেন তাহলে তাকে ঠিক কি বলা যায়? অতিমানব বললে হয়তো কিছুটা মিলে যায়। ব্রায়ান লারা ছিলেন ঠিক এমনই একজন অতিমানব।
৮
২০০৭ বিশ্বকাপের ২১ এপ্রিল। ইংল্যান্ড আর উইন্ডিজের বিপক্ষে গুরুত্বহীন একটা ম্যাচ। উইন্ডিজ আগেই বাদ পড়ে গিয়েছে। শেষ ম্যাচটা নিয়ম রক্ষার একটা ম্যাচ। কিন্তু সেই নিয়ম রক্ষার ম্যাচটাই অনেক বিগ ম্যাচের চেয়ে আকর্ষণীয়। কারণ এই ম্যাচটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্রায়ান লারার শেষ ম্যাচ। রাজার মতোই খেলা শুরু করলেন ব্রায়ান লারা। তিনটা চারের সাহায্যে ১৭ বলে করলেন ১৮ রান। কিন্তু সতীর্থ স্যামুয়েলসের ভুলে রান আউট হয়ে গেলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শেষ ইনিংসে উইকেটটা কোন বোলারকে দিবে না হয়তো, উপরওয়ালা লিখে রেখেছিলেন। মাঠ থেকে বের হয়ে যাবার সময় ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকদের দিকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন ব্রায়ান লারা, ‘ডিড আই এন্টারটেইন’?
উত্তরটা সবারই জানা, বরং এই মুহূর্তে প্রশ্নটা এমন হওয়া উচিত যে ব্রায়ান চার্লস লারা চলে যাওয়ার পর ক্রিকেট কি আর এমন এন্টারটেইনার পেয়েছে যে কিনা প্রবল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথেও প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচ এক হাতে জিতিয়ে ফেরত আসতেন।
Featured photo: Getty Images