ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো ব্যাগি গ্রিন ও মুশফিকের ১৩ বছর

এই তো সেদিনের কথা। বড় ছুটি পেয়েছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। কেউ বিদেশ ভ্রমণে, কেউ দেশের বাড়িতে, কেউবা রাজধানীতেই ছুটির আমেজে দিন কাটাচ্ছিলেন। ক্রিকেটারদের ছুটির কারণে মাঠকর্মী ও অন্যান্য স্টাফরাও অবসর পেয়েছিল। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম পুরো ফাঁকা। স্টেডিয়ামের বাইরের দিকে একাডেমি মাঠের জিমনেশিয়ামে তালা পড়েছে। একাডেমি মাঠও সুনসান। কিন্তু, পুরোটা নয়। এককোণায় খাটোমতন একজন সমানে ব্যাটিং অনুশীলন করে যাচ্ছেন দুজন নেট বোলার নিয়ে।

একটু কাছে গিয়ে চেনা যায়। ব্যাট করছেন মুশফিকুর রহিম! শুরুতে নতুন মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই সত্যি। খুব চাপ না থাকলে ঝড়-বৃষ্টি যখনই হোক, মুশফিক আছেন। কোচরা পর্যন্ত তাকে সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটার হিসেবে সনদ দিয়ে ফেলেছেন।  সেই পরিশ্রমের ঘামে ভেজা ক্যারিয়ার আজ ১৩ বছর পা দিলো। মুশফিক নিজেকে গেল ১৩ বছরে দলের ‘অটোমেটিক চয়েজ’ হিসেবে পরিণত করেছেন। হয়ে উঠেছেন দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান। বলা চলে, বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়। অতঃপর, মুশফিকের বুনো উল্লাস; Image Source: AFP

প্রিয় ফরম্যাট টেস্ট ক্রিকেট। ২০১১-১৭ সাল পর্যন্ত অধিনায়কত্বও করেছেন। আর সাদা পোশাকের এই পুরোটা সময় তার পরিশ্রমের সাক্ষী হয়ে আছে কেবল ক্ষয়ে যাওয়া, পুরোনো হয়ে যাওয়া একটি ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ। টেস্ট ক্রিকেটের ঐতিহ্যকে মনে-প্রাণে ধারণ করে এখনও সযত্নে তুলে না রেখে বরং সেই সযত্নেই ব্যবহার করে যাচ্ছেন এটি।

অভিষেক

সাদা পোশাকের টেস্ট দিয়েই বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল মুশফিকের। সেই সুযোগ পাওয়াটাও বেশ নাটকীয়। ২০০৫ সালে লর্ডসে সফর করে বাংলাদেশ দল। সেই দলে জায়গা হয়েছিলো ১৮ বছরের মুশফিকের। মূলত অতিরিক্ত উইকেটরক্ষক হিসেবে খালেদ মাসুদ পাইলটের অবর্তমানে যেন উইকেটের পিছনে দাঁড়াতে পারেন সেই জন্য তাকে নেওয়া। তখনও কিশোর বলা যায় মুশফিককে। মুখে কেবল গোঁফের রেখাটাই হয়েছে। সেই মুশফিক হুট করেই সুযোগ পেয়ে গেলেন টেস্টে। তার পেছনে বড় প্রভাব ছিল প্রস্তুতি ম্যাচের। একটিতে ৬৩ ও আরেকটিতে ১১৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন মুশফিক। ব্যস, তাতেই মিলে যায় স্বপ্নের ব্যাগি গ্রিন ক্যাপ আর সাদা জার্সি।

প্রথম টেস্টে জায়গা পেয়েছিলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে। উইকেটের পেছনে পাইলটই ছিলেন। কিন্তু মুশফিক প্রস্তুতি ম্যাচে যে কারিশমা দেখিয়েছিলেন, সেই মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখলেন টেস্টে। মার্ক ট্রেসকোথিক, অ্যান্ড্রু স্ট্রসদের মতো কিংবদন্তিদের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ২০ ও পরের ইনিংসে ৯ রান তোলেন। ফলাফল, বাদ পড়েন পরের ম্যাচেই।

সেই অভিষেক ম্যাচেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চাপটা টের পেয়েছিলেন। হয়তো সেদিনই তাই পরিশ্রমকেই সৌভাগ্যের প্রসূতি হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। যার ফলাফল গেল ১৩ বছরে ভোগ করছেন তিনি। একইসঙ্গে ভোগ করছে বাংলাদেশ।

নতুন করে শুরু

সেই যে ২৬ মে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক করলেন মুশফিক, তারপর বাদ পড়লেন। কিন্তু ফেরাটা দ্রুত হলো না। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে এসে আবারও সেই টেস্টেই সুযোগ পেলেন। এবারের প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। কিন্তু মুশফিক এবার আরও বেশি ব্যর্থ। দুই ইনিংসের একটিতে ০, অপরটিতে ২ রান। নিজের উপর বিশ্বাস ছিল মুশফিকের। বিশ্বাস রেখেছিল টিম ম্যানেজমেন্টও।

সেই বিশ্বাস আর আত্মবিশ্বাসে ভর করে একই বছরের জুলাই মাসে একই প্রতিপক্ষ অর্থাৎ, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ইনিংসে করলেন ৮৯ রান, যার মধ্যে একটি ইনিংস ছিল ৮০ রানের। আগস্টে অভিষেক হলো রঙিন পোশাকের ওয়ানডে ম্যাচে। কিন্তু প্রথম দুটি ম্যাচে তার ব্যাট করারই সুযোগ হয়নি। যেবার সুযোগ পেলেন, সেই ম্যাচে খেললেন ১৮ রানের অপরাজিত ইনিংস।

অধিনায়ক মুশফিক। ফাফ ডু প্লেসির সঙ্গে টসের সময়; Image Source; AFP

টি-টোয়েন্টিতে মুশফিকের অভিষেক হয় ২০০৬ সালেই। নভেম্বর মাসে। শুরুতে সেখানেও বলার মতো কোনো ইনিংস নেই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে খেলেন ২ রানের ইনিংস।

সেই থেকে শুরু গেল ১৩ বছরে অনেক পরিণত হয়েছেন মুশফিক। খেলেছেন ৬০ টেস্ট, ১৮৪ ওয়ানডে ও ৬৮ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। সাদা পোশাকের টেস্টে তার মোট রান ৩৬৩৬, সর্বোচ্চ ২০০ রানের ইনিংসও তার। বলে রাখা ভালো, টেস্টে বাংলাদেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান এই মুশফিক। সেঞ্চুরি ৫টি, হাফ সেঞ্চুরি ১৯টি। ওয়ানডেতে মুশফিকের মোট রান ৪৭১৮। সর্বোচ্চ ১১৭ রানের ইনিংসের পাশাপাশি এখানেও সেঞ্চুরি পাঁচটি। তবে হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে ২৮টি। টি-টোয়েন্টিতে মুশফিকের রান ১০১২। সর্বোচ্চ ৭২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন তিনি। চারটি হাফ সেঞ্চুরি আছে তার।

অধিনায়কত্ব ও সমালোচনা

মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব পান ২০১১ সাল থেকে। একটা সময়ে দেশের হয়ে তিন ফরম্যাটেই টস করতে নেমেছেন তিনি। তার অধীনে বড় সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে টেস্ট ক্রিকেটে। তার অধীনেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কাকে টেস্টে হারানোর গৌরব অর্জন করেছে। শুধু তা-ই নয়, বড় দলগুলোর বিপক্ষে লড়াই করে ড্র করা বাংলাদেশ দল অভ্যাসে পরিণত করেছে তারই অধিনায়ত্বে।

মুশফিক সমালোচিতও হয়েছেন সবচেয়ে বেশি অধিনায়ক থাকাকালীন সময়ে। তার বক্তব্য বিভ্রান্ত করেছে অনেককেই। এমনকি সংবাদ সম্মেলনে তার বক্তব্য ভালোভাবে নিতে পারেনি বিসিবিও। সর্বশেষ ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট চলাকালীন সময়ে অধিনায়ক হয়েও বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিংয়ে দাঁড়ান মুশফিক। এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়। পরে মুশফিকই সংবাদ সম্মেলনে জানান, তিনি নিজে থেকে কিছুই করেননি। কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের নির্দেশেই তাকে বাউণ্ডারি লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মুশফিকের ব্যাটিং ব্যর্থতা; Image Source; AFP

এ নিয়ে মুশফিক বিসিবির চাপের মুখে পড়েন। তখন থেকেই গুঞ্জন ওঠে অধিনায়কত্ব হারাচ্ছেন মুশফিক। সেটাই হয়। মাসখানেক পর চলতি বছরে আনুষ্ঠানিকভাবে টেস্টের দায়িত্ব মুশফিক থেকে নিয়ে দেওয়া হয় সাকিব আল হাসানের হাতে।

গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্যাট হাতে দলকে নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মুশফিক। তারপরও অনেক সময় কেবলমাত্র ‘খামখেয়ালি’তে চড়ে দ্রুত আউট হতে হয়েছে তাকে। তখন এমন কথাও উঠেছে নিন্দুকদের মুখে, এত পরিশ্রম করেন মুশফিক, কিন্তু ম্যাচ খেলতে গিয়ে সেটা কাজে লাগাতে পারেন না তিনি।

কোনো এক ফুটবল কোচ একবার বলেছিলেন, অনুশীলনে সব শট নিও না, কিছু বাকি রাখো ম্যাচের জন্য। কিন্তু মুশফিকের বেলায় ঘটেছিল উল্টো। বোধ হয় অনুশীলনেই সবকিছু ঢেলে দিয়েছেন তিনি। ফলাফল, অনেকবারই ব্যর্থ হতে হয়েছে মূল ম্যাচে।

ব্যাগি গ্রিন ও কিছু আফসোস

মুশফিকের কাছে বরাবরই ক্রিকেট মানে টেস্ট ক্রিকেট। যে ফরম্যাটটা দিনে দিনে তাল হারাতে বসেছে, সেটাকে মুশফিক মনের উচ্চ আসনে জায়গা দিয়েছেন। আর যে ব্যাগি গ্রিন অভিষেকের দিন পেয়েছিলেন, সেটাকেই এখনও প্রতি ম্যাচে ব্যবহার করে চলেছেন।

গেল ১৩ বছরে মুশফিক খেলেছেন কেবল মাত্র ৬০ টেস্ট ম্যাচ। অথচ তার পরে অভিষেক করা ইংলিশ ওপেনার অ্যালিস্টার কুক খেলেছেন ১৫৪ টেস্ট! এর চেয়ে বেদনার আর কোনোকিছু মুশফিকের ক্যারিয়ারে নেই। বারবারই বেশি টেস্ট খেলতে যাওয়ার আবেদন জানিয়ে এসেছেন তিনি।

মুশফিকুর রহিম; Image Source; India TV

১৩ বছরের ক্যারিয়ারটা কেমন গেলো মুশফিকের? সেটা নিয়ে বলেছেন, “বাংলাদেশকে প্রথমবার প্রতিনিধিত্ব করার পর ১৩ বছর কিভাবে কেটে গেল বিশ্বাসই হচ্ছে না। কত দ্রুত সময় পায় হয়! এই দিনটি আমার আজীবন মনে থাকবে। আমি ভাগ্যবান যে এই দিনে আমি বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াতে পেরেছিলাম। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। সবাইকে ভালোবাসি।

মুশফিকের পরিশ্রমটা হয়তো পথ দেখাতে সাহায্য করবে পরবর্তী প্রজন্মের। একইসঙ্গে ক্যারিয়ারের যতদিন বাকি আছে, সেই সময়ে মুশফিক পৌঁছে যাবেন স্বপ্নের উচ্চাসনে।

ফিচার ইমেজ- Cricinfo

Related Articles

Exit mobile version