আপনি যদি একজন উঠতি ফুটবলার হয়ে থাকেন, হয়তো জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে আপনার স্বপ্ন ছিল আপনি স্ট্রাইকার হবেন, গোলের পর গোল করবেন, হয়ে উঠবেন একজন ‘পারফেক্ট নাম্বার নাইন’। জর্জ উইয়াহ, রোনালদো লিমা, অ্যালান শিয়ারার, কিংবা হালের রবার্ট লেভানডফস্কি – ইতিহাসের পাতায় নাম্বার নাইন হিসেবে ‘রোল মডেল’ হিসেবে কিংবদন্তী নামের অভাব খুব একটা নেই।
আর ‘নাম্বার নাইন’ হতে চাওয়াতেও তাই তেমন অস্বাভাবিকতা নেই। সাধারণভাবে তারাই দলের আক্রমণের মধ্যমণি, প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে প্রবেশের আগে বলে তাদের পায়ের স্পর্শ দেখতে চান সবাই। কিন্তু গোলপোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আর দুই উইং থেকে ভেসে আসা ক্রস বা মিডফিল্ড থেকে আসা কোনো থ্রু বলে পা লাগানোই কি ‘নাম্বার নাইন’দের একমাত্র কাজ? গোল করা ছাড়াও দলের খেলায় বা আক্রমণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কীভাবে ভূমিকা রাখেন এই নয় নম্বর জার্সিধারীরা? সব নম্বর নাইনদের কাজের ধরন কি একই? চলুন চেষ্টা করা যাক সেই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার।
প্রথমে নাম্বার নাইনদের সাধারণ পরিচয়ে আসি। এমনিতে ‘নাম্বার নাইন’ বললে চোখের সামনে যেটা ভেসে ওঠে, তারা আসলে সেটাই। ফুটবল মাঠে একটি দলের সবচেয়ে সামনে থাকা খেলোয়াড়টিই নাম্বার নাইন, যাদের অনেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড বা স্ট্রাইকারও বলেন। প্রথম দিককার ফুটবলের ২-৩-৫ ফরমেশনের সেন্টার ফরোয়ার্ডই নম্বর নাইন। পরে ফুটবলে অনেক পরিবর্তন এসেছে, ডিফেন্ডারের সংখ্যা বেড়েছে, মধ্যমাঠের গুরুত্ব বেড়েছে; তবে নাম্বার নাইনের গুরুত্ব কমেনি। তবে এর ধরনে এসেছে অনেক পরিবর্তন। নম্বর নাইনের কাজ এখন শুধুই গোল করা নয়, ধরনভেদে তাদের কাজও হয় ভিন্ন।
ভূমিকা শেষ। চলুন এবার একে একে বিভিন্ন ধরনের নম্বর নাইনদের সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
সেন্টার ফরোয়ার্ড
এই ধরনের নম্বর নাইনরা সাধারণভাবে শারীরিকভাবে শক্তিশালী। গোল করা ছাড়াও প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাকদের শারীরিক শক্তিতে টেক্কা দেওয়া, মাঠের ওপরের দিকে বলের দখল রাখা এবং আক্রমণে সতীর্থদের যোগদানের সুযোগ দেওয়াই সেন্টার ফরোয়ার্ডদের কাজ। ফিজিক্যালিটি আর টেকনিক দিয়ে গোল করার সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোও সেন্টার ফরোয়ার্ডদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ভালো সেন্টার ফরোয়ার্ডদের শর্ট পাসিং আর লাফিয়ে বলে মাথা লাগানোর দক্ষতাও থাকা প্রয়োজন।
এই সেন্টার ফরোয়ার্ডদের অন্যতম সাম্প্রতিক উদাহরণ দিদিয়ের দ্রগবা। এই নয় নম্বর জার্সিধারী চেলসির হয়ে প্রিমিয়ার লিগে ২৫৪ ম্যাচে করেছিলেন ১০৪টি গোল। তবে শুধু গোল দিয়ে দ্রগবাকে বিচার করা উচিত নয়। চেলসির রক্ষণভাগ যখনই চাপের মুখে পড়েছে, তখনই দ্রগবাকে খুঁজে পেয়েছে পাস দেওয়ার নিরাপদ অপশন হিসেবে। দ্রগবা বল হোল্ড করতে পারতেন, ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড আর জো কোলের মতো খেলোয়াড়দের দ্রুত আক্রমণে ওঠার সুযোগ করে দিতেন। দ্রগবার মতো এমন সেন্টার ফরোয়ার্ডের আরো উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গঞ্জালো হিগুয়াইন, মারিও মানজুকিচ, অ্যালান শিয়ারার, আর্তেম জিউবার নাম।
পোচার
সহজ ভাষায় এসব নম্বর নাইনকে ‘সুযোগসন্ধানী’ বলা যেতে পারে। পোচারদের আবশ্যকীয় এবং একমাত্র কাজ ‘গোল করা’, এজন্য ‘সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায়’ থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য পোচারদের গেম রিডিং ক্ষমতা থাকা প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের বক্সের মধ্যে গোলরক্ষক ও ডিফেন্ডারদের দ্বারা বলের রিবাউন্ড বা ডিফ্লেকশন বুঝতে পারাটাও পোচারদের দক্ষতার মধ্যে পড়ে। দারুণ পজিশনাল সেন্স, দুর্দান্ত ক্ষীপ্রতা আর প্রতিক্রিয়াই গড়ে তোলে একজন অসাধারণ পোচারকে।
তবে দলের আক্রমণ গড়ে তুলতে পোচারদের ভূমিকা কম থাকে। এদের পাসিং ক্ষমতাও অপেক্ষাকৃত কম, বল ক্যারি করার দক্ষতাও ভালো না। ফলে পুরো ম্যাচেও বলে তাদের স্পর্শের সংখ্যা কম থাকে। এর বদলে পোচাররা নিজেদেরকে ‘ওয়ান টাচ’-এ গোল করায় পারদর্শী করে গড়ে তোলেন। আর টেকনিক্যাল বা ফিজিক্যাল দক্ষতার অভাবটা পূরণ করার চেষ্টা করেন ফুটবল-জ্ঞান দ্বারা।
পোচারদের উদাহরণ দিতে বললে প্রথমেই আসে ফিলিপ্পো ইনজাগির নাম। এসি মিলানের হয়ে দুটো চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী আর ইতালির বিশ্বকাপজয়ী দলের এই ফরোয়ার্ডকে বলা হয় অন্যতম সেরা গোলস্কোরার। যেকোনো পরিস্থিতিতে দুর্দান্ত পজিশন সেন্স, অফসাইড ট্র্যাপ ভেঙে দুর্দান্ত অ্যাটাকিং রান নেওয়া ছিল ইনজাগির বৈশিষ্ট্য (যদিও উপযুক্ত পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয়, ইনজাগিই সবচেয়ে বেশি অফসাইড ট্র্যাপে পড়া ফুটবলার)। পোচারদের আরো উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হাভিয়ের হার্নান্দেজ, মিরোস্লাভ ক্লোসা প্রমুখের নাম।
টার্গেট ম্যান
নাম থেকেই এর পরিচয় স্পষ্ট, প্রতিপক্ষের অর্ধে পাস দেওয়ার জন্য খেলোয়াড়রা যাকে সবার আগে খোঁজেন, তিনিই ‘টার্গেট ম্যান’। টার্গেট ম্যানের প্রধান কাজ প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাকদের কাছাকাছি থাকা, প্রয়োজনে শারীরিক শক্তি দিয়ে তাদের পরাজিত করে বলের দখল নেওয়া এবং দ্রুত পাস দিয়ে দেওয়া। সাধারণত যেসব দল বলের দখল বেশি রাখতে পারে না, অর্থাৎ বল পজেশন কম থাকে, তারা নম্বর নাইনকে টার্গেট ম্যান হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ এ ধরনের দলগুলো দ্রুত নিজেদের অর্ধ থেকে বল ক্লিয়ার করে বিপদমুক্ত হতে চায়, এজন্য দ্রুত নম্বর নাইনকে পাস দিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে টার্গেট ম্যান বল রিসিভ করে হোল্ড করেন, যেন প্রতিপক্ষ আরো একটি আক্রমণ শুরু করতে না পারে। অর্থাৎ নম্বর নাইন হলেও টার্গেট ম্যানের মূল কাজ শুধু গোল করা নয়, বরং বল হোল্ড করে মিডফিল্ডারদের দ্রুত আক্রমণে উঠতে সাহায্য করা।
তবে অনেক ক্ষেত্রে বল পজেশন বেশি থাকে, এমন দলগুলোও তাদের নম্বর নাইনকে ‘টার্গেট ম্যান’ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রে টার্গেট ম্যানের কাজ থাকে মূলত এরিয়াল ডুয়েল জেতা, বক্সে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের শারীরিক শক্তিতে পরাজিত করা এবং গোল করা।
বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সাবেক কোচ লুসিয়েন ফাভরে তার দলের নম্বর নাইন আর্লিং হালান্ডকে খেলাতেন টার্গেট ম্যান হিসেবে। বল পায়ে থাকা অবস্থায় ৩-৪-২-১ এবং বল পায়ে না থাকা অবস্থায় ৫-৪-১ ফরমেশনে খেলতো ডর্টমুন্ড। এক্ষেত্রে বল রিসিভ করার জন্য হালান্ড একটু নিচে নেমে আসতেন, তাকে কাভার করার জন্য একজন বা দুইজন সেন্টারব্যাককে উপরে উঠতে হতো, তাহলে ডর্টমুন্ডের অন্য মিডফিল্ডাররা প্রতিপক্ষের অর্ধে জায়গা পেয়ে যেতেন।
টার্গেট ম্যানের আরো একটি উদাহরণ রোমেলু লুকাকু, যখন তিনি ইন্টার মিলানে ছিলেন। আন্তোনিও কন্তের অধীনে দলটি খেলতো ৩-৫-২ ফরমেশনে। এক্ষেত্রে মিডফিল্ড থেকে ভেসে আসা বলগুলো রিসিভ করতে লুকাকু তার গতি আর শারীরিক শক্তি ব্যবহার করতেন। এক্ষেত্রে এরিয়াল ডুয়েলের পর ‘সেকেন্ড বল’ জেতার দায়িত্ব ছিল লুকাকুর পাশে সেকেন্ড স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা লাউতারো মার্টিনেজের। সেকেন্ড বল জেতার পর মার্টিনেজ তার সামনে বেশ খানিকটা জায়গা পেয়ে যেতেন, যেখান থেকে তিনি চাইলে শট নিতে বা পাস দিতে পারতেন।
আগেই বলেছি, টার্গেট ম্যানরা সবসময়ে দলের মূল গোলস্কোরার নন। এই গোল না পাওয়ার কারণেই ২০১৮ বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স দলের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর হাস্যরসের শিকার হতে হয়েছিল অলিভিয়ের জিরুকে। নিজে গোল না পেলেও জিরু নিয়মিত এরিয়াল ডুয়েলে জিতেছেন, এবং জায়গা করে দিয়েছেন আঁতোয়ান গ্রিজমানকে। প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনাল এবং চেলসির হয়ে খেলার সময়েও কোচরা জিরুকে ব্যবহার করেছেন টার্গেট ম্যান হিসেবে, যেখানে জিরু নিকের উচ্চতা ও ফিজিক্যালিটি কাজে লাগিয়েছেন বেশ ভালোভাবেই, যদিও ২৫৫ ম্যাচে ৯০ গোলের পরিসংখ্যানে সেটা ফুটে ওঠে না। টার্গেট ম্যানের অন্যান্য উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ক্রিস্টিয়ান বেনটেকে, পিটার ক্রাউচ বা আরিজ আদুরিজের নাম।
ফিনিশার
এক শব্দে এই ধরনের নম্বর নাইনকে বর্ণনা করতে হলে বলতে হবে, ‘লিথাল’। তাছাড়া নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এদের কাজ হলো ফিনিশিং করা। গড়ে ওঠা আক্রমণের সুন্দর পরিণতি দেওয়াই এদের কাজ। ফিনিশারদের সাথে অন্যান্য নম্বর নাইনদের মূল পার্থক্য হলো, ফিনিশাররা সব ধরনের ফিনিশিংয়ে পারদর্শী হয়ে থাকেন। প্রতিপক্ষের অ্যাটাকিং থার্ড বা বক্সে পোচিং বা ওয়ান-টাচ গোল, লং-রেঞ্জ বা শর্ট-রেঞ্জ গোল, হেডার, অর্থাৎ সব ধরনের ফিনিশিংয়ে ফিনিশারদের দক্ষ হতে হয়। এছাড়া ফিনিশারদের যথেষ্ট জোরে এবং পরিষ্কারভাবে বলে শট নেওয়া, দুর্দান্ত ফার্স্ট টাচ, এবং দ্রুত জায়গা তৈরি করে বলে শট নেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হয়।
ফিনিশারদের উদাহরণের প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই আসবে রবার্ট লেওয়ানডস্কির নাম। বায়ার্ন মিউনিখের এই নম্বর নাইন একজন লম্বা, শারীরিক শক্তিশালী এবং দুর্দান্ত টেকনিকের স্ট্রাইকার। পোল্যান্ডের এই ফরোয়ার্ড গত কয়েক মৌসুম ধরে অবিশ্বাস্য ফর্মে আছেন। একের পর এক গোল করে চলেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ আর বুন্দেসলিগায়, গত মৌসুমে জিতেছেন ইউরোপীয়ান গোল্ডেন বুটও। লেওয়ানডস্কি ছাড়াও সার্জিও আগুয়েরো, রবিন ভ্যান পার্সি, ইব্রাহিমোভিচরাও দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ের উদাহরণ।
প্লেমেকার
এই ধরনের নম্বর নাইনরা প্লেমেকিংয়ের জন্য নিচে নামেন এবং অন্যদের জন্য গোল করার সুযোগ তৈরি করে থাকেন। এরা পায়ে বল রাখতে পছন্দ করেন, তাই প্রায়শই নিচে নেমে সতীর্থদের কাছ থেকে পাস রিসিভ করে থাকেন, এজন্য অনেক সময়ে তাদের মিডফিল্ডেরও নিচে নেমে আক্রমণ শুরু করতে দেখা যায়। এই ধরনের নম্বর নাইনদের ফিনিশিং দক্ষতা থাকে অবিশ্বাস্য, পাশাপাশি দুর্দান্ত ফার্স্ট টাচ, দারুণ ড্রিবলিং আর ওয়াইড পাসিং রেঞ্জের মাধ্যমে এঁরা সতীর্থদের গোল বানিয়ে দেওয়ার কাজটাও করেন চমৎকারভাবে। সাধারণত শারীরিকভাবে তারা খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারেন না, তাই নিজেদের ক্ষিপ্রতা, ড্রিবলিং, পাসিংয়ের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয়। তবে একজন শুধুমাত্র প্লেমেকার আর প্লেমেকিং নম্বর নাইনের মধ্যে মূল পার্থক্য তাঁদের ফিনিশিং দক্ষতায়। প্লেমেকিং নম্বর নাইনরা মূলত গোল করার দিকে বেশি গুরুত্ব দেন, এরপর সতীর্থদের গোল করার সুযোগ তৈরি করেন।
এই শতাব্দীতে প্লেমেকিং নম্বর নাইনের প্রথম উদাহরণ আর্সেনালের সাবেক ফরোয়ার্ড থিয়েরি অঁরি। বার্সেলোনার হয়েও দুটো লা লিগা আর একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতলেও অঁরির মূল বিকাশটা ঘটেছিল আর্সেনালে থাকা অবস্থায়। প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভেঙে ‘ট্রেডমার্ক’ লং রান নেওয়ার পর নিজে গোল করা বা কোনো সতীর্থকে দিয়ে গোল করাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন অঁরি। অঁরির সেরা সময়টা এসেছিল ২০০২-০৩ মৌসুমে। ঐ মৌসুমে অঁরি ২৪টা গোলের পাশাপাশি করেছিলেন ২০টা অ্যাসিস্ট, ইউরোপের টপ পাঁচ লিগে এক মৌসুমে বিশটা করে গোল আর অ্যাসিস্টের প্রথম উদাহরণ ঐটাই।
এক মৌসুমে বিশ গোল, বিশ অ্যাসিস্টের পরবর্তী উদাহরণটা তৈরি হয়েছে কিছুদিন আগেই। ২০১৯-২০ মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে লা লিগায় ২৫ গোল আর ২১ অ্যাসিস্ট করেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা প্লেমেকিং নম্বর নাইন লিওনেল মেসি। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, বিভিন্ন কোচ লিওনেল মেসিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছেন। পেপ গার্দিওলার সময়ে ফলস নাইন, লুইস এনরিকের সময়ে রাইট উইং, রোনাল্ড ক্যোমানের সময়ে প্লেমেকিং নম্বর নাইন পজিশনে খেলেছেন মেসি।
কমপ্লিট ফরোয়ার্ড
ফরোয়ার্ড ঘরানার মধ্যে সেরা বলা হয় এই ধরনের ফরোয়ার্ডদেরকেই। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তারা ফরোয়ার্ড হিসেবে পূর্ণতা পেয়েছেন। সব ধরনের নম্বর নাইনদের সেরা গুণগুলোকে মাখনের মতো ছেঁকে নিয়ে যে ফরোয়ার্ডকে তৈরি করা হয়েছে, তারাই কমপ্লিট ফরোয়ার্ড। একজন ফিনিশারের গোল করার ক্ষমতা, একজন সেন্টার ফরোয়ার্ডের শারীরিক শক্তি, একজন টার্গেট ম্যানের হেড করার সক্ষমতা, একজন পোচারের ক্ষিপ্রতা আর প্রতিক্রিয়া, এর সাথে দারুণ টেকনিক আর আক্রমণের যেকোনো জায়গায় খেলার সামর্থ্য নিয়ে তৈরি হয় একজন কমপ্লিট ফরোয়ার্ড। তাই স্বাভাবিকভাবেই ফুটবল ইতিহাসে তারা প্রায় বিরল প্রজাতির।
উদাহরণ দিতে চাইলে প্রথমেই আসবে রোনালদো নাজারিওর নাম। দুর্দান্তভাবে ক্যারিয়ার শুরু করা এই ফরোয়ার্ড সিনিয়র ফুটবলে নিজের প্রথম চার মৌসুমেই করেছিলেন ৮৮ গোল, সেটিও তিনটা ভিন্ন ক্লাবের হয়ে। আর শুধু গোলের সংখ্যাই নয়, গোলগুলোর ধরন আর সৌন্দর্যও ছিল নজরকাড়া। প্রতিপক্ষের পুরো ডিফেন্সকে কাটিয়ে বল নিয়ে বক্সের ভেতরে ঢুকে পড়া, অনেক ডিফেন্ডারের চেয়ে উচ্চতা কম থাকা সত্ত্বেও দারুণ হেড করার সামর্থ্য, দুর্দান্ত গতি, দারুণ পাস দেওয়ার সক্ষমতা, বারবার ইনজুরি সত্ত্বেও সব মিলিয়ে রোনালদো নাজারিওকে সর্বকালের সেরা নম্বর নাইন বলা যেতেই পারে।
বর্তমান সময়ের কমপ্লিট ফরোয়ার্ডদের মধ্যে লুইস সুয়ারেজ আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (২০১৬ পরবর্তী) উল্লেখযোগ্য। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অবশ্য ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রাইট উইঙ্গার হিসেবে, পরে থিতু হন লেফট উইংয়ে। এরপর রিয়াল মাদ্রিদের কোচ জিনেদিন জিদানের অধীনে খেলা শুরু করেন সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে, এখন তিনি পুরোদস্তর গোলস্কোরার। অফ দ্য বলে দারুণ মুভমেন্ট, চমৎকার পজিশনিং সেন্স, হেড করার সামর্থ্য – সব মিলিয়ে ৩৭ বছরের রোনালদো এখনও বিশ্বের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড।
ফলস নাইন
সাধারণত একজন নম্বর নাইনই একটা দলের সবচেয়ে সামনে থাকা খেলোয়াড় হয়ে থাকেন। আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে তিনিই থাকেন, চেষ্টা করেন প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাকদের মাঝে জায়গা খুঁজে বের করে গোল করার জন্য। তবে ফলস নাইনদের কাজ কিছুটা ভিন্ন, তারা মাঠের নিচের দিকে নেমে আসেন এবং প্রতিপক্ষের রক্ষণ আর মধ্যমাঠের মাঝে অবস্থান করেন। প্রথাগত নম্বর নাইনদের চেয়ে ফলস নাইন একটু নিচে নেমে আসায় প্রতিপক্ষের সেন্টারব্যাকদের সমস্যায় পড়তে হয়। ফলস নাইনকে মার্ক করতে সেন্টারব্যাককে একটু উপরে উঠে আসতে হয়, ফলে রক্ষণের অনেকটা জায়গা খালি পড়ে থাকে, উইঙ্গাররা যা কাজে লাগিয়ে দ্রুতগতিতে ঢুকে পড়েন প্রতিপক্ষের বক্সে। অনেক ক্ষেত্রে একজন মিডফিল্ডার নিচে নেমে ফলস নাইনকে মার্ক করার চেষ্টা করেন, কিন্তু এতে মিডফিল্ডে নিউমেরিক্যাল সুপিরিওরিটি পেয়ে যায় আক্রমণকারী দলটি।
২০০৬-০৭ মৌসুমে রোমার ফ্রান্সেসকো টট্টি এই ভূমিকায় খেললেও ফলস নাইনের সবচেয়ে ভালো উদাহরণ পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনার লিওনেল মেসি। কাগজে-কলমে সেন্টার ফরোয়ার্ড হলেও মাঠে মেসির ভূমিকা ছিল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের। মেসি নিজে সতীর্থদের জন্য জায়গা তৈরি করে গোলের সুযোগ যেমন তৈরি করতেন, সাথে দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ের জন্য নিজেও গোল পেতেন প্রচুর। গার্দিওলার অধীনে ২১৯ ম্যাচ খেলে মেসি গোল করেছেন ২১১টা, সাথে ৯৪টা অ্যাসিস্ট। মেসি ছাড়া রিয়াল মাদ্রিদের ফরাসি ফরোয়ার্ড করিম বেনজেমাকেও এই ধরনের নম্বর নাইন হিসেবে ধরা যায়।
তবে ফলস নাইন হোক বা পোচার, ফিনিশার হোক বা কমপ্লিট ফরোয়ার্ড, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের খেলার ধরন স্বতন্ত্র। নিজের সামর্থ্যের সাথে কোচের পরিকল্পনা, সব মিলেই নির্ধারিত হয় খেলার ধরনটা। তাই নয় নম্বর জার্সিধারীদের মোটাদাগে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা গেলেও প্রত্যেকেই নিজের জায়গায় অনন্য।