১.
ঘটনাটা এরকম হবার কথা ছিল না। গত ৪ মৌসুমের মধ্যে ২ বার ফাইনাল খেলা জুভেন্টাস এই মৌসুমে আঁটঘাট বেধে নেমেছিলো চ্যাম্পিয়নস লিগে ভালো করার প্রত্যয় নিয়ে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বেই এত বড় বাধার সম্মুখীন হতে হবে, সেটা কে ভেবেছিলো?
কিছু কিছু সময় সাধারণ একটা ম্যাচও পরিস্থিতির কারণে জটিল হয়ে ওঠে। জুভেন্টাস আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মধ্যকার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় পর্বের দ্বিতীয় লেগের ম্যাচটাও অনেকটা তেমনই। জুভেন্টাসের বিপক্ষে শক্তিমত্তার তুলনায় অবশ্যই অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ পেছনে থাকবে। তবে প্রথম লেগে ঘরের মাঠে ২-০ গোলে জিতে যাওয়ার কারণে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ অবশ্যই এগিয়ে রয়েছে।
জুভেন্টাসকে ম্যাচে টিকে থাকতে হলে প্রথম কাজ হবে কমপক্ষে দু’টি গোল করা। দু’টি গোল করার পর যদি একটা গোলও না খায় তাহলে ম্যাচটা টাইব্রেকারে যাবে। এর উপর যদি জুভেন্টাস ১ টি গোল খেয়ে ফেলে তাহলে করতে হবে ৪ টি গোল। এখন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মাঠে গিয়ে দুই গোল করে ম্যাচ জিতে আসা কতটুকু কঠিন কাজ? এজন্য একটু রেকর্ডের আশ্রয় নেওয়া যাক।
জুভেন্টাস আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ এই পর্যন্ত ম্যাচ খেলেছে ৮টি। এর মধ্যে জুভেন্টাস জিতেছে ৪টি, আর অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ জিতেছে ৩টি, বাকি ম্যাচটা ড্র হয়েছে। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রসঙ্গ আসলেই জুভেন্টাস পিছিয়ে যায়। চলতি টুর্নামেন্টের আগে দুই দল চ্যাম্পিয়ন্স লিগে একবারই মুখোমুখি হয়েছিলো। ২০১৪-১৫ সালের সেই টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বের দুইবারের মুখোমুখিতে জুভেন্টাসের মাঠে গিয়ে ড্র করলেও ঘরের মাঠে ১-০ গোলের জয় পায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। জুভেন্টাসের জয়গুলোর সবই ইউরোপাতে, সেটাও ১৯৬৪-৬৫ সালের টুর্নামেন্টে।
সাম্প্রতিক সময়টাতে দুই দলই ভালো অবস্থানে থাকলেও প্রথম লেগে ২-০ গোলে জয় পাওয়ার কারণে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা এগিয়ে আছে। তাছাড়া সর্বশেষ দুই অ্যাওয়ে ম্যাচেও রিয়াল সোসিয়েদাদ আর রায়ো ভায়েকানোর ম্যাচে জয় পেয়েছে অ্যাথলেটিকো। জুভেন্টাসের জন্য কাজটা কঠিন। ম্যাচটাকে টাইব্রেকারে নিতে হলেও ন্যূনতম ২-০ গোলের জয় পেতে হবে তাদেরকে। রক্ষণাত্মক খেলা অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে কাজটা করতে পারা যথেষ্টই কঠিন। এর মধ্যে যদি অ্যাথলেটিকো কোনোক্রমে ১টি গোল দিয়ে ফেলতে পারে, তাহলে জুভেন্টাসকে ৪টি গোল করতে হবে। অন্যদিকে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রথম লেগে হেরে ফিরে আসার রেকর্ড জুভেন্টাসের নেই। তবে একই সাথে এই কথাটাও সত্য, আগের ম্যাচগুলোতে তাদের দলে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো খেলোয়াড়ও ছিলেন না।
২.
যেকোনো সেক্টরে বিশ্বাস বলে একটা কথা আছে। বিষয়টা কেমন সেটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। প্রথমে ক্রিকেট নিয়ে শুরু হোক।
মনে করুন, শেষ ওভারে ১০ রান দরকার। আপনাকে সুযোগ দেওয়া হলো, পরিস্থিতিটা জেতার জন্য আপনার পছন্দমতো যেকোনো একজন ব্যাটসম্যানকে নেওয়ার। আপনি ব্যাটসম্যান হিসেবে কাকে বাছাই করবেন? গেইল, আফ্রিদি, নাকি বিরাট কোহলিকে? অনেকেই হয়তো প্রথম দু’জনকে বেছে নেবেন। আবার মনে করুন, আপনাকে ৩৩০ রান চেজ করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষই নির্দ্বিধায় পরেরজনকেই বেছে নেবেন। প্রথম ক্ষেত্রে মাত্র ৬টি বল টিকে থাকলেই রানটা করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে রান তোলার পাশাপাশি উইকেটে টিকেও থাকাটা জরুরী। গেইল কিংবা আফ্রিদির চাইতে নিঃসন্দেহে বিরাট কোহলি সেখানে বেশি নির্ভরযোগ্য।
এখন আরেকটা পরিস্থিতিতে যাওয়া যাক। মনে করুন, আপনি বোলিং দলে আছেন। এখন এই ১০ রান সেইভ করার জন্য আপনি কোন বোলারের হাতে বল তুলে দিবেন? ওয়াসিম আকরাম, মালিঙ্গা, নাকি ডেল স্টেইন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো যে কেউ প্রথম দুইজনের হাতেই বল তুলে দেবেন, ডেথ ওভারে ওয়াসিম আর মালিঙ্গার বিকল্প নেই। এর মানে কিন্তু ডেল স্টেইন খারাপ বোলার হয়ে যান না। ওই পরিস্থিতিতে স্টেইনের চেয়ে ওয়াসিম কিংবা মালিঙ্গার রেকর্ড ভালো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গেইল বা আফ্রিদি কি সবসময় শেষ ওভারে ১০ রান করে ম্যাচ বের করতে পারবেন? অথবা বিরাট পারবেন না, সেটা কি আমরা নিশ্চিত বলতে পারি? এরকম পরিস্থিতিতেই বা তারা ক্যারিয়ারে কয়বার পড়েছেন?
এখানেই আপনার কিংবা আমার খেলা বুঝতে পারার বিষয়টা চলে আসে। আপনি ভালোভাবে ম্যাচ রিড করলে বুঝতে পারবেন, ৩৩০ রান চেজ করার জন্য কোহলির বিকল্প নেই। এরকম ১০ ম্যাচে মুখোমুখি হলে গেইল যদি একদিন ম্যাচ বের করতে পারেন, তবে কোহলি পারবেন পাঁচদিন। কথাটা লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই? কোহলি পারলেও হয়তো ৫ দিন পারবেন, বাকি ৫ দিন কিন্তু ব্যর্থই হবেন। তারপরও কোহলিকে বেছে নেওয়ার কারণ কী? কারণ, কোহলিকে বেছে নিলে আপনি সবচেয়ে বেশিদিন জয় নিয়ে মাঠে থেকে বের হতে পারবেন, সেটা আশা করা যায়। শেষ ওভারে ১০ রান আটকানোর জন্য সবচেয়ে ভালো অপশন ওয়াসিম আকরাম। তিনি প্রতিদিন আপনাকে জেতাতে পারবেন না বটে, তবে নিঃসন্দেহে বেশি দিন জেতাবেন অন্যান্যদের তুলনায়।
এটাই বিশ্বাস।
৩.
এখন ফুটবলের প্রসঙ্গে আসা যাক। দল খাঁদের কিনারে, এই ধরনের ক্রুশিয়াল ম্যাচে ক্রিসের কিছু ভালো পারফরম্যান্স থাকার কারণেই আসলে ক্রিসের প্রতি বিশ্বাসটা সবার রয়েছে। কয়েকটি ম্যাচের দিকে চোখ বুলানো যাক।
-
সুইডেন বনাম পর্তুগালের প্লে-অফ ম্যাচ ( দ্বিতীয় লেগ)
হারলেই বিশ্বকাপ খেলতে পারবে না, এমন ম্যাচে ৫০ মিনিটে ক্রিস প্রথম গোল করলেও ইব্রা’র করা ৬৮ আর ৭২ মিনিটের দু’টো গোলে ফিরে আসে সুইডেন। শেষ পর্যন্ত ৭৭ আর ৭৯তম মিনিটে ক্রিস আরো দুটো গোল করে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেন। সুইডেনের মাঠে নিজের দল খারাপ খেলে পিছিয়ে যাবার পরও একক কৃতিত্বে দলকে উদ্ধার করেন।
-
হাঙ্গেরি বনাম পর্তুগাল গ্রুপ ম্যাচ
২০১৬ ইউরোর পর্তুগাল আর রনের পারফরম্যান্সটা একটু লক্ষ্য করা যাক।
প্রথমে আইসল্যান্ড বনাম পর্তুগালের খেলায় রন কোনো গোল পাননি। ম্যাচটা ১-১ গোলে ড্র হয়, নানি ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন। এর পরের ম্যাচ হয় অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে। এখানে ক্রিস ভালো খেলা তো দূরে থাক, উল্টো একটা পেনাল্টি মিস করে দলকে বিপদে ফেলে দেন। হাঙ্গেরির সাথে শেষ ম্যাচটা তাই হয়ে যায় বাঁচা-মরার ম্যাচ। জিততেই হবে, এমন ম্যাচগুলোর অর্থ হচ্ছে ম্যাচ শুরুর আগেই এক গোলে পিছিয়ে থাকা। এই ধরণের ম্যাচগুলোতে অনেক বড় দলও তুলনামূলক ছোট দলের কাছে হোচট খেয়েছে। ২০০২ বিশ্বকাপে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে ‘জিততেই হবে’ এমন ম্যাচে তার আগের বিশ্বকাপজয়ী দল ফ্রান্স হারে ২-০ গোলে। একই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাও গ্রুপের শেষে ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচে সুইডেনের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে পড়ে।
হাঙ্গেরির সাথে পর্তুগালের ম্যাচটা হয়ে যায় তাই নক-আউটের মতো। ম্যাচ শুরুর আগে পর্তুগাল মনস্তাত্বিকভাবে খানিকটা পিছিয়ে থেকেই খেলা শুরু করে। এরপর ম্যাচের ১৯ মিনিটেই গোল খেয়ে আরো পিছিয়ে পড়ে। ৪২ মিনিটে নানি গোল দিয়ে সমতা আনার পর ৪৭ মিনিটে আবার গোল খায় পর্তুগাল। ৫০ মিনিটে গোল করেন রোনালদো। ৫৫ মিনিটে আবার পিছিয়ে পড়ার পর ৬২ মিনিটে রোনালদোর গোলেই সমতা ফেরায় পর্তুগাল। ম্যাচটাতে ড্র করার ফলেই পরের পর্বের টিকেট পায় পর্তুগাল।
-
ক্লাব বিশ্বকাপ ২০১৬
বেনজেমার গোলে ৯ মিনিটেই এগিয়ে যায় রিয়াল। কিন্তু শিবাসাকির ২ গোলে ম্যাচের ৫২ মিনিটে কাশিমা ২-১ গোলে এগিয়ে যায়। সেই অবস্থা থেকে ক্রিসের হ্যাটট্রিকে চ্যাম্পিয়ন হয় রিয়াল।
-
২০১২ ইউরো গ্রুপ ম্যাচ
২০১২ এর ইউরোতে গ্রুপের শেষ ম্যাচে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে মাস্ট উইন ম্যাচে ১১ মিনিটে গোল খেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার পরও ২ গোল করে ম্যাচটা জেতান ২-১ গোলে, এবং ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন। মনে রাখতে হবে, গ্রুপটাকে বলা হচ্ছিলো ‘গ্রুপ অফ ডেথ’। বাকি তিনটি দল ছিল জ়ার্মানি, ডেনমার্ক আর নেদারল্যান্ড।
-
রিয়াল মাদ্রিদ বনাম ভলফসবার্গ, ২০১২
কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম লেগে ভলফসবার্গের মাঠে গিয়ে ২-০ গোলে হেরে আসে মাদ্রিদ। ঘরের মাঠে ‘টালমাটাল’ মাদ্রিদকে ৩-০ গোলের জয় উপহার দেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোই।
৪.
তবে এই ধরণের কিছু ম্যাচে রন ব্যর্থও হয়েছেন।
২০১৭ কোপা দেল রে’তে ঘরের মাঠে সেল্টা ভিগোর বিপক্ষে ২-১ গোলে হারার পর প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে জিতে আসতে পারেনি। সেই ম্যাচে ক্রিস ১টি গোল করলেও মিস করেছিলেন ২টি গোল। পরে ২-২ গোলের ড্র রেজাল্টে বাদ পড়ে মাদ্রিদ।
কিন্তু এরপরও জুভেন্টাসের হয়ে ম্যাচটা জয়ের জন্য ক্রিসের দিকেই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করবেন সমর্থকরা। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ৩০ ম্যাচে ২২ গোল আর ৮ অ্যাসিস্টের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স বাদেও আরেকটা বিষয় সমর্থকদের আশা জাগাতে পারে।
এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ঠিক খুনে ফর্মে নেই ক্রিস। ক্রিসের মতো খেলোয়াড়দের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জ্বলে ওঠা। সেটা অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষেও হয়ে যেতে পারে।
এখন কথা হলো, ক্রিস ফ্লপ থাকার পর, কিংবা না খেললেও ম্যাচটা জুভেন্টাসের পক্ষে বের করা সম্ভব কি না?
সম্ভব। কারণ, ক্রিস বাদেও দিবালার মতো তরুণ কিছু খেলোয়াড় আছেন, যাদের পক্ষে ম্যাচ বের করে নেওয়া সম্ভব। তবে ক্রিস থাকা অবস্থায় যতটা কঠিন, না থাকলে তার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি কঠিন।
এই সম্পর্কে ভালোভাবে বোঝার জন্য সম্ভাবনা সম্পর্কে একটা কথা বলা যাক। মনে করুন, ম্যাচের ৯০ মিনিট শেষ। অতিরিক্ত সময় চলছে। এখন ম্যাচ উইনিং গোল করার জন্য আপনার সামনে তিনটা অপশন দেওয়া হলো, আপনি যেকোনো একটা নিতে পারবেন।
-
কর্নার কিক। ধরে নিন, আপনার হাতে রামোস আছেন।
-
ফ্রি কিক। মনে করুন, আপনার হাতে জুনিনহো আছেন।
-
পেনাল্টি কিক। মনে করুন, আপনার হাতে মেসি আছেন।
মেসির কিছু কিছু সময় পেনাল্টি রেকর্ড একটু খারাপ, জুনিনহোর ফ্রি কিক রেকর্ড ভালো (ইদানিং অবশ্য মেসিরও ভালো), রামোসের কর্নারে গোল করার রেকর্ডও ভালো। তবে এরপরও বেশিরভাগ মানুষ পেনাল্টিকেই বেছে নেবে। কারণ, মেসি মাঝে মাঝে মিস করলেও রামোসের কর্নার, কিংবা জুনিনহো’র ফ্রি কিকে গোল করার সম্ভাবনার চেয়ে মেসির পেনাল্টিতে গোল করার সম্ভাবনা বেশি। এবং বুদ্ধিমান মানুষ সেই কাজটাই করতে চায়, যার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
আজ হয়তো বা ক্রিসের পারফরম্যান্সেই জুভেন্টাস জিতবে, কিংবা জুভেন্টাস জিতলেও ক্রিস ফ্লপ থাকবে, অথবা জুভেন্টাস হয়তো হেরেই যাবে। তবে ক্রিকেটে যেমন বড় রান তাড়া করার ক্ষেত্রে আফ্রিদির চাইতে বিরাটের উপরই মানুষ বেশি নির্ভর করবে, ঠিক তেমনই এই ধরণের ম্যাচগুলোতে ক্রিসের দিকেই তাকিয়ে থাকবে দর্শকরা। সেটা আজকে ব্যর্থ হলেও মিথ্যে হয়ে যাবে না। তাছাড়া মেসির সাথে এই মৌসুমেও লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য জয় ছাড়া বিকল্প নেই ক্রিসের সামনে।
দিনটা ক্রিসের হবে কি না, সেটা বুঝতে পারা যাবে আজ (১২ই মার্চ) রাতেই।