দশ ‘দশে দশ’

“চাঁদে প্রথম কে পা রাখেন?”
“নীল আর্মস্ট্রং।”
“সঠিক উত্তর। এবার বলো তো, দ্বিতীয় পা রাখেন কে?”
“অ্যা?!”
“আরে, এটাও নীল আর্মস্ট্রংই ছিলো। নাহলে এক পায়ে ল্যাংড়া হয়ে হাঁটবে নাকি?”

বহুল প্রচলিত এবং কচলিয়ে কচলিয়ে তেতো হয়ে যাওয়া একটা কৌতুক দিয়ে বোরিং একটা শুরু করলাম এই লেখাটার। তবে এই কৌতুকটার রেফারেন্স দেখিয়েই ছোটবেলায় আমরা একটা প্রবাদ শিখেছিলাম, “দ্বিতীয়দের পৃথিবী মনে রাখে না, মনে রাখে প্রথমদেরই।” একটু শক্তপোক্ত হয়ে বসুন, এই ধারণা এখনই ভুল প্রমাণ করে দেবো। কিছুটা বৈঠকি কেতায় আড্ডাচ্ছলে লিখে ফেলবো পুরোটা, সেজন্য কেউ দয়া করে কপাল কুঁচকে বসবেন না।

প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংসে দশ উইকেট পান জিম লেকার; Image Source: Getty Image

একটা প্রশ্ন। বলুন তো, ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে প্রথমবারের মতো ইনিংসে দশ উইকেট কে নেন? জিম লেকার তো?

উহু, হয়নি। জিম লেকার একই মৌসুমে দু’বার ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়ার অনন্য কীর্তি গড়েছিলেন বটে, তবে সেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একবার এবং একবার কাউন্টিতে। এই কীর্তি প্রথমবারের মতো গড়েন যিনি, ওই ভদ্রলোকের নাম এডমান্ড হিংকলি, জাতিতে ছিলেন খাঁটি ব্রিটিশ। খটমটে এই নামটাই অপরিচিত লাগছে তো? স্বাভাবিক। বিশ্বাস করুন, এই লেখা শুরু করার আগপর্যন্ত আমি এই ভদ্রলোকের নাম কস্মিনকালেও শুনি নি। তবে তাঁর ক্যারিয়ার নিয়ে ঘেঁটে খুব কম যা তথ্য জোগাড় করতে পারলাম, সে হিসেবে বলাই যায় যে তিনি নিরতিশয় প্রতিভাবান ছিলেন। ৪৩টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলে তিনি ‘অন্তত’ ১৮৯টি উইকেট পেয়েছিলেন। গড়টাও নেহায়েত মন্দ নয়, ১৪.৩৪*।

নিশ্চয়ই খেয়াল করে ফেলেছেন এতক্ষণে, আমি উইকেটের সংখ্যার আগে ‘অন্তত’ এবং গড়ের ঠিক উপরে একটা তারকা চিহ্ন দিয়েছি। আসলে ব্যাপারটা আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগের ব্যাপার, সাল ১৮৪৮। তখনো ঠিক সেভাবে কাগজে-কলমে হিসাবনিকাশ রাখা হতো না এসবের, ফলে একেবারে ঠিকঠাক হিসাব পাওয়ার সম্ভাবনা নেহায়েত কম। ঘেঁটেঘুঁটে কোনোরকমে একটা মোটামুটি স্কোরকার্ড খুঁজেটুজে বের করে এনেছি বটে, তাতে ওভার কিংবা রানের বিশেষ বর্ণনা না থাকলেও দশ উইকেট যে হিংকলিই নিয়েছিলেন, সে সত্যতা কিছুটা প্রমাণ করতে পারে।

ক্রিকইনফো বলছে সেই ইনিংসে তিনি ৪৮ রানেই পেয়েছিলেন ১০ উইকেট, তবে সেটা ঠিক শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছি না। কারণ ওই যে, সঠিক হিসেব নেই। ওই ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই পেয়েছিলেন আরো ৬টি উইকেট, তবে দলকে জেতাতে পারেননি। দুই ইনিংসে ইংল্যান্ড একাদশকে বেঁধে ফেলেছিলেন যথাক্রমে ১২০ ও ৭৪ রানে, তবুও হিংকলির দল ‘কেন্ট’কে হারতে হয়েছিলো ৫৫ রানে।

হিংকলির কীর্তি গড়া সেই ইনিংসের স্কোরকার্ড; Image Source: cricketarchive.com

একই ম্যাচে ইংল্যান্ড একাদশের হয়ে খেলেছিলেন আরেকজন খেলোয়াড়, যিনি দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে দু’বছর বাদেই ইনিংসে দশ উইকেট পান। ওই খেলোয়াড়ের নাম জন উইজডেন। পরিচিত লাগছে বুঝি নামটা? ঠিক ধরেছেন, ‘বাইবেল অফ ক্রিকেট’ খ্যাত ‘উইজডেন অ্যালমানাক’ নামের ম্যাগাজিনটা তাঁর নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছে।

উইজডেন অ্যালমানাকের ২০১৪ সংস্করণের কভারে শচীন টেন্ডুলকার; Image Source: John Wisden & Co

জন উইজডেন আবার শুধু এক দফা ‘দশে দশ’ নিয়ে ক্ষান্ত হননি, ওই দশটা উইকেটের সবগুলোই ছিলো বোল্ড! বিশ্বাস হলো না তো? বেশ, তবে স্কোরকার্ডই দেখুন। তবে রান কিংবা ওভার জানতে চাইবেন না, পুরো ইন্টারনেট তন্নতন্ন করে ফেলেও ঠিক জোগাড় করে দিতে পারলাম না। কেউ পেয়ে গেলে অনুগ্রহ করে জানাবেন অবশ্যই।

উইজডেনের ‘দশে দশ’, সবগুলোই ছিলো বোল্ড; Image Source: cricketarchive.com

দেখলেন তো? ‘দ্বিতীয়দের কেউ মনে রাখে না’ কথাটা একেবারে ঘোরতর মিথ্যে! উইজডেনকে তো ঠিকই মনে রেখেছে সবাই; যেভাবেই হোক না কেন, শতবর্ষ পর আজও তাঁর নাম নেওয়া হয় গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে।

তবে হিংকলি বা উইজডেন নন, দশ উইকেট নেওয়াতে সবচেয়ে চৌকষ ছিলেন হেডলি ভ্যারিটি। ১৯৩১ সালে নিজের ২৬তম জন্মদিনে ওয়ারউইকশায়ারের বিপক্ষে ৩৬ রানে ১০ উইকেট নিয়ে গুটিয়ে দিলেন প্রতিপক্ষকে। তবে তাতে যেন ঠিক মন ভরলো না ভ্যারিটির, পরের বছর নটিংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে ১৯.৫ ওভারে মাত্র ১০ রানেই নিয়ে নিলেন ১০ উইকেট! যে কীর্তি গড়া একজন বোলারের আজীবনের স্বপ্ন, সেই কীর্তি পরপর দু’বছরে দু’বার গড়লেন ভ্যারিটি!

হেডলি ভ্যারিটির ‘দশে দশ’ পাওয়ার সেই ম্যাচে স্কোরকার্ডের একটি স্থিরচিত্র; Image Source: Getty Image

ভ্যারিটির কীর্তি দেখে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? তাহলে আলফ্রেড ‘টিচ’ ফ্রিম্যানকে আপনার মনে হবে অতিমানব। ইংলিশ এই লেগ স্পিনার ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন মাত্র ১২টি ম্যাচ, তবে তাতেই তাঁর রেকর্ড রীতিমত দুর্ধর্ষ! এই ১২ ম্যাচেই ২৫.৮৬ গড়ে নিয়েছেন ৬৬ উইকেট, যার মধ্যে তিনবারই নিয়েছেন ম্যাচে দশ উইকেট। নাহ, এগুলোর কোনোটাতেই তিনি দশ উইকেট পাননি। তিনি দশ উইকেট পেয়েছিলেন কেন্টের হয়ে, দু’বার ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে আর একবার এসেক্সের বিপক্ষে। কত হলো বলুন তো? চোখ কচলানোর কিছু নেই, ঠিক পড়েছেন, তিনি গুনে গুনে তিনবার এই কীর্তি গড়েছেন। সেটাও টানা তিন বছরে তিনবার; ১৯২৯ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে ১০-১৩১, এরপর ১৯৩০ সালে এসেক্সের বিপক্ষে ১০-৫৩ এবং ১৯৩১ সালে ১০-৭৯। এখনও অতিমানব মনে হচ্ছে না? তবে আর একটা বোনাস তথ্য, এই তিনবার কীর্তি গড়ার সময় তাঁর বয়স ছিলো যথাক্রমে ৪২, ৪৩ এবং ৪৪ বছর। কাউন্টি ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা এই লেগ স্পিনারকে নিয়ে বিস্তারিত কথা হবে অন্য কোনোদিন।

টিচ ফ্রিম্যান ‘অন অ্যাকশন’; Image Source: PA Photos

তবে কি ফ্রিম্যানই ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বয়স্ক বোলার, যিনি ইনিংসে দশ উইকেট নিয়েছেন?

আজ্ঞে না, তাঁর চেয়েও বেশি বয়সে ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়া এক ভদ্রলোক রয়েছেন। খেলোয়াড়ি জীবনে পাঁড় মাতাল হিসেবে বিশেষ ‘সুখ্যাতি’ থাকা ব্রিটিশ মিডিয়াম ফাস্ট বোলার উইলিয়াম ‘বিলি’ বেস্টউইক গ্ল্যামারগনের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়ার সময় তাঁর বয়স ছিলো ৪৬ বছর ১১৬ দিন।

বেস্টউইক যেদিন এই কীর্তি গড়েন, তারিখটা ছিলো ২০ জুন ১৯২১। অদ্ভুতভাবে ওই একই দিনে উরচেস্টারে অনুষ্ঠিত ম্যাচে সমারসেটের হয়ে দশ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন আরেক ব্রিটিশ জ্যাক হোয়াইটও। একই দিনে দুজনের দশ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এই একটাই।

উইলিয়াম ‘বিলি’ বেস্টউইক; Image Source: Getty Image

আচ্ছা, সবচেয়ে বয়স্ক ‘টেন অন টেন’-এর নাম জানা গেলো। এবার তাহলে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়টির নাম জানার পালা। এই রেকর্ডটি দখলে রয়েছে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ইমরান আদিলের। তিনি ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ফয়সালাবাদের বিপক্ষে যখন দশ উইকেট পান, তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ১৮ বছর ৩৪৪ দিন!

আর যদি বিবেচনা করা হয় সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে ইনিংসে দশ উইকেট পাওয়ার কথা, সেক্ষেত্রে দশে দশ পাবেন ব্রিটিশ বোলার অ্যালবার্ট মস। প্রায় সব বোলারের আজন্ম স্বপ্ন থাকে ইনিংসে সবগুলো উইকেট পাওয়ার, আর সেখানে মস নিজের অভিষেক ম্যাচেই নাম লিখিয়েছিলেন ইতিহাসে। ১৮৮৯-৯০ মৌসুমে ওয়েলিংটনের বিপক্ষে মসের অভিষেক হয়ে যায় ক্যান্টারবুরির হয়ে, আর অভিষেকেই বাজিমাৎ করে দেন মাত্র ২৮ রানে ১০ উইকেট তুলে নিয়ে! ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা বোলিং ফিগারের তালিকায় এটি রয়েছে পাঁচ নম্বরে। অথচ সে ম্যাচের পর মাত্র তিন ম্যাচ খেলতে পারার সৌভাগ্য হয়েছে মসের, সে গল্প হয়তো অন্য আরেকদিন শোনা যাবে!

এই কীর্তিতে যদি কেবলই ‘সাদা চামড়ার নাক উঁচু ব্রিটিশদের ছড়াছড়িই দেখতে পান, তবে জেনে রাখুন এ তালিকায় একজন বাঙালিও অবস্থান করছেন সগৌরবে। তিনি ভারতীয় প্রয়াত মিডিয়াম পেসার প্রেমাংশু চট্টোপাধ্যায়, ১৯৫৬-৫৭ সালের রঞ্জি ট্রফিতে ‘বাংলা’ বনাম ‘আসাম’ ম্যাচে প্রথম ইনিংসে মাত্র ২০ রানেই ১০ উইকেট নিয়ে গুটিয়ে দেন আসামকে। তবে কোনো এক অদ্ভুত কারণে আসামের বিপক্ষে ওই ম্যাচেই দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮ ওভার বোলিং করেও রইলেন উইকেটশূন্য। বলাই বাহুল্য, প্রথম ইনিংসে প্রেমাংশুর দশ উইকেট সর্বকালের সেরা বোলিং ফিগারের তালিকায় অবস্থান করছে তিন নম্বরে।

প্রথম ইনিংসে প্রেমাংশুর দশ উইকেট সর্বকালের সেরা বোলিং ফিগারের তালিকায় অবস্থান করছে তিন নম্বরে। Image Source: CrickInfo

শুধু এই কয়েকটাই নয়, বরং এমন কীর্তি রয়েছে সাকুল্যে ৮০টি। আর যদি ১২ উইকেটের যুগে দশ উইকেট হিসেবে নেওয়া হয়, তবে সেটা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ৮৩তে। ফলে বিরল হলেও যে এই কীর্তি নেহায়েত কম ঘটেনি, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। তবে ক্রিকেট একটা অদ্ভুত খেলা। এই খেলা খালি হাতে যেমন ফিরাতে পারে, তেমনি উপহারে দু’হাত ভরিয়ে দিতেও পারে। প্রায় ১৭০ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র ৮৩ বার দশে দশ পাওয়াটাই বুঝিয়ে দেয় এই অর্জনের মাহাত্ম্য কতটা।

সবশেষে একটা বোনাস তথ্য। সর্বশেষ কবে, কোন বোলার ইনিংসে দশ উইকেট পেয়েছেন? উত্তরঃ ২০০৯-১০ সালে ইসলামাবাদের বিপক্ষে পাকিস্তানী স্পিনার জুলফিকার বাবর এই কীর্তি গড়েন।

 

This article is in Bangla language. It's about some amazing record in cricket history. 

Featured Image: Getty Image

Source: 

(১) cricketarchive.com/Archive/Scorecards/0/829.html

(২) espncricinfo.com/england/content/player/14844.html

(৩) espncricinfo.com/ci/content/story/128779.html

(৪) cricketarchive.com/Archive/Scorecards/0/889.html

(৫) espncricinfo.com/magazine/content/story/303624.html

(৬) espncricinfo.com/england/content/player/22688.html

(৭) stats.espncricinfo.com/ci/content/records/209288.html

(৮) static.espncricinfo.com/db/ARCHIVE/1950S/1956-57/IND_LOCAL/RANJI/ASSAM_BENG_RJI_26-29JAN1957.html

(৯) cricketarchive.com/Archive/Scorecards/13/13657.html

(১০) cricketarchive.com/Archive/Scorecards/13/13195.html

(১১) cricketarchive.com/Archive/Scorecards/13/13845.html

(১২) espncricinfo.com/england/content/player/12918.html

Related Articles

Exit mobile version