আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল: কে জিতবে রোমাঞ্চকর দ্বৈরথ?

১.

তিন ম্যাচ খেলে মাত্র এক ম্যাচে জয়, ফর্মে নেই দলের সেরা খেলোয়াড়। এদিকে পরবর্তী ম্যাচের প্রতিপক্ষ স্বাগতিক ব্রাজিল, যারা কি না স্বাগতিক হিসেবে খেলা প্রতিটি কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এরকম একটা দলের বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচের মুখোমুখি হওয়ার আগে স্বাভাবিকভাবেই যে কারোরই ব্রাজিল দলকেই এগিয়ে রাখার কথা। তাছাড়া এই টুর্নামেন্টের পারফর্মেন্সও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে।

টুর্নামেন্টের এই পর্যায় পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গোল (৮টি) করেছে ব্রাজিল। সর্বশেষ ৫ ম্যাচের মাঝে তিনটিতেই ৩+ গোল করেছে। নিজেদের শেষ ১৪টি ম্যাচেই তারা অপরাজিত, যার ১১টিতেই জয় তুলে নিয়েছে ব্রাজিল। সর্বশেষ ২০টি ম্যাচের মাঝে ১৮টিতেই তারা প্রতিপক্ষের জাল খুঁজে পেয়েছে, অন্যদিকে নিজেরা গোল খেয়েছে মাত্র ৪টি ম্যাচে।  

শুধু বর্তমান পরিস্থিতিই নয়, সাম্প্রতিক ইতিহাসও ব্রাজিলের পক্ষে।

প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ব্রাজিলের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার সর্বশেষ জয় ২০০৬ সালে। সেই ম্যাচটা ৩-১ গোলে জেতার পর থেকে প্রীতি ম্যাচ ব্যতীত আর ব্রাজিল কখনো হারেনি আর্জেন্টিনার কাছে। এই শতাব্দীতে মেজর কোনো টুর্নামেন্টেও ব্রাজিলকে হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। কোপা ২০০৪ এর ফাইনালে ২-২ গোলে ড্র হবার পর টাইব্রেকারে ম্যাচটা জিতে নেয় ব্রাজিল। ২০০৫ সালের কনফেডারেশনস কাপেও ব্রাজিল জয় পায় ৪-১ গোলে। সর্বশেষ কোপা ২০০৭ ফাইনালে ব্রাজিল জেতে ৩-০ গোলে

এই ম্যাচের পর আবার ১২ বছর পর ব্রাজিল আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হচ্ছে কোনো মেজর টুর্নামেন্টের নকআউট পর্বে।

ব্রাজিলের বিপক্ষে ব্রাজিলের মাঠে হওয়া সর্বশেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচেও আর্জেন্টিনা হেরেছিল ৩-০ গোলে। এছাড়া ব্রাজিলের মাঠে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ কোপা আমেরিকাতেও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সেমিফাইনালেই মুখোমুখি হয়েছিল।

ব্রাজিলের মাঠে হওয়া সর্বশেষ কোপার সেমিতে আর্জেন্টিনাকে হারানোর নায়ক ছিলেন রোমারিও; Image Source: Ahdaaf

১৯৮৯ সালের সেই ম্যাচে সেই সময়ের সেরা খেলোয়াড় ম্যারাডোনাও ছিলেন আর্জেন্টিনা দলে। কিন্তু ম্যারাডোনাকে ছাপিয়ে ম্যাচে আলো ছড়ান তরুণ খেলোয়াড় রোমারিও। ২-০ গোলে জেতা সেই ম্যাচে ১টি গোলও করেন রোমারিও।

২.

সাম্প্রতিক পারফর্মেন্স আর অতীত ইতিহাস, দুটোই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে থাকায় আগামী ম্যাচটাতে যে কেউই চাইলে ব্রাজিলকে এগিয়ে রাখতে পারেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, মোটামুটি ফুটবল জ্ঞান আছে এমন কেউ এই ভুল কাজটা করেন না। কেন করেন না, সেটা বোঝার জন্য প্রথমে দুটো ম্যাচের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

ম্যাচ নং ১

১৯৯০ বিশ্বকাপ। স্বাগতিক ইতালি বাদে ব্রাজিল ছিল সেই বিশ্বকাপে একমাত্র দল, যারা কি না গ্রুপপর্বে তিন ম্যাচের তিনটিতেই জয়লাভ করেছে। অন্যদিকে, আর্জেন্টিনা সেই বিশ্বকাপে দ্বিতীয় পর্বে ওঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ক্যামেরুন, রোমানিয়া আর সোভিয়েত ইউনিয়নের গ্রুপ থেকে তৃতীয় হয়ে ওঠাটা আগের আসরের বিশ্বকাপজয়ীদের জন্য একটা লজ্জাজনক পারফর্মেন্সই। প্রতি গ্রুপ থেকে দু’টি দল পরের পর্বে ওঠার পাশাপাশি সেরা চারটি তৃতীয় দলটিও পেয়েছিল পরের পর্বে খেলার সুযোগ। সেই হিসেবেই আর্জেন্টিনা পরের পর্বের টিকেট পায়।

ব্রাজিলকে হারানো ম্যাচে ম্যারাডোনার সেই ম্যাজিকাল পাস; Image Source: YouTube

স্বাভাবিকভাবেই নকআউট ম্যাচে ব্রাজিলই ফেভারিট ছিল। ম্যাচের নিয়ন্ত্রণটাও ব্রাজিলের হাতেই ছিল। কিন্তু অনেকগুলো আক্রমণ করলেও গোল নামক সোনার হরিণটার দেখা পায়নি ব্রাজিলিয়ানরা। অন্যদিকে ম্যাচের ৮০তম মিনিটে স্রোতের বিপরীতে ম্যারাডোনার একটা অসাধারণ অ্যাসিস্টে গোল পেয়ে গেলেন ক্যানিজিয়া। ম্যাচ শেষের পরের দিন পত্রিকার হেডিং ছিল ‘ব্রাজিল ৮৯ মিনিট, ম্যারাডোনা ১ মিনিট’। এই ১ মিনিটেই ছিটকে যায় সেই বিশ্বকাপের টপ ফেভারিট ব্রাজিল। অথচ, দলগত শক্তির বিচারে ব্রাজিলের ধারে কাছেই ছিল না আর্জেন্টিনা।

ম্যাচ নং ২

২০০৭ কোপা আমেরিকা। টুর্নামেন্টের একমাত্র দল হিসেবে গ্রুপপর্বের তিনটি ম্যাচই জিতেছে আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে মেক্সিকোর কাছে ২-০ গোলে হার দিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু হয় ব্রাজিলের। পরের দুটো ম্যাচ জিতলেও রবিনহো বাদে আর কোনো খেলোয়াড় গোল পাননি। নকআউটের ম্যাচ দুটোতেও আর্জেন্টিনা হেসেখেলে জিতে নেয়, বিপরীতে সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে জিততে হয় টাইব্রেকারে। ফাইনালে তাই চোখ বন্ধ করে আর্জেন্টিনা ফেভারিট ছিল।

তারকাসমৃদ্ধ আর্জেন্টিনা ম্যাচ হেরে হতাশ ; Image Source: Sportskeeda

তারকার বিচারেও আর্জেন্টিনা এগিয়ে ছিল। রিকেলমে, আইমার, তেভেজ, আয়ালা, ভেরন, কিংবা তরুণ মেসির বিপরীতে ব্রাজিলে উল্লেখ করার মতো তারকা ছিলেন কেবল রবিনহো। কিন্তু দিন শেষে ম্যাচটা ব্রাজিল জেতে ৩-০ গোলে।

৩.

সবসময় সব বিষয় হিসেব অনুযায়ী কাজ করে না। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ হচ্ছে এরকম একটা বিষয়। আগের দুটো উদাহরণ থেকেই হয়তো বা কিছুটা আঁচ করা গিয়েছে। এই ধরণের ম্যাচগুলোতে সাধারণত প্রতিটি খেলোয়াড়ই প্রচণ্ড চাপে থাকেন। এই চাপের কারণে বেশিরভাগ সময়ই স্বাভাবিক খেলাটা তারা খেলতে পারেন না। চাপ থেকে নিজেকে সরিয়ে যারা স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারেন, তারাই সফল হন।

সমস্যা হচ্ছে, আর্জেন্টিনার সেরা এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসিই এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টে তার সেরাটা উপহার দিতে পারছেন না। চার ম্যাচ খেলে গোল করতে পেরেছেন মাত্র ১টিতে, সেটাও পেনাল্টি থেকে। সমর্থকদের পাশাপাশি তিনি নিজেও জানেন যে ব্রাজিলের বিপক্ষে জয় পেতে হলে তার ভালো খেলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কোপা ২০১৯ এ মেসির পারফর্মেন্স ঠিক আশানুরূপ নয়; Image Source: Barca Blaugranes

তবে রাইভাল ব্রাজিলের বিপক্ষে লিওনেল মেসির পারফর্মেন্স ঠিক আশানুরূপ নয়। ব্রাজিলের বিপক্ষে ৯ ম্যাচ খেলে গোল পেয়েছেন মাত্র ২টি ম্যাচে। সেই দু’টিই ছিল প্রীতি ম্যাচ। এই ৯ ম্যাচে তিনটি ম্যাচে জয় পাওয়ার পাশাপাশি হেরেছে পাঁচটিতে, বাকি ম্যাচটা ড্র হয়েছে। ব্রাজিলের বিপক্ষে তিনি সর্বশেষ গোল করেছেন ২০১২ সালে। এরপর তিনটি ম্যাচ খেলা হলেও আর গোল করতে পারেননি।

এই শতাব্দীতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচে হ্যাটট্রিক করা দুজন খেলোয়াড়ের একজন হচ্ছেন রোনালদো লিমা; Image Source: The18

এসব কিছু যদি হতাশাজনক অধ্যায় হয়, তাহলে আশার কথাটাও শোনা যাক। এই শতাব্দীতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচে হ্যাটট্রিক হয়েছে মাত্র দুইটি। ব্রাজিলের পক্ষে কাজটা করেছেন রোনালদো লিমা, আর আর্জেন্টিনার পক্ষে লিওনেল মেসি।

৪.

লিওনেল মেসি কোপা আমেরিকা খেলেছেন ৪টি আসরে। এর মাঝে তিনটি আসরেই (২০০৭, ২০১৫, ২০১৬) উনি ফাইনাল খেলেছেন। কোপা আমেরিকার ইতিহাসে সবচাইতে বেশি অ্যাসিস্ট করার রেকর্ডও মেসির। কোনো এক বিচিত্র কারণে এবারের কোপাটাই মেসির বাজে কাটছে। তবে এই বিষয়টাই আর্জেন্টিনার জন্য শাপে বর হতে পারে।

একজন খেলোয়াড় প্রতিদিনই ভালো খেলতে পারেন না। এখানে ল অফ অ্যাভেরেজের একটা বিষয় কাজ করে। ঠিক তেমনভাবেই মেসির মতো একজন বিশ্বমানের খেলোয়াড়ের প্রতিটা দিনই বাজে কাটার কথা না। চারটা গড়পড়তা ম্যাচ খেলার দুঃখ সমর্থকদের ভুলিয়ে দিতে পারে ব্রাজিলের বিপক্ষে একটা অসাধারণ ম্যাচজয়ী পারফর্মেন্স।

ব্রাজিলের বিপক্ষেই কি সেরাটা দিবেন মেসি? Image Source: Barca Blaugranes

সেরা খেলোয়াড়েরা সাধারণত দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের দিন নিজের সেরাটা উপহার দেয়। লিওনেল মেসিও কি নিজের সেরাটা জমিয়ে রেখেছেন ব্রাজিলের জন্য?

৫.

অন্যদিকে ব্রাজিলও কিন্তু অনেকদিন ধরে একটা মেজর ট্রফি জেতার জন্য মরিয়া। মাঝে কনফেডারেশনস কাপ জিতলেও কোপা আমেরিকা কিংবা বিশ্বকাপে অনেকদিন ধরেই তারা ব্যর্থ । ২০০৭ কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হবার পরের দুই আসরে ব্রাজিল বাদ পড়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই। সর্বশেষ আসরে তো বাদ পড়ে গিয়েছিল গ্রুপপর্ব থেকেই। ২০০২ বিশ্বকাপের পর থেকে বিশ্বকাপেও ব্যর্থ তারা। এত সব ব্যর্থতার ক্ষতে প্রলেপ দেবার জন্য নিজেদের মাঠে হওয়া টুর্নামেন্ট জেতাটা খুবই প্রয়োজনীয়।

কৌতিনহোর সুযোগ এসেছে নিজেকে প্রমাণের; Image Source: Stadium Astro

এর সাথে আরেকটা বিষয় হচ্ছে, কৌতিনহো। নিজের পছন্দের পজিশনে খেলতে না পারার জন্য বার্সেলোনাতে অনেকদিন ধরেই খারাপ খেলছেন তিনি। নেইমারবিহীন ব্রাজিলের পরিকল্পনাটা আপাতত গড়ে উঠেছে তাকে ঘিরেই। পছন্দের পজিশনে খেলতে পারলে যে তিনিও সময়ের একজন সেরা খেলোয়াড় হতে পারবেন, সেটা প্রমাণ করার জন্য এর চেয়ে বড় সুযোগ সম্ভবত আপাতত আর পাবেন না কৌতিনহো।

ইনজুরির জন্য নেইমারের অনুপস্থিতিও একটা বড় আঘাত ব্রাজিলের জন্য; Image Source: CBC

লিওনেল মেসি কিংবা কৌতিনহো, দু’জনকেই চূড়ান্ত সাফল্য পাওয়ার জন্য দলকে চ্যাম্পিয়ন করাতে হবে। কারণ, ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার দর্শকদের কাছে রানার্সআপ হওয়া মানে ‘খারাপ দলগুলোর মাঝে সবচেয়ে ভালো’।

সেই চ্যাম্পিয়ন হবার পথে দুই দলের জন্যেই শক্ত বাধাটা সেমিফাইনালে। দেখা যাক, বাধাটা কে জিততে পারে?

This article is in Bangla language. This is about the superclassico match between Argentina and Brazil. References are given inside as hyperlinks.

Feature Image:  SATV

Related Articles

Exit mobile version