ক্রিকেটের শুরুটা টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে হলেও, সময়ের সাথে সাথে ৬০ ওভার, ৫০ ওভার এবং সর্বশেষ ২০ ওভারের আগমনে খেলাটি বর্তমানে রান সর্বস্ব খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বোলারদের প্রাধান্য কমে গিয়ে তাই ব্যাটসম্যানদের দাপট প্রতিনিয়ত যেন বেড়েই চলেছে। ২০ ওভারের ম্যাচে ২০০ বা ৫০ ওভার ম্যাচে তাই ৪০০ রান দেখলেও এখন আর কাউকে হতবাক হতে দেখা যায় না। তবে যাদের ক্রিকেটের সাথে বেড়ে ওঠা, তাদের কাছে পরিবর্তনের হাওয়াটা কিছুটা হলেও যেন উষ্ণতা ছড়াতে বাধ্য।
একটা সময় ছিল, যখন পঞ্চাশ ওভারের একদিনের ম্যাচে দলীয় ২০০ রান তুলতেই অনেক দলকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয়েছে। অথচ বর্তমানে অনেক খেলায় এক ম্যাচে ব্যক্তিগত ২০০ রানের গণ্ডি পেরুতেও যেন তেমন বেগ পেতে হয় না। তবে এখনো পর্যন্ত ৫০ ওভারের ম্যাচে ব্যক্তিগত ২০০ রান করার ঘটনা মাত্র ৭টি, যার মধ্যে ৫টিই ভারতীয়দের দখলে। আর ২০০ রানের রেকর্ডের মালিক হিসেবে আছেন মোট পাঁচজন খেলোয়াড়। সেই পাঁচজনকে নিয়েই আমাদের আজকের লেখা।
শচীন টেন্ডুলকার
এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্যক্তিগত ২০০ রানের গণ্ডি পেরুতে দেখা অনেকটা সময় পর্যন্ত ক্রিকেট ভক্তদের কাছে একধরনের স্বপ্নের মতোই ছিল। ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত ২০০ রানের মাইলফলকের খুব কাছাকাছি গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার তালিকায় রয়েছেন জিম্বাবুয়ের কোভেন্ট্রি (১৯৪), পাকিস্তানের সাইদ আনোয়ার (১৯৪), শ্রীলঙ্কার জয়াসুরিয়া (১৮৯), নিউজিল্যান্ডের গাপটিলের (১৮৯) মতো খেলোয়াড়। সকলের মাঝে যেন একধরনের অবিশ্বাস কাজ করতো যে, এক দিনের ম্যাচেও ব্যক্তিগত ২০০ রান করা সম্ভব!
২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের গোয়ালিয়রের ক্যাপ্টেন রূপসিংহ স্টেডিয়ামের পঁয়তাল্লিশ হাজার দর্শক যেন সাক্ষী হলেন সেই অসাধ্য সাধনের। সাউথ আফ্রিকার সাথে ভারতের সেই ম্যাচে ব্যাটিং বিস্ময় শচীন টেন্ডুলকার দ্বিশতক হাঁকিয়ে করে পুরো পৃথিবীকে জানান দিলেন, অসম্ভব বলে কিছু নেই। সাউথ আফ্রিকার সাথে সেই ম্যাচে ১৪৭ বল খেলে শচীন ২৫টি চার ও তিনটি ছক্কার সাহায্যে অপরাজিত থেকে গড়ে তোলেন এই অনন্য রেকর্ড। এই কিংবদন্তীর ব্যক্তিগত অনেক রেকর্ডের মধ্যে ২০০ রানের এই ইনিংসটি ক্রিকেট ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা। শচীনময় সেই ম্যাচে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দলীয় ৪০১ রান করে বিশাল জয় ছিনিয়ে আনে।
বীরেন্দর শেবাগ
ভারতীয় ক্রিকেটের একসময়ের অনন্য জুটি ছিলেন শচীন টেন্ডুলকার এবং বীরেন্দর শেবাগ। বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম মারকুটে ওপেনিং জুটি ছিলেন এই দুজন। তাই শচীনের সাথে তাল মিলিয়েই যেন ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালে ভারতের ইন্দোরে শেবাগ এক অসাধারণ ইনিংস খেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
১৪৯ বল খেলে ২৫ টি চার ও ৭ টি ছক্কা মেরে শেবাগ করেন ২১৯ রান। শেবাগের হাত ধরে ভারতের দলীয় রান দাঁড়ায় ৪১৮ রানে। বলাই বাহুল্য, বিশাল রান ব্যবধানে সেই ম্যাচে ভারত জয় ছিনিয়ে আনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।
ক্রিস গেইল
বিশ্বের সকল বোলারের জন্য ত্রাস সৃষ্টিকারী ব্যাটসম্যানের নামটি হয়তো সকলেই এক বাক্যে স্বীকার করবেন। আর এমন এক বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানের নামের পাশে ২০০ রান করার কীর্তি থাকবে না; এমনটি যেন মানাই যায় না।
২০১৫ সালের ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, অস্ট্রেলিয়ার কেনাবেরাতে অনুষ্ঠিত ২০১৫ এর বিশ্বকাপের ১৫তম ম্যাচে ক্রিস গেইল এক বিধ্বংসী ইনিংস উপহার দেন পুরো বিশ্বকে। সেই ম্যাচে দলীয় ৩৭২ রানের মধ্যে ২১৫ রানই করেন ক্রিস গেইল। জিম্বাবুয়ের বোলিং শক্তিকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে চার আর ছক্কার বর্ষণ ছড়িয়ে দিতে থাকেন ক্রিস গেইল। এই ম্যাচে ক্রিস গেইল ১০টি চার আর ১৬টি ছক্কা দিয়ে সাজান তার ইনিংস।
মার্টিন গাপটিল
পাওয়ার ক্রিকেটের নাম এলেই নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিলের নাম অনায়াসেই চলে আসে। পুরো বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের বেশ কিছু চমৎকার ইনিংস উপহার দিয়েছেন এই ক্রিকেটার। তেমনি একটি চোখ ধাঁধানো ইনিংস ছিল ২০১৫ সালের আই সি সি’র বিশ্বকাপের চতুর্থ কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচটি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচটিতে ১৬৩ বল খেলে ২৪টি চার ও ১১টি ছক্কার সাহায্যে করেন অপরাজিত ২৩৭। নক আউট রাউন্ডের ঐ ম্যাচে নিউজিল্যান্ড ১৪৩ রানের বিশাল ব্যবধানে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অপরাজিত ১৮৯ রান এবং ২০১৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে অপরাজিত ১৮০ রান করেও ২০০ রানের মাইলফলক ছোঁয়ার আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি এই ক্রিকেটার। এখনও ক্রিকেটের সকল শাখায় বেশ দাপটের সাথে খেলে চলেছেন এই অনন্য প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান।
রোহিত শর্মা
২০০ রানের মাইলফলক ছোঁয়া যেন অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় এবং প্রতিভাবান খেলোয়াড় রোহিত শর্মা। কিছুটা ধীরগতির খেলোয়াড় বলা হলেও, যখন একবার ক্রিজে জেঁকে বসেন, তখন বোলাররা পপিং ক্রিজের ঠিক কোথায় বল ফেলাটা নিরাপদ তাই যেন হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন। যেখানে প্রত্যেক ব্যাটসম্যান জীবনে একবার ২০০ রানের মাইলফলক পেরুনোকে জীবন চরম প্রাপ্তি বলে ধরে নিতে ব্যস্ত, সেখানে রোহিত শর্মা তিন-তিনবার এই কীর্তি করিয়ে দেখিয়েছেন!
২০১৩ সালে চরম শক্তিশালী দল অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের বেঙ্গালুরুতে প্রথম ২০০ রানের কীর্তি গড়েন রোহিত। ১৫৮ বল খেলে ১২টি চার আর ১৬টি ছক্কা দিয়ে সাজান ছিল তার ২০৯ রানের এই অনবদ্য ইনিংস। এর ঠিক পরের বছর কলকাতা ইডেন গার্ডেন সাক্ষী হয়েছিল এক বিধ্বংসী অতি দানবীয় ব্যাটিংয়ের। শ্রীলঙ্কার সাথে সেই ম্যাচে ১৭৩ বলে ৩৩টি চার ও ৯টি ছক্কা দিয়ে সাজান তার ২৬৪ রানের অনবদ্য ইনিংসটি, যা এখনও পর্যন্ত ক্রিকেটের ইতিহাসে একদিনের ম্যাচে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান। ১৫২.৬০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করে ভারতকে সেই ম্যাচে দলীয় চারশ রানের গণ্ডি পার করান রোহিত। খুব সম্প্রতি ভারতের মোহালিতে শ্রীলঙ্কার সাথে তৃতীয়বারের মতো রোহিত ২০০ রানের কোটা পার করে আবার হতবাক করেন পুরোবিশ্বকে। ১৫৩ বল খেলে ১৩টি চার ও ১২টি ছক্কার বদৌলতে তার রান দাঁড়ায় অপরাজিত ২০৮। বিশ্ব ক্রিকেটে শুধুমাত্র রোহিত শর্মাই আছেন, যিনি একের অধিকবার একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে দুশোর বেশি রান করেছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রেকর্ডের কোনো সীমারেখা নেই। প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে রেকর্ড। কেউ ভাঙছেন, অন্যদিকে নতুন কেউ গড়ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন কিছু রেকর্ড রয়ে যায়, যা ক্রিকেটের দর্শকদের সবসময়ই অবাক করে তোলে। কিছু রেকর্ডের আবেদন কখনো মুছে যাওয়ার নয়। টি-টোয়েন্টির এই রমরমা সময়ে যখন শুধু মারকুটে ব্যাটিং দেখার আশায় খেলা দেখতে বসেন অনেকে, তখন এই ধরনের রানের রেকর্ডগুলো আবার ভালো ব্যাটিং, খেলোয়াড়ি মান এবং ওয়ানডে খেলার আবেদনকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ফিচার ইমেজ- The Independent