১
বলুন তো, সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই আপনার মাথায় আসবে পেলের নাম, কিন্তু এর সাথে ম্যারাডোনাকেও এড়াতে পারবেন না। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের মতে প্রথম দুটো নাম পেলে আর ম্যারাডোনাই। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় এ দুজনের পর কার অবস্থান?
এখানেও মতভেদ হবে। কারো মতে ক্রুয়েফ, কারো মতে ডি স্টেফানো, কারো মতে বেকেনবাওয়ার, কেউ কেউ আবার জর্জ বেষ্টকেও রাখেন। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যারা ফুটবল দেখেছেন, তাদের বেশির ভাগের মতে ফুটবল বিশ্বের ৩য় সেরা খেলোয়াড় হচ্ছেন জিনেদিন জিদান।
আমার মতে সেরার তালিকায় কে কততম অবস্থানে আছেন সেটা বের করার জন্য কোনো খেলোয়াড়ের অবসর নেবার পর অন্তত ৩০ বছর অপেক্ষা করে তারপর বিবেচনায় আনা উচিত। এই ৩০ বছরে সেই নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে ঘিরে আবেগটা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে। তখন বিচার কিছুটা নিখুঁত হয়।
সেরার বিবেচনায় জিদান কত নম্বরে থাকবেন সেটা নিয়ে মতভেদ থাকতেই পারে। তবে জিদান যে সর্বকালের সেরাদের অন্যতম একজন সেটা নিয়ে আশা করা যায় কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত না। তবে তিনি কেন সর্বকালের সেরাদের একজন সেটা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেবার জন্যই আজকের এই লেখা।
২
আরো অনেক গ্রেট খেলোয়াড়ের মতো জিদানের জন্মও হয়েছিল আলজেরিয়ান দরিদ্র এক পরিবারে। জিদানের এক ইন্টারভিউ থেকে জানা যায় যে, তার বাবা ছিলেন একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের নাইটওয়াচম্যান। বেশিরভাগ সময়ই রাতের বেলা তাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হতো। অন্যদিকে তার মা ছিলেন একজন গৃহিণী। এ পরিবারেই সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে ফ্রান্সের মার্শেইতে জন্মগ্রহণ করেন জিদান। তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই জিদান তার প্রতিবেশীর বাচ্চাদের সাথে একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে ফুটবল খেলা শুরু করেন। দশ বছর বয়সেই ইউএস সেইন্ট হেনরি ক্লাবের জুনিয়র টিমে জিদানের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয়। এটি মার্সাইল জেলার লা ক্যাস্তেইল্যানের একটি স্থানীয় ক্লাব। এখানে দেড় বছর থাকার পর জিদান লীগ চ্যাম্পিয়নশীপের বাছাইপর্বে অংশ নেন। সেখানে AS Cannes এর রিক্রুটার জিন ভ্যারার্ড এর চোখে পড়ে যান তিনি। এখান থেকেই শুরু হয় তার ক্লাব ক্যারিয়ার ফুটবলের মূল অধ্যায়।
৩
মাত্র ছয় সপ্তাহ থাকার উদ্দেশ্যে জিদান Cannes এ যান। কিন্তু পরবর্তী চার বছর সেখানেই থাকেন। League 1 এ Cannes এর অবস্থা ছিলো খুব শোচনীয়। ১৯৪৮-৪৯ মৌসুমে তারা প্রথম বিভাগ থেকে রেলিগেট হয়ে যায়, আবার উত্তীর্ণ হয় ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে। জিদান ক্লাবে আসার আগপর্যন্ত শেষ তিন বছরে লীগে ক্লাবের পজিশন ছিল যথাক্রমে ১২, ১২ আর ১১ তম। প্রথম সিজনেই তিনি দলকে লীগে চতুর্থ পজিশনে নিয়ে আসেন এবং এর ফলে তারা প্রথমবারের মতো উয়েফা লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। এমনকি এই পজিশন ছিল ক্লাবের ইতিহাসে ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে রানার্স আপ হবার পর সর্বোচ্চ।
১৯৯২-৯৩ মৌসুমে জিদান Bordeaux ক্লাবে চলে আসেন। এখানে খেলে ১৯৯৪ সালে মৌসুমের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের পুরষ্কারটা জিতে নেন তিনি। ১৯৯৫ সালে Intertoto Cup জেতেন, কিন্তু উয়েফা কাপের ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হার মানতে বাধ্য হন। ১৯৯৬ সালে জিদান নিউক্যাসেল ইউনাইটেড থেকে ১.২ মিলিয়ন এর বিনিময়ে যোগদানের প্রস্তাব পান। কিন্তু সামনাসামনি তাকে দেখার পর নিউক্যাসেল ইউনাইটেড অফার প্রত্যাখ্যান করে। তারা মনে করেছিলেন যে EPL-এ খেলার জন্য জিদান উপযুক্ত ছিলেন না। সেই সিজনে League 1 এর সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জেতেন জিদান। এর পরপরই ৩ মিলিয়ন ডলার ট্রান্সফারের বিনিময়ে জিদান ইতালির জুভেন্টাসে যোগ দেন।
সেই সময়ে জুভেন্টাসের প্রধান খেলোয়াড় ছিলেন দেল পিয়ারো। কিন্তু সময়ের পালাবদলে এডগার ডেভিডসের সাথে সাথে মধ্যমাঠের প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে কোচ মার্সেলো লিপ্পির আস্থাভাজন হয়ে যান জিদান। ১৯৯৬-৯৭ ও ১৯৯৭-৯৮ পরপর দুই সিজনে সিরি এ জিতেন তিনি। ১৯৯৬-৯৭ সিজনে সিরি এ-এর সেরা বিদেশী খেলোয়াড়ের পুরষ্কার জিতে নেন জিদান। ১৯৯৭-৯৮ আর ১৯৯৮-৯৯ পরপর দুই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে ওঠে তার দল, কিন্তু দু’বারই ফাইনালে হেরে যায়। এর মাঝে ১৯৯৭-৯৮ সালের ইউসিএল পারফর্মেন্স ছিল জিদানের ক্যারিয়ার বেষ্ট ইউসিএল পারফর্মেন্স, ৩ গোল আর ৭ এসিস্ট। ৭ এসিস্টের চারটিই ছিল ১০ গোল করা ডেল পিয়েরোকে করা। গ্রুপ পর্বে ইউনাইটেডের সাথে দুবারের দেখায় তার ছিল ২টি এসিস্ট ও ১টি গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে ডায়নামোর সাথে হ্যাট্রিক এসিস্ট, সেমিতে মোনাকোর সাথে গোল ও এসিস্ট।
পরবর্তীতে জুভেন্টাস ২০০১ সালে সিরি এ-তে রানার্স আপ হয়, সাথে জিদান আবার পুরষ্কার পান শ্রেষ্ঠ বিদেশী খেলোয়াড়ের। কিন্তু এবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগে জুভেন্টাস গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে যায়। কারণ হিসেবে ধরা হয় গ্রুপ পর্বে হামবুর্গের খেলোয়াড় Jochen Kientz-কে মাথা দিয়ে ঢুঁ মারার অপরাধে জিদানের পাঁচ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হওয়াকে।
এই সিজনেই রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে জিদান রিয়াল মাদ্রিদে যোগদান করেন। দল অনুযায়ী জিদান রিয়াল মাদ্রিদে প্রত্যাশিত সফলতা পাননি। এরপরও চার বছরে দলের হয়ে একটা লা লীগা সহ মোট ছয়টি শিরোপা জিতেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ২০০১-০২ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়। বা পায়ের এক ভলিতে ম্যাচের জয়সূচক গোলটি করেন জিদান। চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ইতিহাসে গোলটিকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি গোল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ চ্যাম্পিয়ন্স লীগের পর রিয়াল মাদ্রিদ পরবর্তী চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জেতে আবার ২০১৪ সালে।
এই ক্লাবে থাকা অবস্থাতেই উয়েফার একটা ভোটে গত ৫০ বছরের সেরা ইউরোপিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচিত হন জিদান।ক্যারিয়ারের শেষ সিজনটা জিদানের ট্রফিহীন কাটে। তবে ব্যক্তিগতভাবে সিজনটাকে একেবারে অসফল বলা যাবে না। এই সিজনেই জিদান পান তার ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাট্রিক, ম্যাচটিতে সেভিয়ার বিপক্ষে তার দল জেতে ৪-২ গোলে। এছাড়া মাত্র ২৮টি ম্যাচ খেলে দলের পক্ষে রোনালদো লিমার পর সিজনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা (৯টি) এবং বেকহামের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসিস্টদাতা (১০টি) হন। সিজন শেষে ভিলারিয়ালের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেন যা কিনা ৩-৩ গোলে ড্র হয়। ম্যাচে ৮০,০০০ ফ্যান তাকে ব্যানারে ‘Thanks for the magic’ লিখে স্বাগত জানায়।
৪
জিদান একই সাথে ফ্রান্স এবং আলজেরিয়ার নাগরিক ছিলেন। প্রথমে তার আলজেরিয়ার জাতীয় দলের হয়ে খেলার কথা ছিল। কিন্তু জিদানকে দলে নেওয়ার বিপক্ষে থাকেন আলজেরিয়ার তৎকালীন কোচ আবদেল হামিদ কারমালি, যিনি কিনা ‘আলজেরিয়ান ফুটবল দলের পিতা’ নামে পরিচিত। না নেওয়ার কারণ হিসেবে বলেন ‘জিদান যথেষ্ট গতি সম্পন্ন নন’।
কারমালির কথাটা মোটেও ভুল ছিল না। সত্যিকার অর্থেই গতি বলতে আমরা যেমনটা বুঝি, ঠিক তেমনটা গতিসম্পন্ন ছিলেন না তিনি। আরো অনেক দিকেই ঘাটতি ছিল। তবে চ্যাম্পিয়নদের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা তাদের ঘাটতিগুলো অন্য দিক দিয়ে পুষিয়ে নেন। জিদান যে চ্যাম্পিয়নের মতো সব ঘাটতি পোষাতে পেরেছিলেন সেটা তার ক্যারিয়ার ঘাটলে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়।
জাতীয় দলের হয়ে জিদান
১৯৯৪ সালের ১৭ই আগষ্ট ফ্রান্সের জার্সি গায়ে জিদান প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাঠে নামার সুযোগ পান। চেক প্রজাতন্ত্রের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে ৬৩ মিনিটে যখন মাঠে নামেন, তখন ফ্রান্স ২ গোলে পিছিয়ে ছিল। মাঠে নেমে জিদান ২টি গোল করেন এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হয়।
১৯৯৬ ইউরো
আস্তে আস্তে জিদান দলে নিজের জায়গা গড়ে তুলতে থাকেন। তবে বড় ব্রেক থ্রু পান ১৯৯৬ সালের ইউরোতে। সেই সময় ফ্রান্সের বড় তারকা ছিলেন ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের হয়ে মাঠ কাঁপানো এরিক ক্যান্টোনা। কিন্তু ফ্যানকে আক্রমণ করার অভিযোগে জাতীয় দল থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ক্যান্টোনা দলের হয়ে খেলতে পারেন নি। তখন জিদান প্লে মেকার হিসেবে দলে সুযোগ পান। জিদানকে দলে নেওয়ার কারণে ভক্ত এবং ফুটবল বোদ্ধারা ব্যাপক সমালোচনা করেন তৎকালীন কোচ আইমে জ্যাকের।
ইউরো ১৯৯৬-তে জিদান দলের সাথে নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারেন নি। টুর্নামেন্টে অ্যাভারেজ পারফর্ম করেন, যদিও ফ্রান্স সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌছে। সেমিতে নেদভেদের চেক প্রজাতন্ত্রের বিপক্ষে পেনাল্টিতে ৫-৬ গোলে হেরে যায় ফ্রান্স। কোয়ার্টার এবং সেমিফাইনালে জিদান টাইব্রেকারে দুটো গোল করেন।
১৯৯৮ বিশ্বকাপ
‘৯৮ এর বিশ্বকাপ ছিল জিদানের প্রথম বিশ্বকাপ। নিজ দেশে বিশ্বকাপ হওয়ার কারণে ফ্রান্স ফেভারিট দলগুলোর মাঝে ছিল। সেই বিশ্বকাপে জিদান খুব আহামরি খেলেছিলেন সেটা বলা সম্ভবত উচিত হবে না। কিন্তু থুরামের চেয়ে ভালো ছিলেন সেটা বলা যায়। এরপরও সেই বিশ্বকাপের সেরা তিনে জিদানের বিপরীতে থুরামের থাকার কয়েকটি কারণ ছিল। বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনে পারফর্মেন্সের সাথে সাথে ফেয়ার প্লেটাও খুব গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই একটা হলুদ কার্ড পান জিদান। দ্বিতীয় ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে অধিনায়ক ফুয়াদ আমিনকে থুথু মারার অপরাধে জিদানকে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় এবং পরের দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন। এ সময়ে যারা আশেপাশে ছিলেন তাদের ভাষ্যমতে আমিন জিদানকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করেছিলেন।
তবে গ্রুপ পর্ব থেকে ফ্রান্স খুব ভালোভাবেই উতরে পরের পর্বে যায়। দ্বিতীয় রাউন্ডে প্যারাগুয়ের বিপক্ষেও ১-০ গোলে ফ্রান্স জয় পায়। কোয়ার্টারে ইতালীর বিপক্ষে জিদান আবার দলে ফিরে আসেন। সেই ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেন তিনি, যদিও ম্যাচটা জিততে হয় ট্রাইবেকারে। সেমিতে মোটামুটি খেলেন, ম্যাচটা বাঁচিয়ে নিয়ে যান থুরাম।
ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনাল শুরুর আগে ব্রাজিল একতরফা ফেভারিট ছিল। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা রোনালদো লিমা তখন পেলে ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে বিশ্বকাপ জয়ের অপেক্ষায়। ফ্রান্সের একটিই সুবিধা- তারা স্বাগতিক। কিন্তু খেলা শুরু হবার পর থেকেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ফ্রান্স আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে এবং জিদান হেড থেকে প্রায় একই রকমের দুটো গোল করেন। ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত ফ্রান্স ৩-০ গোলে জেতে এবং জিদান ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন।
ইউরো ২০০০
ইউরো ২০০০ এ জিদান দলের মূল খেলোয়াড় হিসেবে খেলেন এবং দলের সফলতার পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন। কোয়ার্টারে স্পেনের বিপক্ষে সরাসরি ফ্রি কিক থেকে গোল করেন। সেমিতে পর্তুগালের বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল্ডেন গোল করেন। ফাইনালে ইতালীকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবার পর ফুটবল ইতিহাসে ২৬ বছর পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের পর ইউরো কাপ জেতার গৌরব অর্জন করেন। এ পারফর্মেন্সের পরেই ফ্রান্স প্রথমবারের মতো র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে আসে। টুর্নামেন্ট সেরার পুরষ্কার পান জিদান।
বিশ্বকাপ ২০০২
২০০২ বিশ্বকাপে টপ ফেভারিট দল ছিল ফ্রান্স। তাদের দলের স্ট্রাইকার ছিল তিনজন। থিয়েরি হেনরি ছিলেন সেই সিজনে ইংলিশ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, ডেভিড ত্রেজগে ছিলেন সেই সিজনে ইতালীয়ান লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা আর সিসে ছিলেন ফ্রেঞ্চ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। কিন্তু ফ্রান্স মূল পর্বে একটি গোলও করতে পারেনি, ফলশ্রুতিতে প্রথম পর্ব থেকেই দল বিদায় হয়! এর মূল কারণ ধরা হয় ইনজুরির জন্য জিদানের সেই বিশ্বকাপে প্রথম দুটো ম্যাচ খেলতে না পারা। ইনজুরি নিয়েও জিদান শেষ ম্যাচটা খেলেন। ২-০ গোলে হারা ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন তিনি।
ইউরো ২০০৪
গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৯০ মিনিট পর্যন্ত স্কোর ছিল ১-০। বেকহামের ক্রসে গোলটা করেন ল্যাম্পার্ড। অতিরিক্ত সময় ছিল ৩ মিনিট। ৯৩ মিনিট পর ম্যাচের স্কোর ২-১, গোল দুটি করেন জিদান। ৯১ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে করেন প্রথম গোল, ৯৩ মিনিটে পেনাল্টি থেকে করেন দ্বিতীয় গোল। ম্যান অব দ্য ম্যাচও হন জিদান। ক্রোয়াশিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচ ড্র হয়। গ্রুপের শেষ ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-১ গোলে জেতা ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন জিদান এবং আবারও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। কিন্তু কোয়ার্টারে দুর্দান্ত খেলতে থাকা গ্রীসের কাছে হেরে যায় তার দল।
টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ার পর জিদান আন্তর্জাতিক আসর থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।
বিশ্বকাপ ২০০৬
২০০৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ফ্রান্স ভুগছিল। এক পর্যায়ে বাছাই পর্বে চতুর্থ অবস্থানে চলে যায়। এরপর তৎকালীন কোচ ডমেনেখের অনুরোধে জিদান অবসর ভেঙ্গে ফেরত আসেন এবং দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। সাথে দেশম, লিলিয়ান থুরাম, ম্যাকলেলে আর লিজারাজুর মতো খেলোয়াড়েরাও ফেরত আসেন। এদের নিয়েই বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপে খেলতে যায় ফ্রান্স। নক আউট স্টেজে দ্বিতীয় পর্বে স্পেনের বিপক্ষে জিদানের এসিস্টে ভিয়েরা গোল করেন। বিশ্বকাপে প্রথম কঠিন ম্যাচের মুখোমুখি হয় ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে। রোনালদো লিমা, রোনালদিনহো, কাফু, কার্লোসদের নিয়ে গড়া ব্রাজিলকে ফ্রান্স হারাতে পারবে এই বিশ্বাসটা সেই সময়ে কারো মাঝে ছিল না। তবে জিদান এই ম্যাচে চমক দেখান। শেষ পর্যন্ত ফ্রি কিক থেকে জিদানের এসিস্টেই ম্যাচের এক মাত্র গোল করেন থিয়েরি হেনরি। সেমিফাইনালে মুখোমুখি হন আরেক গ্রেট ফিগোর সোনালি প্রজন্মের পর্তুগালের বিপক্ষে। সেদিনও ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন জিদান।
ফাইনালে মুখোমুখি হন ইতালীর। ম্যাচের সপ্তম মিনিটেই পেনাল্টি পেয়ে যায় ফ্রান্স। চিপ করে পেনাল্টি থেকে গোল করতে ভুল হয়নি জিদানের। এর সাথে সাথে পেলে, ভাভা, পল ব্রিটনারের পর মাত্র চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে দুটো বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। ম্যাচের ১৯তম মিনিটে মাত্তারেজি গোল করলে ইতালী আবার ম্যাচে ফেরত আসে। নির্ধারিত সময় কেটে যায় ১-১ গোলে। অতিরিক্ত সময়ে জিদানের একটা হেড চমৎকারভাবে বুফন ফিরিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণ পরেই মাত্তারাজির সাথে জিদানের কিছু বাকবিতন্ডা হয়। ফলশ্রুতিতে জিদান মাথা দিয়ে মাত্তারাজির বুকে আঘাত হানেন এবং লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরে চলে যান।
টাইব্রেকারে ত্রেজগে মিস করার কারণে ফ্রান্স বিশ্বকাপ হেরে যায়। তবে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল পান জিদান। সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল পাওয়ার রেকর্ড তারই।
৫
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জিদানের অবদান
শুধু গোল এসিস্টের পরিসংখ্যান দিয়ে জিদানের মতো খেলোয়াড়দের মূল্যায়ন করা উচিত না। জিদানের পজিশন দেখুন, এই পজিশন থেকে কালেভাদ্রে কেউ স্কোর করে। কেউ যদি এ পজিশন থেকে ১০০ ম্যাচ খেলার পর ১০টির কমও গোল করে, তাহলেও মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করবে না। জিজুর কাজ স্কোর না, শুধু কন্ট্রোল করা। কিন্তু সেই কন্ট্রোল করার পর গোলের সুযোগ তৈরি, থ্রো বল থেকে সব করেছেন, সাথে করেছেন গোলও।
ইউরো ১৯৯৬, ২০০০, ২০০৪ আর বিশ্বকাপ ১৯৯৮, ২০০২ এবং ২০০৬ এ ফ্রান্সের পক্ষে খেলেছেন জিদান। এই ৬ টুর্নামেন্টে ফ্রান্সের পক্ষে ১০টি গোল করেছেন তিনি। ফ্রান্সের হয়ে জিদানের চেয়ে বেশি গোল করেছেন কেবল মাত্র একজন, থিয়েরি হেনরি (১১টি)। তবে জিদান হেনরির চেয়ে পজিশন বাদেও আরেকটি দিক থেকে এগিয়ে আছেন। জিদানের ১০টি গোলের ৭টিই যে নক আউট স্টেজে করা। অন্যদিকে হেনরির ১১টি গোলের মাঝে মাত্র ২টি নক আউট স্টেজের।
ব্যক্তিগত অর্জন বাদ দিলেও ভিন্ন দিক থেকে জিদানের অবদান ফ্রান্সের জন্য অনন্য। জিদান আসার আগে ফ্রান্স মোটামুটি মিডিওকার দল হিসেবেই পরিচিত ছিল। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে ফন্তেইনের কিছু ঝলক বাদ দিলে প্লাতিনি বাদে সেরকম কোনো স্টার ফ্রান্সে আসেনি। জিদান যুগের পরেই ফ্রান্সকে এখন যেকোনো টুর্নামেন্টে প্রথম সারির ফেভারিট ধরা হয়।
ফ্রান্স দলে জিদানকে একটা যুগ হিসেবে ধরা যায়। প্লাতিনি যাবার পর ফ্রান্স ১৯৯০ আর ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০২ বিশ্বকাপে আবার জিদানবিহীন ফ্রান্স প্রথম পর্ব থেকে বাদ পড়ে। ২০০৬ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে খাবি খেতে থাকা ফ্রান্সকে মুল পর্বে ওঠান তিনি। ২০১০ বিশ্বকাপে জিদানবিহীন ফ্রান্স আবার বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকে বাদ পড়ে যায়।
৬
খেলোয়াড় হিসেবে জিদান ঠিক কোন যোগ্যতার জন্য সর্বকালের সেরার প্রথম দিকে থাকেন? ফিফা বর্ষসেরা পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি ক্যারিয়ারে তিনবার। কিন্তু বর্ষসেরা পুরষ্কারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সেরার জন্য খুব বড় কিছু মনে করি না।
যেকোনো একটি প্রতিযোগিতায় যথেষ্ট যোগ্য প্রতিযোগীর অভাবটাও অনেক সময় কাউকে পুরষ্কার পাইয়ে দিতে পারে। কিন্তু জিদানের সময়ে বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক বেশী ক্লাস খেলোয়াড় ছিলেন।
সেই সময়ে অন্যান্য দলের তারকা খেলোয়াড়গুলোর দিকে একটু লক্ষ্য করুন।
- ‘৯৮ বিশ্বকাপে জিদানের জন্য কঠিন প্রতিপক্ষ ইতালী আর ব্রাজিল।
ইতালীর স্কোয়াডের স্টার খেলোয়াড়দের নাম একটু লক্ষ্য করি। মালদিনি, নেস্তা, ক্যানাভারো, আলবার্তিনি, ব্যজিও, দেল পিয়ারো ও ভিয়েরি।
ব্রাজিলের স্কোয়াডটা একটু খেয়াল করি। তাফারেল, কাফু, কার্লোস, দুঙ্গা, রোনালদো, রিভালদো, বেবেতো, ডেনিলসন ও এমারসন। - ২০০৬ বিশ্বকাপে জিদানের কঠিন প্রতিপক্ষ ছিল স্পেন, ব্রাজিল, পর্তুগাল আর ইতালী। এদের স্কোয়াডের কয়েকজন খেলোয়াড়ের নামগুলো একটু দেখি।
স্পেনে ছিল ক্যাসিয়াস, পুওল, রাউল, জাভি ও তোরেস।
ব্রাজিলে ছিল কাফু, এমারসন, কার্লোস, লুসিও, আদ্রিয়ানো, কাকা, রোনালদো, রোনালদিনহো ও রবিনহো।
ইংল্যান্ডে ছিল নেভিল, জেরার্ড, ফার্ডিনান্দ, টেরি, বেকহাম, ল্যাম্পার্ড, রুনি, ওয়েন, কোল ও ক্যাম্বেল।
পর্তুগালে ছিল ফিগো, ডেকো, রুই কস্তা, গোমেস, পস্তিগা, পাওলেতা এবং তরুণ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
ইতালীতে ছিল বুফন, ক্যানাভারো, দেল পিয়ারো, গাত্তুসো, টট্টি, টনি, পিরলো ও নেস্তা। - ২০০২ ইউরোতে ফ্রান্সের কঠিন প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালী। (নেদভেদের চেককে বাদ দিলাম।) নেদারল্যান্ডের স্কোয়াডে ছিল ভ্যান ডার সার, সিডর্ফ, ডেভিডস, ক্লুইভার্ট, বার্গক্যাম্প, ওভারমার্স ও ডি বোর।
স্পেনের স্কোয়াডে ছিল গার্দিওলা, হিয়ারো ও রাউল।
পর্তুগালের স্কোয়াডে ছিল ফিগো, রুই কস্তা, গোমেস, পস্তিগা ও পাওলেতা।
ইতালীর স্কোয়াডে ছিল মালদিনি, ক্যানাভারো, দেল পিয়ারো, নেস্তা ও টট্টি।
উপরে যে কতগুলো খেলোয়াড়দের নাম বললাম তাদের প্রত্যেকেরই ক্লাব পারফর্মেন্স যথেষ্ট সম্মানজনক। এদের মাঝ থেকে নিজের জাতীয় দলকে নিয়ে আলাদাভাবে একটি পর্যায়ে পৌছানো অবশ্যই বিশেষ কিছু।
ফুটবলে সেরা হবার জন্য একজন খেলোয়াড়ের যে কত ধরনের গুণ থাকা প্রয়োজন, তার অনেক কিছুরই অভাব ছিল জিদানের মাঝে। গতির অভাবের কথা তো আগেই বললাম, শারীরিক গঠনের কারণে হেডেও দুর্বল ছিলেন। তবে এক্সট্রা অর্ডিনারি ছিলেন উইক ফুট এবিলিটিতে। ডি বক্সের বাইরে থেকেও বাম পায়ে অসংখ্য গোল করেছেন। এছাড়া ড্রিবলিংয়েও সর্বকালের সেরাদের সংক্ষিপ্ত তালিকাতে থাকবেন। তবে জিদান সবচেয়ে এগিয়ে যান খেলার ধরন বুঝতে পারা আর বড় ম্যাচে পারফর্মেন্সের কারণে। নার্ভ খুবই শক্ত ছিল তার। কোনো পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়তেন না। একজন পারফেক্ট লিডার ছিলেন তিনি।
৭
ম্যানেজার জিদানও শুরু থেকে সাফল্য পাচ্ছেন। অনেকে ভাবতে পারেন যে, রিয়াল মাদ্রিদের মতো বড় দলের কোচ হলে কাজটা সহজ হবার কথা। কাজটা যে সহজ না সেটা আগের কয়েক সিজনের রেকর্ড দেখলেই বুঝতে পারার কথা। প্রায় একই একাদশ নিয়ে বেনিতেজের আমলে মাদ্রিদ হিমশিম খাচ্ছিল। সেই দলকেই এক সুতোয় গেঁথে অসামান্য সাফল্য আনা মুখের কথা না। কোচ হিসেবে অনেকে এখনই তাকে ক্রুয়েফের সাথে তুলনা শুরু করে দিয়েছেন। আসলে সফলতা পেলেও ক্রুয়েফ যে কাজ করেছিলেন সেটা জিদান এখনো করেননি বা করার প্রয়োজন হয় নি। কোচিং এ গার্দিওলার মতো নতুন কোনো স্টাইলও নিয়ে আসেন নি তিনি।
কোচ হিসেবে ক্রুয়েফের সাথে তুলনা করার সময় এখনো আসেনি। তবে একজন কোচের জন্য ফুটবলে সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সফলতা। সেটা যেহেতু আপাতত এসে পড়েছে, কাজেই বাকিটা আসবে না সেটা বলা এই মূহুর্তে বোকামি হবে। বোকামি না করে কি হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।