কিলিয়ান এমবাপ্পে নামক এক ১৯ বছরের তরুণ মুগ্ধ করে রেখেছে পুরো বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের। মেসি-রোনালদো-নেইমার পরবর্তী যুগে এমবাপ্পের হাতেই সম্ভবত উঠতে যাচ্ছে ফুটবলের ব্যাটন। শুধু এমবাপ্পেই নন; জেসুস, রাশফোর্ড, ভিনিসিয়াসের মতো তরুণ ফুটবলাররাও মাঠ মাতাচ্ছেন সমান তালে। তবে এমবাপ্পেদের মতো অনেক তরুণ খেলোয়াড়ই আশা দেখিয়ে ঝরে পড়েছেন অকালেই। প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে না পারা প্রিমিয়ার লিগের এমন কয়েকজন তরুণ ফুটবলার সম্পর্কেই জানানো হবে আজ।
ফ্রেডি সিয়ার্স – ওয়েস্ট হাম
নিজের প্রতিভার জানান দিয়েছেন ২০০৭ সালেই। মিলওয়েলের বিপক্ষে অনূর্ধ্ব ১৮ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে সবার নজড় কাড়েন সিয়ার্স। সেই বছরই লিগে অভিষেক হয় তার। অভিষেক ম্যাচে তিনি দেখান আরো বড় চমক। প্রথম ম্যাচেই ব্ল্যাকবার্নের বিপক্ষে করেন জয়সূচক গোল।
কিন্তু এরপরেই খেই হারিয়ে ফেলেন এই সম্ভাবনাময় তরুণ খেলোয়াড়। পরবর্তী ৪৫ ম্যাচে ওয়েস্ট হামের হয়ে করেন মাত্র ১টি গোল। ওয়েস্ট হাম থেকে ধারে ক্রিস্টাল প্যালেস, কভেন্ট্রি ও বিভিন্ন ক্লাবে গেলেও গোলশূন্য থাকতে হয়েছে সিয়ার্সকে। বর্তমানে ২৮ বছর বয়সী ফ্রেডি সিয়ার্স খেলছেন ইপসউইচ ক্লাবে।
ফ্রান্সিস জেফার্স – এভারটন
ওল্ড ট্রাফোর্ডে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে অভিষেক হয় তরুণ জেফার্সের। ১৯৯৯/২০০০ সালের সেই মৌসুমে ৬টি গোল করেন এই ফুটবলার। পরবর্তী মৌসুমে ইনজুরির দরুন মাত্র ১৪টি ম্যাচ খেললেও গোল করেন ৭টি।
গুডিসন পার্কে অবশ্য আর থাকতে চাননি জেফার্স। ২০০১ সালে ৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে তাকে দলে নেন আর্সেন ওয়েঙ্গার। ওয়েঙ্গার জেফার্সকে উপাধি দেন ‘ফক্স ইন দ্য বক্স’। কিন্তু আর্সেনালে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। তিন মৌসুমে করেন মোটে ৮টি গোল।
আর্সেনাল থেকে ২০০৪ সালে যোগ দেন চার্লটনে। সেখানেও তার গোল খরা অব্যাহত থাকে। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা এই ফুটবলার একে একে রেঞ্জার্স, শেফিল্ড, ব্ল্যাকবার্নের হয়ে জার্সি গায়ে তুললেও নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন সব জায়গায়ই।
ফ্রান মেরিদা – আর্সেনাল
এসি মিলান ও রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে লা মাসিয়া প্রোডাক্ট ফ্রান মেরিদাকে দলে ভেড়ায় আর্সেনাল। এর দুই বছর পরে লিগ কাপে নিউক্যাসলের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে মেরিদার।
২০০৭ সালে ধারে রিয়াল সোসিয়েদাদে যোগদানের পর মেরিদা নিজেকে প্রমাণের জন্য প্লাটফর্ম খুঁজে পান। নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে তাকে আর্সেনালে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসও দেন ওয়েঙ্গার। কিন্তু রিয়াল সোসিয়েদাদ হয়ে এটলেটিকো মাদ্রিদে গিয়েও নিজের সামর্থ্যের জানান দিতে ব্যর্থ হন তিনি। পরবর্তীতে মেরিদা যোগ দেন ওসাসুনাতে। ২০১৬ সাল থেকে ওসাসুনার হয়ে স্প্যানিশ লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলছেন ফ্রান মেরিদা।
মাইকেল ফরসেল – চেলসি
ফিনল্যান্ডের একটি স্থানীয় ক্লাব থেকে মাত্র ১৭ বছর বয়সী খেলোয়াড় মাইকেল ফরসেলকে দলে ভিড়িয়েছিলো চেলসি। নিজের অভিষেক ম্যাচেই লিগ কাপে অক্সফোর্ডের বিপক্ষে জোড়া গোল করে নিজের সামর্থ্যের জানান দেন ফরসেল। প্রিমিয়ার লিগ অভিষেকেও নটিংহাম ফরেস্টের বিপক্ষে করেন আরো একটি গোল। সেই সময় মনে হচ্ছিলো ব্লুজরা তাদের রত্ন পেয়ে গেছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ক্রিস সোটনের স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে যোগ দেওয়ার ফলে।
এই ফরোয়ার্ডের আগমনে ফরসেলকে ধারে পাঠাতে বাধ্য হয় চেলসি। ধারে মাইকেল ফরসেল ক্রিস্টাল প্যালেস, বরুশিয়া মনচেগ্লাডবাখ ও বার্মিংহামে পাঁচ মৌসুম কাটালেও চেলসিতে আর ফেরা হয়নি। সবশেষে ফরসেল ২০০৫ সালে স্থায়ীভাবে তাবু গাড়েন বার্মিংহাম ক্লাবে।
ড্যানি ক্যাডামারটারি – এভারটন
১৯৯৭/৯৮ মৌসুমের শুরুতেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন এই এভারটন খেলোয়াড়। প্রথম তিন লিগ ম্যাচেই করেন চারটি গোল। তার মধ্যে রয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিভারপুলের বিপক্ষে করা সেই স্মরণীয় গোলটিও। সেই সময় ১৮ বছর বয়সী ক্যাডামারটারি পাল্লা দিচ্ছিলেন তৎকালীন লিভারপুলের ১৮ বছরের বিস্ময় বালক মাইকেল ওয়েনের সাথে।
কিন্তু মাইকেল ওয়েন একের পর এক গোল করে গেলেও পরবর্তী এক বছর নিজেকে হারিয়ে ফেলেন ক্যাডামারটারি। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থাকলেও নিজের পড়তি ফর্মের জন্য গুডিসন পার্কে আর বেশিদিন থাকতে পারেননি ক্যাডামারটারি। ২০০১ সালে এভারটন ছাড়েন এই ফুটবলার। পরবর্তীতে শেফিল্ড ইউনাইটেড, লেস্টার সিটি ও হাডার্সফিল্ডের হয়ে খেললেও নিজের প্রতিভার ঝলক দেখাতে পারেননি কোথাও।
গুইসেপ্পে রসি – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
ম্যানচেস্টারের একাডেমিতে থাকাকালীন সময়ে স্যার এলেক্স ফার্গুসনের চোখে পড়েছিলেন এই ইতালিয়ান ফুটবলার। পল স্কোলসের পরে একাডেমি খেলোয়াড়দের মধ্যে তাকেই ধরা হতো সবচেয়ে প্রতিভাবান হিসেবে। নিজের প্রিমিয়ার লিগ অভিষেকে দারুণ এক গোল করেন সান্ডারল্যান্ডের সাথে। কিন্তু ক্রমশই বাজে ফর্মের কারণে তাকে ধারে পাঠানো হয় নিউক্যাসল ও পার্মাতে। কিন্তু পরবর্তীতে যেকোনো সময়ে কিনে নিতে পারবেন এ রকম শর্তেই রসিকে ধারে পাঠান ফার্গুসন।
কিন্তু ওল্ড ট্রাফোর্ডে আর ফেরা হয়নি রসির। ইনজুরির সাথে লড়াই করতে করতেই হারিয়ে যান তিনি। ২০০৭ সালে ভিলারিয়ালে স্থায়ীভাবে যোগদানের পর ২০১২ ও ২০১৪ সাল পুরোটাই কাটিয়েছেন অস্ত্রোপচারের নিচে।
৩১ বছর বয়সী এই খেলোয়াড় গত মৌসুমে খেলেছিলেন জেনোয়াতে। কিন্তু ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার অপরাধে বর্তমানে ১ বছরের নিষেধাজ্ঞায় আছেন এই ইতালিয়ান ফুটবলার।
ফাবিও দা সিলভা – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
২০০৭ সালে দুই যমজ ভাই ফাবিও ও রাফায়েল ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্লুমিনেন্স থেকে যোগদান করেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। কিন্তু রাফায়েলের মতো নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি তিনি।
প্রাক-মৌসুম ম্যাচগুলোতে দারুন খেললেও কাঁধের ইনজুরির জন্য অভিষেকের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয় ফাবিওকে। অবশেষে ২০০৯/১০ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয় এই ব্রাজিলিয়ান লেফট ব্যাকের। কিন্তু নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই উলভসের বিপক্ষে লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যেতে হয় ফাবিওকে।
২০১১ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে বার্সেলোনার বিপক্ষে শুরুর একাদশে থাকাটাই পরবর্তীতে ফাবিওর ক্যারিয়ারে বড় অর্জন হয়ে আছে। কিছুদিন ধারে কিউপিআর এবং কার্ডিফে থাকলেও ২০১৪ সালে স্থায়ীভাবে পাড়ি জমান মিডলসব্রোতে। বর্তমানে তিনি খেলছেন ফরাসি ক্লাব নঁতেতে।
মাইকেল জনসন – ম্যানচেস্টার সিটি
২০০৭/০৮ মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে নজর কাড়েন জনসন। তৎকালীন সময়ের সিটি কোচ গোরান এরিকসন জনসনকে তুলনা করেন ল্যাম্পার্ড ও জেরার্ডের সাথে।
লিভারপুল জনসনের প্রতি আগ্রহ দেখালেও তাকে বিক্রি করেনি সিটি। বরং মাইকেল জনসনের সাথে ৫ বছরের চুক্তি করে ক্লাবটি। কিন্তু ইনজুরি ও মাঠের বাইরের নানা নেতিবাচক কর্মকান্ডে নিজের ফর্ম হারান তিনি। অবশেষে ২০১২ সালে সিটি রিলিজ করে দেয় এই ফুটবলারকে। এরপর থেকে অবশ্য আর পেশাদার ফুটবলই খেলেননি এই খেলোয়াড়। জড়িয়ে পড়েন রিয়েল এস্টেট ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়।
ফেডেরিকো মাচেদা – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
২০০৯ সালে অ্যাস্টন ভিলার সাথে অতিরিক্ত সময়ে গোল করে রেড ডেভিলদের জিতিয়ে নিজের অভিষেককে রাঙিয়ে রেখেছিলেন ফেডেরিকো মাচেদা। সেই ম্যাচ জেতার কারণে শিরোপা দৌড়েও সেবার টিকে ছিলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। পরবর্তী সপ্তাহে সান্ডারল্যান্ডের সাথেই আরেকটি গোল করেন এই ইতালিয়ান ফুটবলার। কিন্তু নিজে থেকেই ইতালিয়ান একটি ক্লাবে ধারে যেতে চাইলে রাজি হননি সেই সময়ের কোচ ফার্গুসন। বরং মাচেদাকে ফার্গুসন চেয়েছিলেন প্রিমিয়ার লিগের কোনো দলের কাছে ধারে পাঠানোর জন্য।
২০১৪ সালে ইউনাইটেড রিলিজ করে দেয় মাচেদাকে। পরবর্তীতে কার্ডিফ, নটিংহ্যাম ফরেস্টের হয়ে চার মৌসুমে এই ফুটবলার করেন ১৬ গোল। বর্তমানে ২৭ বছর বয়সী এই ফুটবলার প্যান্থিনাইকোসের হয়ে নিজের ক্যারিয়ার নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
আদনান ইয়ানুজাই – ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার পর পুরোপুরি হারিয়ে না গেলেও নিজের প্রতিভার জানান কখনোই সেভাবে দিতে পারেননি এই বেলজিয়ান ফরোয়ার্ড।
মাত্র ১৮ বছরেই ওল্ড ট্রাফোর্ডকে মুগ্ধ করেছিলেন ইয়ানুজাই। ডেভিড ময়েসের অধীনে খেলে বেশ চমক দেখিয়েছিলেন সেই সময়। তার পারফরম্যান্সে ইংল্যান্ড জাতীয় দলও চেয়েছিলো যাতে ইয়ানুজাই থ্রি লায়ন্সের জার্সি গায়ে চাপান। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলায় পরে ইয়ানুজাইকে ধারে পাঠানো হয় ডর্টমুন্ড, সান্ডারল্যান্ডে। সেখান থেকে বর্তমানে স্থায়ীভাবে আছেন রিয়াল সোসিয়েদাদে। বেলজিয়ামের বিশ্বকাপ দলে থাকলেও শুরুর একাদশে কখনোই জায়গা করে নিতে পারেননি এই প্রতিভাবান ফুটবলার। ক্যারিয়ারের অনেক সময় পড়ে থাকায় হয়তো নিজেকে প্রমাণ করার আরো অনেক সুযোগ পাবেন আদনান ইয়ানুজাই।