রমজানে টিভির দোকানগুলো রকমারি অফার দিচ্ছে। সারাদিন তো বটেই, সন্ধ্যের পর ভিড় আরও বাড়ে। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দেখেন, টিভি কেনেন। নতুন দম্পতিরা বারবার আসেন। সুশ্রী চেহারার নতুন বউ লাজুক মুখে নখ খুঁটে খুঁটে টিভির ফিচারগুলো দেখেন, হাতে করে একটা কাগজ নিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়েও রাখেন। গিন্নীর ভাব ধরে, আলগোছে ছবি তুলে নিয়ে যান নিজের ফোনে। ঘরে ফিরে জমানো টাকার সাথে টিভির নান্দনিকতার যাচাইবাছাই হবে। দোকানগুলো তাই খোলা থাকে অনেক রাত পর্যন্ত।
কিন্তু শুক্রবারের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন ছিল। প্রায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝড়, বায়তুল মোকাররমের প্যান্ডেল ভেঙে একজন নিহতসহ কয়েকজন আহত, সারা দেশে মোট ১৪ জন নিহত, আর পাড়ায় পাড়ায় গাছ ভেঙে একাকার হয়েছে দোকানির খদ্দেরের আশা। সন্ধ্যের পর দম্পতিরা বের হয়েছে কি হয়নি, তারপরও চাইলেও দোকান কিন্তু বন্ধ করা যায়নি!
কেন যাবে? আজ যে দোকানের বাইরে খুব ভিড়! রাত যখন গভীর হওয়ার পথে, তখনই তো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল হাতে পেয়েছে সাত রাজার ধন… পুরুষ দলের প্রথম ট্রফি! কাকতালীয়ভাবে, কাল সন্ধ্যায় যখন এই নাতিশীতোষ্ণ দেশে সারাদিন সূর্য আগুন গিলিয়ে সন্ধ্যায় তুমুল বৃষ্টিতে শহর ভিজিয়েছে, তেমনই ইউরোপের দেশ আয়ারল্যান্ডের মালাহাইডে প্রচণ্ড শীতেও বৃষ্টিতে মাঠ ভাসিয়েছে। বৃষ্টিও থামে, একটা সময়ে খেলা শুরু হয়েছে বৃষ্টি আইনে। মাত্র ২৪ ওভারে ২১০ রান তাড়া করার স্পর্ধাই শুধু দেখায়নি বাংলাদেশ, জিতিয়েও এনেছে ম্যাচ। পরপর ৬ ফাইনালে হারের পর, সপ্তম ফাইনালে জয়। আইসিসি ট্রফির পর এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা। উইন্ডিজের সাথে হোক বা প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড, যে ফাইনাল বারবার ভুগিয়েছে আমাদের, সেখানে ফিরে আসাটা তো কম কথা নয়!
***
ততক্ষণে বলের চেয়ে রান কমে এসেছে। মুশফিকুর রহিম আউট হওয়ার পর রানের চাকা খানিকটা থমকে গিয়েছিল। ভেজা আউটফিল্ডে বল বেশি দূর গড়িয়ে যেতে চায় না। সবার তাই উড়িয়ে মারার চেষ্টা। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ উইকেটে যাওয়ার পর যখন হাল ধরলেন, ড্রেসিংরুমে খানিকটা হলেও ভরসা এসেছিল। কিন্তু কপালের ভাঁজ গাঢ় হচ্ছিল ক্রমশ। যদিও মিঠুন গিয়েই দুখানা বাউন্ডারি মেরে উইন্ডিজ দলকে ঘাবড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়েই তিনি আউট হলেন।
মাঠের বাইরে ডাগআউটে তখন মাশরাফি বিন মুর্তজা একেবারে ভাবলেশহীন। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত যখন সমানে বল উড়িয়ে বাউন্ডারির বাইরে পাঠাচ্ছিলেন, তখনও নিরুত্তাপ। মিরাজ, লিটনদের উত্তেজনা বাড়লেও, দলের এই অধিনায়ক এ দফায় ‘অগ্রিম’ রোমাঞ্চ নিতে নারাজ। এভাবে ‘ধোঁকা’ তো আর কম খাননি তিনি!
সেই মাশরাফিও লাফিয়ে উঠলেন, যখন সৈকত এক রান নিয়ে রিয়াদের সাথে প্রান্ত বদল করেছেন। ততক্ষণে জয়ের জন্য প্রয়োজন ১ রান, হাতে অনেকগুলো বল, ব্যাটিং লাইনআপে আছেন তিনি, মিরাজসহ আরও কয়েকজন। মাশরাফিও বুঝলেন, নাহ! এ দফা আর ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। পরের বলেই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ চার হাঁকিয়ে জয় তুলে নিলেন।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল সাক্ষী হলো প্রথম কোনো ওয়ানডে টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়ের!
***
মালাহাইড শহর থেকে অনেকটা বাইরে স্টেডিয়াম। সবুজে ঘেরা। এখানকার মানুষের ক্রিকেট খুব একটা রোচে না। ওই জার্মানদের মতোই আর কি; যে খেলা পাঁচদিন পরও ফলাফলহীন থাকে, সে আবার কীসের খেলা! অ্যাডলফ হিটলার আইরিশ হলে বোধহয় এখানেও ক্রিকেট বন্ধ করে দিতেন।
এমন একটা দেশে যখন বাংলাদেশ খেলছে, তখন গ্যালারির বাইরে শ’খানেক দর্শক। প্রায় সবাই প্রবাসী বাংলাদেশী। পুরোটা সিরিজজুড়ে তাদের কন্ঠের তোপেই প্রতিপক্ষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল প্রায়। বাংলাদেশ অনেকটাই ‘স্বাগতিক’ অনুভব করেছে কেবল এই কারণে।
তাই তো রেমন রেইফের বলে চার মারতেই শ’খানেক কন্ঠ ফেটে পড়লো কোটি বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীদের কন্ঠ হয়ে!
আর মাশরাফির উচ্ছ্বাস তখন দেখে কে! তিনি লাফাচ্ছেন, বাকি সবাই তাকে জড়িয়ে ধরেছে। মেহেদী হাসান মিরাজ প্যাড পরেই ছুটে বেড়াচ্ছেন এখান থেকে ওখানে। কোচ স্টিভ রোডস খুশিতে সৈকতকে এমনই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন, সৈকতের তখন হাঁসফাঁস অবস্থা।
একটু ফাঁকা পেতেই সৌম্যকে জড়িয়ে ধরে কান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া হাসিতে মাঠের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। পুরস্কার বিতরণীতে যখন তার হাতে ট্রফি তুলে দেওয়া হলো, সেটা নিয়ে মেতে উঠলো পুরো দল। এমনটা আগে কখনও হয়নি। চ্যাম্পিয়ন লেখা বিশাল ব্যানারের সামনে শুয়ে-বসে, দাঁড়িয়ে, কাঁধে হাত রেখে, কত রকমের ভঙ্গিতে গ্রুপ ছবি যে উঠালো এক টুকরো বাংলাদেশ! যে খুশি বারবার কাছে এসেও ফিরে গেছে, সেই খুশি যখন সত্যিই ধরা দেয়, তা কি কোনো বাধা মানে?
***
বিশ্বকাপের প্রস্তুতি হিসেবে আয়ারল্যান্ড সফর করেছিল বাংলাদেশ। স্বাগতিকদের পাশাপাশি উইন্ডিজ দলকে নিয়ে বাংলাদেশ মাঠে নেমেছিল ত্রিদেশীয় সিরিজ। প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছিল বটে, কিন্তু মূল ম্যাচের সবক’টিতে জয়। একটি ম্যাচ বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়েছিল, সেটি ছিল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে।
ফাইনালে জয়ের মূল দুই নায়ক ওপেনার সৌম্য সরকার ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। আগে ব্যাট করা উইন্ডিজ ১ উইকেটে ২৪ ওভারে ১৫২ রান তোলার পর বৃষ্টিতে থমকে যায় ম্যাচ। অবশ্য ম্যাচ পরিত্যক্ত হলে নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু প্রথম ট্রফিটা হয়তো এভাবে পেতে চায়নি ছেলেরা। তাই তো দীর্ঘ সময় পর যখন বৃষ্টি আইনে ২৪ ওভারে ২১০ রানের লক্ষ্য দেওয়া হলো, তাতেও নড়ে যায়নি মাশরাফিবাহিনী।
তামিম ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে সৌম্য ৫৯ রানের জুটি ওপেনিং গড়েছিলেন। এরপর ব্যক্তিগত ১৮ রানে দেশের সেরা ব্যাটসম্যান তামিম ফিরে গেলে দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন সৌম্য। ৪১ বলে ৬৬ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন তিনি। যে কারণে শুরু থেকেই জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করে বাংলাদেশ। সৌম্যের বিদায়ের পর মুশফিকুর রহিম ২২ বলে ৩৬ রানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছিলেন। ১৪ বলে মোহাম্মদ মিঠুনের ১৭ রানের ইনিংসেরও তাৎপর্য কম নয়। এরপর উইকেটে সৈকতকে যে ‘ফ্রি লাইসেন্স’ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন মাশরাফি, তার পরিপূর্ণ ব্যবহার তিনি করতে পেরেছেন। একপাশে রিয়াদ যখন ব্যাকফুটে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, অন্যপাশে সৈকতের ব্যাট কেবলই উঠেছে উপরের দিকে। ফলাফল, ২৪ বলে ৫ ছক্কা আর ২ বাউন্ডারির সাথে ৫২ রানের অপরাজিত ইনিংস। রিয়াদ ২১ বলে ১৯ রান করে একইভাবে অপরাজিত ছিলেন। বাংলাদেশ ফাইনালে জিতে যায় ৭ বল হাতে রেখে ৫ উইকেটের ব্যবধানে।
পঞ্চপাণ্ডবের ফর্মের দৌরাত্ম্যে যখন তরুণদের নিয়ে টিম ম্যানেজমেন্টের কপালে ভাঁজ পড়ছিল, তখন তামিমের দ্রুত আউট হওয়া আর সাকিবের অনুপস্থিতির মধ্যেও তরুণরাই হাল ধরে মনে করিয়ে দিল, ‘আমরাও ফুরিয়ে যাইনি’!
***
২০১৮ সালে একটা ভিডিও খুব ভাইরাল হয়। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুমে মাশরাফি-সাকিব-তামিম-মুশফিকদের টেলিভিশনে একটি জয় দেখে বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে ওঠার ভিডিও। জয়টা ছিল বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের। নারী এশিয়া কাপে জাহানারা-সালমারা ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে এটাই প্রথম শিরোপা, যেটা পুরুষদের আগে অর্জন করেছে নারীরা।
তাই তো মাশরাফি নিজেদের এই অর্জনের কথা বলতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে সবার আগে স্মরণ করলেন মেয়েদের কথা,
‘একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের প্রথম ট্রফি আমাদের মেয়েরা এনে দিয়েছে গত এশিয়া কাপে। ছেলেদের একটি ট্রফির অপেক্ষা ছিল, সেটি হলো। আকরাম ভাই, বুলবুল ভাইরা ২২ বছর আগে আইসিসি ট্রফি জিতেছিলেন। ওই পর্যায়ে সেটিও ছিল প্রথম, একটি ইতিহাসও। ভালো লাগছে যে আমরা, আমাদের এই দল ছেলেদের প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের ইতিহাসের অংশ হতে পেরেছি।’
কে জানে, সালমারা হয়তো শক্তি পেয়েছেন মাশরফিদের থেকেই। অন্যদিকে, মাশরাফিদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছেন এই মেয়েগুলোই!
***
সন্তানহীন দম্পতিই কেবল সন্তানের মর্ম বোঝেন। তাই অনেক সময় পর যখন ঘর আলো করে সন্তান আসে, তাকে নিয়ে তাদের পৃথিবী খুশিতে ভরে ওঠে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হয়তো এই ট্রফি খুব একটা ফারাক করবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাছে এই ট্রফিটিই অনেক অপেক্ষার পর জন্ম হওয়া সন্তানের মতো। যাকে ঘিরে আলোকিত হয় সবকিছু, বেড়ে যায় আত্মবিশ্বাসের পারদ।
ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তগুলোর তালিকায় লেখা হয়ে থাকবে ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনাল ম্যাচটি। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ বলে হেরেছিল বাংলাদেশ। সাকিব-রিয়াদ-মুশফিক-বিজয়ের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল পুরো গ্যালারি। হয়তো মাঠের বাইরে শত শত কিলোমিটার দূরেও লুকিয়ে চোখ মুছেছিলেন সেই সমর্থকটি, যিনি কোনোদিন ক্রিকেট বুঝতেও চাননি।
চার বছর পর আবারও সেই এশিয়া কাপেই ভারতের বিপক্ষে নিদাহাস ট্রফির ফাইনালেও চোখের পানিতে হারিয়ে গেছেন মাশরাফিরা। সর্বশেষ এশিয়া কাপেও ট্রফি থেকে ১ রান দুরত্বে থেকে শিরোপার হাতছানি মিয়ে গিয়েছিল। নিদাহাস ট্রফির মতো এবারও প্রতিপক্ষ ছিল ভারত।
গেল বছরের শুরুর দিককার কথা। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজ। ফাইনালে স্বভাবতই বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলঙ্কা। এবারেও ট্রফিটা হাতে উঠল না মাশরাফিদের। কেবল এই ফাইনালে এলেই যেন আটকে যায় সবকিছু!
‘চ্যাম্পিয়ন’ লেখা বিশাল ব্যানার দেখে বারবার হয়তো রোমাঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। হয়তো ভেবেছে, একদিন তারাও হাসিমুখ করে দাঁড়াতে পারবে ঠিক একইভাবে।
বিশ্বকাপ হোক না হোক, ৬ ফাইনালের পর ‘লাকি সেভেন’ নামক কুসংস্কার হয়তো এখন থেকে দলের সব্বাই বিশ্বাস করবেন। কেন করবেন না, এই সাতেই যে কাটলো ফাঁড়া!
***
সিরিজশেষে তামিম ইকবাল পথ ধরেছেন ওমানের, আর মাশরাফি বাংলাদেশের। বাকিদের সবাই বিশ্বকাপের মিশনে ইংল্যান্ডে। তামিম-মাশরাফির এই ছোট্ট ছুটিটা যে অন্য যেকোনো ছুটির চেয়েও সেরা কাটবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আর এমন খুশির উদযাপনে পরিবারের চেয়ে বড় উপলক্ষ আর কী হতে পারে! হয়তো আকাশপথে গন্তব্যে যেতে যেতে স্বচ্ছ জানালার ওপারে তুলোর মতো মেঘকে ইশারা করে বলছেন,
‘মেঘবালিকা, একটা ট্রফির গল্প শোনো…’