মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম থেকে যেদিন এশিয়া কাপের মিশনে রওয়ানা হলো বাংলাদেশ, সেদিনই বলে দিয়েছিল ফাইনালের কথা। বাংলাদেশ ফাইনাল খেলতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছে। হিসেবের মারপ্যাঁচ, ভাগ্যের ছেঁড়া সুতো কিংবা আবেগী চিন্তাভাবনা; যা-ই হোক, মুশফিকুর রহিম-মাশরাফি বিন মুর্তজাদের পণ এশিয়া কাপের শিরোপা। মুখে ফাইনাল বললেও, মনে কেবলই শিরোপা। কিন্তু হয়নি, আবারও ভারতের বিপক্ষেই এশিয়া কাপের ফাইনাল থেকে ছিটকে পড়ে বাংলাদেশ। হার মানে, সেই শেষ বলে পরাজয়। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘দানে দানে, তিন দান’। কিন্তু আবুধাবিতে মাশরাফিদের সঙ্গে প্রবাদটা ঠিক খাটলো না। তৃতীয়বারের মতো ফাইনাল থেকে ফিরতে হলো রানার্সআপের তকমা নিয়ে।
এশিয়া কাপে বাংলাদেশের এবারের সফরটা ছিল ঘটনাবহুল। তামিমের আঙ্গুল ভেঙ্গে যাওয়া, সেই ভাঙ্গা আঙ্গুলেই এক হাত দিয়ে ব্যাট করতে নামা, পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়, আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে পরাজয়, মুশফিকের পাঁজরের ব্যথায় ড্রেসিংরুমে টিম ম্যানেজমেন্টের মাথায় হাত, খেলার আগেই সূচি বদলে দেওয়া, সাকিবের শেষ মুহূর্তে ইনজুরির কারণে দেশে ফেরা আর মাশরাফির ক্যাচ ধরতে গিয়ে আঙুলের চোট। পুরো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ কি করেনি, তার ইয়ত্তা নেই।
হার-জিত, শিরোপা হাতছাড়া সবই হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ জিতেছে কোটি সমর্থকের হৃদয়। মাঠে লাল-সবুজ জার্সিধারীদের পারফরম্যান্সে গ্যালারির সমর্থকরা কখনও কেঁদেছে, কখনও আবার উল্লাসে ফাটিয়েছে গলা। আরবের মরুভূমির তপ্ত বালুও গেয়েছে মাশরাফিদের স্তুতিবাক্য।
বাংলাদেশ দিনশেষে জিতিয়েছে ক্রিকেটকে, চিনিয়েছে নিজেদেরকে। সাকিব-তামিম ছাড়া যেখানে দলের নির্ভরতার খুঁটি প্রায় যায়-যায়, সেখানে তরুণদের নিয়েও জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। ফাইনাল ম্যাচে ধোনি-রোহিত-শেখরদের সামনে খেলেছে বুক চিতিয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট, টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডেতে যেখানে বারবার সমালোচিত হয়েছিল দলের তরুণ ক্রিকেটাররা, সেখানে এশিয়া কাপে বড়দের অনুপস্থিতিতে দায়িত্বগুলো দারুণভাবে কাঁধে তুলে নিয়েছিল এই লিটন কুমার দাস, মেহেদী হাসান মিরাজরা।
বাংলাদেশের এমন পারফরম্যান্সে একটুও অবাক হননি পাকিস্তানের কিংবদন্তী সাবেক ফাস্ট বোলার ওয়াকার ইউনিস। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ৮৭ টেস্টে ৩৭৩ উইকেট ও ২৬২ ওয়ানডে ম্যাচে ৪১৬ উইকেট নেওয়া এই বোলার মাশরাফিদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই তিনি খুব ভালো করেই জানেন, এই ছেলেগুলো কি করতে পারে। তাই জানিয়ে দিয়েছেন, ফাইনালে শিরোপা হাতে মাশরাফি-রিয়াদদের হাসিমুখে দাঁড়াতে দেখলে তিনি একটুও অবাক হতেন না। তবে পাকিস্তানের এহেন পারফরম্যান্সে তিনি যারপরনাই হতাশ। যে দলটা সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপা জিতলো, সেই দলটিই এবার এশিয়া কাপে মুখ থুবড়ে পড়লো দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। বাংলাদেশ ও ভারত তো বটেই, পাকিস্তান হেরেছে আফগানিস্তানের বিপক্ষেও। বাংলাদেশকে এশিয়ান ক্রিকেটের নতুন ‘পরাশক্তি’ বললেও, তাকে ভাবাচ্ছে পাকিস্তান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক এই হেড কোচ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সেসব কথাই বলেছেন মন খুলে। পুরো এশিয়া কাপে পাকিস্তান দলের পারফরম্যান্সের কাটাছেঁড়া করেছেন। বলেও দিয়েছেন, আসলে কী করা উচিত ছিল সরফরাজ আহমেদদের। পাশাপাশি ক্রিকেটপ্রেমী জাতি হিসেবে পাকিস্তানের ক্রিকেটে কী কী হওয়া উচিত, তা নিয়েও আলোচনা করেছেন।
এবারের এশিয়া কাপে পাকিস্তানের পারফরম্যান্স দেখে আপনি মনে হয় খুব হতাশ হয়েছেন। আপনার কাছে এর কোন ব্যাখ্যা আছে?
হ্যাঁ, ঘটনাটা খুব কষ্টদায়ক। গেল এক বছর ধরেই পাকিস্তান প্রতিনিয়ত বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এবারের এশিয়া কাপে দলের কোন সদস্যই তাদের ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি, মনে রাখার মতো ইতিবাচক কিছু করে দেখাতে পারেনি। আরেকটা ব্যাপার হলো, ফলাফল জিনিসটা কারোর হাতে নেই। কিন্তু ফল যা-ই হোক, আপনাকে জয় পাওয়ার জন্য সঠিক ও সর্বোচ্চ চেষ্টাটা তো করতে হবে! পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে পাকিস্তান দলের প্রতিটি সদস্যদের শরীরী ভাষা নিষ্প্রভ ছিল। তাদের আত্মবিশ্বাসের অনেক ঘাটতি ছিল। দল হিসেবে তাদের অভিজ্ঞতা খুব কম ছিল, তেমন কিছুও নয়। কিন্তু তারা মাঠে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেনি। শুধু তা-ই নয়, এই দলেরই বেশ কয়েকজন সদস্য চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলেছে, শিরোপা জিতেছে। তারা পরীক্ষিত ক্রিকেটার। কিন্তু এশিয়া কাপে নিজেদেরকে কেউই মেলে ধরতে পারেনি।
এশিয়া কাপে পাকিস্তান দলের ফাইনালে জায়গা না পাওয়া, ধারাবাহিক ব্যর্থতা; সবমিলিয়ে ক্রিকেটপ্রেমী দেশ হিসেবে পাকিস্তানের সমর্থকদের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখছেন?
যেমনটা হওয়ার, তেমনই হয়েছে (পাকিস্তানি সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া)। কেউ খুশি নয়, সবাই হতাশ। কারণ টুর্নামেন্টের শুরুতে সবাই বিশ্বাস রেখেছিলো, পাকিস্তান অন্তত ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছাবে। কিন্তু হয়েছে তার উল্টোটা। আমরা যেভাবে খেলেছি, যেভাবে আত্মসমর্পণ করেছি, তা আসলে খুব করে চোখে লেগেছে। হয়তো কেবল আমার নয়, সবারই চোখে লেগেছে।
ভারত-পাকিস্তানের দ্বৈরথের কথা যদি বলতে হয়, এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই হেরেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানি সমর্থকরা হয়তো ব্যাপারটিকে ভালোভাবে নেয়নি?
দেখুন, আমি আবারও বলছি। এই ধরণের প্রতিযোগিতায় ভারতের বিপক্ষে হারাটা মুখ্য নয় একেবারেই। গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমরা আসলে কিভাবে খেলেছি। পাকিস্তান ক্রিকেট দল একেবারেই লড়তে পারেনি। সে কারণেই পাকিস্তানের বিপক্ষে দুইটি ম্যাচই ভারতের জন্য অনেকটা পানিভাতের মতো সহজ হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া পাকিস্তান তো কেবল ভারতের বিপক্ষে হারেনি; আফগানিস্তানের বিপক্ষেও হেরেছে, বাংলাদেশের বিপক্ষেও হেরেছে।
সেক্ষেত্রে টুর্নামেন্টের শুরু থেকে পাকিস্তানের করণীয়টা কি হতে পারতো?
সবাইকে দল হিসেবে খেলতে হতো, যার যার দায়িত্ব তাকে নিতে হতো। আমি এই দলটি সঙ্গে অতীতে কাজ করেছি। তাই দেশের ক্রিকেটের ব্যাপারে আমার খুব ভালো ধারণা আছে। আমি জানি, পাকিস্তানে মেধাবী ক্রিকেটারের অভাব নেই। তাদেরকে কেবল ঠিকভাবে পরিচর্যা করতে হবে, সঠিক পথটা বাতলে দিতে হবে। তাদেরকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ দিতে হবে। দলে জায়গা হারানোর আতঙ্ক থেকে মুক্ত রাখতে হবে। আমাদেরকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। আমাদের অধিনায়ক (পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ইমরান খান) এই মুহূর্তে পুরো জাতির অভিভাবক(প্রধানমন্ত্রী)। আমি নিশ্চিত, ক্রিকেট দলের ব্যাপারে তার স্বচ্ছ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে। হয়তো তার হাত ধরে আমরা কোনো স্থায়ী সমাধান পাবো।
এবারের এশিয়া কাপে কোন ক্রিকেটার আপনাকে মুগ্ধ করেছে?
ভারতীয় পেস বোলার জসপ্রীত বুমরাহ। তরুণ এই পেসারের বলে ভালো গতি আছে। পাশাপাশি সঠিক লাইনে বল করতে পারে, উইকেট নেওয়ার ক্ষুধা আছে। মারাত্মক সব ইয়র্কার দিতে পারে ও। বুমরাহ যে ব্যাপারে আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছে, তা হলো এশিয়া কাপ টুর্নামেন্টের ডেথ ওভারে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে কোন বাউন্ডারি সে হজম করেনি!
এবারের এশিয়া কাপে ভারত কি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উপযুক্ত ছিল?
বাংলাদেশ দল যদি এবারের এশিয়া কাপের শিরোপা জিততো, তাতে আমি একটুও অবাক হতাম না। তারা শেষ বল পর্যন্ত যেভাবে লড়েছে, তাতে নিঃসন্দেহে তারা প্রশংসার পাত্র। এরই মধ্যে বাংলাদেশ এশিয়া ক্রিকেটের ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারা অনেক কিছু শিখেছে, অর্জন করেছে। আমার মনে হয় মাশরাফি বিন মুর্তজা ও তার দল কোনভাবেই কখনও আপসেট হয় না। ওরা সবাইকে গর্বিত করেছে। এই মুহূর্তে ওয়ানডেতে যেকোনো দলই ওদের সামনে বুঝেশুনে খেলতে চাইবে।
Featured Image Credit : Michael Steele/Getty Images