আরও একটি বছরের বিদায়। সাথে পুরো একটি দশকের সমাপ্তি। যদিও ফুটবলে একটি বছর শেষের সাথে সাথেই মৌসুম শেষ হয় না। উল্টে সে সময় থাকে প্রত্যেক লিগের মাঝামাঝি অবস্থার ম্যাচগুলো। আর এ সময়েই ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকে লিগের চ্যাম্পিয়ন হবার সম্ভাব্য নাম গুলো। তাই লিগ জয়ের লড়াইয়ের এই মাঝামাঝি সময়ে এসে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে দারুণ কিছু ম্যাচ। সেই ম্যাচগুলোকে বিশ্লেষণ করে আমরা বেছে নিয়েছি গত মাসের সেরা খেলোয়াড়দের। আসুন দেখে নেওয়া যাক।
প্রিমিয়ার লিগ – সার্জিও আগুয়েরো
প্রথমে থাকা লিভারপুলের সাথে ম্যানচেস্টার সিটির পয়েন্ট ব্যবধান যে বড্ড বেশি হয়ে গেছে সেটা স্বয়ং পেপ গার্দিওলাও জানেন। তবুও তিনি চান, লিগের লড়াইয়ে হাত গুটিয়ে বসে না থাকতে। অন্তত দ্বিতীয় স্থানটি তো সিটিজেনরা ধরে রাখুক। তবে ক্রিস্টাল প্যালেসের সাথে ড্র ও টটেনহামের সাথে হারের ফলে বর্তমানে সেই স্থানও হারাচ্ছে তারা। তার উপর ইনজুরি সমস্যা তো আছেই।
চলতি বছর শুরু আগেই ইনজুরিতে মাঠের বাইরে ছিলেন সিটিজেন স্ট্রাইকার সার্জিও আগুয়েরো। বছরের প্রথম ম্যাচে আগুয়েরো তাই ছিলেন না দলের সাথে। প্রিমিয়ার লিগে আগুয়েরো ফেরেন ১০ জানুয়ারি অ্যাস্টন ভিলার মাঠে। বছরের প্রথম ম্যাচে আগুয়েরো জ্বলে ওঠেন। তার হ্যাটট্রিকে নিজেদের মাঠে গোলবন্যায় ভেসে যায় অ্যাস্টন ভিলা।
দুর্দান্ত এক জয়ের পর ১৮ জানুয়ারি সিটিজেনরা আবার মাঠে নামে ক্রিস্টাল প্যালেসের বিপক্ষে। কিন্তু নিজেদের মাঠে প্রথম থেকেই ম্যাচের লাগাম হারায় তারা। কেভিন ডি ব্রুইন বেশ কিছু সুযোগ তৈরি করলেও রহিম স্টার্লিং ও বের্নাদো সিলভা গোল করতে ব্যর্থ হন। বিপরীতে ক্রিস্টাল প্যালেস দুই গোলে এগিয়ে। ৮০ মিনিটের পর যখন সিটিজেনদের হার নিশ্চিত তখন জ্বলে ওঠেন আগুয়েরো। ৫ মিনিটে করেন জোড়া গোল। তার এই দুই গোলে নিশ্চিত হার এড়িয়ে ড্র করে ম্যানচেস্টার সিটি।
জানুয়ারি মাসের তৃতীয় ম্যাচ ছিল শেফিল্ড ইউনাইটেডের সাথে। প্রথম থেকে তাদের লক্ষ্য ছিল রক্ষণে। তাই সিটিজেনরা আটকে ছিল ৭২ মিনিট পর্যন্ত। ৭৩ মিনিটে ত্রাতা হয়ে আর্বিভূত হন আগুয়েরো। তার পাস থেকে জয়সূচক গোল করেন কেভিন ডি ব্রুইন। জানুয়ারি মাসে ৫টি গোল ও ২টি অ্যাসিস্ট করেছেন এই আর্জেন্টাইন। অথচ বছর শুরু আগে তিনি ছিলেন ইনজুরির কবলে। ইনজুরি থেকে ফেরত এসেই যে এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স উপহার দেবেন তা কে আঁচ করতে পেরেছিল!
আগুয়েরো জানুয়ারি মাসের সেরা খেলোয়াড় হলেও বিশেষভাবে বলা উচিত তারই ক্লাব সতীর্থ গ্যাব্রিয়েল জেসুসের নাম। গত মাস জুড়ে তিনি করেছেন ৩টি গোল ও ১টি অ্যাসিস্ট।
লা লিগা – ম্যাক্সি গোমেজ
খুনে এবং ঠাণ্ডা মাথায় গোল দেওয়ার ক্ষেত্রে গোমেজের বেশ সুনাম আছে। তার খেলার ধরন একদম তথাকথিত স্ট্রাইকারের মতো। নিচে নেমে বল তৈরিতে তার একদম মনোযোগ নেই। ডি-বক্সে তার কাছে একটি পাসই গড়ে দিতে পারে ম্যাচের ভাগ্য। গত মাস জুড়ে এমন ম্যাচের দেখা মিলেছে ভ্যালেন্সিয়া ও গোমেজের।
আলবার্তো সেলাদেসের অধীনে বেশ ভালোই এগিয়ে আছে ভ্যালেন্সিয়া। গত জানুয়ারিতে লিগে তিনটি ম্যাচ খেলেছে তারা। তাতে তারা পেয়েছে দুটি জয় ও একটি হার। জয়ের ভেতর একটি আবার বার্সেলোনার বিপক্ষে। এইবারের বিপক্ষে গোমেজের একটিমাত্র গোলে জয় পায় তারা। পুরো ম্যাচে মাঠে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ড্যানিয়েল ওয়াসের নিখুঁত পাস ঠিকই খুঁজে নিয়েছে গোমেজের পা। তা থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি গোমেজ।
মায়োর্কার মাঠে ৪ গোলে হারার ম্যাচে কোনো ছন্দেই ছিলো না ভ্যালেন্সিয়া। গোমেজও তা-ই। কিন্তু দুর্দান্তভাবে তারা ফিরল পরিবর্তনের ভেতর থাকা বার্সেলোনার বিপক্ষে। বার্সেলোনার বিপক্ষে গোমেজ মোট চার শট নিয়েছেন। তাতেই দুই গোল। ১২ মিনিটে তার পেনাল্ট শট টের স্টেগান রুখে না দিল সেদিন হ্যাটট্রিকের স্বপ্নও পূরণ হয়ে যেত ২৩ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের।
লিগ ওয়ান – নেইমার
ইনজুরির কবলে পড়ে ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো নষ্ট করার সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ নেইমার। অথচ ফিট থাকলে তিনি কেমন দুর্দান্ত খেলেন তার উদাহরণ আবারও মিলল গত মাসে।
সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর পিএসজির হয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। চলতি বছর মাঠে ফেরেন ১৩ জানুয়ারি, মোনাকোর বিপক্ষে। সেদিন দুর্দান্ত এক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল পিএসজির মাঠে। খেই হারিয়ে ফেলা মোনাকো সেদিন পিএসজির সাথে পাল্লা দিয়ে লড়ে গেলো। কিন্তু অপরপ্রান্তে পিএসজির সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। মাত্র তিন মিনিটে নেইমারের গোলে এগিয়ে যাবার পর মার্টিন্স ও বেন ইয়েদারের গোলে লিড নেয় মোনাকো। ২৪ মিনিটে তাওরের আত্মঘাতী গোল ও ৪৫ মিনিটে নেইমারের পেনাল্টিতে বিরতির আগে ৩-২ গোলে এগিয়ে থাকে ফরাসি চ্যাম্পিয়নরা। তবে ৭০ মিনিটে ইসলাম স্লিমানি মোনাকোর হয়ে তৃতীয় গোল করে বসেন। তাই এই ম্যাচ পয়েন্ট ভাগাভাগি করেই শেষ হয়।
কিছুদিন পরেই আবারও লিগের ম্যাচ, প্রতিপক্ষ সেই মোনাকো। যদিও নিজেদের মাঠে এবার আর পাত্তা পায়নি স্বাগতিকরা। ৪৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে পিএসজির দ্বিতীয় গোল ও ৯২ মিনিটে এমবাপেকে একটি অ্যাসিস্ট করেন নেইমার। ম্যাচ শেষ হয় ১-৪ গোলের ব্যবধানে। জানুয়ারি মাসের তৃতীয় ম্যাচে লিঁলকে ০-২ গোলের ব্যবধানে হারায় পিএসজি। তাতে জোড়া গোল করে ম্যাচসেরা হন নেইমার।
জানুয়ারি মাসে নেইমার ৩ ম্যাচ খেলে করেছেন ৫ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট। যদিও এই গোল বা অ্যাসিস্টের পরিসংখ্যান নয়। প্রতিটি ম্যাচে তিনি খেলেছেন নান্দনিক ফুটবল। তাই কোনো সন্দেহ ছাড়াই জানুয়ারি মাসে ফরাসি লিগ ওয়ানের সেরা খেলোয়াড় নেইমার।
সেরি এ – ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
বুড়ো হারের ভেলকি বিষয় তার সাথে ঠিক মানানসই নয়। রোনালদোর বয়স যতই হোক, তার বয়সের সাথে ফর্ম সেভাবে কখনও নিম্নগামী হবে না বলে ধারণা করেন অনেকেই। তবে জুভেন্টাসে গত বছরের শেষ সময়ে একটি বৃহৎ সময় জুড়ে রোনালদো ছিলেন নিশ্চুপ। কিন্তু নতুন বছরে তিনি নতুন রূপে যেভাবে ফিরলেন, সেভাবে তাকে কখনও দেখা যায়নি জুভেন্টাসের সাদা-কালো জার্সিতে।
৬ জানুয়ারি ক্যালিয়ারির বিপক্ষে ম্যাচে তিনি তুলে নেন হ্যাটট্রিক। রোমার বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে ১০ মিনিটে তার নিখুঁত পেনাল্টিতে গোলই জুভেন্টাসকে ৩ পয়েন্ট এনে দিয়েছিল। কারণ ডিয়েগো পেরত্তির পেনাল্টি গোলে ৬৮ মিনিটে ১ গোল পেয়ে গিয়েছিল রোমা। পরের ম্যাচ ঘরের মাঠে পার্মার বিপক্ষে। ২-১ গোলে সে ম্যাচে জয় পায় সারির দল। রোনালদো করেন জোড়া গোল। ৯০ শতাংশ সঠিক পাস দিয়ে পার্মার গোলবারে সেদিন ৭টি শট নেন এই পর্তুগিজ তারকা।
জানুয়ারিতে জুভেন্টাস প্রথমদিকে সব ম্যাচে সহজ জয় তুলে উড়ছিল। নিজেদের মাঠে তাদের টেনে মাটিতে নামায় গাত্তুসোর নাপোলি। পিতর জিলেনেস্কি ও লরেঞ্জো ইনসিনিয়ের ২ গোলের বিপরীতে বেন্টানকুরের পাসে ৯০ মিনিটে ১ গোল পরিশোধ করেন রোনালদো। এই গোল নিয়ে গত মাসে সিরি ‘এ’-তে জুভেন্টাসের হয় সব ম্যাচে গোল করেন রোনালদো।
৪ ম্যাচ খেলে ২ ম্যাচে নির্বাচিত হয়েছেন ম্যাচসেরা। করেছেন ৭ গোল ও ১টি অ্যাসিস্ট। এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে বিপরীতে সেভাবে কেউ নেই ইতালিতে। তাই জানুয়ারিতে ইতালির লিগের সেরা খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
বুন্দেসলিগা – আর্লিং ব্রুট হালান্ড
রেডবুলের হয়ে গোলের বন্য বইয়ে দিয়েছিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে তার গোল করার ক্ষমতা দেখে ইউরোপের অনেক বড় বড় ক্লাব তাকে নেবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু হালান্ড গিয়ে যোগ দিলেন জার্মান ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে।
এক ক্লাব থেকে অন্য ক্লাবে গিয়ে মানিয়ে নিতে অনেক বড় বড় খেলোয়াড়ের সময়ের প্রয়োজন হয়। এবং সেই সময়ের ব্যবস্থা ক্লাবই করে দেয়। কিন্তু হালান্ড কী আর এসব গল্পগাঁথা মানেন! তার কাজ গোল করা, সেটা যে তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে করতে পারেন। এরই দেখা মিলল ডর্টমুন্ডের হয়ে তার প্রথম ম্যাচে।
১৮ তারিখে অগসবার্গের বিপক্ষে ২ গোলে পিছিয়ে ডর্টমুন্ড। হালান্ড ছিলেন না প্রথম থেকে মূল একাদশে। ৫৬ মিনিটে লুকাস পিসজেকের বদলে হালান্ডকে নামিয়ে দেন ফাভরে। ডর্টমুন্ড কোচ চাচ্ছিলেন অগসবার্গের কিঞ্চিৎ দুর্বল রক্ষণের বিপরীতে আক্রমণের ধার বাড়াতে। কিন্তু হালান্ড আবির্ভূত হলেন খুনে চরিত্রে। মাঠে নামার ৪ মিনিটের মাথা জর্দান স্যাঞ্চোর পাসে প্রথম গোল, ৭০ মিনিটে দ্বিতীয় ও ৭৯ মিনিটে রয়েসের পাসে ঠান্ডার মাথার ফিনিশিং। ডর্টমুন্ডের হয়ে হালান্ড প্রথম ম্যাচেই করলেন হ্যাটট্রিক, সাথে অভিষেক ম্যাচে নেমেই দলকে তুললেন খাদের কিনারা থেকে।
দ্বিতীয় ম্যাচ এফসি কোলনের বিপক্ষে। এবারও হালান্ড নেই প্রথম একাদশে। ৩-১ গোলে এগিয়ে থাকার পর ৬৫ মিনিটে থর্গান হ্যাজার্ডের পরিবর্তে মাঠে নামেন হালান্ড। অগসবার্গের ম্যাচে যেখানে তিনি শেষ করেছিলেন সেখান থেকেই আবার শুরু করলেন তিনি। ৭৭ ও ৮৭ মিনিটে ২ গোল, হালান্ড যেন স্বর্গীয় ছোঁয়া পাওয়া গোল মেশিন।
এই দুই ম্যাচে হালান্ড অদ্ভুত এক কান্ড করছেন। দুই ম্যাচে নেমেছেন দ্বিতীয়ার্ধে। আর গোলবারে শট নিয়েছে ৫টি। আর ৫টি শটে করে ফেলেছেন ৫ গোল। হালান্ড যেভাবে গোল করাকে ছেলেখেলা বানিয়ে নিচ্ছেন, তাতে সম্ভবত বুন্দেসলিগায় লেভান্ডডস্কি নামক গোলমেশিন আদর্শ সঙ্গী পেতে চলেছে।