একটা ওয়ানডে ম্যাচের কথা চিন্তা করা যাক। যেখানে আপনার দলের লক্ষ্যটা তিনশ ছাড়ানো। চেজ করতে নেমে ১০০ রানের মধ্যেই নেই পাঁচ উইকেট। এমন দশায় ম্যাচ বাঁচাতে প্রয়োজন প্রতিপক্ষকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়া, প্রতিপক্ষের বোলিং অ্যাটাকে আতঙ্ক ছড়ানো একটা ইনিংস। পছন্দের যেকোনো এক ক্রিকেটারকে নিতে পারবেন। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, হার্দিক পান্ডিয়া, আন্দ্রে রাসেল, বেন স্টোকস, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, জস বাটলার। এমন অনেক অপশনই আছে আপনার হাতে। ধরি, তাদের থেকে একজনকে দায়িত্ব দিলেন ম্যাচ জেতানোর। কাকে বেছে নিবেন? ধরুন দারুণ এক সেঞ্চুরিতে সেই ব্যাটসম্যানই ম্যাচ জেতালেন। উপরি পাওনা হিসেবে সেই ইনিংস হয়ে গেল বর্ষসেরা। ব্যাপারটা দারুণ নিশ্চয়ই।
সেই দারুণ ব্যাপারটাই ঘটেছে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাক্সওয়েলের সাথে। ২০২০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন মারকুটে এই ব্যাটসম্যান। সেই ইনিংসের পাশে বসেছে ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত ‘উইজডেন’-এর বর্ষসেরার তকমা। রোর বাংলার আজকের আয়োজনে থাকছে করোনার দাপটকাল অর্থাৎ ২০২০ সালের সেরা পাঁচটি ওয়ানডে ইনিংসের কথা।
ম্যানচেস্টারে ম্যাক্সওয়েল ম্যাজিক
ম্যাক্সওয়েলের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির কথা মনে আছে? ২৬ বছরের টগবগে তরুণ তখন তিনি। ২০১৫ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বোলারদের ওপর টর্নেডো বইয়ে দিয়েছিলেন। ৫১ বলে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি, তাও বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে। সিডনির সেই আলো ছড়ানো ইনিংসের পর কে ভেবেছিল, পরের সেঞ্চুরির জন্য তাকে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে! অবশ্য তার ব্যাটিংয়ের যে ধরন, তাতে দেখে মনে হয় না তিনি সেঞ্চুরি কিংবা মাইলস্টোনের জন্য খেলেন। নব্বইয়ের ঘরেই আউট হয়েছেন পাঁচবার। একটু রয়েসয়ে খেললে সেঞ্চুরির সংখ্যা বাড়তই বোধহয়।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর মোট ছয়টি ওয়ানডে খেলেছেন ম্যাক্সওয়েল। তিনটি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, বাকি তিনটি ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে। সেই ছয় ম্যাচেই সাত নম্বর পজিশনে ব্যাট করেছেন। আর সেখানেই সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল তিনি। এক সেঞ্চুরির সাথে আছে দুইটি ঝড়ো হাফসেঞ্চুরি। জ্বলজ্বল করছে কুইক ক্যামিও ইনিংসও।
এবার ফেরা যাক ম্যানচেস্টারে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের শেষ ওয়ানডে রূপ নিয়েছে সিরিজ ডিসাইডারে। প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ৩০২। ৩০২ রান এখনকার ক্রিকেটে খুব বেশি নয়। কিন্তু সেই রান টপকাতে গিয়ে যখন টপ অর্ডার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে, তখন সেটা ছোঁয়া অসম্ভবের পর্যায়েই পড়ে।
গোলমাল লাগলো অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং অর্ডারে। ক্রিস ওকস আর পার্ট টাইমার জো রুট মিলে ধ্বস নামালেন অজি শিবিরে। ৭৩ রানে নেই পাঁচ উইকেট। সাত নম্বরে ব্যাট করতে গেলেন ম্যাক্সওয়েল। জয়ের রাস্তা তখন অনেক দূর। তার সঙ্গী অফ অফ ফর্মে থাকা অ্যালেক্স ক্যারি। শেষ স্বীকৃত ব্যাটিং জুটি তারাই। তাদের পর ছিলেন চার বোলার। তাই ম্যাক্সওয়েলের সামনে একটা রাস্তাই খোলা, পাল্টা আক্রমণ করে ম্যাচ বের করে আনা। ম্যাক্সওয়েলও তাই করলেন, দুই বল সময় নিলেন ইংলিশদের জবাব দিতে। জফরা আর্চারকে উড়িয়ে মারলেন কাউ কর্নার দিয়ে দারুণ এক ফ্লিকে। একদম নিজের সহজাত স্বভাবে।
ইনিংসের শুরুর দিকে দলকে ব্রেক-থ্রু এনে দেয়া রুটকে সরিয়ে আদিল রশিদকে বোলিংয়ে পাঠান অধিনায়ক ইয়োন মরগান। ম্যাক্সওয়েল তখন ৩০ বলে ৩৫ রানে ব্যাট করছেন। অধিনায়ক মরগানের অন্যতম ভরসা রশিদকেই একহাত নিলেন ম্যাক্সওয়েল। এই লেগ স্পিনারকে হাঁকালেন তিন ছক্কা। বোলিং অ্যাটাক নড়বড়ে হয়ে গেল খানিকটা। ফলাফলটা অস্ট্রেলিয়া পেল হাতেনাতেই। একপ্রান্তে ম্যাক্সওয়েল হাত খুলে খেলেছেন, তাই অন্য প্রান্তে চাপহীন ক্রিকেট খেলতে পেরেছেন ক্যারি। ২১২ রানের ম্যাচ জেতানো জুটি।
৯০ বলে ১০৮ রানের ইনিংস খেলেন ম্যাক্সওয়েল। চারটা চারের সঙ্গে আছে সাতটি ছক্কার মার। শেষ ছক্কাটা মেরেছেন টম কারেনকে। সুইপার কভার দিয়ে মারা সেই ছক্কাতেই পূর্ণ করেছেন সেঞ্চুরি। ওদিকে ম্যাক্সওয়েল বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলেন আদিল রশিদের লেগ স্পিনে। সেই রশিদকে ছক্কা মারতে গিয়েই শর্ট থার্ডম্যানে ক্যাচ দেন ম্যাক্সি। অবশ্য ততক্ষণে ম্যাচের লাগাম অজিদের হাতের নাগালে চলে গেছে। ম্যাক্সওয়েলের পর আউট হন ক্যারিও। তবে প্যাট কামিন্সকে নিয়ে বাকি কাজটা সারেন মিচেল স্টার্ক। শেষ ওভারে আদিল রশিদকে এক ছক্কা, এক চারের প্যাকেজে পিটিয়ে ম্যাচটা জেতান স্টার্ক।
বিখ্যাত ক্রিকেট লিখিয়ে নেভিল কার্ডাস বলে গেছেন, ‘পরিসংখ্যান একটা আস্ত গাধা।’ ম্যাক্সওয়েলের ক্ষেত্রেও এই উক্তিটা খাটে। কেবল স্ট্যাটস-রেকর্ডস দিয়ে তাকে মাপা সমীচীন নয় বোধ করি। কেন? একটু ধারণা দেয়ার চেষ্টা করি।
ক্রিকেট বলকে পেটানোর তার এক অসীম ক্ষমতা। ছয় আউন্সের বলটা যে পেটানোরই জিনিস, তার ঝুলিতে থাকা একেকটা শটে যেন এরই সাক্ষ্য দেয়। এমন হিটিং অ্যাবিলিটির এক মারকাটারি ব্যাটসম্যানকে ব্যাট করতে দেখা দর্শকের জন্য নিঃসন্দেহে আনন্দের। শুধু তাই নয়, তার সতীর্থ-নির্বাচকরাও একই দলে। যখন ছন্দে থাকেন, তখন পয়সা উসুল ধরনের আনন্দ হয় সবারই। ২০১৫ বিশ্বকাপে ৫১ বলে সেঞ্চুরি, কিংবা ২০১৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে ১৪৫*। এমন অবিশ্বাস্য ইনিংসগুলোই তার প্রতি সবার প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলস্বরূপ ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন। টিম ম্যানেজমেন্টের উদ্দেশ্য, ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা না করে ম্যাচের ফলাফলে প্রভাব ফেলার চেষ্টা। এতে হলো হিতে বিপরীত। বিবর্ণ না হলেও অধারাবাহিক ছিল তার ব্যাট।
২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপ পর্যন্ত, শুরুর ছয় পজিশনে ব্যাট করেছেন। কিন্তু যতটা আনন্দ দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি হতাশ করেছেন, হতাশ হয়েছেন। পাঁচ নম্বরে ব্যাট করেছেন ২২ ইনিংসে। যার মধ্যে হাফ সেঞ্চুরি মাত্র তিনটি। ছয় নম্বরে ব্যাট করে ১৩ ইনিংসে চার হাফসেঞ্চুরি। নিজের পছন্দের সাত নম্বর পজিশনে ব্যাট করেছেন মাত্র চার ইনিংসে। ২০১৯ বিশ্বকাপের কথাই বলা যাক। দশ ম্যাচে মোট চারটি আলাদা পজিশনে ব্যাট করতে হয়েছে তাকে। পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস নেই একটিও। কিন্তু বিশ্বকাপের পর সাত নম্বর পজিশনে ফিরেই চমক দেখিয়েছেন। ১১৬ ওয়ানডেতে ৩,২৩০ রান; গড়টা ৩৫ ছুঁইছুঁই। ২২ হাফ সেঞ্চুরি, দুই সেঞ্চুরি।
সংখ্যাগুলো আরো একটু বাড়তেই পারতো। যদি ব্যাটিং পজিশন নিয়ে মিউজিক্যাল চেয়ার খেলতে না হতো তাকে। ব্যক্তিগত মাইলফলকের কথা বললে, ওসব নিয়ে খুব বেশি ভাবেন না ম্যাক্সওয়েল। ম্যানচেস্টারের সেই ম্যাচে আদিল রশিদকে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন। অথচ আগের বলেই অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, যদি তখন সেঞ্চুরি না-ও হতো, তাও বোধহয় এভাবেই উড়িয়ে মারতেন আদিল রশিদকে।
স্পার্কলিং স্টার্লিং
প্রথম ওয়ানডেতে ছয় উইকেটের হার। তা ছাপিয়ে আয়ারল্যান্ডের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলল টপ অর্ডারের ব্যাটিং। ইংলিশ বোলারদের দাপটে সিরিজের প্রথম ম্যাচে ২৮ রানে পাঁচ উইকেট খুইয়ে বসে আইরিশরা। সে যাত্রায় কার্টিস ক্যাম্ফার-ম্যাকব্রাইনরা বাঁচিয়ে দিলে রান দাঁড়ায় ১৭২। তৃতীয় ম্যাচে আগে ব্যাট করে ইংল্যান্ড। মরগানের সেঞ্চুরি, টম ব্যান্টন আর ডেভিড উইলির হাফ সেঞ্চুরিতে ইংলিশদের রান ৩২৮। আগের ম্যাচে আইরিশ ব্যাটসম্যানরা ব্যর্থ, দ্বিতীয় ম্যাচে বোলাররা পাত্তা পাননি।
রান পাহাড় সামনে নিয়ে ব্যাটসম্যানদের দুর্নাম ঘুচানোর দায়িত্ব নিলেন ওপেনার পল স্টার্লিং। শুরুটাও করলেন একদম ফটোজেনিক। এর চেয়ে পিকচার পারফেক্ট শুরু আর হতেই পারে না বোধহয়। উইলির হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া ওয়াইডিশ একটা ফুল লেংথ ডেলিভারি, স্টার্লিং খেললেন দারুণ একটা কভার ড্রাইভ। কভারে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন স্যাম বিলিংস। দারুণ একটা ইনিংসের শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। বিশাল রানের বাঁধা টপকাতে এমন একটা বারুদে শুরুই দরকার ছিল আইরিশদের। সহ-অধিনায়ক স্টার্লিংয়ের কল্যাণে তা বেশ ভালোভাবেই হয়েছে। পেসার সাকিব মাহমুদকে পুল করে টানা দুই ছক্কা। ক্যাপ্টেন মরগানের গো-টু ম্যান আদিল রশিদকে নিজের টার্গেট বানিয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে কয়েকবার আছড়ে ফেলা সীমানার ওপারে। উইলি কিংবা টম কারেন-কেউই বাদ যায়নি সেদিন। ১২৮ বলে খেলেছেন ম্যাচ জেতানো ১৪২ রানের ইনিংস। নয় চারের সাথে আছে ছয়টি ছক্কা। যার মধ্যে তিনটি একাই হজম করেছেন আদিল রশিদ।
ব্যক্তিগত ৯৫ রানে একবার জীবন পান স্টার্লিং। জেমস ভিন্স তার ক্যাচ ছেড়ে দেন। পরের ওভারেই অবশ্য দেখা পান নবম ওয়ানডে সেঞ্চুরির। তবে কাজ তখনো ঢের বাকি। ইতিহাস গড়ে জিততে আইরিশদের চাই আরো ১৫৮ রান। দম ফেলার ফুরসত নেই কারো। সেই সময়ে জমে উঠেছিল উইলি-স্টার্লিংয়ের দ্বৈরথ। ৩৪তম ওভারে বল করতে যান উইলি। সেই ওভারের প্রথম বলেই উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে খেলেন স্টার্লিং। আগের দুই ম্যাচে উইলির বলেই আউট হন তিনি। তবে ইতিহাস গড়ার এই ম্যাচে ঠিকই জিতে যান স্টার্লিং। পুরনো দুই ম্যাচের হিসাবও তাহলে মিটলো। অধিনায়ক বালবির্নের সাথে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হন স্টার্লিং। দলকে জয়ের রসদ তো আগেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলের তরী জয়ের বন্দের ভেড়ানোর কাজটা করেন কেভিন ও’ব্রায়েন-হ্যারি ট্যাক্টর।
স্টার্লিংয়ের বারুদঠাসা, স্পার্কলিং এই ইনিংসটি আছে উইজডেনের বর্ষসেরার তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে।
হ্যামিল্টনের সন্ধ্যা আর রস টেলর
ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যা। করোনাভাইরাস তখনও সেভাবে ছড়িয়ে পড়েনি বিশ্বজুড়ে। নিউ জিল্যান্ড সফরে ভারত। হ্যামিল্টনে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডে। লোকেশ রাহুল, বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আয়ারদের চওড়া ব্যাটে পাত্তা পায়নি নিউ জিল্যান্ডের বোলাররা। তাদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে ভারতের সংগ্রহ ৩৪৭।
কোহলিকে বলা হয় চেজিংয়ের রাজা। সেই কোহলির দলের বিপক্ষে জিততে হলে রেকর্ড সংগ্রহ টপকাতে হবে ব্ল্যাক ক্যাপসদের। কোহলির সামনেই সেই রানের পাহাড় অনায়াসে পেরিয়ে যায় কালো টুপিওয়ালারা, তাও ১১ বল হাতে রেখে, যার অন্যতম কারিগর রস টেলর। একপ্রান্তে ঢাল হয়ে থেকেছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। টেইলর নামেন চার নম্বরে সেদিন, ৮৪ বলে খেলেন ১০৯* রানের ইনিংস। রেকর্ডগড়া জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার আগে ১০ চারের সঙ্গে মেরেছেন চারটি ছক্কা। ইতিহাসগড়া এই রান তাড়ায় টেলরের সঙ্গী ছিলেন দুইজন। হেনরি নিকোলস, ও টম ল্যাথাম। দু’জনের সাথেই গড়েন দারুণ দুটা জুটি।
তবে টেলর আলো ছড়িয়েছেন কয়েকটা শটে। ভার্টিক্যাল ব্যাটে এত দুর্দান্ত কয়টা শট খেলেছেন, চোখ ফেরানো দায়। জসপ্রিত বুমরাহর ১৪০+ ছুঁইছুঁই ডেলিভারিটাকে স্রেফ আলতো করে তুলে দিয়েছিলেন ফুটওয়ার্ক আর কব্জির মুন্সিয়ানায়। বলের ঠিকানা লং অনের ওপারে। একই স্টাইলে শার্দূল ঠাকুরকে ছক্কা মেরেছেন। আর রবীন্দ্র জাদেজাকে যে দুটো স্লগ সুইপ করেছেন, তা দেখে জাদেজা নিজেও অবাক হয়েছেন। ভারতের স্পিনারদের বিপক্ষে সেদিন দারুণ খেলেছেন টেলর। স্কোরিং শট সুইপ; রান তুলেছেন ২৬।
অন্য প্রান্তে ল্যাথাম, জিমি নিশামরা আসা-যাওয়া করেছেন। অটল থেকেছেন টেলর। উইনিং শটটাও তার ব্যাট থেকেই। চকমকে ব্যাটটা দিয়ে জমজমাট সেই সন্ধ্যায় যে ইনিংসটা খেলেছেন, সেই ইনিংসটা গত বছরের তৃতীয় সেরা।
সিডনিতে স্মিথ ঝড়
স্টিভেন স্মিথ ওয়ানডে খেলতে নেমেছিলেন নয় মাস পর। গত বছরের নভেম্বরে ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে। অথচ সেই ম্যাচে এত সাবলীল ব্যাটিং করেছেন, কেউ বলবেই না এতদিন পর এই ফরম্যাটে খেলছেন তিনি। শুধু খেলেননি স্মিথ, ভারতের বোলিং অ্যাটাককে একাই ধ্বসিয়ে দিয়েছেন। হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় দ্রুততম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান। স্মিথের এই ইনিংসটি আছে উইজডেনের বর্ষসেরা তালিকার চতুর্থ স্থানে।
সিডনিতে সেদিন খুনে অবতারে আবির্ভূত হয়েছিলেন স্মিথ। এই ম্যাচের আগে ওয়ানডেতে তার স্ট্রাইকরেট ছিল ৮৬। অথচ সিডনিতে এমন মারকুটে ইনিংস খেলেছেন যে সেটা বেড়ে গিয়ে হয়েছে ১৫৯! স্মিথ যখন মাঠে নামেন, অস্ট্রেলিয়ার রান তখন ১৫৬। উইকেটে আগে থেকেই সেট হয়ে ছিলেন অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ। সেঞ্চুরি করেছেন তিনিও। কিন্তু সেটা ম্লান হয়ে গেছে স্মিথের তাণ্ডবে। ওয়ার্নার-ফিঞ্চ মিলে মঞ্চটা তৈরি করেই রেখেছিলেন। স্মিথের কাজটা ছিল শুধু পারফর্ম করা। মোট খেলেছেন ৬৬ বল। রান করেছেন ১০৫। ১১ চারের সাথে আছে চারটা ছক্কা।
আইপিএলে তেমন কিছুই করতে পারেননি। খাবি খেয়েছেন ভারতের স্পিনারদের বিপক্ষেও। কিন্তু সিডনিতে ঠিকই জাদেজা-চাহালদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন। ফুটওয়ার্কে দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা। বলের লাইন-ট্রাজেক্টরি-লেংথ সবই পড়েছেন ঠিকমতো। ইনসাইড আউট করে লফটেড কভার ড্রাইভ খেলেছেন, মিড উইকেট দিয়ে উড়িয় মেরেছেন। বাদ যায়নি পেসাররাও। ইনিংসের শেষদিকে বুমরাহর স্লোয়ার ইয়র্কারে যেভাবে সুইপ করেছেন, তাতে তার সাহসের তারিফ না করে পারা যায় না। তখন ৯৫ রানের ব্যাট করছিলেন স্মিথ। সিডনিতে তার তাণ্ডবে ভারতের সামনে ৩৭৫ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় অজিরা। ৩০৮ রানে আটকে যায় ভারত।
ক্লাসেন ‘ফায়ার’ ওভার বুশফায়ার
করোনাকালের আগের কথা। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে অস্ট্রেলিয়া। তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডে বোল্যান্ড পার্কে। টস জিতে ব্যাট নেয়া দক্ষিণ আফ্রিকার টপ অর্ডারের তিনজন ড্রেসিংরুমে ৫০ রানের আগেই। স্টার্ক-কামিন্স-হ্যাজলউড ওদিকে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন।
পাঁচ নম্বরে নামেন হেনরিখ ক্লাসেন, অভিজ্ঞতা মাত্র ১৪ ম্যাচের। তার সঙ্গী কাইল ভ্যারেনে একদমই আনকোরা। তার অভিষেক ম্যাচ। দু’জন মিলে হাল ধরেন শক্ত হাতে। ৭৮ রানের জুটিতে ভরসার প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা। টু-পেসড উইকেটে শুরুটা অবশ্য ধীর ছিল ক্লাসেনের। প্রথম খেলা ২৪ বল ৯ রান। হাত খুলে খেলা শুরু করেন মিচেল মার্শ আর ডি’আর্চি শর্টকে দুই প্রান্ত থেকে পেয়ে। সাথে ছিল নিয়মিত স্ট্রাইক রোটেশন। হাফ সেঞ্চুরি করেন ৬৫ বলে। অমন টু-পেসড উইকেটের জন্য আদর্শ ইনিংসই বলা চলে। যেখানে প্রতিপক্ষের বোলিং অ্যাটাক সমীহ জাগানিয়া। কাইলের আউট হওয়াটা শাপেবর হয় প্রোটিয়াদের জন্য। ক্লাসেনের নতুন পার্টনার ডেভিড মিলার। মাঠে মিলারের এন্ট্রির পরই ডিফেন্স আর সতর্কতার চাদর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ক্লাসেন। দারুণ এক টনিক যেন। হ্যাজলউড, জ্যাম্পাকে উপহার দেন তিনটি করে বাউন্ডারি।
বুশফায়ারের কারণে সেদিন বোল্যান্ড পার্কের হাওয়া ছিল বেজায় গরম। তাপমাত্রার পারদ ছিল ঊর্ধ্বমূখী। ম্যাচটা অল্পের জন্য বাতিল হয়নি। ম্যাচটা বেচে গেলেও অস্ট্রেলিয়া রক্ষা পায়নি ক্লাসেনের ব্যাটের আগুন থেকে। মাঠে নেমেছেন দশ ওভারের সময়। যখন অজিদের পেস-ট্রায়ো চেপে ধরেছে প্রোটিয়াদের। অভিজ্ঞতার ঝুলিও ভারী নয়। তবুও বুক চিতিয়ে তাদের বল খেলেছেন ক্লাসেন। হাঁকান ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরিটাও এসেছে দারুণ এক শটে। কামিন্সকে লেগ সাইডে বিশাল এক ছয় মেরে। ১১৪ বলে ১২৩* রানের ইনিংসে সাত চার ও তিন ছক্কা। দলের রান পৌঁছায় ২৯১তে। ম্যাচটাও প্রোটিয়ারা জিতে ৭৪ রানে। এটি গত বছরের পঞ্চম সেরা ইনিংস।