রাশিয়াতে অনুষ্ঠিত ২০১৮ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড যাচ্ছে অনেকটাই আন্ডারডগ হিসেবে। স্পেন, ব্রাজিল, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, বেলজিয়াম এসব দলের সাথে তুলনা করলে ইংল্যান্ডের এবারের স্কোয়াড নিতান্তই দুর্বল। তবে খুব বেশি দিন আগের কথা নয় যখন ইংল্যান্ডের স্কোয়াড ছিল বিশ্বমানের প্রতিভা দিয়ে পূর্ণ। জন টেরি, সল ক্যাম্পবেল, রিও ফার্ডিনান্ড, অ্যাশলি কোল, ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, স্টিভেন জেরার্ড, পল স্কোলস, ডেভিড ব্যাকহাম, ওয়েইন রুনি, মাইকেল ওয়েন এসব অসাধারণ খেলোয়াড় খেলতেন ইংল্যান্ড দলে। মিডিয়া এই দলকে অভিহিত করতো ‘দ্য গোল্ডেন জেনারেশন’ হিসেবে।
কিন্তু এই গোল্ডেন জেনারেশন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছিল ব্যর্থ। ২০০২ ও ২০০৬ বিশ্বকাপ এবং ২০০৪ ইউরোতে তারা বাদ পড়ে কোয়ার্টার ফাইনালে। ২০১০ বিশ্বকাপে ২য় রাউন্ডে জার্মানির কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে পরাজিত হয় তারা। আর ২০০৮ ইউরোতে তো তারা বাছাই করতে পারেনি! যে খেলোয়াড়েরা সে সময় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মাতিয়েছেন, তারাই আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্যের কোনো দেখা পাননি। ফলে ১৯৬৬ সালের পর থেকেই ইংল্যান্ড দলের কাছে একটি আন্তর্জাতিক শিরোপা এখনো অধরা।
কেন এই ইংল্যান্ড দল তারকা দিয়ে পরিপূর্ণ থাকার পরেও এর কোনো সুফল নিতে পারেনি? এর পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ।
১) ক্লাব প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ইংল্যান্ড দলের খেলোয়াড়দের মাঝে ক্লাব প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বিরাট আকারে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তারা অন্য ক্লাব দলের ফুটবলারদের সাথে মানিয়ে চলতে পারতেন না। এমনকি খাবার টেবিলেও দেখা যেত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, আর্সেনাল, লিভারপুল এদের খেলোয়াড়রা একই টেবিলে বসতেন নিজেদের ক্লাব সতীর্থদের মধ্যেই। নিজেদের মধ্যে এই বন্ধনের অভাব তাঁদের খেলাতেও প্রভাব বিস্তার করত।
এক ইন্টারভিউতে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড ও রিও ফার্ডিনান্ড দুজনেই এই ব্যাপার স্বীকার করেন। তারা দুজনেই ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেড দল থেকে উঠে এসেছেন। টিন এজ বয়স থেকেই তারা ছিলেন একে অপরের বন্ধু। অথচ রিও ফার্ডিনান্ড ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ও ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড চেলসির খেলোয়াড় হবার পরে তাদের মধ্যে কথাবার্তাই বন্ধ হয়ে যায়! নিজেদের মধ্যে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এই পুরনো বন্ধুদের সম্পর্কে পড়ে যায় বিশাল ব্যবধান, যা তাদের ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময় প্রভাবিত করতো। এমনকি ইংল্যান্ডের ফুটবলাররা প্রয়োজনীয় ট্যাকটিকাল ব্যাপারগুলোতেও একে অপরের সাথে কথা বলতে চাইতেন না এই ভয়ে যে, নিজ ক্লাব দলের সম্পর্কে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তারা ফাঁস করে দিবেন।
২) উপযুক্ত ম্যানেজারের অভাব
২০০২ বিশ্বকাপ, ২০০৪ ইউরো ও ২০০৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ম্যানেজার ছিলেন সভেন-গোরান এরিকসন। বিশাল সময় ধরে ইংল্যান্ডের ম্যানেজার থাকলেও এরিকসন খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করতে কখনোই সক্ষম হননি। তার নেতৃত্বে ইংল্যান্ড দলের পারফর্মেন্স ছিল হতাশাজনক। এই টানা তিনটি টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ড বাদ পড়ে কোয়ার্টার ফাইনালে। ২০০৬ সালে তিনি বিশ্বকাপের সময় ইংল্যান্ডের ফুটবলারদের তাদের নিজেদের বউ বা গার্লফ্রেন্ডের সাথে থাকার অনুমতি দেন, যার জন্য তিনি মিডিয়ার কাছে ভয়াবহভাবে সমালোচিত হন। মিডিয়া মজা করে এই বউ ও গার্লফ্রেন্ডদের নাম দেয় ‘ওয়াগ’ (ওয়াইফ অ্যান্ড গার্লফ্রেন্ড)। রিও ফার্ডিনান্ডের মতে, এই পুরো ব্যাপারটা ছিল একটি সার্কাসের মতো। নিজেদের সহধর্মিণী বা গার্লফ্রেন্ডের সাহচর্য তখন হয়ে গিয়েছিল ইংলিশ ফুটবলারদের কাছে মুখ্য বিষয়, ফুটবল খেলা হয়ে গিয়েছিল গৌণ।
সভেন-গোরান এরিকসনের পরে ম্যানেজার হন স্টিভ ম্যাকলারেন। এই গোল্ডেন জেনারেশনের খেলোয়াড়রা তখন তাদের ক্যারিয়ারের চূড়ায় অবস্থান করছেন। তাই গোটা ইংল্যান্ডের ফ্যানরা ২০০৮ ইউরোকে নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলেন। অথচ স্টিভ ম্যাকলারেনের অধীনে এই ইংল্যান্ড দল ইউরোতে বাছাই করতেই অসক্ষম হয়! এত অসাধারণ খেলোয়াড়দের নিয়ে এই দল ইউরোতেই বাছাই করতে পারলো না, যা পুরো ইংল্যান্ডের জন্য ছিল এক বিশাল লজ্জার বিষয়।
স্টিভ ম্যাকলারেনকে বিদায় দেবার পর ইংল্যান্ডের দায়িত্ব পান ইতালিয়ান ফাবিও ক্যাপেলো। সভেন-গোরান এরিকসনের মূল সমস্যা ছিল তার শান্তশিষ্ট ব্যবহার, অন্যদিকে ক্যাপেলো ছিলেন রাগী হেডমাস্টারের মতো। বিশাল অহংবোধের অধিকারী ইংলিশ ফুটবলাররা ক্যাপেলোর এই আচরণে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। ২০১০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ২য় রাউন্ডেই ছিটকে পড়ে জার্মানির কাছে ৪-১ গোলে হেরে।
৩) যথাযথ ট্যাকটিক্সের অভাব
ইংল্যান্ডের এই গোল্ডেন জেনারেশনকে ম্যানেজাররা খেলিয়ছেন ৪-৪-২ ফর্মেশনে। অথচ একসময়ের জনপ্রিয় এই ফর্মেশনের তখন ছিল অন্তিম মুহূর্ত। বেশিরভাগ বড় আন্তর্জাতিক দলের তখন ৪-৪-২ বাদ দিয়ে ৩ জন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার খেলানো যায় এমন ফর্মেশন ব্যবহার শুরু করেছে। ৪-৫-১ ফর্মেশন তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। কিন্তু ইংল্যান্ডের ম্যানেজাররা ৪-৪-২ এর উপরেই ভরসা করতেন।
ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড এক ইন্টার্ভিউতে ৪-৪-২ ফর্মেশনের সমস্যা তুলে ধরেছিলেন। ৪-৪-২ ফর্মেশনে খেলা মাত্র ২ জন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের পক্ষে বেশ কঠিন ছিল ৪-৫-১ এ খেলা প্রতিপক্ষের ৩ জন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারদের কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়া। অন্যদিকে ইংল্যান্ড দলে সৃজনশীল মিডফিল্ডারের কমতি ছিল না। তাই ইংল্যান্ডের পক্ষে উচিত ছিল কোনো ডায়মন্ড ফর্মেশন খেলানোর চেষ্টা করা। কিন্তু ইংল্যান্ডের ম্যানেজাররা কখনোই ৪-৪-২ এর বাইরে যেতে চাননি, যেখানে খেলবেন মাত্র ২ জন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার।
আর বেশিরভাগ সময়েই এই ২ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতেন ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড ও স্টিভেন জেরার্ড। আলাদা আলাদাভাবে দুজনেই বিশ্বমানের দুই মিডফিল্ডার হলেও তাদের নিজেদের মধ্যে বিন্দুমাত্র বোঝাপড়া ছিল না। এই দুজনকে খেলানোর জন্য সভেন-গোরান এরিকসন পল স্কোলসের মতো সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারকে খেলান বাম উইংয়ে। রাগে-ক্ষোভে পল স্কোলস ২০০৪ ইউরোর পরে জাতীয় দল থেকেই অবসর নিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে দলে কখনো জায়গা হয়নি মাইকেল ক্যারিকের মতো মিডফিল্ডারের। স্টুয়ার্ট ডাউনিং ও শন রাইট ফিলিপসের মতো খুবই সাধারণ মানের দুজন খেলোয়াড় ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন যথাক্রমে ৩৫টি ও ৩৬টি ম্যাচ। আর ক্যারিয়ারের বিরাট সময় ধরে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো দলের মূল একাদশের খেলোয়াড় হয়ে থাকা মাইকেল ক্যারিক ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন মাত্র ৩৪টি ম্যাচ।
ইউরো ২০০৪ এ ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের কাছে হেরে বিদায় নেয়। গ্যারি নেভিল তার আত্মজীবনীতে এই ম্যাচ নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তার মতে, এই ম্যাচে ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য উচিত ছিল পল স্কোলসকে বাম উইং থেকে মাঝে নিয়ে আসা, মিডফিল্ডে আধিপত্য বাড়ানোর জন্য। কিন্তু তৎকালীন ইংল্যান্ড ম্যানেজার সভেন-গোরান এরিকসন উল্টো স্কোলসকে উঠিয়ে নামান ডারিয়াস ভাসসেলকে, যে সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন সাবেক এই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলোয়াড়।
২০১০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের তিন গোলরক্ষকের মধ্যে ডেভিড জেমস খেলবেন বলেই সবাই ধরে নিয়েছিল। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের প্রথম ম্যাচ শুরুর মাত্র ২ ঘণ্টা আগে ম্যানেজার ফাবিও ক্যাপেলো সে সময়ের ওয়েস্টহ্যাম গোলরক্ষক রবার্ট গ্রিনকে জানান, তিনি এই ম্যাচ খেলতে যাচ্ছেন। এই হতবাক করা সিদ্ধান্তে রবার্ট গ্রিন ঘাবড়ে গিয়ে সেই ম্যাচে করে বসেন এক হাস্যকর ভুল। এই ভুলের মাশুল দিতে হয় তাকে পরের ম্যাচে। ২য় ম্যাচ থেকে ক্যাপেলো ডেভিড জেমসকেই খেলানো শুরু করেন। পুরো ইংল্যান্ড ক্যাম্প ক্যাপেলোর এমন সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট ছিল।
এই বিশ্বকাপের ২য় রাউন্ডে জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচে জার্মানির থমাস মুলার গোল করেন ৭০ মিনিটে। ইংল্যান্ড পিছিয়ে যায় ৪-১ গোলে। এর প্রতিক্রিয়ায় ক্যাপেলো স্ট্রাইকার জার্মেইন ডিফোকে উঠিয়ে নামান এমিল হেস্কিকে, যার ইংল্যান্ড দলের হয়ে আছে ৬২টি ম্যাচে মাত্র ৭ গোল। এরকম হাস্যকর সিদ্ধান্তে ম্যাচটির ভাগ্য অনেকটা সেখানেই নির্ধারিত হয়ে যায়।
এভাবে ইংল্যান্ড ম্যানেজারদের অদ্ভুত ট্যাকটিক্যাল সিদ্ধান্তে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক ট্রফি জয় অধরাই থেকে গিয়েছে।
৪) ইংলিশ মিডিয়া
কোনো ফুটবলারকে ওভারহাইপ্ড করাতে ইংল্যান্ডের মিডিয়ার জুড়ি নেই। আবার সেই ওভারহাইপ্ড ফুটবলার যদি আশা পূরণ করতে না পারেন, তবে সেই খেলোয়াড়ের সমালোচনাতেও ইংলিশ মিডিয়া বেশ পটু।
প্রতি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আগেই ইংলিশ মিডিয়ার পাতা পূর্ণ থাকতো কিভাবে ইংল্যান্ড দল এবার বিশ্বজয় করবে তা নিয়ে। ক্লাবের হয়ে প্রতি সপ্তাহে অসাধারণ পারফর্মেন্স করা ফুটবলাররা পারতেন না এত বড় প্রত্যাশাকে সামলাতে। দল হারলে মিডিয়া তাদের কী করবে সেই চিন্তায় তারা নিজেদের খেলায় মনোযোগ দিতে পারতেন না। তাই দেখা যেত, প্রতি টুর্নামেন্টের বাছাইপর্বে ইংল্যান্ডের পারফর্মেন্স অসাধারণ হলেও আসল টুর্নামেন্টেই ইংলিশ খেলোয়াড়রা তাদের স্বাভাবিক খেলা দিতে পারতেন না।
২০১০ বিশ্বকাপে ওয়েইন রুনির পারফর্মেন্স এর বিশাল উদাহরণ। অসাধারণ মৌসুম কাটানো রুনি পুরো বিশ্বকাপে একটিও গোল দিতে ব্যর্থ হন।
৫) দুর্ভাগ্য
পেনাল্টি শুটআউট অনেকটা লটারির মতোই। আর এই লটারি অনেকদিন ধরেই ইংল্যান্ডের ‘অ্যাকিলিস হিল’ বা দুর্বলতা। ২০০৪ ইউরো ও ২০০৬ বিশ্বকাপ এই দুই টুর্নামেন্টেই ইংল্যান্ড পর্তুগালের কাছে পেনাল্টি শুটআউটে হেরে বিদায় নেয়। ২০০৪ ইউরোতে ওয়েইন রুনি পর্তুগালের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের মাত্র ২৭ মিনিটের মাথায় ইনজুরিতে পড়েন। আর ২ বছর পরে সেই পর্তুগালের বিপক্ষে ২০০৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ওয়েইন রুনি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন।
২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের গোল রেফারি ভুলক্রমে বাতিল করে দেন। রেফারি যদি এই গোল ইংল্যান্ডের পক্ষে দিতেন, তাহলে তখন ম্যাচের ফলাফল দাঁড়াত ২-২। এমতাবস্থায় ফুটবলে যেকোনো কিছুই ঘটা সম্ভব ছিল। ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের এই বাতিল গোলের পরিপ্রেক্ষিতেই ফিফা ২০১৪ বিশ্বকাপ থেকে গোল-লাইন টেকনোলজি ব্যবহার শুরু করে।
এই গোল্ডেন জেনারেশন ইংল্যান্ড ফ্যানদের কাছে এক হতাশা হয়েই থাকবে। একইসাথে এতগুলো বিশ্বমানের ফুটবলারের আগমন ফুটবলে খুব কমই হয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে একমাত্র ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ই ইংল্যান্ড ফুটবলের একমাত্র বড় সাফল্য হয়ে আছে।
Featured photo: Getty Images