ডাম্বুলায় সিরিজের প্রথম একদিনের ম্যাচে বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে থেকে একই ভেন্যুতে ২৮শে মার্চ সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে প্রথম ম্যাচে টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়ার খেসারত দিতে হয়েছিল বড় ব্যবধানে হারের মধ্য দিয়ে। তাই আগে থেকেই অনুমেয় ছিল যে সেদিন টসে জেতার পর দুই দলেরই অধিনায়ক ব্যাটিংই করতেই পছন্দ করবেন। সিরিজ জুড়ে বাংলাদেশের টস ভাগ্য ছিল একশোতে শূন্য। দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও তা-ই হলো। নিজের ২০০তম একদিনের ম্যাচ খেলতে নামা উপুল থারাঙ্গা টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
ব্যাটিংয়ে নামার পর থেকেই শ্রীলঙ্কান ওপেনার গুনাথিলাকা বাংলাদেশি বোলারদের উপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেন। ১১ বলে মাত্র ৯ রান করে আউট হয়ে ফিরে গেলেও ইঙ্গিত করে গেছেন আজ আর টুকটুক করে খেলতে নামেনি শ্রীলঙ্কা। প্রথম ম্যাচের মতো এইবারও মাশরাফিতে কাটা পড়েন গুনাথিলাকা, মুশফিকের দুর্দান্ত ক্যাচে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয় তাকে। নিজের ২০০তম ওয়ানডে ম্যাচকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য থারাঙ্গা দেখেশুনে খেলতে থাকেন। রিয়াদের সরাসরি থ্রো’তে অসতর্কতাবশত রান আউট হয়ে ফিরে যাওয়ার আগে খেলেন ৭৬ বলে ৬৫ রানের ইনিংস। ম্যাচের বাকি গল্পটা কুশাল মেন্ডিসের। শুরুতে ধীরগতিতে ব্যাট করলেও পরে সময়ের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১০৭ বলে ১০২ রান করে ম্যাচের আরেক নায়ক তাসকিনের বলে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেন।
এক্ষেত্রে তাসকিনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলাই যায়, মেন্ডিসের সজোরে হাঁকানো বলটি তার কাঁধে লেগে উপরের দিকে উঠে যায়। তাৎক্ষণিক ব্যথা ভুলে ক্যাচ লুফে নিতে ভুল করেননি তাসকিন। তাসকিন আহমেদ যখন ইনিংসের শেষ ওভার করতে বোলিং প্রান্তে আসেন, তখন শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ৭ উইকেটে ৩০৬ রান। তাসকিনের করা প্রথম বলে কুলাসেকারা সিঙ্গেল নিয়ে গুনারত্নকে স্ট্রাইকে দেন। স্ট্রাইকে এসেই চার হাঁকান গুনারত্নে। ব্যস, এখানেই থেমে যায় শ্রীলঙ্কানদের রান সংখ্যা। ম্যাচের বাকি মুহূর্তটুকু ছিল তাসকিনময়। নিজের করা শেষ ওভারের তৃতীয় বলে গুনারত্নকে সৌম্যের ক্যাচে পরিণত করেন তাসকিন। এরপর সুরাঙ্গা লাকমলকে বাধ্য করেন মুস্তাফিজের হাতে ক্যাচ দিতে। নতুন ব্যাটসম্যান নুয়ান প্রদীপ শেষ ব্যাটসম্যান হিসাবে যখন ক্রিজে আসেন তখন ইনিংসের মাত্র ২ বল বাকি ছিল। অন্যদিকে তাসকিন আহমেদ দাঁড়িয়ে ছিলেন হ্যাটট্রিকের সামনে। ক্রিকেটের প্রথাগত নিয়ম মেনে ঠিক স্ট্যাম্পের নিচে বল করে নুয়ান প্রদীপের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলে ওয়ানডেতে ৫ম বাংলাদেশি বোলার হিসাবে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন তাসকিন আহমেদ।
তাসকিনের আগে ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে হ্যাটট্রিকের ঘটনা ঘটেছে ৪০ বার। এর মধ্যে বাংলাদেশি ক্রিকেটারের সংখ্যা ছিল ৪জন। ওয়ানডেতে সর্বপ্রথম হ্যাটট্রিক করেছিলেন পাকিস্তানের জালাল উদ্দিন। ওয়ানডে ক্রিকেটের পথচলা শুরু হওয়ার প্রায় একযুগ পর ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন জালাল উদ্দিন। ৪০ ওভারের একদিনের ম্যাচে পাকিস্তানের দেওয়া ২৩০ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা ভালোই করেছিলেন দুই অজি ওপেনার। উদ্বোধনী উইকেট জুটিতে তারা যোগ করেন ১০৪ রান। এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়া ৪ উইকেটে ১৬২ রান সংগ্রহ করেছিল। দ্রুত রান তোলার তাগিদে পাকিস্তানি বোলারদের উপর চড়াও হতে গিয়ে জালাল উদ্দিনের বোলিং তোপের মুখে পড়েন অজিদের মিডল অর্ডার। সেখান থেকে শুরু হয় জালাল উদ্দিনের ধ্বংসলীলা। মার্শ, ইয়ার্ডলি এবং লসনকে পরপর তিন বলে ফিরিয়ে প্রথম বোলার হিসাবে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন তিনি।
তাসকিনের আগে ৪ বাংলাদেশি ক্রিকেটার ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক করেছেন। চলুন জেনে নিই একে একে তাদের হ্যাটট্রিকের মুহূর্তগুলো।
শাহাদাত হোসেন রাজীব
প্রথম বাংলাদেশি বোলার হিসাবে ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক করেন পেসার শাহাদাত হোসেন রাজীব। ততদিনে ওয়ানডেতে ২০বার হ্যাট্রিকের ঘটনা ঘটে গেছে। ২০০৬ সালের আগস্টের ২ তারিখে এই কীর্তি গড়েন শাহাদাত হোসেন।
সেসময় জিম্বাবুয়েকে বলে-কয়ে হারানো যেত না। বোর্ডের সাথে বিরোধের জের ধরে জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড়রা তখন ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের হারিয়ে খুঁজছেন, অন্যদিকে বাংলাদেশ ক্রিকেটে ক্রমাগত উন্নতি করে যাচ্ছিল। হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ৫ ম্যাচের সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে প্রথমে ব্যাট করে জিম্বাবুয়েকে ২৩৭ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় বাংলাদেশ। ৫ ম্যাচের সিরিজ তখন ১-১ এ সমতায় ছিল। নির্ধারিত লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ঠিক পথেই ছিল জিম্বাবুয়ে। মাসাকাদজা, ডাফিনদের ব্যাট চড়ে একপর্যায়ে তাদের রান সংখ্যা ছিল ২ উইকেটে ১২১। তখনো শাহাদাত হোসেন রাজীবের ধ্বংসলীলা শুরু হয়নি। শাহাদাত যখন ৩৯তম ওভারে বল হাতে নেন তখন জিম্বাবুয়ে ৪ উইকেটে ১৫০ রান করে জয়ের পথেই ছিল। কিন্তু তিনি এসে ওভারের তৃতীয় বলে মুফাম্বিসিকে পাইলটের হাত ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন। এরপর চিগাম্বুরা এবং উৎসেয়াকে পরপর দুই বলে ফিরিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন তিনি।
জিম্বাবুয়ের ৪ উইকেটে ১৫১ রান থেকে ৭ উইকেটে ১৫১ রানে পরিণত হয় চোখের পলকেই। অবশ্য শাহাদাৎ হোসেনের হ্যাটট্রিকের পরেও ম্যাচ জিততে পারেনি বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের উইকেটরক্ষক ব্রেন্ডন টেইলরের অসাধারণ ইনিংসের সুবাদে জয় তুলে নেয় তারা। জয়ের জন্য শেষ বলে জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন ছিল ৫ রান, টেইলর মাশরাফির বলে ছয় হাঁকালে জিম্বাবুয়ের ২ উইকেটের জয় নিশ্চিত হয়। ব্রেন্ডন টেইলর ৭২ বলে অপরাজিত ৭৯ রান করে শাহাদাত হোসেনের হ্যাট্রিকের দিনটি স্মরণীয় করতে রাখতে দেননি।
আবদুর রাজ্জাক
প্রথম বাংলাদেশি স্পিনার হিসাবে আবদুর রাজ্জাক ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক করেন ২০১০ সালে। এবারও প্রতিপক্ষ হিসাবে ছিল জিম্বাবুয়ে। নিজেদের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে পরাজিত হয়ে ৫ ম্যাচ সিরিজে ১-০ তে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ।
২০১০ সালের ডিসেম্বরের ৩ তারিখে সিরিজের দ্বিতীয় একদিনের ম্যাচে টসে জিতে জিম্বাবুয়েকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় বাংলাদেশ। শুরু থেকেই সাকিব আল হাসান আর আবদুর রাজ্জাকের স্পিন বিষে কোণঠাসা ছিল জিম্বাবুয়ে। ১৩২ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর আরভাইন এবং উৎসেয়া ৫৭ রানের জুটি গড়েন। রাজ্জাক নিজের ৮ম ওভারের শেষ বলে উৎসেয়াকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন। এরপর নিজের ৯ম ওভারের প্রথম দুই বলে প্রাইস এবং এমপফুকে ফিরিয়ে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন রাজ্জাক।
ঐ ম্যাচে রাজ্জাক ৯.২ ওভার বল করে ৩০ রান খরচায় ৫ উইকেট শিকার করেন। তার বিধ্বংসী বোলিংয়ে ৬ উইকেটের জয় তুলে নিয়ে সিরিজে ১-১ এ সমতায় ফিরে বাংলাদেশ।
রুবেল হোসেন
২০১৩ সালের ২৯শে অক্টোবর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজেদের মাটিতে সিরিজের প্রথম একদিনের ম্যাচে টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। মাত্র ২৫ রানের মধ্যে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে হারায় দল। এরপর অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ৯০ রান এবং নাঈম ইসলামের ৮৪ রানের ইনিংসের উপর ভর করে এক বল বাকি থাকতে অল আউট হওয়ার আগে ২৬৫ রানের লড়াকু সংগ্রহ দাঁড় করায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের শেষ সিরিজে ৪-০ তে হোয়াইটওয়াশ হওয়া ব্ল্যাক ক্যাপসরা ২৬৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামে।
২০ ওভারে ৩ উইকেটে ৮২ রান করার বৃষ্টি বাধায় খেলা বন্ধ থাকে বেশ কিছু সময়। বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর মাঠ খেলার উপযোগী হলে নিউজিল্যান্ডের সামনে বৃষ্টি আইনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩৩ ওভারে ২০৬ রান। দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান গ্রান্ট এলিয়ট এবং কোরি অ্যান্ডারসন দ্রুত রান তুলতে থাকেন বৃষ্টি থামার পর। এই দুইজন পুনরায় খেলা শুরু হওয়ার পর ৩.৩ ওভারে ৩৯ রান যোগ করেন। মাত্র ৩১ বলে ৩ চার এবং ৪ ছয়ে ৪৬ রান করা কোরি অ্যান্ডারসনকে আউট করে রানের চাকার লাগাম টেনে ধরেন রুবেল হোসেন। পরের বলে অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে রানের খাতা খোলার আগেই প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে হ্যাট্রিকের সুযোগ তৈরি করেন রুবেল। এরপর নতুন ব্যাটসম্যান জিমি নেশামকে আউট করে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন তিনি।
তার বিধ্বংসী স্পেলের কারণে বাংলাদেশ ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডে ৪৩ রানের জয় পায়। রুবেল হোসেন ৫.৫ ওভারে ২৬ রান দিয়ে ৬ শিকার করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন।
তাইজুল ইসলাম
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ৮ উইকেট নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়া তাইজুল ইসলামকে শুধুমাত্র টেস্টের জন্যই বিবেচনা করা হচ্ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের বিশ্বকাপকে সামনে রেখে বাড়তি স্পিনার হিসাবে ওয়ানডে দলেও জায়গা করে নেন তাইজুল।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫ ম্যাচ সিরিজের প্রথম ৪ ম্যাচ জিতে খোশ মেজাজে ছিলো বাংলাদেশ। তাই সৌম্য সরকার এবং তাইজুলকে শেষ ম্যাচে খেলানো হয়। আর খেলার সুযোগ পেয়েই বিশ্বরেকর্ড গড়ে ফেলেন তাইজুল ইসলাম। নিজের ৬ষ্ঠ ওভারের প্রথম বলে সোলাইমান মিরেকে আউট করে ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের প্রথম উইকেট শিকার করেন তিনি। ঐ ওভারের শেষ বলে পানিয়াঙ্গারাকেও আউট করেন তাইজুল। নিজের ৭ম ওভারের প্রথম দুই বলে জন নিম্বু এবং তেন্দাই চাতারাকে আউট করে প্রথম বোলার হিসাবে অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিকের রেকর্ড গড়েন তাইজুল।
সাকিব আল হাসান এবং তাইজুল ইসলামের বোলিং তোপের মুখে পড়ে ১ উইকেটে ৯৫ রান থেকে মাত্র ১২৮ রানেই গুটিয়ে যায় জিম্বাবুয়ে। তাইজুল ৭ ওভারে ১১ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে অভিষেকেই ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতে নেন। সিরিজের শেষ ম্যাচে ৫ উইকেটের জয় তুলে নিয়ে ৫ ম্যাচের সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ।
ওয়ানডেতে সর্বশেষ ২১টি হ্যাটট্রিকের মধ্যে বাংলাদেশি বোলারদের দখলেই আছে ৫টি। বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে দিনদিন নিজেদের উন্নতির চাপ রাখছে ব্যক্তিগত এবং দলগত পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে। ক্রিকেট জগতের পরাশক্তি হয়ে উঠছে টাইগাররা, অনবদ্য হ্যাটট্রিকগুলো তারই আভাস দেয়।