ক্রিকেটার হিসেবে মাইক ব্রিয়ারলি আহামরি কিছু ছিলেন বলে শোনা যায়নি। পরিসংখ্যান অন্তত সেরকমটাই বলবে। টেস্ট খেলেছেন ৩৯টি, তাতে রান করেছেন মাত্র ১,৪৪২। হাফ সেঞ্চুরির সংখ্যা ৯, সেঞ্চুরি নেই একটিও। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর ৯১। গড় ২২.৮৮, টেনেটুনে যাকে ২৩ বলা যায়।
ওয়ানডেতেও একই অবস্থা। ২৫ ওয়ানডেতে মোট রান ৫১০, সর্বোচ্চ ৭৮। গড় ২৪.২৮। হাফ সেঞ্চুরি ৩টা আছে বটে, কিন্তু এখানেও সেঞ্চুরি নেই কোনো। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন অঙ্কের দেখা কখনো পাননি এই ভদ্রলোক।
কিন্তু পাঠক, বিশ্বাস করুন, এইসব রান-সেঞ্চুরি-গড় দিয়ে মাইক ব্রিয়ারলিকে মাপা যাবে না। ব্রিয়ারলিকে মাপতে হবে তার প্রজ্ঞা দিয়ে, তার মস্তিষ্ক দিয়ে। বিশ্বাস হচ্ছে না? দাঁড়ান, আরেকটা পরিসংখ্যান দেখাই তাহলে।
কমপক্ষে ২৫টা টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমন অধিনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে সফল স্টিভ ওয়াহ। ৪১ টেস্টে জিতেছেন, হেরেছেন ৯ টেস্ট। জয় পরাজয়ের অনুপাত ৪.৫৫। দ্বিতীয় স্থানেই আছেন ব্রিয়ারলি, ১৮ টেস্টে জয়ের সাথে হার মাত্র ৪টিতে। জয় পরাজয়ের অনুপাত ৪.৫।
কিন্তু স্টিভের দলটাকে মনে করা হয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা দল হিসেবে। অন্যদিকে, ব্রিয়ারলি আহামরি কোনো দলের নেতৃত্ব দেননি কখনোই। ১৯৮১ সালের অ্যাশেজ, ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় যা কি না পরিচিতি পেয়ে গেছে ‘ইয়ান বোথামের অ্যাশেজ’ নামে, সেই সিরিজ ব্রিয়ারলির নেতৃত্বে জিতেছিল ইংল্যান্ড। সাথে ধরা যেতে পারে চার বছর আগের অ্যাশেজে ৩-০ ব্যবধানে জয়ও। যে নয়টি সিরিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ব্রিয়ারলি, জিতেছিলেন তার মধ্যে সাতটিতেই। ড্র ও হার একটি করে। তিনি আসলে ক্যাপ্টেন হিসেবে কেমন ছিলেন, তা বলে দেয় এই পারফরম্যান্সই।
তবে আজকের গল্প অ্যাশেজ সিরিজের কোনো ম্যাচের না, গল্পটা কাউন্টি ক্রিকেটের এক ম্যাচের। আরও ভালো করে বললে, কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের। তিনদিনের সেই ম্যাচটা ছিল মিডলসেক্স বনাম সারে’র মধ্যে। ব্রিয়ারলি ছিলেন মিডলসেক্সের অধিনায়ক।
এই ম্যাচ শুরুর আগে একবার পয়েন্ট তালিকায় চোখ বুলিয়ে নেয়া যেতে পারে। পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে তখন কেন্ট, তাদের পয়েন্ট ১৭৫। ১৭৩ পয়েন্ট নিয়ে তাদের ঘাড়েই নিঃশ্বাস ফেলছিল মিডলসেক্স। খেলার নিয়ম ছিল এরকম, জিতলে ১২ পয়েন্ট। হারলে, এমনকি ড্র করলেও পয়েন্ট ০। শীর্ষে উঠতে হলে তাই জিততেই হতো মিডলসেক্সকে।
টস হলো। টসে জিতলেন ব্রিয়ারলি, এবং জিতেই বোলিং নিলেন।
সমস্যাটা করলো আবহাওয়া। বৃষ্টি নামল মুষলধারে, আর সেই বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল প্রথম দিনের খেলা।
খেলা শুরু হয়েছিল শনিবারে। ‘রেস্ট ডে’ বলে খেলা বন্ধ থাকল তার পরদিন। দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ সোমবারে বৃষ্টির বেগ কমলো বটে, তবে খেলা শুরু হতে হতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেল। টসে জিতে বোলিং নিয়েই রেখেছিলেন, লাঞ্চের পরে বৃষ্টিভেজা পিচে আগুন ঝরানোর জন্য বল ওয়েইন ড্যানিয়েলের হাতে তুলে দিলেন ব্রিয়ারলি।
কিন্তু বিধি বাম! সারে’র সংগ্রহ যখন ১ উইকেটে ৮ রান, তখনই বৃষ্টি নামল আবার। আবার মুষলধারে, এবং সেদিনের মতো খেলা পণ্ড।
বৃষ্টির কারণে তিনদিনের ম্যাচ পরিণত হলো একদিনের ম্যাচে। ম্যাচটা ফলাফলবিহীনভাবে শেষ হবে, এই বিষয়ে ততক্ষণে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছেন সবাই।
সোমবার রাতে বৃষ্টি থেমে গেল। মঙ্গলবার সকালটা শুরু হলো মেঘলাভাবে, বৃষ্টি না থাকলেও মুখ গোমড়া করে ছিল আকাশ। আগের দু’দিন পিচ খোলা পড়ে ছিল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পিচ হয়ে আছে তখন বধ্যভূমি। খেলা শুরু হতেই সেই পিচে ঝড় তুললেন ওয়েইন ড্যানিয়েল। তার সাথে যোগ দিলেন মাইক সেলভি’ও। এই দু’জনের মিলিত আক্রমণে সারে’র স্কোর দাঁড়ালো ৩৮/৮।
একটানা বল করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ড্যানিয়েল, তৃতীয় কোনো পেসারও ছিল না ব্রিয়ারলির হাতে। স্পিনার লাগালেন, কিন্তু প্রতিপক্ষকে অলআউট যেন করা যাচ্ছিলই না। এই সময়ে প্রথম জুয়াটা খেললেন ব্রিয়ারলি, বোলিংয়ে আনলেন মাইক গ্যাটিংকে। আর দশ বছর পরে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে এই ভদ্রলোকই হাত থেকে ফেলে দেবেন ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপটা।
জুয়া কাজে লেগে গেল। রিচার্ডস আর পোকক নামের দু’জন ব্যাটসম্যানকে চটজলদি তুলে নিলেন গ্যাটিং, সারে’র ইনিংস শেষ হলো ৪৯ রানে।
***
ম্যাচের তখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি, এমনটাই ভাবছে সবাই। কিন্তু মাইক ব্রিয়ারলি অন্যরকম ভেবেছিলেন।
বোলিংয়ে নেমে যখন গা গরম করছে সারে’র ফিল্ডাররা, তখন মিডলসেক্সের হয়ে মাঠে নামলেন জন এমবুরি আর ইয়ান গৌল্ড। তাদেরকে দেখে অবাক হয়ে গেল সারে’র ক্রিকেটাররা, কারণ ওপেনার ছিলেন না দুজনের কেউই। সেই বিস্ময় আরও বাড়লো, যখন একটা বল খেলার পরই ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটা ধরলেন এমবুরি আর গৌল্ড।
মাত্র এক বল খেলে কোনো রান না করেই ইনিংস ঘোষণা করলেন মাইক ব্রিয়ারলি! এই ঘটনার পর সংশোধন করা হয় আইন। মাঠে না নেমে, একটি বল না খেলেও ডিক্লেয়ার করতে পারে যেকোনো দল।
এদিকে এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন ব্রিয়ারলি; ইনিংস ডিক্লেয়ার করলেন, সেই সাথে দ্বিতীয়বারের মতো সারেকে ব্যাটিংয়ে নামালেন সেই জঘন্য পিচে।
পিচের অবস্থা সকালের চেয়ে ভালো বটে, কিন্তু আদর্শ পিচ হতে ঢের দেরি। লাঞ্চ হতে তখন বাকি আর ৪৫ মিনিট। সেই সময়ে আবার ব্যাটিংয়ে নামলো সারে, আবার বোলিংয়ে ড্যানিয়েল-সেলভি জুটি, এবং ধ্বংসযজ্ঞ আরেকবার! তবে এবার আগের চাইতে ভালো ব্যাটিং করলো সারে’র ব্যাটসম্যানেরা। তাদের আগের ইনিংস যেখানে শেষ হয়েছিল ৪৯ রানে, দ্বিতীয় ইনিংসে তারা থামল ৮৯-এ। মিডলসেক্সের ফিল্ডাররা পাঁচটি ক্যাচ না ফেললে আরও লজ্জায় পড়তে হতো তাদের।
***
৪৯ আর ৮৯ মিলে সারে’র লিড দাঁড়ালো ১৩৮ রানের, জিততে হলে মিডলসেক্সকে করতে হতো ১৩৯। তবে সময়টা বিপক্ষে ছিল তাদের, এই রান করতে হতো ২৬-২৭ ওভারের মধ্যে। যার মানে, ওভারপ্রতি পাঁচেরও বেশি। সময়টা ১৯৭৭ সাল, ওয়ানডে ক্রিকেটের বয়সই মাত্র কয়েক বছর। ওভারপ্রতি পাঁচ করে রান তোলার ইচ্ছেকে তাই এক কথায় যা বলা যায়, তা হলো উচ্চাভিলাষ।
এবার মিডলসেক্সের হয়ে ব্যাটিংয়ে নামলেন দুই নিয়মিত ওপেনার দুই ‘মাইক’ – ব্রিয়ারলি ও স্মিথ। শুরু থেকেই চালিয়ে খেলতে লাগলেন দু’জন। ভাগ্যও যেন পাশে এসে দাঁড়ালো তাদের। স্মিথের ক্যাচ পড়লো দু’বার, রানআউট হতে হতেও বেঁচে গেলেন ব্রিয়ারলি। দলের রান যখন ১০১ (আর নিজের ৫১), আউট হয়ে গেলেন স্মিথ। বাকি পথটুকু ওয়ান ডাউনে নামা র্যাডলিকে সাথে নিয়ে নিজ দায়িত্বে পার করে দিলেন ব্রিয়ারলি। ম্যাচশেষে অপরাজিত থাকলেন ৬৬ রানে।
ম্যাচ শেষ হলো বটে, কিন্তু জয় উদযাপন করার সময় পেলেন না ব্রিয়ারলি। কারণ, এর দু’দিন পরেই হেডিংলিতে শুরু হতে যাচ্ছিল অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্ট। তাড়াহুড়ো করে রওনা দিলেন তিনি, পৌঁছেও গেলেন সেখানে। গিয়ে দেখা হলো ডেরেক আন্ডারউডের সাথে। ইংল্যান্ড দলে ডেরেক আর ব্রিয়ারলি সতীর্থ হলেও কাউন্টিতে ডেরেক খেলতেন কেন্টের হয়ে। ব্রিয়ারলিকে তিনি বললেন,
‘একদিনের মধ্যে প্রতিপক্ষকে যেহেতু দু’বার অলআউট করতে পেরেছ, এবারের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ তুমিই ডিজার্ভ করো।’
***
মিডলসেক্স সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বটে, তবে কেন্টও খালি হাতে ফেরেনি। ২২৭ পয়েন্ট নিয়ে সেবার যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছিল মিডলসেক্স আর কেন্ট উভয় দলকেই। কিন্তু মাইক ব্রিয়ারলি সেই জুয়াটা না খেললে কিন্তু আর চ্যাম্পিয়ন হওয়া হয় না মিডলসেক্সের। রিচি বেনো তো এমনি এমনি বলেননি,
‘অধিনায়কত্ব হচ্ছে নব্বই শতাংশ ভাগ্য আর দশ শতাংশ দক্ষতা। কিন্তু দোহাই লাগে, ওই দশ শতাংশ ছাড়া বাকি নব্বই শতাংশ প্রয়োগ করতে যেও না।’