স্বাধীন মুমিনুলের হাতে বিজয়ীর ঝাণ্ডা

তিনি এমনভাবে কথা বলেন যেন মনে হয় নরম তুলোতে কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সেই মুমিনুল বুধবার অচেনা রূপে ধরা দিলেন। সাগরিকায় সেঞ্চুরি হাকিয়ে আগ্রাসী উদযাপনে মত্ত হলেন। যেন কোনো পিশাচের রাজ্য থেকে মুক্তির জয়গান গাইলেন ব্যাট হাতে। ভেঙ্গেচুরে, তেড়েফুড়ে সবকিছু একাকার করলেন। আগুন ঝরা চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন শ্রীলঙ্কার ড্রেসিংরুমের দিকে। এরপর ফিরলেন বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমের দৃষ্টি সীমানায়। যেখানে বসে আছে তার সতীর্থরা। সদর্পে ব্যাট তুলে নির্বাক ঘোষণা দিলেন, আমি দুর্বল নই। আমি শক্তির স্তম্ভ।

১.

সাল ২০১৫; বাংলাদেশে দুটি টেস্ট খেলতে সফর করবে অস্ট্রেলিয়া দল। এমন সময় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। সেটাকে অজুহাত মেনে কয়েক দফা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালো ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। সঙ্গে যোগ হল বাংলাদেশে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়া দূতাবাসের সতর্কবার্তা। দুইয়ে মিলিয়ে সফর বানচাল করল অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল। আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হল, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে খেলবে স্মিথ-ওয়ার্নাররা।

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে। Source: AFP

এবার আর কথার খেলাপ করল না অস্ট্রেলিয়া। আসছেই তারা। প্রথমটি অনুষ্ঠিত হবে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। তার আগে দল ঘোষণার পালা। কিন্তু এ কী! দলে নেই মুমিনুল হক! যিনি কিনা বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান। গণমাধ্যমের তোপের মুখে পড়লেন নির্বাচকরা। দল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে গুনে গুনে ২৭টি প্রশ্ন ছোঁড়া হল নির্বাচকদের কাছে, যার ২৩টিই মুমিনুল সম্পর্কিত! একপর্যায়ে না পেরে ক্ষেপে গেলেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। বললেন, ‘সব কিছুর দায় আমাকে কেন দিচ্ছেন! কোচ নিজেও তো নির্বাচক প্যানেলের সদস্য। আমি তো একা দল নির্বাচন করি না। মুমিনুলকে না রাখার সিদ্ধান্ত আমার নয়, কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের!’

সেদিনই সংবাদমাধ্যমে মুমিনুলকে না রাখার ইস্যুটি ফলাও করে প্রচারিত হল। শেষপর্যন্ত তোপে পড়ে নতুন করে মুমিনুলকে দলে ভেড়াতে বাধ্য হল টিম ম্যানেজমেন্ট। যদিও ঢাকায় প্রথম টেস্টে তাকে মূল একাদশে জায়গা দেওয়া হয়নি। চট্টগ্রামে রাখা হয়েছিল।

২.

দলের বাইরে থেকে কোচের তোপের মুখে পড়েছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। ঘরোয়া ক্রিকেটে মারমার কাটকাট পারফরম্যান্স করেও বয়সের কারণে জাতীয় দলে জায়গা হয়নি তার। অন্যদিকে, জাতীয় দলে থেকেও স্পিনে দুর্বলতা, ফুটওয়ার্কে সমস্যার মতো অপবাদ দিয়ে হাতুরুসিংহে মুমিনুলকে বারবার অবহেলা করেছেন। তার কারণেই রঙ্গিন পোশাকের ক্রিকেটের দরজা একরকম বন্ধই হয়েছিল তার আমলে। উলটো গায়ে লাগাতে হয়েছিল ‘টেস্ট ব্যাটসম্যানের’ তকমা। তারপরও রেহাই নেই। সাদা পোশাকের টেস্টেও নিয়মিত হতে পারেননি তিনি। কোনো এক অজানা কারণে হাতুরুসিংহের পছন্দের তালিকায় যেতে পারেননি ২৯ বছর বয়সী এই বাঁ হাতি ব্যাটসম্যান।

গেল বছরে শ্রীলঙ্কার মাটিতে দেশের হয়ে শততম টেস্টে ড্রেসিংরুমে বসে থেকেছেন স্রেফ দর্শক হয়ে। অথচ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চলমান টেস্ট বাদ দিলে তার গড় ৪৩.৮০! ২৫ ম্যাচের ৪৬ ইনিংসে মোট রান ১৮৪০। সেঞ্চুরি পাঁচটি, হাফ সেঞ্চুরি ১২টি। তাকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘ব্র্যাডম্যান’। সবার চোখেই তিনি নায়ক। শুধু ভিলেন হাতুরুসিংহের চোখে।

মুমিনুলকে মুশফকের উষ্ণ শুভেচ্ছা।Source: AP

তাই হয়তো জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে নিজেকে সামলাতে পারেননি মুমিনুল। উদযাপনের এক পর্যায়ে প্যাডে ব্যাট দিয়ে আঘাত করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, ফুটওয়ার্কটা ঠিক আছে। শুধু ‘কোচের ওয়ার্ক’ ভুল ছিল। তার সাফল্যে মুশফিকের একান-ও’কান বিস্তৃত হাসিটাও মনে রাখার মতো। হাতুরুসিংহের অধীনে অধিনায়ক ছিলেন তিনি। তারপরও বারবার গঞ্জনায় পড়তে হয়েছে। কোচের সিদ্ধান্তে সবকিছু করেছেন, অথচ বিপদের সময় সটকে গিয়েছেন।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচের প্রথম দিন যেন সেসবের জবাব দিতেই মাঠে নেমেছিল মুশফিক-মুমিনুল। হাতুরুসিংহের ছাত্রদের পিঠের উপর চড়ে বসে গড়েছেন ২৩৬ রানের রেকর্ড। বাংলাদেশের হয়ে তৃতীয় উইকেটে অতীতে এর চেয়ে বড় জুটি আর হয়নি।

৩.

এই প্রতিবেদনটি যখন লেখা হচ্ছে, টিম হোটেলে তখন নির্ভার সময় কাটাচ্ছেন মুমিনুল। পরদিন সকালে কীভাবে দলকে নিয়ে এগিয়ে যাবেন, হয়তো সতীর্থদের সঙ্গে সেই রণপরিকল্পনায় আঁটছেন খোশ মেজাজে। কিন্তু ১৭৫ রানের এই ইনিংস নিয়ে আরও কিছু না বললে অবিচার করা হবে মুমিনুলের সঙ্গে।

বুধবারের আগপর্যন্ত টেস্টে দুই হাজারি ক্লাব থেকে ১৬০ রানে পিছিয়ে ছিলেন ‘মিনি’। ১৭৫ রানের ইনিংস খেলতে গিয়ে সেই মাইলফলক পার করেছেন তিনি। আর এই সেঞ্চুরি হয়েছে ৯৬ বলে, যা কিনা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম টেস্ট সেঞ্চুরি। ২০১৪ সালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯৪ বলে টেস্ট সেঞ্চুরি করেছিলেন তামিম ইকবাল। ওটাই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের দ্রুততম টেস্ট সেঞ্চুরি।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট জয়ের পর। Source:AP

শুধু তা-ই নয়, এটি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। প্রথম সেঞ্চুরিটিও হয়েছিল এই সাগর পাড়ের স্টেডিয়ামে। ২০১৪ সালের সেই ম্যাচে ৩১৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন লঙ্কান কিংবদন্তি ও সাবেক অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা। নিজেদের প্রথম ইনিংসে মুমিনুল ১৫ রানে আউট হলেও দ্বিতীয় রানে ১০০ রানে অপরাজিত ছিলেন। ম্যাচটি লড়াই করে ড্র করেছিল বাংলাদেশ।

বলে রাখা ভাল, তিন বছর পর টেস্টে সেঞ্চুরি পেলেন। সর্বশেষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৩১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন মুমিনুল। সেটাও এই একই ভেন্যুতে। আরও মজার কথা হল, মুমিনুল ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করেন নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৩ সালে, একই ভেন্যুতে। অর্থাৎ, টেস্টের পাঁচটি সেঞ্চুরির মধ্যে চারটিই এই জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে। সেদিক থেকে সাগরিকা তার জন্য ‘লাকি ভেন্যু’ বলা চলে।

৪.

শেষ বিকেলের সূর্যটা হেলে পড়েছিল। হয়তো মুমিনুলের আলো ঝলমলানো ইনিংসের সামনে লজ্জা পাচ্ছিল, মুখ লুকাচ্ছিল। সূর্য লজ্জা পাক আর না পাক, নোনা বাতাস, হেলে পড়া সূর্য আর কয়েক হাজার দর্শককে সাক্ষী রেখে বাংলাদেশের সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহেকে লজ্জা দিতে পেরেছেন মুমিনুল হক।

দিন শেষে তাই সংবাদ সম্মেলনেও মুমিনুল বন্দনা।

বাংলাদেশের পক্ষে হাজির হওয়া তামিম ইকবাল বলে গেলেন, ‘মুমিনুলের ইনিংসটা ছিল মুগ্ধকর। প্রথম থেকেই ও আক্রমণাত্মক ছিল। পুরো ইনিংস সেভাবেই খেলে গেছে। যখন সে ১০০ করে তখন তার স্ট্রাইকরেট ছিলো ১০৩! যে জিনিসটা আমাদের জন্য এই উইকেটে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা জানতাম এখানে ব্যাটিং করা সহজ হবে। বিশেষ করে প্রথম দিনে ও ওর উইকেটটা নষ্ট করেনি। অনেক সময় ব্যাটিং উইকেটে বেশি উত্তেজিত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলে অনেকে আউট হয়ে যায়। ও সেটা করেনি। মুমিনুল জানতো ওর উইকেটটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা বড় জুটি গড়া আমাদের জন্য খুব দরকার ছিলো। আমার মনে হয় মুশফিক ও মুমিনুল দুজনেই খুব ইতিবাচক ছিল। মারার মতো বল হলে তারা মেরেছে। তাদের খেলাটা পূর্ণাঙ্গ ছিল। মুমিনুল যদিও নট আউট; আশা করি সে আরো অনেক দূর যাবে।’

আর উদযাপন নিয়ে তামিমের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত, ‘ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তার (মুমিনুল) কিছু প্রমাণ করার ছিল এবং সে সেটা দারুণভাবে করেছে।’

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষী ২০১৪ সালে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সেঞ্চুরি পরার পর উদযাপনে মুমিনুল। Source: BCB

শ্রীলঙ্কার পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন দলটির বর্তমান ব্যাটিং কোচ ও বাংলাদেশের সাবেক ব্যাটিং কোচ থিলান সামারাবীরা। মুমিনুলকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তার। তাই বুধবারের মুমিনুলকে তার ‘অচেনা’ লেগেছে।

মুমিনুল প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘মিনি (মুমিনুল) আজ অসাধারণ ব্যাট করেছে। স্পিনের বিপক্ষে তার শরীরী ভাষা ছিল চোখে পড়ার মতো। বোলারদের জন্য ও সবকিছু কঠিন করে দিচ্ছিল। আজ অনেক বেশি আক্রমনাত্মক ছিল। আমি যখন ওর ব্যাটিং কোচ ছিলাম তখন ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কঠিন উইকেটে খেলতে হত।’

আপাতত স্বাধীন মুমিনুল। সেই স্বাধীনতা যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ নিজেকে প্রমাণ করে যেতে হবে মুমিনুলকে। হয়তো সেটাই করবেন তিনি। ছড়াবেন ক্রিকেটীয় ‘সৌরভ’। কারণ তার নামই সৌরভ!

ফিচার ইমেজ- AP

Related Articles

Exit mobile version