ইউরোপিয়ান ফুটবলে আরও একটি নতুন মৌসুম শুরু হবার মুখে। গ্রীষ্মকালীন বিরতির পুরোটা সময় সবাই ব্যস্ত ছিলো ফিফা বিশ্বকাপ নিয়ে। বিশ্বকাপে যেসব দেশ সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিলো, সেসব দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড় এখনও ক্লাবে এসে যোগ দেননি, যদিও ক্লাবগুলো তাদের অ্যাকাডেমির খেলোয়াড় দিয়েই প্রাক-মৌসুম নিয়ে ব্যস্ত।
২০১৮/১৯ মৌসুম খুব দ্রুতই শুরু হচ্ছে, প্রিমিয়ার লিগ ও লিগ ওয়ানের শুভ সূচনা হবে এ মাসের ১১ তারিখে। আর লা লিগা, সিরি আ ফিরবে এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ শেষে। নতুন মৌসুম শুরুর আগে ১০টি দলকে বিশেষভাবে বাছাই করা হলো, যারা এ মৌসুমে ভালো ফুটবল খেলার যোগ্যতা রাখে। এ দলগুলো বাছাই করা হয়েছে কোনো দলের নিম্নসারির লিগ থেকে উঠে আসা, নতুন খেলোয়াড়, নতুন উদ্দীপনা ও এই সিজনে ভালো পারফর্মেন্স করার প্রবণতার উপর ভিত্তি করে।
জুভেন্টাস
শুধু রোনালদোর সমর্থক কেন! তার সবথেকে বড় নিন্দুকও জানতে চাইবেন রোনালদোর নতুন অধ্যায় কীভাবে শুরু হয়। কারণ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল চলাকালীন সময়েই পর্তুগিজ সুপারস্টার রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে আকস্মিক জুভেন্টাস পাড়ি জমিয়েছেন। গত কয়েক বছর চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদোর পারফর্মেন্স বরাবরই নজরকাড়া। আর এবার যেন চ্যাম্পিয়নস লিগকে পাখির চোখ করছে জুভেন্টাস। তাই নিশ্চয়ই বলতে হবে না রোনালদো ওল্ড লেডিদের কতটা গুরুত্বপূর্ণ দল-বদল।
রোনালদো ছাড়াও ট্রান্সফার উইন্ডোতে বেশ সরব জুভেন্টাস। দলে এনেছে বুফনের উত্তরসূরী গোলরক্ষক পেরিনকে। হোয়াও ক্যানসেলো এসেছেন রাইট-ব্যাকের দায়িত্বে। প্রতিভাবান ডিফেন্ডার মাত্তিয়া কালদারাকেও বিক্রি করে ফিরিয়ে এনেছে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় লিওনার্দো বোনুচ্চিকে।
জুভেন্টাস বিদায় করে দিয়েছে ইগুয়াইনকেও। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন লিগ জিততে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেই দল গুছিয়েছে জুভরা। তাই পুরো মৌসুম চোখ রাখতে হবে জুভেন্টাসের উপর।
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ
স্প্যানিশ লা লিগা অনুসরণ করলে এটা পরিষ্কার যে, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ এবার ট্রান্সফার উইন্ডোতে বসে নেই। রোনালদোর বিদায়ে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু এখন টালমাটাল অবস্থায়, নতুন কোনো খেলোয়াড়ও কিনছে না তারা। বার্সেলোনাও ইনিয়েস্তার উত্তরসূরী খুঁজতে ব্যস্ত। তাই তারা যেন এই সময়টার সদ্ব্যবহার করতে চায়।
বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের পাশাপাশি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ পাল্লা দিয়ে চললেও এ সিজনে তাদেরকে বার্সা, মাদ্রিদের পাশেই স্থান দিতে হবে। মোনাকো থেকে তারা এনেছে থমাস লেমারকে, ফুটবলের অন্যতম সেরা ইয়াংস্টার গেলসন মার্টিনেজকে তারা ফ্রিতেই পেয়েছে। ইয়ান অবলাকের পর দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষকও হাজির। রাইট-ব্যাক ভার্সালকো চলে গেলেও সান্তিয়াগো আরাইসকে নিয়ে এসেছে স্প্যানিশ দলটি। আর গ্রিজমান, কস্তা, সাউল, গোডিন ও হোসে গিমেনেজরা তো আছেনই। গত সিজনে ইউরোপা জেতা দলটি তাই এবার প্রস্তুত আরও বড় কোনো ট্রফি জিততে।
লিভারপুল
ইয়ুর্গেন ক্লপ ট্রান্সফারের বড় সিদ্ধান্তগুলো নিতে নিজেকে যেন মাইক্রোস্কোপের তলায় দিয়ে রেখেছিলেন। তবে তিনি কেন এবার এরকম বড় ট্রান্সফারগুলো করেছেন তা পরিষ্কার। প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকতে ও শিরোপা জিততে যে রকম বিশ্বমানের দলের প্রয়োজন হয়, সেটিই তৈরিতে মেতেছেন ক্লপ।
এটি সত্য যে, দলের পজিশন অনুযায়ী লিভারপুল একদম ঠিকঠাক খেলোয়াড় কিনেছে। সেটা আবার উঠতি কোনো তারকা বা সদ্য নাম করা খেলোয়াড় না, একদম পরীক্ষিত সৈনিক। সালাহ, ফিরমিনো, ভ্যান ডাইকরা আগেই ছিলেন। চ্যান ক্লাব ছাড়ার পর ওয়াইনালদুম, হ্যান্ডারসন, চেম্বারলিনের মতো খেলোয়াড় দিয়ে মিডফিল্ড বানিয়ে প্রিমিয়ার লিগে টিকে থাকা যাবে না বুঝেই ক্লপ এনেছেন ফ্যাবিনহোর মতো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ও নাবি কেইতার মতো সৃজনশীল মিডফিল্ডারদের। সাথে ব্যাকআপ মিডফিল্ডার জেদরান শাকিরিকেও স্বপ্নছোঁয়া মূল্যে কিনেছে অল রেডরা। কারিওস ও মিনিগোলেতের মতো মধ্যমমানের গোলরক্ষক বদলে ক্লপ সময়ের অন্যতম সেরা গোলরক্ষকদের একজনকে দলে ভিড়িয়েছেন। গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার সিটিকে বদলে দিয়ে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন গার্দিওলা। এবার কি তাহলে লিভারপুল ও ক্লপের রুপকথা রচিত হতে যাচ্ছে?
ইন্টার মিলান
সিরি আ-তে শেষ কয়েক মৌসুমজুড়ে জুভেন্টাসের একক অধিপত্য। তবে নিজেদের সেরা সময়কে ফিরে পাবার যুদ্ধে নেমেছে ইন্টার মিলার। তারা ধীরে ধীরে প্রস্তুত এখন নিজেদের ফিরে পেয়ে জুভেন্টাসকে চ্যালেঞ্জ জানাতে।
লুইসিয়ানো স্পলেত্তি রক্ষণ থেকে মধ্যমাঠ, এমনকি আক্রমণেও বিস্তর পরিবর্তন এনেছেন। ২০১৮/২০১৯ চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার সুযোগ পেয়ে নতুন দল এবং খেলোয়াড়দের প্রতিভাকে যেন যথাযথ ব্যবহার করতে চাইছেন তিনি। ইতালির লিগের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার স্টিফেন ডি ভ্রাইকে ফ্রিতে পেয়েছে তারা, ক্রোয়েশিয়ার হয়ে বিশ্বকাপে নজরকাড়া সিমে ভার্সালকোকেও দলে ভিড়িয়েছে আজ্জুরিরা। এছাড়াও রাদজা নাইঙ্গোলান, কোয়াদো আসামোহায়, মাত্তেও পলিতানো, লাউতারো মার্টিনেজ নামগুলোও দলের শক্তি বৃদ্ধি করছে। বর্তমানে শুধু দেখার বিষয় লুইসিয়ানো স্পলেত্তি ইন্টার মিলানের সেরা সময়কে ফিরিয়ে দিতে পারেন কি না!
আর্সেনাল
আর্সেন ওয়েঙ্গারের সাথে আর্সেনালের সম্পর্ক শেষ হয়েছে গত মৌসুমেই। তার পরিবর্তে কোচ হয়ে এসেছেন উনাই এমেরি। তার ফুটবল দর্শনের পাশাপাশি নতুন ক্লাবে এসেই এমন কিছু পরিবর্তন এনেছেন, যা দেখে ধারণা করা হচ্ছে এবার বদলে যেতে পারে আর্সেনাল।
নতুন গোলকিপার লেনো প্রতিভাবান এবং প্রশংসনীয় গোলরক্ষক। বর্তমান দলের আক্রমণভাগ যথেষ্ট মজবুত, কিন্ত সমস্যা ছিলো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নিয়ে। সেখানেও উঠতি সেরা একজনকে বেছে এনেছেন এমেরি। রামসি, ঝাকাদের পাশাপাশি লুকাস তোরেইরা যদি দলের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন, তাহলে আর্সেনালকে এবার নতুন করে আবিষ্কার করা লাগতে পারে।
চেলসি
মারিৎসিও সারি নাপোলিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন গত দুই বছরে, সেদিক থেকে ভাবলে প্রিমিয়ার লিগে সারি কতটা ভালো করতে পারেন সেটাই লক্ষ্যণীয়। ইতালিয়ান কোচ বিশ্বাস করেন সুন্দর, দ্রুত পাসিং ফুটবলে। তিনি খেলোয়াড়দের ধারণাই পাল্টে দেন, বের করে নিয়ে আসেন এমন দক্ষতা যা খেলোয়াড়রা নিজেই জানতেন না।
চেলসিতে এসেই দারুণ একটি সাইনিং সম্পূর্ণ করেছেন সারি। নাপোলি থেকে নিজের শিষ্য জর্জিনহোকে নিয়ে এসেছেন চেলসিতে। সারির সিস্টেমের সাথে জর্জিনহো ও কান্তে জুটি মিললে চেলসির রূপই পাল্টে যাবে। কন্তের রক্ষণাত্মক ট্যাকটিসের একঘেয়ে ফুটবল পাল্টে চেলসিতে এক নতুন জোয়ার আসতে চলেছে সারির হাত ধরে।
ফুলহাম
গত মৌসুমে শৈল্পিক ও সবথেকে আনন্দদায়ক ফুটবল খেলে প্রিমিয়ার লিগে উঠে এসেছে ফুলহাম। দলে বেশ কিছু তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড় রয়েছে তাদের। ১৮ বছর বয়সী রায়ান সিসসেগনন এর অন্যতম সেরা উদাহরণ। বড় দলগুলোর মতো তারকা ফুটবলার কিনতে না পারলেও দলের জন্য কার্যকরী খেলোয়াড় কিনে ফেলেছে তারা। নিস থেকে জান-মিচেল সেরিকে এনেছে, যাকে গতবার নিতে চেয়েছিলো আর্সেনাল ও বার্সেলোনার মতো ক্লাবগুলো। এক মৌসুমে অন্তত ১০টি গোল করার মতো স্ট্রাইকার আলেক্সান্ডার মিত্রোভিচকেও দলে ভিড়িয়েছে ফুলহাম। সাথে আরও আছে এ মৌসুমেই প্রিমিয়ার লিগে লোনে ফেরত আসা আন্দ্রে শুরলে। এদের সমন্বিত খেলা দেখাটা নিশ্চয়ই আনন্দদায়ক হবে।
অলিম্পিক লিঁও
প্রতি মৌসুমেই লিঁও অ্যাকাডেমি থেকে কিছু খেলোয়াড় উঠে আসে যারা পরবর্তীতে ফুটবল মঞ্চের ভালো কোনো পর্যায়ে পৌঁছায়। এ মৌসুমেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। হোসেম আওয়ার, টাঙ্গুই এনদমবেলে, মার্টিন টেরেইর, ফ্রিল্যান্ড মেন্ডি এবার খেলবে লিঁওর প্রতিভাবান ইয়াংস্টার খেলোয়াড় হয়ে।
আর পরীক্ষিত খেলোয়াড় হিসেবে মেম্ফিস ডিপাই, বেরট্রান্ড টোরেইরা ও বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড় নাবিল ফেকির তো আছেনই।
উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডার্স
উলভারহ্যাম্পটন এ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম চমকের নাম। এ মৌসুমেই প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পাওয়া দলটি সুনাম কুড়িয়েছে গত মৌসুম থেকেই। দলটি আগে থেকেই স্থিতিশীল অবস্থায় ছিলো, প্রিমিয়ার লিগে ফিরে এসে আরও শক্তিশালী হবার চেষ্টা করে যাচ্ছে দলটি। তাই ট্রান্সফার মার্কেটে দারুণ সরব তারা।
ডিয়েগো জোটা, রুবেন নেরেস আর উইলি বয়েলসের মতো খেলোয়াড় আগে থেকেই ছিলো। নতুনভাবে যোগ হয়েছে রুই প্যাট্রিসিও ও জোয়াও মৌতিনহো। উলভারহ্যাম্পটন গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে প্রমাণ করেছে তারা প্রিমিয়ার লিগে খেলার মতোই দল। এখন তারা খেলোয়াড়দের দিক থেকে আরও শক্তিশালী দল, তাই তাদের প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে।
রোমা
গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে চমক দেখিয়েছিলো রোমা। সিরি আ-তে গতবার তারা লিগ শেষ করেছে তৃতীয় হয়ে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইতালিয়ান লিগে সমানভাবে লড়তে তাই রোমাও এবার আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে।
অ্যালিসন ও রাদজা নাইঙ্গোলানকে হারিয়েও তারা দমে যায়নি। তাদের বিক্রি যেমন করেছে চড়া মূল্যে, তেমনই সেই অর্থের দারুণ ব্যবহারও করেছে তারা। অ্যালিসনের পরিবর্তে সুইডিশ গোলরক্ষক রবিন ওলসনকে এনেছে রোমা। কোলারভের স্থানে এনেছে রিক কার্সড্রপকে। এছাড়াও হাভিয়ে পাস্তোরে, জাস্টিন ক্লুইভার্টকে এনে ইতিমধ্যে দলের শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করেছে তারা। তবে রোমা এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে খেলোয়াড় কিনতে। তাই তাদেরকে এবার সাধারণভাবে গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই।
ফিচার সোর্স: Bleacherreport