একটি দৃশ্য কল্পনা করা যাক। অদ্ভুতুড়ে বোলিং অ্যাকশনের একজন বোলার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই একজন প্রথিতযশা আম্পায়ার দ্বারা চাকিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হলেন। তার তিন বছর পর আবারো সেই খেলোয়াড়কে চাকিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত করা হলো; তবে এবার রঙ্গমঞ্চে অন্য আরেকজন আম্পায়ার। এই ঘটনা নিয়ে চারিদিকে আলোচনার ঝড়, সবাই ওই খেলোয়াড়ের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে ওই বোলারের ভবিষ্যৎ ঠিক কী হতে পারে?
হতাশ হয়ে অকালে ঝরে পড়ার উত্তরই বেশি আসার কথা, ক্যারিয়ারের শুরুতেই এত বড় বিতর্ক উঠে আসলে আত্মবিশ্বাস তলানিতে চলে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু সেটা হয়নি, সমস্ত বিতর্ককে মিথ্যা প্রমাণিত করে বারবার তিনি ফিরে এসেছেন স্বরূপে, ক্যারিয়ার শেষে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা বোলার হিসেবে। তিনি শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি অফ স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন।
দেশাবন্দু মুত্তিয়া মুরালিধরন ১৯৭২ সালের ১৭ই এপ্রিল ক্যান্ডির এক তামিল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেইন্ট অ্যান্থনি কলেজে মাত্র নয় বছর বয়সেই ক্রিকেটের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তবে মজার বিষয় হলো, ইতিহাস গড়া এই স্পিনার সেসময়ে ছিলেন একজন মিডিয়াম পেস বোলার! ১৪ বছর বয়সে তার কোচ সুনীল ফার্নান্দোর পরামর্শে অফ স্পিনার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে শুরু করেন। স্কুল ক্যারিয়ার শেষে, ১৯৯১ সালে যোগ দেন তামিল ইউনিয়ন ক্লাবে।
পেশাদার ক্রিকেটে যোগদানের পর খুব দ্রুতই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের নির্বাচকদের নজরে পড়ে যান মুরালিধরন। এর মূল কারণ ছিল তার অদ্ভুত বোলিং অ্যাকশন, ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনিই ছিলেন প্রথম রিস্ট-স্পিনিং অফ স্পিনার। তাছাড়া মুরালির অস্ত্রভাণ্ডার ছিল দারুণ বৈচিত্র্যময়, অফ ব্রেক ছাড়াও টপ স্পিন ও দুসরার সমন্বয় তাকে রহস্যময় এক স্পিনারে পরিণত করে। সাধারণত রিস্ট স্পিনারদের সবাই লেগ স্পিনার হয়ে থাকেন সেখানে এমন বিরল প্রজাতির একজন বোলারকে খুঁজে পেয়ে নির্বাচকরা খুব দ্রুত তাকে জাতীয় দলে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন।
সেকারণে ১৯৯১ সালেই শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলে ডাকা হয় তাকে। তবে সেবার পাঁচ ম্যাচ খেলেও উইকেটশূন্য ছিলেন মুরালি। তবুও তাকে জাতীয় দলে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তে অটল থাকে লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড। শেষমেশ ১৯৯২ সালের ২৮ আগস্ট অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কলম্বো টেস্টের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে মুরালির। অভিষেকটা অবশ্য তেমন স্মরণীয় হয়নি, দুই ইনিংস মিলিয়ে তিনি নিয়েছিলেন তিন উইকেট। পরের বছরের আগস্টে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচেও বেশ গড়পড়তা ছিলেন মুরালিধরন, ১০ ওভারে ৩৮ রান খরচায় সেই ম্যাচে তিনি নিয়েছিলেন এক উইকেট। তবে সেই মাসেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মোরাতুয়া টেস্টে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো পাঁচ উইকেট তুলে নেন তিনি।
শুধু ঘরের মাঠেই নয়, বরং প্রতিপক্ষের মাঠেও যে তিনি সমান কার্যকরী বোলার, সেটা প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় নেননি মুরালি। ১৯৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নেপিয়ার টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৪ রানে পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে বিদেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার প্রথম টেস্ট জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন এই অফ স্পিনার। এই ম্যাচে মুরালির বোলিং দেখে তৎকালীন লঙ্কান ম্যানেজার দুলিপ মেন্ডিস বলেন, “মুরালির যা প্রতিভা তাতে সে কংক্রিটের পিচেও টার্ন আদায় করতে সক্ষম।” সেই বছরেই পাকিস্তানের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১৯ উইকেট তুলে নিয়ে, উপমহাদেশের দলগুলোর বিপক্ষেও নিজেকে ভয়ঙ্কর হিসেবে প্রমাণ করে দেন। এভাবে মাত্র অল্প সময়েই পুরো ক্রিকেট বিশ্বে সাড়া ফেল দেন মুরালিধরন।
মুরালিধরনের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৯৫ সালের বক্সিং ডে টেস্টে। সেই ম্যাচে আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার চাকিংয়ের দায়ে বারবার মুরালিধরনের বলকে নো বল হিসেবে অভিহিত করতে থাকেন, একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে হেয়ার যে প্রান্তে আম্পায়ারিং করছিলেন সে প্রান্তে মুরালিকে আর বোলিংয়েই আনেননি রানাতুঙ্গা। ম্যাচ শেষে হেয়ারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানায় শ্রীলঙ্কা দল, কিন্তু আইসিসি সেই অভিযোগ খুব একটা আমলে নেয়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সিরিজের শেষ ম্যাচে মুরালিকে ছাড়াই খেলতে নামে শ্রীলঙ্কা।
এসবে অবশ্য মুরালি মোটেও দমে যাননি, নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বায়োমেকানিক্যাল পরীক্ষায় অংশ নেন এবং সেখানে তার বোলিং অ্যাকশনকে বৈধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আসলে মুরালির কনুই জন্মগতভাবেই কিছুটা বাঁকানো, পুরো কনুই তিনি কখনোই সোজা করতে পারেন না। আর ঠিক এই কারণেই মুরালি যখন বল ছুঁড়েন তখন তিনি চাকিং করছেন বলে একটা বিভ্রম তৈরি হয়, কিন্তু মূল ঘটনা মোটেও সেরকম নয়। এই পরীক্ষার ফলে মুরালিকে নিয়ে সংশয়বাদীদের মুখ সেই সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সবাইকে তাক লাগিয়ে শিরোপা জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। সেবারের বিশ্বজয়ে খালি চোখে মুরালির অবদান আহামরি কিছু মনে না হলেও, পর্দার আড়ালে জয়ের ভিত গড়ার কাজটা তিনিই করেছিলেন। সেই বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচ খেলে তিনি নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। সবদিক থেকেই এই পারফর্মেন্স বেশ গড়পড়তা ছিল, তবে মুরালি আসল জাদুটা দেখিয়েছিলেন রান আটকে রাখার কাজে। সেই আসরে তিনি ওভারপ্রতি খরচ করেছিলেন মাত্র ৩.৭৮ রান! আসলে সেই আসরে সবাই মুরালিকে সমীহ করে খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তার প্রান্ত থেকে সেভাবে রানই বের হতো না, ফলে চাপে পড়ে প্রতিপক্ষ ধর্মসেনা, জয়াসুরিয়া আর ডি সিলভার উপর চড়াও হতে গিয়ে তাদেরকেই উইকেট বিলিয়ে আসতো।
এদিকে বিশ্বজয়ের ঘটনা যে কোনো অপ্রত্যাশিত সাফল্য ছিল না সেটা প্রমাণের জন্য শ্রীলঙ্কার উপর আলাদা একটা চাপ তৈরি হয়। সেই চাপ সামলানোয় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন মুরালিধরন, আরেক কালজয়ী লঙ্কান পেসার চামিন্দা ভাসকে সাথে নিয়ে শ্রীলঙ্কার বোলিং লাইনআপকে টেনে নিতে থাকেন তিনি। ১৯৯৬ সালে তিনি ১৩ ওয়ানডেতে ২৩.৯৭ গড়ে তুলে নেন ৩৬ উইকেট। ১৯৯৭ সালে প্রথম লঙ্কান বোলার হিসেবে টেস্টে ১০০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন মুরালিধরন।
১৯৯৮ সালে টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো এক ম্যাচে দশ উইকেটের দেখা পান মুরালিধরন, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে তিনি নিয়েছিলেন বারো উইকেট। সেই বছর এপ্রিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাত্র ২৩ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ৫ উইকেট তুলে নেন তিনি। মুরালি সবচেয়ে বড় ধামাকাটা উপহার দেন সেই বছরের আগস্টে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওভাল টেস্টে দুই ইনিংস মিলে তিনি একাই তুলে নেন ১৬ উইকেট! এর মধ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৪.২ ওভারের ম্যারাথন এক স্পিন বোলিং করে ৬৫ রান খরচায় তিনি একাই তুলে নেন ৯ উইকেট! তার এই অতিমানবীয় পারফরম্যান্সে ভর করেই সেই ম্যাচ দশ উইকেটে জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। এটিই ছিল ইংলিশদের মাঠে তাদের প্রথম টেস্ট জয়।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে আবারো মুরালির বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এবার প্রশ্ন তোলেন আম্পায়ার রয় এমারসন। ফলশ্রুতিতে আবারো তাকে বায়োমেকানিক্যাল পরীক্ষা করাতে হয় এবং এবারো তার বোলিং অ্যাকশন বৈধ বলে প্রমাণিত হয়। ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও বেশ ভালো পারফর্ম করেছিলেন তিনি, তবে সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় লঙ্কানদের। ২০০০ সালের ২৭ অক্টোবর শারজাহ কাপে আরেকটি বিস্ময়কর পারফরম্যান্স উপহার দেন মুরালিধরন। ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে মাত্র ৩০ রানে তিনি তুলে নেন ৭ উইকেট! সেই সময়ে এটিই ছিল ওয়ানডেতে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড, পরে অবশ্য তারই সতীর্থ চামিন্দা ভাস জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮ উইকেট তুলে নিয়ে এই রেকর্ড ভেঙে দেন।
২০০২ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যান্ডি টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ৫১ রানে ৯ উইকেট তুলে নেন মুরালিধরন। এটিই তার টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার। সেই সিরিজেই নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের ৭২তম ম্যাচে দ্রুততম সময়ে ৪০০ উইকেট তুলে নেওয়ার কীর্তি গড়েন তিনি। সেই বছর ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অসাধারণ পারফরম্যান্স উপহার দেন এই স্পিন জাদুকর, তিন ইনিংস বোলিং করে তিনি তুলে নেন ১০ উইকেট, যা ওই আসরের সর্বোচ্চ সংখ্যক উইকেট। তার এই দারুণ পারফরম্যান্সে ভর করে ভারতের সাথে যুগ্মভাবে সেই আসরের শিরোপা জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।
২০০৩ বিশ্বকাপে ১০ ম্যাচ খেলে ১৮.৭৬ গড়ে ১৭ উইকেট তুলে নেন মুরালিধরন, ওভারপ্রতি খরচ করেছিলেন মাত্র ৩.৬৪ রান! এবার অবশ্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো দলকে শিরোপা জেতাতে পারেননি, সেই বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকেই বিদায় নিতে হয় লঙ্কানদের। এই বছরের পর থেকে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক হওয়া নিয়ে মুরালির সাথে আরেক স্পিন কিংবদন্তি শেন ওয়ার্নের অলিখিত এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। সেই প্রতিযোগিতায় অবশ্য মুরালিই এগিয়ে ছিলেন। ওয়ার্নের আগে তিনিই ৫০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন, এমনকি কোর্টনি ওয়ালশের ৫১৯ উইকেটের রেকর্ডও তিনিই ভেঙে দেন।
তবে কিছুদিন পরেই মুরালিকে টপকে টেস্টের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকের জায়গাটা দখল করে নেন শেন ওয়ার্ন। আসলে দল হিসেবে শ্রীলঙ্কার তুলনায় অনেক বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পেত অস্ট্রেলিয়া। তাই সেই সময়ে ওয়ার্নকে টপকে সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহক হওয়াটা মুরালির পক্ষে কিছুটা কঠিনই ছিল। তাতে অবশ্য তিনি দমে যাননি, নিজের কাজটা নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেছেন।
২০০৪ সালের মার্চে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে মুরালির ‘দুসরা’ বলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন সেই ম্যাচের রেফারি ক্রিস ব্রড। ফলে তৃতীয়বারের মতো বায়োমেকানিক্যাল টেস্ট করাতে যান তিনি, সেখানে দেখা যায় দুসরা করার সময় তার হাত ১৪ ডিগ্রি বাঁকে। কিন্তু সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী স্পিনাররা সর্বোচ্চ ৫ ডিগ্রি, মিডিয়াম পেসাররা ৭.৫ ডিগ্রি এবং পেসারররা সর্বোচ্চ ১০ ডিগ্রি হাত বাঁকাতে পারতেন। তবে এই পরীক্ষার পর আইসিসি খেয়াল করে, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সিংহভাগ বোলারের অ্যাকশনই অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। তাই সবকিছু বিবেচনা করে সব ধরনের বোলারের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ ডিগ্রি হাত বাঁকাতে পারার অনুমতি দেয় আইসিসি। ফলে মুরালির দুসরাও বৈধ বলে ঘোষিত হয়, এই ঘটনার পর মুরালির বোলিং অ্যাকশন নিয়ে আর কখনোই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।
২০০৬ সালে ট্রেন্টব্রিজে আবারো অনবদ্য এক পারফরম্যান্স উপহার দেন মুরালিধরন, টেস্ট সিরিজ বাঁচাতে সেই ম্যাচে জয় ভিন্ন অন্য কোনো পথ লঙ্কানদের সামনে খোলা ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে চতুর্থ ইনিংসে ইংল্যান্ডকে ৩২৫ রানের টার্গেট ছুঁড়ে দেয় শ্রীলঙ্কা। বড় টার্গেট হলেও শুরুটা দারুণ করে ইংলিশরা, উদ্বোধনী জুটিতে ট্রেসকোথিক আর স্ট্রস মিলে যোগ করেন ৮৪ রান। এরপরই নাটকের রঙ্গমঞ্চে জাদুকরের আগমন, স্পিন ভেলকিতে সবাইকে বোকা বানিয়ে মুরালি একাই তুলে নেন ৮ উইকেট! এই তাণ্ডবলীলায় ৮৪/০ থেকে ইংল্যান্ড অলআউট ১৯০ রানে! পরিসংখ্যানের বিচারে এটি ছিল মুরালির ক্যারিয়ারের সেরা বছর, ২০০৬ সালে ১১ টেস্ট খেলে তিনি তুলে নেন ৯০ উইকেট!
২০০৭ বিশ্বকাপে ১০ ম্যাচে ২৩ উইকেট তুলে নিয়ে সেই আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক হন মুরালিধরন। তবে অল্পের জন্য ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে ব্যর্থ হয় লঙ্কানরা, অস্ট্রেলিয়ার কাছে ফাইনালে হেরে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। এই বিশ্বকাপের পর থেকে ওয়ানডে ক্যারিয়ার থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে টেস্টেই পূর্ণ মনোযোগ দিতে থাকেন তিনি। এদিকে ততদিনে ওয়ার্ন অবসরে চলে যাওয়ায় আবারো টেস্টের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান মুরালিধরন।
২০০৭ সালের জুলাইয়ে ওয়ার্নের পর দ্বিতীয় বোলার হিসেবে টেস্টে ৭০০ উইকেট পাওয়ার কীর্তি গড়েন মুরালি আর সেই বছরের ডিসেম্বরে ক্যান্ডি টেস্টে ইংলিশ ব্যাটসম্যান পল কলিংউডকে আউট করে ওয়ার্নের ৭০৮ উইকেটের রেকর্ড টপকে আবার টেস্টের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক হন মুরালিধরন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ওয়াসিম আকরামের ৫০২ উইকেটের রেকর্ড টপকে ওয়ানডেতেও সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক হন এই কিংবদন্তি। এই অর্জনের পর মুরালির ক্যারিয়ারে সত্যিই পাওয়ার মতো আর কিছু বাকি ছিল না। অবশেষে ২০১০ সালের জুলাইয়ে ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলেই দীর্ঘ ১৮ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানার ঘোষণা দেন এই মহানায়ক।
এদিকে মুরালির উইকেট সংখ্যা তখন ৭৯২টি অর্থাৎ পৃথিবীর প্রথম মানব হিসেবে ৮০০ উইকেট পাওয়ার কীর্তি গড়তে আর মাত্র ৮ উইকেট দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এই কিংবদন্তি। পুরো সিরিজ খেললে এই আট উইকেট পেতে মুরালির খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা না কিন্তু এক টেস্ট খেলেই আট উইকেট পাবেন কি-না, সেটা নিয়ে ভক্তকুলে একটা দোলাচল সৃষ্টি হয়।
বৃষ্টির কারণে খেলার দ্বিতীয় দিন পরিত্যক্ত হলে সেই দোলাচল আরো বেড়ে যায়, শেষপর্যন্ত ৮ উইকেটে ৫২০ রানের পাহাড়সম সংগ্রহ দাঁড় করিয়ে ইনিংস ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কা। এরপর বল হাতে মুরালির জাদু, মাত্র ৬৩ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে ফলো-অনে পাঠিয়ে মাইলফলক ছোঁয়ার কাজটা আরেকটু সহজ করে ফেলেন এই স্পিন জাদুকর। শেষ ইনিংসে আর মাত্র ৩ উইকেট পেলেই পৌঁছে যাবেন সেই স্বপ্নের মাইলফলকে কিন্তু সতীর্থ মালিঙ্গা বল হাতে এমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন যে মুরালির ৩ উইকেট পাওয়া নিয়েই সংশয় জেগে ওঠে!
ভারতের যখন নবম উইকেটের পতন ঘটে তখনো মুরালি ৮০০ উইকেট থেকে ১ উইকেট দূরে অর্থাৎ মাইলফলক স্পর্শ করতে গেলে শেষ উইকেটটি মুরালিকে নিতেই হবে। মুরালি যাতে উইকেটটি নিতে পারে সেজন্য সাঙ্গাকারা ভয়ে মালিঙ্গাকেও বোলিংয়ে আনছিলেন না, এদিকে শেষ দুই ব্যাটসম্যান হুট করে যেন চীনের প্রাচীর হয়ে গেছিলেন! বহু চেষ্টা করেও মুরালি তাদের আউট করতে পারছিলেন না। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! প্রজ্ঞান ওঝার ব্যাটের কোণায় লেগে স্লিপে থাকা মাহেলা জয়াবর্ধনের হাতে বল তালুবন্দী হওয়ার সাথে সাথে পুরো গল স্টেডিয়াম আনন্দে নেচে উঠে। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে ৮০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন।
সেই ম্যাচ শ্রীলঙ্কা দশ উইকেটে জিতে নেওয়ায় মুরালির টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষটা হয় একদম নিখুঁতভাবে। তবে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষটা অত রঙিন হয়নি, ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে ৬ উইকেটে হেরে যায় শ্রীলঙ্কা। এই ম্যাচের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান মুত্তিয়া মুরালিধরন।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা স্পিনার কে সেটা নিয়ে সবসময়ই একটা বিশাল বিতর্ক আছে। তবে পরিসংখ্যানের বিচারে কিন্তু সবদিক থেকে ওয়ার্নের চেয়ে এগিয়ে আছেন মুরালিধরন। ওয়ার্ন ১৪৫টি টেস্টে পেয়েছেন ৭০৮ উইকেট, উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২৫.৪১ রান। অন্যদিকে ১৩৩টি টেস্ট খেলে ৮০০ উইকেট পেয়েছেন মুরালি, উইকেটপ্রতি খরচ করেছেন ২২.৭ রান। মুরালি প্রতি ৫৫ বলে একটি উইকেট শিকার করেছেন, অন্যদিকে ওয়ার্নের ক্ষেত্রে সেটা ২.৪ বল বেশি। মুরালি ওভারপ্রতি ২.৪৭ রান খরচ করেছেন, আর ওয়ার্ন খরচ করেছেন ২.৬৫। ওয়ার্ন ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৩৭ বার, আর মুরালি ৬৭ বার! মুরালি ম্যাচে দশ উইকেট নিয়েছেন ২২ বার, আর ওয়ার্ন ১০ বার। একদম সোজাসাপ্টা পরিসংখ্যান দেখলে মুরালি সবকিছুতেই ওয়ার্নের চেয়ে এগিয়ে!
ওয়ার্ন-মুরালি বিতর্কে মুরালির বিপক্ষে সবচেয়ে বড় পয়েন্ট হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের বিপক্ষে বেশি উইকেট লাভ। তখনকার সময়ে জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ বাকি দলগুলোর চেয়ে টেস্টে বেশ পিছিয়ে ছিল। তবে এই দুই দলের বিপক্ষে ম্যাচগুলো যদি বাদও দেওয়া হয় তবে মুরালি ১০৭ টেস্টে ২৪.৮৮ গড়ে পেয়েছিলেন ৬১৬ উইকেট, অন্যদিকে ওয়ার্ন ১৪২ টেস্টে ২৫.৪ গড়ে পেয়েছিলেন ৬৯১ উইকেট। অর্থাৎ জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা ম্যাচগুলো বাদ দিলেও মুরালির গড় ওয়ার্নের চেয়ে ভালো, উইকেটসংখ্যায় ওয়ার্ন এগিয়ে থাকলেও তিনি ৩৫টি ম্যাচ বেশি খেলায় সেটিও খুব একটা বড় পার্থক্য না।
টেস্টের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের সাথে ওয়ানডেতেও সমানভাবে দাপট দেখিয়ে গেছেন মুরালিধরন। ৩৫০টি ওয়ানডে খেলে ২৩.০৮ গড়ে শিকার করেছেন ৫৩৪ উইকেট, ওভারপ্রতি খরচ করেছেন মাত্র ৩.৯৪ রান! ওয়ানডেতে সবচেয়ে ৫ বা তারচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন মোট দশবার, এই ফরম্যাটে তারচেয়ে বেশি পাঁচ উইকেট নিয়েছেন শুধুমাত্র ওয়াকার ইউনুস (১৩ বার)। সবচেয়ে বড় কথা দীর্ঘ পথচলায় চামিন্দা ভাস ছাড়া বিশ্বমানের কোনো বোলিং সঙ্গী তিনি পাননি, তা-ও একাই শ্রীলঙ্কাকে টেনে নিয়ে গেছেন, গড়েছেন অবিশ্বাস্য সব কীর্তি। মুরালির উপর তার দল কতটা নির্ভরশীল ছিল সেটা প্রমাণের জন্য একটা তথ্যই যথেষ্ট হবে, তার অবসরের পর দীর্ঘ দুই বছর শ্রীলঙ্কা কোনো টেস্ট সিরিজ জিততে পারেনি!
মুরালি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়েছেন আজ থেকে আট বছর আগে অথচ এখনো তার যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজে হয়রান হচ্ছে শ্রীলঙ্কা। রহস্যময় বোলিং অ্যাকশনের কাউকে পেলেই খুব দ্রুত তাকে দলে সুযোগ করে দেয়, এ কারণেই মেন্ডিস, কৌশাল, ধনঞ্জয়রা বেশ সহজেই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু কেউই মুরালির অভাব পূরণ করতে পারেননি। শুধু রহস্যময় বোলিং অ্যাকশন থাকলেই মুরালি হওয়া যাবে এটা ভাবা নিতান্তই অবান্তর, অদ্ভুত বোলিং অ্যাকশন সাথে সব পিচে টার্ন পাওয়ার ক্ষমতা ছাড়াও একই লেন্থে বল করতে পারার ক্ষমতাটাও মুরালিকে এই উচ্চতায় আনতে ভূমিকা রেখেছে। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় বল করার ব্যাপারে তিনি ঠিক কতটা পটু ছিলেন তা এই লিঙ্কের ভিডিও ক্লিপটি দেখলেই সবাই বুঝতে পারবেন।
এক লাইন-লেন্থে বল করার এই ক্ষমতা একদিনে আসেনি, প্রতিনিয়ত অধ্যবসায় আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এই গুণ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন মুরালিধরন। মাঠের বাইরের বিভিন্ন বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে তিনি যেভাবে নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। যতই বাধা আসুক, কেউ যদি নিজের কাজে সৎ থাকে তবে সাফল্য আসবেই– এই কথাটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন মুত্তিয়া মুরালিধরন।