গাট্টাগোট্টা ছোটখাট শরীর। হেলমেটের নিচে বাঁধা জাতীয় পতাকার লাল বৃত্তটা কপাল বরাবর তাকিয়ে থাকতো। হেলমেটের ফাঁক গলে মাঝেমধ্যে চোখে পড়তো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটো, যেখানে ভালো পারফর্ম করার ক্ষুধাটা টের পাওয়া যেত খুব সহজে। ছেলেটির নাম আফতাব আহমেদ।
হাবিবুল বাশার-জাভেদ ওমরদের সময়ে নড়বড়ে মিডল অর্ডারে আফতাব আহমেদের মাঝারি মানের ইনিংসগুলোই বারবার ব্যবধান গড়ে দিতো। তাতে কখনও কখনও সফলতা মিলত, আবার কখনও কখনও বাকিদের ব্যর্থতায় হারিয়ে যেত আফতাবের ইনিংস। ক্যারিয়ারের ভরা সময়ে আফতাবের কাজটা ছিল ঠিক এই সময়ের মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের মতো। তবে একটা পার্থক্য আছে। আফতাব রিয়াদের মতো পর্দার আড়ালে ছিলেন না। তার ‘ফ্যানবেজ’ ছিল সেই সময়ে আকাশছোঁয়া। গ্যালারির ফ্যান্টাসিলিগে কিংবা নির্বাচকদের টেবিলে, ডানহাতি ব্যাটিংয়ের সঙ্গে মিডিয়াম পেসের কম্বিনেশন ছিল এককথায় ‘অটোমেটিক চয়েস’।
২০০৪ সালে অভিষেকের পর ২০১০ সাল পর্যন্ত আফতাব আহমেদ খেলেছেন ১৬ টেস্ট, ৮৫ ওয়ানডে আর ১১টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। মূলত, ওয়ানডে ক্রিকেটে তার অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্যারিয়ারে শেষপর্যন্ত ১,৯৫৪ রান তুলেছিলেন, সর্বোচ্চ ৯২ রানের ইনিংস। মোট হাফ সেঞ্চুরির সংখ্যা ১৪টি। এই ফরম্যাটে উইকেট ১২টি। মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে আফতাবের বেশ কদর ছিল। সেই কদরকে কাজে লাগিয়েই ২০০৭ বিশ্বকাপে মোহাম্মদ আশরাফুলের সাথে জুটি বেঁধে হারিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
আফতাবের ওটাই প্রথম ও শেষ বিশ্বকাপ খেলা। এরপর ক্যারিয়ারে এসেছে বহু উত্থান-পতন। পরিশ্রমের অভাব তথা ‘ঘুমকাতুরে’ আফতাবের ফর্মহীনতা, নিষিদ্ধ লিগ আইসিএলে যোগ দেওয়া, দেশে ফিরে ঘরোয়া লিগেও সুবিধা করতে না পারা; নির্বাচকরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। শেষপর্যন্ত নিজেই অবসরের ঘোষণা দিলেন।
আফতাব আহমেদ এখন পুরোদস্তুর কোচ। চট্টগ্রামের সাবেক এই খ্যাতিমান ক্রিকেটার চট্টগ্রামেই নিজের নামে ক্রিকেট একাডেমি গড়েছেন। পাশাপাশি ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে কাজ করছেন কোচ হিসেবে। গেল কয়েক আসরে একাধিক দলের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব দিয়ে শুরু, সর্বশেষ আসরে ছিলেন লিজেন্ড অব রূপগঞ্জের সাথে।
ক’দিন পরই ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২০১৯ বিশ্বকাপ। সেই টুর্নামেন্টে নিজেদের সেরা দল নিয়ে মাঠে নামবে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। মাশরাফি, তামিম, মুশফিক, সাকিব আর রিয়াদকে সঙ্গে নিয়ে অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশেলে গড়া হয়েছে শক্ত দল। তারপরও, বিশ্বকাপ এলেই যেন মনে পড়ে ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আফতাব আহমেদের সেই ৩৫ রানের ইনিংসের কথা। গ্রায়েম স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্সদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী প্রোটিয়াদের হারিয়ে দেওয়ার সেই সুখস্মৃতি। এমন অবস্থায় আফতাব আহমেদকে তাই স্বরণ করতেই হয়।
কেমন ছিল সেই সময়ের অভিজ্ঞতা? আর এবারের বাংলাদেশের করণীয়ই বা কী?
এক সাক্ষাতকারে উত্তর খুঁজেছেন ‘কোচ’ আফতাব আহমেদ।
২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেটাই ছিল আপনার একমাত্র বিশ্বকাপ। অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?
বিশ্বকাপের মাঠে নামা অবশ্যই ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। তাছাড়া অন্যান্য আন্তর্জাতিক ম্যাচের চেয়ে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো কিছুটা হলেও বাড়তি আবেদন রাখে। প্রতিটি দলই চায় বিশ্বকাপে অংশ নিতে, কারণ এই টুর্নামেন্ট এমন একটা প্ল্যাটফর্ম যেখানে একজন ক্রিকেটার কিংবা একটি দল ভালো করলে এক্সপোজারটা সবচাইতে বেশি পাওয়া যায়। তো সব খেলোয়াড়ের কাছেই বিশ্বকাপ স্পেশাল।
আপনি নিজের ঐ একমাত্র বিশ্বকাপেই দলের হয়ে বেশ কিছু মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স করেছিলেন। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আপনার ৩৫ রানের ইনিংস সেটাও আবার মোহাম্মদ আশরাফুলের সাথে ৭৫ রানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জুটি ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জয়ও পায়। সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের কথা মনে পড়লে কেমন লাগে?
বাংলাদেশ যে ম্যাচে জয় পায়, সেখানে রান করতে পারলে খুব ভালো লাগতো আমার। আমি ক’দিন আগেও সেই ম্যাচের রিপ্লে দেখছিলাম। যদিও আমি বলবো বিশ্বকাপ অন্যান্য যেকোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের চেয়ে আলাদা, কারণ বিশ্বকাপের আসর বসে চার বছর পরপর। সেখানে কোনো ক্রিকেটার পারফর্ম করার সুযোগ হারানো মানে তাকে আরও চার বছরের অপেক্ষা করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, একজন ক্রিকেটার এবারের বিশ্বকাপে খেললে পরের বিশ্বকাপেও সুযোগ পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এমনিতে একজন ক্রিকেটার এক ম্যাচ খারাপ করলে পরের ম্যাচে ফিরে আসার চেষ্টা করে, কারণ আন্তর্জাতিক সূচি অনুযায়ী সেই নির্দিষ্ট ক্রিকেটার আশা করতেই পারে যে পরের ম্যাচে ও ভালো করবে। কিন্তু বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। তো খেলোয়াড়রা বিশ্বকাপে সবসময়ই ভালো খেলার চাপে থাকে।
বিশ্বকাপে এমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে আপনাকে এখনও যেটা স্মৃতিকাতর করে?
আসলে আমার বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ নিয়ে নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে চাই না। আমি আগে ভালো ক্রিকেট খেলেছি বলেই বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছি। সেটা নিয়ে আমি অনেক খুশি ছিলাম। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, বিশ্বকাপের প্রথম কয়েকটি ম্যাচে যদি কেউ খারাপ খেলে, তার জন্য পরের ম্যাচগুলোতে ভালো করা কঠিন হয়ে যায়। আমি ওই সময়ে এমন চাপেই ছিলাম।
বিশ্বকাপে ভালো করতে ইংল্যান্ডের পেস সহায়ক উইকেটে কীভাবে ব্যাট করা উচিত বলে একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনি মনে করেন?
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং ইউনিট আসলেই অনেক ভালো। তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটাররা বড় রান করার যথেষ্ট সামর্থ্য রাখে। কিন্তু তাদের পাশাপাশি অন্য ব্যাটসম্যানরা যদি তাদের কাজটাও পরিপূর্ণভাবে করে, তামিম-মুশফিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পারফর্ম করে তাহলে বাংলাদেশ সত্যিই খুব ভালো করবে। যেমন- সৌম্য সরকারের কথা বলা যায়; সে যদি রান করে তাহলে সেটা যেকোনো দলের জন্যই ভালো হয়। আপনি যদি ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে দেখেন, সে আমাদের (লিজেন্ড অব রূপগঞ্জ, আফতাব আহমেদ এই দলের বর্তমান কোচ) বিপক্ষে সেঞ্চুরি করলো। এরপর শেখ জামালের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করলো। সেই ম্যাচে সৌম্যর দল আবাহনী লিমিটেড ৯ উইকেটের ব্যবধানে জয় পেয়েছিল।
তো সৌম্যর মতো তরুণ ক্রিকেটাররা যদি ব্যাটে রান পায়, তাহলে অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। তবে ইংল্যান্ডের ‘ট্রু উইকেট’ এ বোলারদের কাজটা বেশ কঠিন হবে। প্রথম ১০ ওভারে প্রতিপক্ষকে ৪০-৫০ রানের মধ্যে আটকে রাখার চেষ্টা করতে হবে। বোলারদের ইয়র্কার এবং স্লোয়ার নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে। কারণ, আমি মনে করি, ইংলিশ কন্ডিশনে এই দুই বোলিং বৈচিত্র্য কাজে লাগানো বেশ সহজ হবে। আমি এটাও খেয়াল করেছি যে, ইংল্যান্ডে বড় শট খেলা, বড় রান করাও খুব সহজ। আরও একটা ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের বোলাররা যদি ডেথ ওভারে সঠিক লাইনে, বৈচিত্র্য এনে বল করতে পারে তাহলে বাংলাদেশ এবারের বিশ্বকাপে অনেক দূর যাবে।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলকে আপনি কী বার্তা দেবেন?
আমার একটাই মেসেজ তাদের জন্য, সেটা হলো মাঠে ইতিবাচক থাকা।