এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের মূল ভিত কে?
নির্দিষ্ট কোনো নাম ঠিক বলা যাবে না। বাংলাদেশ দলের মূল ভিত পাঁচজন, বাকিরা তাদের ঘিরে তৈরি হওয়া দেয়ালের মতো। এই পাঁচজনই দলের সিনিয়র ক্রিকেটার, যারা পরিচিত ‘পঞ্চপাণ্ডব’ হিসেবে। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ; এই পাঁচে পঞ্চ পাণ্ডব। ২০১৪ সালের শেষদিক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দল সাফল্যের চূড়ায় যেভাবে তরতর করে উঠছে, তার পিছনে সবচেয়ে বড় অবদান এই পাঁচ শেরপার। বিভিন্ন সময়ে দলের হয়ে বিভিন্ন অর্জন তো বটেই, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেও নিজেদের ছাড়িয়ে গিয়েছেন তারা। এবার এই পঞ্চ পাণ্ডব বিরল এক রেকর্ডের সামনে। উইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডের মধ্যে দিয়ে এই পাঁচ ক্রিকেটার একসঙ্গে খেলে ফেলবেন শততম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এমন অর্জন বাংলাদেশ দল, বোর্ড, ম্যানেজমেন্ট তথা তরুণ ক্রিকেটারদের সামনেও একটা উদাহরণ। একটা ঐক্য, একটা দল এবং একটা সাফল্যের গল্পের উদাহরণ।
বাংলাদেশ দলের এখন পর্যন্ত সেরা আবিষ্কার সাকিব আল হাসান। বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার প্রতি মৌসুমেই নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন, যাচ্ছেন। তামিম ইকবাল দেশের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ব্যাটিং রেকর্ডের প্রায় সবটুকুই তিনি ভরেছেন নিজের সাফল্যের ঝুলিতে। ভুল থেকে শেখা, নিজেকে ভেঙ্গে ফেলা, পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে ২০১৫ সাল থেকে দলের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান এই ওপেনার। মুশফিকুর রহিম দলের মিডল অর্ডারের সেরা অস্ত্র, রয়েছে দু’টি ডাবল সেঞ্চুরি। পর্দার আড়ালের নায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ডেথ ওভারে ব্যাট হাতে তিনি নিজের দলের সবচেয়ে সফল, সবচেয়ে মারকুটে ব্যাটসম্যান। সম্প্রতি উইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠে দুই টেস্টে দু’টি সেঞ্চুরি পেয়েছেন তিনি। বলে রাখা ভালো, ৮ বছর পর টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নিয়েছেন এই ব্যাটিং অলরাউন্ডার।
এই পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ইনজুরির তোপ বারবার তাকে মাঠের বাইরে নিয়ে গেছে। তারপরও দলের সেরা ফাস্ট বোলার হিসেবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সফল হয়েছেন ২০১ তম ওয়ানডে খেলতে নামা এই ক্রিকেটার। ২০১৫ সাল থেকে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সফল হয়েছেন। শুধু তাই নয়, মাঠের বাইরে ড্রেসিংরুমেও দলকে ‘দল’ হিসেবে রাখতে তার বিকল্প নেই।
১.
২০০৭ সালে মাহমুদউল্লাহর অভিষেকের পর এই পাঁচ ক্রিকেটার প্রায় পুরোটা সময় একসঙ্গে খেলেছেন। এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়, এখানে কোন সন্দেহও নেই যে এই সময়ে বাংলাদেশ দারুণ উন্নতি করেছে। ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে, ঘরের মাঠে একই বছরে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জিতেছে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলেছে; সর্বশেষ ঘরের মাঠে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে উইন্ডিজকে ২-০ ব্যবধানে হারিয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের অধীনেই অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গেল দুই বছরে টেস্ট ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ।
এ কথা মিথ্যে নয় যে, অতীতে বাংলাদেশ শুধুমাত্র কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই জয় পেতো। বড় দলগুলোর বিপক্ষে খেলার সুযোগও তাদের তেমন একটা ছিলো না। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৬ সাল পর্যন্ত ১৪৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ১১৪টিতেই হেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদের প্রধান নির্বাচক হয়ে আসার আগ পর্যন্ত এই দলটি একরকম ‘আনসেটেলড’ ছিল। তবে ২০০৩-২০০৭ সাল পর্যন্ত কোচ ডেভ হোয়াটমোরের অধীনে জিততে শিখেছিল বাংলাদেশ। সবকিছুই তখন বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, বাংলাদেশের একটা কোর গ্রুপ প্রয়োজন।
কোচ জেমি সিডন্সের সময়কালেও এই পাঁচ ক্রিকেটার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলে্ন। কারণ ২০০৮ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত টুর্নামেন্ট আইসিএল টি-টোয়েন্টি লিগে যাওয়া অনেক বিদ্রোহী ক্রিকেটার আর ফিরতে পারেননি। যারা ফিরেছেন, তারাও ফিরেছেন দেরিতে। ঠিক ওই সময়েই সাকিবের বেড়ে ওঠা। বিশেষ করে ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪-০ তে জয় পাওয়ার সিরিজে সাকিব দেখিয়েছিলেন ‘ওয়ান ম্যান শো’। বলে রাখা ভালো, তামিম ইকবাল ও মাশরাফি বিন মুর্তজা ওই সিরিজে ইনজুরিতে ছিলেন।
বড় দলের বিপক্ষে জয়ের শুরু সেই তখন থেকেই। এরপর ২০১২ সালের এশিয়া কাপে এই পঞ্চপাণ্ডবের হাত ধরে শিরোপা জয়ের খুব কাছে চলে গিয়েছিলো বাংলাদেশ। একই বছরে তারা ঘরের মাঠে উইন্ডিজের বিপক্ষে ৩-২ এ ওয়ানডে সিরিজ জেতে, নিউজিল্যান্ডকে ৩ ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে। ২০১৪ সালটা বাংলাদেশ দলের জন্য ছিল বিভীষিকার মতো। ওই বছরের শেষদিকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে জয় পাওয়ার আগ পর্যন্ত বছরজুড়ে ২২ ম্যাচে হেরেছিলো মাশরাফি-মুশফিক-সাকিব-তামিম-মাহমুদউল্লাহরা, জিতেছিলো মাত্র দু’টিতে।
এরপর মাশরাফি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব ব্যাটন হাতে নিলেন, বাংলাদেশও ধারাবাহিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলো। ২০১৫ বিশ্বকাপে সেরা চারে সুযোগ পাওয়া, ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথমবার র্যাংকিংয়ে থেকে খেলার সুযোগ পাওয়া ও প্রথমবারেই সেমিফাইনালে জায়গা পাওয়া, উইন্ডিজের মাটিতে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ জেতা ছিল অন্যতম সাফল্য। শেষ ৭ বছরে বাংলাদেশ ৫৪% ম্যাচ জিতেছে, যেখানে ২০০৭-২০১৪ পর্যন্ত তাদের জয়ের হার ছিল ৩৯.৬০%।
দলের সেরা এই পাঁচ ক্রিকেটারের অধীনে বাংলাদেশ শুধু মাঠের সাফল্যই পায়নি, পেয়েছে একটি স্বাস্থ্যকর ড্রেসিংরুম। দলের অন্যান্য সদস্যদেরকে স্কিল ও ফিটনেস ট্রেনিংয়ের গুরুত্ব বুঝিয়ে উদ্বুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন তারা।
২.
কিন্তু নিজেদের এমন অর্জন সম্পর্কে কি ভাবছেন তারা? এক প্রশ্নের উত্তরে তামিম ইকবাল বলেন,
‘এই পাঁচজন একে অপরকে চিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে। আমরা সবাই একসঙ্গে খারাপ-ভালোর মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। আশা করছি, সবাই মিলে ১০০তম ম্যাচটা স্মরণীয় করতে পারবো।’
তিনি আরও বলেন,
‘মাশরাফি ভাই ও রিয়াদ ভাই সাকিব, মুশফিক ও আমার চেয়ে বড়। আমরা তিনজনই অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে খেলছি। আমরা নিজেদের মধ্যে সবকিছু শেয়ার করি, আমাদের সম্পর্কটাও অনেক সুন্দর। সাকিব ও মুশফিকের বন্ধু হলেও মাশরাফি ও রিয়াদ ভাইয়ের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটাই।’
মাশরাফি জানিয়েছেন, দলের জ্যেষ্ঠ ক্রিকেটারদের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো থাকলে অধিনায়কের কাজটা সহজ হয়ে যায়। তিনি বলেন
‘তারা সবাই পারফর্ম করলে আমার কাজটা সহজ হয়ে যায়। তাদের ধারাবাহিকতা দলের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বড় বড় টুর্নামেন্টগুলোতে তারা দলের জন্য অবদান রাখছে।’
নিজের চেয়ে অন্যদের কথাই বেশি বললেন মুশফিক। পঞ্চপাণ্ডবের অংশ হয়েও তিনি বাকি চারজনের কাছ থেকে শিখছেন বলে উল্লেখ করেন। সেই শেখাটা কিরকম? উত্তরে মুশফিক জানান, তামিম তাকে সহজভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন। অন্যদিকে, মাহমুদউল্লাহ তাকে শিখিয়েছেন কীভাবে আলোটা নিজের দিকে কেড়ে নিতে হয়।
তিনি বলেন,
‘আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড়দের মধ্যে তামিম একজন। তার নিজেকে ভাঙ্গার ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। তার রেকর্ডগুলোই তার পারফরম্যান্সকে প্রমাণ করে। কিন্তু আমি মনে করি তামিমের এখনও অনেক কিছু দেওয়ার আছে।’
মাহমুদউল্লাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
‘রিয়াদ ভাই অনেক কঠিন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে নিজেকে পার করেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সবচেয়ে বড় জয়গুলোতে তারই সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল।’
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ডেথ-ওভারে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ছাড়া বাংলাদেশ দলের আর কোনো বিকল্প নেই। অথচ গুণী এই ক্রিকেটার বলে দিচ্ছেন, তামিম-মুশফিক ও সাকিবের থেকে অনুপ্রাণিত হন তিনি।
মাহমুদউল্লাহর ভাষায়,
‘আমি ওদের কাছ থেকেই শিখি। তামিম কীভাবে চিন্তা করে, মুশফিক কীভাবে অনুশীলন করে, সাকিব কীভাবে খেলাটাকে পড়ে ফেলে, সব আমি খেয়াল করি। সাধারণ মানুষ কীভাবে ক্রিকেট নিয়ে চিন্তা করে, সেটাও খেয়াল করি। এর সবকিছুই আমাকে ম্যাচে ভালো করার অনুপ্রেরণা দেয়।’
যুগে যুগে ক্রিকেট দুনিয়ায় আরও অনেক পঞ্চপাণ্ডব এসেছিলেন। তবে এটা মিথ্যে নয় যে, এই পঞ্চপাণ্ডবের জন্য মুখ থুবড়ে পড়া এক বাংলাদেশ ক্রিকেট দল দেখেছে সম্ভাবনার আলোকরশ্মি। কিন্তু বাংলাদেশের নতুন পঞ্চপাণ্ডব কারা হচ্ছেন? সেই প্রশ্নটা রয়েই যায়।