ইংল্যান্ড ফিরে এসেছে। সেই চিরচেনা ইংল্যান্ড।
নাহ, এভাবে ‘চিরচেনা’ বলাটা ঠিক হচ্ছে না। নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে দ্বিতীয় টেস্টে যেভাবে চতুর্থ ইনিংসে তাড়া করে জিতল ইংল্যান্ড, সেটা তো ঠিক সেই অর্থে তাদের প্রথাগত নয়। অবশ্য কবে কারা-ই বা ছিল এমন! পঞ্চম দিনে চতুর্থ ইনিংসে ৫০ ওভারে প্রায় ৩০০ রান তাড়া করে জিতেছে তারা, রানরেট ৫.৯৮। এর থেকে বেশি রানরেট এর আগে রেখেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেটাও ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে, দুর্বল জিম্বাবুয়েকে স্রেফ ৫৪ রানে গুটিয়ে দেওয়ার পর মাত্র ৫০ ওভারে ৩৪০ তুলেছিল তারা। সে এক ম্যাচ ছিল বৈকি; গ্রায়েম স্মিথ করলেন ১০৭ বলে করলেন ১২১; এবি ডি ভিলিয়ার্সও কম যাননি, ওপেনে নেমে করেছিলেন ১১৮ বলে ৯৮ রান। তবে জিম্বাবুয়ে হার মেনেছিল জ্যাক ক্যালিসের কাছেই; প্রথম ইনিংসে বল হাতে নিয়েছিলেন ১৩ রানে ৪ উইকেট, এরপর ব্যাট হাতেও করলেন ২৫ বলে ৫৪ রান। রীতিমতো অবিশ্বাস্য, তাই তো?
যদি সেটাই মনে করে থাকেন, তাহলে ১৫ জুন আপনার কল্পনাকেও হার মানাবে জনি বেয়ারস্টোর এই গল্পটা। নাহ, শুধু বেয়ারস্টোর গল্পটা বললে চলবে না, বলতে হবে ইংল্যান্ডের গল্প, তাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞার গল্প। এই গল্পটা তাই কেবল বেয়ারস্টো-স্টোকস কিংবা ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নয়, গল্পটা ইংল্যান্ডের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞার। আর এই শুরুটা হয়ে গেছে সেই ২০১৫ সালে।
বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই পরাজয়ের পর একদম খোলনলচে বদলে গেছে রঙিন পোষাকে ইংল্যান্ডের দল থেকে শুরু করে পারফরম্যান্স। কিন্তু তার থেকেও বেশি বদলটা এসেছে তাদের মানসিকতায়; এখন ইংল্যান্ড স্রেফ জিততে নামে না, তারা নামে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে। যেই ব্রিটিশদের নামে রক্ষণশীল মানসিকতার ট্যাগটা রীতিমতো আঠার মতো লেগে ছিল, তারা হঠাৎ হয়ে উঠল বিধ্বংসী। ইয়োন মরগ্যানের নেতৃত্বে জেসন রয়-অ্যালেক্স হেলস-জস বাটলারের মতো ব্যাটাররা ঝলমলিয়ে উঠল; এমনকি জিতে ফেলল বিশ্বকাপটাও! তবু টেস্টের রহস্যটা যেন কিছুতেই ভেদ করা যাচ্ছিল না। অধিনায়কত্ব উঠল জো রুটের কাঁধে, তিনিও যেন সুবিধা করতে পারছিলেন না। ২০২১-২৩ ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে অবস্থানটা হয়েছিল এতটাই নাজুক যে নামতে নামতে তারা নেমে গিয়েছিল একেবারে তলানিতে! ফলাফল: রুট সরে দাঁড়ালেন অধিনায়কত্ব থেকে। ইসিবি অনেকটা বাধ্য হয়েই সে গুরুভার তুলে দিল বেন স্টোকসের কাঁধে। বেন স্টোকসের সাথে সাথে কোচিং প্যানেলেও একটা বদল আনলো ইসিবি – ‘টেস্ট কোচ’ হিসেবে দায়িত্ব পেলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম।
এটা হলো আরেক মুশকিল। ম্যাককালাম’কে নিয়ে বিন্দুমাত্র কারো সংশয় ছিল না, থাকার কথাও নয়। তার মতো একজন কিংবদন্তীকে ড্রেসিংরুমে পাওয়াটাও যেকোনো দলের জন্য পরম সৌভাগ্য। কিন্তু… তিনি আর টেস্ট কোচিং? তার দর্শনে যে স্রেফ আগ্রাসন আর আগ্রাসন! ইংল্যান্ডের চিরাচরিত টেস্ট ঐতিহ্যের দিকে তাকালে যে গাম্ভীর্যের খোঁজ পাওয়া যায়, সেটার তুলনায় একদম বিপরীত মেরুতে দাঁড়ানো সে দর্শন। উপরন্তু ম্যাককালামের সর্বশেষ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্স; সেখানেও ফলাফলটা খুব একটা তার পক্ষে কথা বলে না। ঠিক সিদ্ধান্ত হলো কি?
ঠিক কি ভুল, সেটা বোঝার জন্য বোধহয় বোঝা দরকার ইসিবির দৃষ্টিভঙ্গিটা। অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস প্রথমবার ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট হয়ে আসার পর ইয়োন মরগানের চাকরিটা যখন পাকা করলেন, তখনই মাইলস্টোনটা বসে গিয়েছিল ইংলিশ ক্রিকেটে – তারা খেলবে ভয়ডরহীন ক্রিকেট। আর এই মানসিকতার বদলটাই তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল সাফল্যের চূঁড়ায়। আর টেস্টে একদম ‘রকবটম’ ছোঁয়ার পর ইংল্যান্ড আবারও উড়তে চেয়েছিল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিল জয়ের ধারায় ফেরার জন্য। সেই ধারাবাহিকতায়ই বোধহয় ইসিবি সিদ্ধান্ত নিল, এবার আর ব্যাকফুটে খেলবে না তারা। আগ্রাসনেই যখন মিলেছে সাফল্য, এইবার তবে ‘অল-ইন’। স্টোকস-বাজ জুটির চেয়ে ভালো বিকল্প আর হতে পারত না সেই উদ্দেশ্যে। কিন্তু স্রেফ কাগজে-কলমে এসব বললেই তো হয় না, পারফরম্যান্সেও তো উত্তর মেলা চাই!
উত্তরটা দু’জন মিলেই দেবেন বলে ঠিক করলেন বোধহয়। দায়িত্ব নিয়েই স্টোকস ফেরালেন জেমস অ্যান্ডারসন-স্টুয়ার্ট ব্রডকে। এই দু’জনে রীতিমতো ধ্বসিয়ে দিলেন নিউ জিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ, সাথে যোগ্য সঙ্গত দিলেন তরুন ম্যাটি পটস। তবে জিমি-ব্রডি তো বরাবরই এমন বিধ্বংসী; মূল পরিবর্তনটা বোঝা গেল ব্যাটিংয়ে।
প্রথম টেস্টটাও জিতে নিয়েছিল ইংল্যান্ড, তাতে এই ধারণাটা পরিষ্কার পাওয়া যাচ্ছিল যে বাজ-স্টোকসি জুটি ব্যাটারদেরকে বার্তা দিয়েছেন, হৃদয় দিয়ে খেলো, নিজের শক্তির জায়গাটা ব্যবহার করো, নিজেকে উজাড় করে দাও, প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দাও। প্রথম টেস্টে কোনোক্রমে উৎরে গিয়েছিল তারা, কিন্তু সেরাটা বোধহয় জমিয়ে রেখেছিল এই দ্বিতীয় টেস্টের জন্য।
প্রথম ইনিংসে লিড নিয়েছিল ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’; ড্যারিল মিচেল-টম ব্ল্যান্ডেল বীরত্বে ৫৫৩ রান তোলার পর ইংল্যান্ডও যোগ্য উত্তর দিয়েছিল, তবু ১৪ রান পিছনেই থামলো ইনিংসটা। তবে মানসিকতার বদলটা ধরা পড়েছিল তাতেই। ইংলিশ ‘পোস্টারবয়’ জো রুট ১৭৬ করলেন স্রেফ ২১১ বলে, এরপর অধিনায়ক স্টোকস নেমে তো ঝড় তুলে ৩৩ বলে করলেন ৪৬! এরপরও যখন লিড নেওয়া গেল না, এবার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন বোলাররা – মাত্র ২৮৪ রানে আটকে দিয়ে মাত্র ২৯৯ রানের টার্গেট বেঁধে দিল সামনে। কিন্তু সেটাও তো সহজ কিছু নয়; ৫০ ওভারে ২৯৯ কি আর বলেকয়ে করা সম্ভব – তাও আবার পঞ্চম দিনের পিচে সাউদি-বোল্ট-হেনরিদের বিপক্ষে!
চতুর্থ ইনিংসের শুরুটা একটু নড়বড়েই হলো। ৭২ ওভারে ২৯৯ রান তাড়া করার জন্য ঠিক তেড়েফুঁড়ে খেলার কথা নয়, তেমনটা হলোও না। ২৫ ওভার শেষেও রানটা তাই ৯৩, উপরন্তু উইকেট নেই ৪টা। ফর্মের তুঙ্গে থাকা ‘ইংলিশ রাজপুত্তুর’ জো রুটও ফিরে গেছেন। শেষ সেশনে তাই জয়-পরাজয়-ড্র তিন ফলই সম্ভব!
৩৪ ওভার শেষে ৪ উইকেটে ১৩৯ রান নিয়ে শেষ চা বিরতিতে যায় ইংলিশরা। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে ডাহা ফেলটুস মারা জনি বেয়ারস্টো তখন অপরাজিত ছিলেন ৪৮ বলে ৪৩ রানে। ঠিক ঝড়ো ইনিংস বলা না গেলেও নেহায়েত খারাপ যে খেলছিলেন না, সেটা বলাই বাহুল্য। সঙ্গে ছিলেন অধিনায়ক বেন স্টোকস।
ইংলিশ ড্রেসিংরুমে ঠিক কী ধরনের কথা হয়েছিল, বলা দুষ্কর। তবে এরপর যা হলো, সেটা টেস্ট ক্রিকেট দেখেনি বহু বছর।
চা বিরতি শেষে যখন ইংল্যান্ড ফিরল, ততক্ষণে তাদের অ্যাপ্রোচটাই খোলনলচে বদলে গেছে। শেষ সেশনের প্রথম চার ওভারে রান উঠল ৫৯। পুরো টেস্ট সিরিজটাই জঘন্য যাচ্ছিল যে বেয়ারস্টোর, তিনিই হয়ে উঠলেন মূল হন্তারক; ভোজবাজির মতো বদলে দিলেন খেলাটা। প্রথম ৪৩ বলে যিনি তুলেছিলেন ৪৮, পরের ২৯ বলে তুললেন ৫৯ রান! গিলবার্ট জোসেফের ৭৬ বলে (ইতিহাসের চতুর্থ দ্রুততম এবং ইংল্যান্ডের পক্ষে দ্রুততম) শতকের রেকর্ডটাকে নিঃশ্বাস দূরত্বে রেখে ৭৭ বলে ছুঁলেন শতক, এরপর শেষ করলেন ৯২ বলে ১৩৬ করে। স্ট্রাইকরেট ১৪৭.৮৩, টেস্টের শেষ সেশনে, সেটাও বোল্ট-সাউদি বোলিং জুটির বিপক্ষে! অন্য পাশটাতেও ‘পাগলা হাওয়া’ তুলেছেন বেন স্টোকস; ঠিক জনির মতো করে নয় বটে, তবে ১০৭.১৪ স্ট্রাইকরেটে ৭০ বলে ৭৫! ফলাফলটা তো এরপর বলাই বাহুল্য, গণ্ডাকয়েক ওভার হাতে রেখেই ম্যাচটা মুঠোয় পুরে নিল ‘থ্রি-লায়ন্স’রা।
ঠিক কতটা প্রভাবশালী এই জয়, সেটা একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ক্রিকবাজ বলছে, চতুর্থ ইনিংসে ২৫০ রানের বেশি তাড়া করে পরপর দুটো টেস্ট জয়ের কৃতিত্ব এর আগে স্রেফ ‘ইনভিন্সিবল’ অস্ট্রেলিয়া করেছিল; জোহানেসবার্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২৯২ তাড়া করে জেতার পর ফতুল্লায় ৩০৭ রান তাড়া করে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই জয়। ১৪৫ বছর বয়সী টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন কৃতিত্ব নেই আর কোনো দলের! একই সাথে এই জয় ইংল্যান্ডের ইতিহাসে পঞ্চম সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। আর যদি দেখা হয় স্রেফ পঞ্চম দিনের রান, এর চেয়ে বেশি রান তারা টেস্টের পঞ্চম দিনে তুলতে পেরেছিল কেবল একবার – লীডসে, ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে (৩১১)।
পার্টনারশিপটা বেয়ারস্টো এবং স্কিপার বেন স্টোকসের জন্যও ছিল স্পেশাল। তাদের এই ১২১ বলে ১৭৯ রানের জুটিতে রানরেট ছিল ৮.৮৭, যা কি না শতাধিক রানের পার্টনারশিপে ইতিহাসেরই তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর আগের দুটো দৃষ্টান্তেও ছিল নিউ জিল্যান্ডের নাম; প্রথমবার করেছিলেন নাথান অ্যাস্টল এবং ক্রিস কেয়ার্নস, সেই ২০০২ সালে ১০.৮৯ তুলেছিলেন প্রতি ওভারে। এরপর দ্বিতীয় সেরা রানরেটের রেকর্ডে আছেন কোরি অ্যান্ডারসন আর ব্রেন্ডন ম্যাককালাম; ২০১৬ সালে তারা তুলেছিলেন প্রতি ওভারে ৯.৭৬ করে।
চা বিরতির সময়টুকুতে ম্যাককালাম এই গালভরা গল্পটাই শুনিয়েছিলেন কি না, কে জানে! এই গল্পটা তার চেয়ে ভালো বলতে পারার যোগ্য মানুষ যে খুব বেশি নেই!