বার্সেলোনার সোনালি প্রজন্মের ঐ দল একসময় বিদায় বলবে। এক ঝাঁক নক্ষত্রের আলো ফুরোবে একদিন। বার্সেলোনার বোর্ড থেকে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে থাকা প্রত্যেক ব্লাউগানা সমর্থক জানতো সে কথা। কিন্তু বার্সেলোনা অতীত নিয়ে কোনদিন ভেবেছে কি? পুয়োল, জাভি, ইনিয়েস্তা, বুসকেটস এবং লিওনেল মেসি — যেদিন এরা থাকবে না সেদিন বার্সা কি করবে? পুয়োল চলে গেছেন, এরপর ধীরে ধীরে জাভি ও ইনিয়েস্তা। তবু মেসি ছিলেন। বার্সার ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রজন্ম ক্রমশ অতীত হয়ে যাচ্ছে কিন্তু মেসি যেন একাই একশো। করোনা মহামারীর পর আর্থিক মারপ্যাঁচে পরে মেসিকে বিদায় জানাতে হল বার্সাকে। জাভি ও ইনিয়েস্তার শূন্যস্থানে বেশ কয়েক মৌসুম ধুঁকে ধুঁকে চলার পর পেদ্রি এবং গাভি এসেছেন। রক্ষণে পুয়োলের মতো একজনকেও বার্সা পেয়ে গেছে। মেসির মতো খেলোয়াড়ের শূন্যস্থান পূরণ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবে মধ্যমাঠে আরও একজন খেলোয়াড়ের শূন্যস্থান পূরণ করা আরও অসম্ভব। কারণ বুসকেটসের মতো ভোলান্তে বর্তমান ফুটবলে আর একজনও নেই।
তার পাসিং, তিনশো আশি ডিগ্রি ইউ-টার্ন নিয়ে প্রতিপক্ষকে খাবি খাওয়ানো, মাঝমাঠ থেকে লং বল বা আক্রমণের খেলোয়াড়দের সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেওয়া থ্রু-বলের মতো কৌশলগুলো একজন পিভট পজিশনে খেলা খেলোয়াড়ের কাছ থেকে আশা করা দায়। কিন্তু বুসকেটস পারতেন, পারতেন বলেই এই পজিশনে তিনি নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছিলেন। সেই বুসকেটস গত মৌসুম শেষে বিদায় জানালেন বার্সাকে। এই শূন্যস্থান এবার বার্সা পূরণ করবে কীভাবে?
অর্থনৈতিকভাবে বার্সার কোমর না ভেঙে গেলে বার্সার একটা ব্যবস্থা হয়তো বের করতে পারতো। কারণ বুসকেটসের প্রোফাইলের কাছাকাছি ধরনের ডিফেন্সিভ খেলোয়াড় ইউরোপে আপাতত দু’জন রয়েছেন। ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলা রদ্রি এবং রিয়াল সোসিয়াদাদের স্প্যানিশ মিডফিল্ডার মার্টিন জুবিমেন্দি। কিন্তু ফিন্যানশিয়াল ফেয়ার প্লে-এর কারণে বার্সা এদের কাউকেই দলে টানতে পারবে না। কারণ ৬০ মিলিয়ন ইউরো রিলিজ ক্লজ দিয়ে বা প্রায় ৮০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরোর দাম পরিশোধ করার পরিস্থিতিতে বার্সা নেই।
জাভি চাচ্ছিলেন একজন ডিফেন্ডিভ মিডফিল্ডারের পাশাপাশি একজন প্লেমেকার এবং বল ক্যারিয়ার মিডফিল্ডার কিনতে যিনি ফাইনাল থার্ডেও ভালো ফিনিশিং বা পাস দিতে পারেন। প্রথমে বার্সা দলে টেনেছে ইলকায় গুন্দোয়ানকে। এবং ফিন্যানশিয়াল ফেয়ার প্লে-এর কারণে বার্সা সবচেয়ে সস্তা অপশনকেই বেছে নিয়েছে। জিরোনা থেকে ওরিওল রোমেউকে তারা দলে ভিড়িয়েছে মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। হয়তো এরপর বার্সা একজন প্লে-মেকার মিডফিল্ডার কিনতেও পারে। কিন্তু বর্তমান দলের পরিপ্রেক্ষিতে বার্সাতে ৪-৩-৩ এর প্রথাগত ছকে খেলানোর জন্য কোনো সিঙ্গেল পিভট নেই। এজন্য জাভি ৪-৪-২ মতান্তরে ৩-২-২-৩ ছক ব্যবহার করতে পারেন। বুসকেটসকে সিঙ্গেল পিভট পজিশনে রেখে যে কৌশল গত মৌসুমেই জাভি একবার ব্যবহার করেছেন।
তখন বুসকেটস ছিলেন। এজন্য সিঙ্গেল পিভট পজিশনে তাকে খেলানো গেছে। বল ক্যারিয়ার হিসেবে থেকেছেন ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, নাম্বার এইট ভুমিকায় পেদ্রি এবং ফলস উইঙ্গার হিসেবে গাভি। তবে পেদ্রি এবং ডি ইয়ংয়ের ভূমিকা ম্যাচভেদে ভিন্ন হতো। এবং সঠিক মিডফিল্ডার না থাকার কারণে প্রায় ম্যাচেই জাভির এই কৌশল ব্যর্থ হতো। কারণ বেঞ্চ থেকে কেসি প্রত্যেক ম্যাচে খেললেও প্রথম মৌসুমে দলের সাথে তিনি সেভাবে মানিয়ে নিতে পারেননি। তবে এই মৌসুমে এই একই কৌশল কিছুটা ভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। ৪-৩-৩ ছকে জাভির বার্সার খেলা শুরু হয় একদম গোলরক্ষকের কাছ থেকে। ছোট ছোট পাসে নিচ থেকে দলের ডিফেন্ডারও আক্রমণ শাণানো শুরু করেন। রক্ষণ এবং আক্রমণভাগের মাঝে একজন সেন্ট্রাল পিভট থাকতেন। কিন্তু এবার বুসকেটস নেই। তাই দলে নির্দিষ্ট কোনো পিভট না-ও থাকতে পারে। তবে প্রথাগত পিভট না থাকলেও জাভি তার চারটি অন্তর্নিহিত নীতিই মেনে চলবেন — পজেশন, পজিশন, প্রেশার এবং পারসেপশন। সামগ্রিকভাবে জাভি চান তার দলের মধ্যমাঠের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে।
এই চার ‘পি’-এর নীতিতে দীক্ষিত হয়েছেন দলের ডিফেন্ডারও। সেন্টারব্যাক থেকে সরে গিয়ে রাইটব্যাকে খেলা ক্যুন্দে, প্রথাগত সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলা আরাউহো থেকে শুরু করে দলের একমাত্র স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডফস্কিকে পর্যন্ত জাভির এই ‘ফোর পি’ নীতি মেনে চলতে দেখা গেছে। পেদ্রি-গাভি এবং ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং আগে থেকেই পাসিং এবং পজেশন নীতিতে বিশ্বাসী। এবং এদের মাঝে এবার এমন একজন খেলোয়াড় এসেছেন যিনি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ট্যাক্টিশিয়ান কোচের কৌশলের তুরুপের তাস ছিলেন।
ইল্কায় গুন্দোয়ান; বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে আসার সময় তিনি দেখা গেল তিনি হাই টেম্পো এবং প্রেসিং এ ভালো খেলেন, তার ভার্টিক্যাল পাসিং বেশ ভালো। পেপ গার্দিওলা তাকে ঘষে মেঝে ভিন্ন এক রূপের গুন্দোয়ানকে অবতীর্ণ করলেন। তখন তিনি সাধারণ সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার, কখনও পজেশন বেইজড ইন্টেরিয়র যিনি ফাইনাল থার্ডে মুড়িমুড়কির মতো গোল করে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি তার রক্ষণাত্মক দক্ষতাও বেশ নজরকাড়া। তার বহুমুখী টেকনিক্যাল ক্ষমতা গার্দিওলার ফুটবল দর্শন ফুটিয়ে তুলতে আরও সাহায্য করেছে। আর বার্সেলোনায় তার এই দিকগুলোর কারণেই আসন্ন মৌসুমে জাভি তার পজেশনভিত্তিক পাসিং ফুটবলকে আরও আগ্রাসী রূপ দিতে পারবেন।
গুন্দোয়ানের পাসিং এবং বল কন্ট্রোল খুবই ভালো। তাছাড়া ওয়াইড পাসিং রেঞ্জ, টাইমিং, দলের সবার সাথে পাসিং লিঙ্কিং এবং মাঠে ফাঁকা জায়গা খুঁজে বের করে বল এগিয়ে দেওয়ার মতো দক্ষতাগুলো জাভির মিডফিল্ডার সিস্টেমের সাথে বেশ ভালোভাবে মিলে যায়। এজন্য প্রথাগত কোনো পিভট না থাকলেও জাভি গুন্দোয়ান এবং ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ংকে ডাবল পিভটের মতো একটা ছক তৈরি করতে পারেন, কিন্তু সেখানেও প্রথাগত কোনো পিভট আসলে থাকবে না। গুন্দোয়ানের রক্ষণাত্মক দক্ষতার জন্য ডি ইয়ং থেকে তিনি সামান্য নিচে খেলবেন ডিফেন্ডার এবং মিডফিল্ডারের সাথে সম্পর্ক জুড়তে। এছাড়াও তার ভিশন ও পাসিং দক্ষতার জন্য একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের পাশে ডিপ-লাইং মিডফিল্ডার হিসেবেও ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। অথবা তিনি ইন্টেরিয়র মিডফিল্ডার হিসেবেও খেলতে পারেন, যেখানে তার গোল ও অ্যাসিস্টের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু প্রথাগত কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না থাকার জন্য গুন্দোয়ানকে সেভাবে ইন্টেরিয়র মিডফিল্ডারের ভুমিকায় না-ও দেখা যেতে পারে।
তবে বর্তমান দলের প্রেক্ষিতে, জাভির সামনে দুটো দরজা খোলা। তিনি চাইলে গত মৌসুমে যেভাবে বুসকেটস এবং ডি ইয়ংকে ডাবল পিভট হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, চাইলে গুন্দোয়ান এবং ডি ইয়ংকে ব্যবহার করতে পারেন। যেখানে গুন্দোয়ান কিছুটা নিচে খেললেও ডি ইয়ং হবেন বল ক্যারিয়ার। অথবা তিনি ওরিওল রোমেউকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ব্যবহার করে গুন্দোয়ানকে ইন্টেরিয়র মিডফিল্ডার এবং ডি ইয়ংকে প্রথাগত বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। যেখানে পেদ্রি থাকবেন নাম্বার এইট পজিশনে। এতে করে গুন্দোয়ান বিটুইন দ্য লাইনের মধ্যে অপারেট করলেও আক্রমণের সময় তার প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের মাঝে চলে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। ম্যানচেস্টার সিটিতে কেভিন ডি ব্রুইনা এবং রদ্রির সাথে অনেকটা এই ভুমিকাতেই খেলে এসেছেন।
৩১ বছর বয়সী ওরিওল রোমেউ-এর ট্রান্সফার নিয়ে বার্সা সমর্থকদের মধ্যে তেমন উত্তেজনা নেই। থাকার কথাও না। বুসকেটসের মতো ঐতিহাসিক মিডফিল্ডারের বদলে অখ্যাত এই মিডফিল্ডার সেভাবে সাড়া জাগাবেন না তা বলাই বাহুল্য। তবে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ওরিওল প্রেসের বিপক্ষে বেশ ভালো খেলতে পারেন। এরিয়াল ডুয়েলেও তার পারফরম্যান্স নজরকাড়া। বল ডিস্ট্রিবিউশন এবং প্রোগ্রেসিভ পাসের পাশাপাশি গত মৌসুমে ড্রিবলিং-এর দিক থেকে তিনি লা লিগার সেরা মিডফিল্ডারদের একজন। তাছাড়া লা লিগার অভিজ্ঞতা ছাড়াও তার নিজের পাসিং হিটম্যাপও অনেকটা বুসকেটসের মতো। এজন্য প্রথাগত সিঙ্গেল পিভট অথবা কৌশলগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ওরিওল বার্সেলোনার জন্য বেশ ভালো সংযোজন।
তবে প্রথাগত ৪-৩-৩ অথবা চারজন মিডফিল্ডার মিলে ৪-৪-২ ছকের কথা চিন্তা করলেও আগামী মৌসুমে গাভিকে তার নতুন পজিশন দেখা যেতে পারে। প্রতিপক্ষের হাফে পজেশন ধরে রাখার সময় ৩-২-২-৩ ছকের বার্সেলোনার বাম পাশের উইংয়ে থাকবেন গাভি। তবে বাম উইং থেকে তিনি ঢুকে পড়েন প্রতিপক্ষের বাশ পাশের হাফ-স্পেসে। গাভির ফেলে আসা শূন্যস্থানে বালদের সোলো রান এবং মিডফিল্ড থেকে ‘নাম্বার এইট’ রোলে থাকা পেদ্রি তখন হয়ে ওঠেন বার্সার আক্রমণের ট্রাম্পকার্ড। তবে গত মৌসুমে এই কৌশল ব্যবহার করলেও সঠিক খেলোয়াড় এবং মানিয়ে উঠতে না পারার জন্য অনেক সময়ই বার্সা তেমন সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। উল্টে পজেশন হারালেই প্রতিপক্ষের কাউন্টার-অ্যাটাকের সময় মাঝমাঠ ছন্নছাড়া হয়ে পরেছে। তবে গুন্দোয়ানের সংযোজন জাভির এই ‘ফোর ম্যান’ মিডফিল্ড কৌশল এবার আরও পোক্ত হয়ে উঠতে পারে।
বার্সেলোনার সেই সোনালী সময়ের মিডফিল্ডত্রয়ীর শেষ সদস্যের বিদায়ে বার্সা একেবারে নতুনভাবে তাদের মৌসুম শুরু করবে। বুসকেটস না থাকার শূন্যতা বার্সা প্রতি ম্যাচে টের পাবে। তাছাড়া মাঝমাঠে এতদিনের নির্ভরশীলতার প্রভাবও তো রয়েছে। সেখানে বুসকেটসকে নিয়ে বার্সার খেলার অভ্যস্ততাকে পেছনে ফেলে জাভি একেবারে ভিন্ন রকমের মাঝমাঠের কৌশল খাটানোর পরিকল্পনা আঁটছেন। হাই রিস্ক হাই রিওয়ার্ড – সেই কৌশলের সফলতা পেলে যেমন দলের চেহারা বদলে যেতে পারে, তেমনি এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে ফেরত আসার সম্ভাবনাকেও ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না।
তবে ব্যর্থতার চাদরে মোড়া দীর্ঘ এক সময় পর প্রথম লা লিগা জয়ে, বার্সা সমর্থকেরা আপাতত ব্যর্থতার প্রসঙ্গ একেবারেই তুলতেই চাচ্ছেন না। সে না উঠুক; আপাতত নতুন দিনের সূচনায় আশায়ই বুক বাঁধুন তারা!