অবশেষে বাংলাদেশের সাথে টেস্ট ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলার পর এগারো বছরের বেশি সময় হতে চলল। ২০১৫ সালে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, নিরাপত্তার অজুহাতে সেবার বাংলাদেশ সফরে আসেনি অস্ট্রেলিয়া। সেই সময়সূচী পেছাতে পেছাতে ২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পৌঁছায়। এবারও অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশে আসা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছিল। বোর্ডের সাথে ক্রিকেটারদের চুক্তি না করার কারণে সফরটির ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিয়তা ছিল। শেষ পর্যন্ত সবকিছু মিটমাট হয়, এবং পূর্বের সময়সূচী অনুযায়ী ২৭ আগস্ট প্রথম টেস্ট এবং ৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় টেস্ট অনুষ্ঠিত হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে আজ রাতেই ঢাকা পৌঁছাবে অজিরা।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ২০০৬ সালে সর্বশেষ টেস্ট খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া। ২০১১ সালে সর্বশেষ দ্বিপাক্ষিক ওডিআই সিরিজ খেলেছিল তারা। এরপর ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে এবং সদ্য সমাপ্ত চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দুবার মুখোমুখি হলেও বৃষ্টির কারণে কোনো ম্যাচে ফলাফল আসেনি। দু’দলের ক্রিকেটারদের কাছেই তাই এই টেস্ট সিরিজটি গুরুত্বপূর্ণ। স্কোয়াডে থাকা দুই দলের ক্রিকেটাররা এই প্রথমবারের মতো একে অপরের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ খেলবেন। সাথ আছে স্টিভেন স্মিথের অস্ট্রেলিয়ার উপমহাদেশে নিজেদের প্রমাণ করার পালা। সেইসাথে বাংলাদেশেরও ক্রিকেট বিশ্বের কাছে নিজেদের সামর্থ্যের বার্তা দেওয়ার অন্যতম পরীক্ষাক্ষেত্র হতে যাচ্ছে এটি। দেশের মাটিতে বাংলাদেশ এখন যেকোনো দলের জন্য হুমকি স্বরূপ। গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে জিততে জিততে হারা এবং মিরপুর টেস্টে জয় পাওয়া সহ শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে হারানোর সুখস্মৃতি এখনও অম্লান। অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে উপমহাদেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার পারফরমেন্স খুবই হতাশাজনক।
উপমহাদেশে নাজেহাল অজিরা
স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংদের অস্ট্রেলিয়া উপমহাদেশের মাটিতে বেশ সফল ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে উপমহাদেশের মাটিতে ১৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলে মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ১১টিতে পেয়েছে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ। অস্ট্রেলিয়া উপমহাদেশের মাটিতে শেষবার টেস্ট সিরিজ জিতেছিল মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বাধীনে, ২০১১ সালে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। তখনও অজিদের টেস্ট দলে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মাইক হাসি, রিকি পন্টিংরা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় গলে। ঐ ম্যাচে ১২৫ রানে জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। সিরিজের বাকি দুটি টেস্ট অমীমাংসিত ভাবে শেষ হলে ১-০ তে সিরিজ জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া। ২০১১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জয়ের পর উপমহাদেশের মাটিতে পরবর্তী সিরিজ খেলে তারা ভারতের বিপক্ষে। মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বে চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে ভারত সফরে আসে অস্ট্রেলিয়া। পুরো সিরিজেই কোণঠাসা ছিল অজিরা। সিরিজের প্রথম ম্যাচে আট উইকেটে পরাজিত হওয়ার পর দ্বিতীয় টেস্টে ইনিংস ও ১৩৫ রানে পরাজিত হয় ক্যাঙ্গারুরা। তৃতীয় এবং চতুর্থ টেস্টে ছয় উইকেটের ব্যবধানে পরাজিত হয়ে হোয়াইটওয়াশ হয় অস্ট্রেলিয়া।
২০১৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুবাই এবং আবুধাবিতে দুটি টেস্ট ম্যাচ খেলে অস্ট্রেলিয়া। দুটি ম্যাচেই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় তারা। সিরিজের প্রথম টেস্ট অনুষ্ঠিত হয় দুবাইতে। পাকিস্তান আগে ব্যাট করে প্রথম ইনিংসে ৪৫৪ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে দুই উইকেটে ২৮৬ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। জবাবে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৩০৩ রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ২১৬ রানে গুটিয়ে গিয়ে ২২১ রানে পরাজিত হয়। আবুধাবিতে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে আরও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ইনিংসে পাকিস্তান ছয় উইকেটে ৫৭০ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে। জবাবে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ২৬১ রানে গুটিয়ে গিয়ে ফলো-অনে পড়ে। অজিদের ফলো-অনে না পাঠিয়ে, দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে তিন উইকেটে ২৯৩ রান করে আবারও ইনিংস ঘোষণা করে পাকিস্তান। যার ফলে, অজিদের সামনে জয়ের জন্য ৬০৩ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড়ায়। দ্বিতীয় ধাপে ব্যাট করতে নেমে ২৪৬ রানে অজিদের ইনিংস থেমে গেলে পাকিস্তান ৩৫৬ রানের বড় জয় তুলে নিয়ে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে অজিদের হোয়াইটওয়াশ করে।
কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে এবং তিলকরত্নে দিলশান বিহীন শ্রীলঙ্কা দলের বিপক্ষে পরবর্তী টেস্ট সিরিজ খেলতে ২০১৬ সালে উপমহাদেশে আসে অস্ট্রেলিয়া। অধিনায়ক বদলালেও অজিদের ভাগ্য বদলায়নি। স্টিভ স্মিথের নেতৃত্বে অনভিজ্ঞ শ্রীলঙ্কানদের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ হয়ে বাড়ি ফিরে তারা। সেই দলের বিপক্ষেই নিজেদের শেষ টেস্টে জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেই একই দলের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ১০৬ রান, দ্বিতীয় টেস্টে ২২৯ রান এবং তৃতীয় টেস্টে ১৬৩ রানের বড় ব্যবধানে পরাজিত হয় অস্ট্রেলিয়া।
অস্ট্রেলিয়া, উপমহাদেশের মাটিতে নিজেদের সর্বশেষ টেস্ট সিরিজ খেলে চলতি বছরে, ভারতের বিপক্ষে। পুনেতে চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ৩৩৩ রানের বড় জয় তুলে নিয়ে সবাইকে চমকে দেয় স্টিভ স্মিথের অস্ট্রেলিয়া। একে তো রবীচন্দ্রন অশ্বিন, জাদেজাদের নিয়ে বিরাট কোহলির ভারত অপ্রতিরোধ্য; অন্যদিকে স্টিভ স্মিথ রেনশ্, হ্যান্ডসকম্বদের নিয়ে দল গোছাতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন। সময়টাও বেশ খারাপ যাচ্ছিলো। তবুও সবরকমের সমীকরণ বদলে দিয়ে অজিদের জয়ের মুখ দেখান বাঁহাতি স্পিনার স্টিভ ও’কিফ। তিনি ম্যাচে ১২ উইকেট শিকার করে উপমহাদেশের মাটিতে টানা নয় হারের পর অজিদের জয় এনে দেন তিনি।
উপমহাদেশের মাটির সাথে অজিদের মধুচন্দ্রিমার স্থায়ীত্ব অল্পদিনেই শেষ হয়ে যায়। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে মাত্র ১৮৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ভারতীয় স্পিনারদের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করে ১১২ রানেই গুটিয়ে যায় তারা। সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ড্র করলেও চতুর্থ টেস্টে আট উইকেটে পরাজিত হয়ে ঘরে ফিরে তারা। এতে করে ২০১১ সালের পর উপমহাদেশের মাটিতে অজিদের সিরিজ জয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেলো।
তুরুপের তাসের খোঁজে অস্ট্রেলিয়া!
উপমহাদেশের মাটিতে অজিদের ব্যর্থতার মূল কারণ অনভিজ্ঞতা। সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিয়ে ভালো পারফর্ম করা ব্যাটসম্যান দলে নেই বললেই চলে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০১১ সালে টেস্ট সিরিজ জয়ের পর উপমহাদেশের মাটিতে ১৩টি টেস্ট ম্যাচ খেলে অস্ট্রেলিয়া। এই ১৩টি টেস্টে ৩০ জন ক্রিকেটার অজিদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। যার মধ্যে সবকটি টেস্ট ম্যাচ খেলেন মাত্র একজন! তিনি হলেন ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার।
স্টিভ স্মিথ ছাড়া আর কোনো ব্যাটসম্যানই উপমহাদেশের মাটিতে নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারেননি। স্টিভ স্মিথ ১১ টেস্টে ৫১.৪৭ ব্যাটিং গড়ে ১,০৮১ রান করেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ডেভিড ওয়ার্নার ৩০.৩৮ ব্যাটিং গড়ে মাত্র ৭৯০ রান করেন। স্টিভ স্মিথ ছাড়া অজিদের আর কোনো ব্যাটসম্যান ৩৫ ব্যাটিং গড়েও রান করতে পারেননি, আর কোনো ব্যাটসম্যান একের অধিক শতকও হাঁকাতে পারেননি।
বোলিং বিভাগেরও একই দশা। স্পিনার নাথান লায়ন প্রায় ৩৮ বোলিং গড়ে ৫৩ উইকেট শিকার করে নিজের দায়িত্ব কোনোরকমে পালন করে গেলেও তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য একেকবার একেক স্পিনারের শরণাপন্ন হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান টিম ম্যানেজমেন্ট। অবশ্য সবচেয়ে বেশি সফল স্টিভ ও’কিফকে বাংলাদেশের বিপক্ষে দুই টেস্টের স্কোয়াডেই রাখেনি নির্বাচকমণ্ডলী। এছাড়া সবচেয়ে সফল পেসার মিচেল স্টার্ক মাত্র আট ম্যাচ খেলেছেন। এই আট ম্যাচে তিনি ৩৩ উইকেট শিকার করে নিজের দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছেন। ইনজুরির কারণে বাংলাদেশ সফরে আসা হচ্ছেনা মিচেল স্টার্কেরও।
উপমহাদেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া বরাবরই ব্যর্থ ছিল, সেটাও বলাও যাবে না। ২০০০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত স্টিভ ওয়াহ এবং রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বে ১৫টি টেস্ট খেলে ১১টিতেই জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সে সময়ের সাথে বর্তমান সময়ের পার্থক্য হলো, ম্যাচ উইনার প্লেয়ারের সংখ্যা। বর্তমানে যেমন ডেভিড ওয়ার্নার উপমহাদেশের মাটিতে নিজের পায়ের তলার মাটি খুঁজে পান না, সে সময় ম্যাথু হেইডেনের বেলায় এমন ছিলো না। ম্যাথু হেইডেন উপমহাদেশের মাটিতেও বোলারদের বেধড়ক পেটাতেন, এখানে ১৫ ম্যাচে ৫৪.৯৬ ব্যাটিং গড়ে ১,৪২৯ রান করেছিলেন তিনি। এছাড়া ড্যামিয়েন মার্টিন, রিকি পন্টিং, ড্যারেন লেহম্যান, স্টিভ ওয়াহ, মাইকেল ক্লার্ক, সাইমন ক্যাটিচ, মাইক হাসিদের ব্যাটিং গড়ও চল্লিশের চেয়েও বেশি ছিল। হেইডেন, গিলক্রিস্ট এবং মার্টিন চারটি করে শতক হাঁকিয়েছিলেন উপমহাদেশে।
বোলিং বিভাগ নিয়েও তখন কোনপ্রকার দুশ্চিন্তা ছিল না অজিদের। সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করছিলো। সে সময় দলে ছিলেন বিশ্বসেরা লেগস্পিনার শেন ওয়ার্ন, তিনি ১৪ ম্যাচে শিকার করেছিলেন ৮৮ উইকেট। ইনিংসে পাঁচ উইকেট আটবার এবং ম্যাচে দশ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনবার। শুধুমাত্র স্পিনারদের উপর নির্ভরশীল ছিল না অস্ট্রেলিয়া। গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পিরাও এশিয়ান ব্যাটসম্যানদের নাস্তানাবুদ করেছেন। গিলেস্পি ১৩ ম্যাচে ৫৪ উইকেট এবং ম্যাকগ্রা ১০ ম্যাচে ৪৫ উইকেট শিকার করেছিলেন। তাদের সাথে শেন ওয়ার্নকে সমর্থন দেওয়ার জন্য স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলও ছিলেন।
উপমহাদেশে ভালো করার জন্য ব্যাটসম্যানদের পাশাপাশি বোলারদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। বাংলাদেশের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্টের সিরিজ থেকে ইতোমধ্যে ইনজুরির কারণে বাদ পড়েছেন মিচেল স্টার্ক এবং জেমস প্যাটিনসন। তাই অজিদের পেস অ্যাটাকে শাণ দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে জস হ্যাজলেউড এবং ক্যারিয়ারে তিনটি টেস্ট খেলা প্যাট কামিন্স ও আটটি টেস্ট খেলা জ্যাকসন বার্ডের উপর। গত কয়েক বছর ধরে অজিদের স্পিন ডিপার্টমেন্ট সামাল দেওয়া নাথান লায়নের উপর এবারও গুরুদায়িত্ব পড়েছে। তাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য স্কোয়াডে থাকা বাকি দুই স্পিনার টেস্ট ক্রিকেটে খুব একটা অভিজ্ঞ নন। অ্যাস্টন আগার দুটি টেস্ট খেললেও মিচেল সুয়েপসন এখনও টেস্ট অভিষেকের অপেক্ষায় আছেন। হয়তো মিচেল সুয়েপসন কিংবা অ্যাস্টন আগারই হতে পারেন অস্ট্রেলিয়ার তুরুপের তাস। নয়তো অভিজ্ঞ নাথান লায়নই উপমহাদেশে অজিদের শেষ ভরসা।