কনকাশন ইনজুরি আর ডিমেনশিয়া কিংবা স্মৃতিভ্রংশ এই নিয়ে খেলাধুলার দুনিয়ায় অনেক দুশ্চিন্তার সৃষ্টি হয়েছে। ক্রিকেটে ফিল হিউজের মৃত্য বলুন কিংবা সাবেক ওয়েলস ডিফেন্ডার কেইথ পন্টিনের মৃত্যু – মাথায় বল লেগে মৃত্যুর ঘটনা কিন্তু নতুন নয়। কিন্তু এতদিন এই নিয়ে এত কথা না হলেও সম্প্রতি এত মৃত্যুর জন্য এই নিয়ে নতুন করে ভাবনায় বসেছে কর্তৃপক্ষ।
ফুটবলে খেলোয়াড়েরা সবচেয়ে বেশি মাথায় আঘাত পায় হেড দিতে গিয়ে। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে মাথায় আঘাত পেয়ে জার্মান মিডফিল্ডার ক্রিস্টোফার ক্রেমার রেফারিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে, “এটি কি ফাইনাল?” তার মুখে এমন কথা শুনে আর একটু আগে তার আঘাত পাওয়ার ব্যাপারটা বুঝে জার্মান কোচ জোয়াখিম লো’কে বলেন ক্রেমারকে তুলে নিতে। ইজিকিয়েল গ্যারাইয়ের সাথে মাথায় ধাক্কা খেয়ে তিনি এমন কনকাশন ইনজুরিতে পড়েন। ম্যাচের শেষের দিকে জার্মানি যে গোলটি পায়, তা গোৎজের আরেকটু কাছে থাকলেই হেড করে ক্লিয়ার করে দিতে পারতেন মার্টিন ডেমিচেলিস। তার ভুল পজিশনিং এবং হেড না দেয়ায় ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণী গোল খায় আর্জেন্টিনা।
তাই হেডের প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই, তা নিয়ে একটি গবেষণাও করেছে ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ও প্রফেশনাল ফুটবলারস অ্যাসোসিয়েশন। তাদের গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ছিল ফুটবলের স্মৃতিভ্রংশের প্রাদুর্ভাব নিয়ে। ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগোর ড. উইলি স্টুয়ার্ট এই গবেষণার প্রধান হিসেবে ছিলেন। এই গবেষণায় পাওয়া যায় ফুটবল খেলায় খেলোয়াড়দের সুস্থ থাকা এবং খেলার সময় মাথার ইনজুরি নিয়ে আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। সেই সাথে দেখা গেছে যে স্নায়ুজনিত ইনজুরিতে যারা ভোগেন, তাদের সংখ্যাটা খেলায় তাদের পজিশন ও খেলার পরিমাণের উপর নির্ভর করে। সেই গবেষণাতেই ফুটবলে হেড সম্পূর্ণ বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। তবে মাঠের কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় হেড করার অনুমতি দেয়া যায়। সেই সাথে ট্রেনিংয়ের সময় পাওয়ারফুল হেড কম দিতে বলা হয়।
পরিসংখ্যান বলে, ২০১৯-২০ মৌসুমে ইউরোপারে টপ লেভেলের লিগগুলোতে মোট গোলের ১০-২০% এসেছে হেড থেকে। শুধু বুন্দেসলিগায় ৭২৮টি গোলের মধ্যে ১১৬টিই এসেছিল হেড থেকে। আবার ইপিএলে ৭৮৪টি গোলের মধ্যে ১১৬টি এসেছে হেড থেকে। গড়ে প্রায় প্রতিটি লিগেই ১০০-এর উপরে গোল আসে হেড থেকেই। লিগে খেলার ধরনের উপর নির্ভর করে হেডে গোলের সংখ্যা বাড়ে বা কমে।
তাহলে হেড ছাড়া ফুটবল কেমন হতো?
প্রথমত, দানবের মতো লম্বা সেন্টারব্যাকদের চাহিদা আগের তুলনায় অনেক কমে যাবে। তবে এমন খেলোয়াড় আসলে নেই যে কি না শুধু হেডের জন্যই দলে সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলার সুযোগ পায়। টেকনিক্যালি যারা একটু ভালো, তারাই এখন সুযোগ বেশি পাচ্ছে। সেন্টারব্যাকদেরও এখন চান্স ক্রিয়েশন, পাসিং স্কিল দিয়ে বিবেচনা করা হয়। লিসান্দ্রো মার্টিনেজের মতো ৫’৯” উচ্চতার খেলোয়াড় ইপিএলে প্রভাব বিস্তার করেছে নিজের আগ্রাসী খেলা, পাসিং ও ট্যাকলিং দিয়ে। উচ্চতা তার জন্য এখানে কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। সেই সাথে দলগুলো স্ট্রাইকার হিসেবে টার্গেটম্যান নিয়ে খেলে না আর। একজন টার্গেট ম্যানের চাইতে কমপ্লিট স্ট্রাইকার কিংবা নিচে নেমে লিংক আপ করে খেলা স্ট্রাইকারের চাহিদা এখন বেশি। শুধু গোল করা নয়, গোল বানানোও এখন স্ট্রাইকারের কাজ। সেই হিসেবে হেড যদি ব্যান করাও হয়, ডিফেন্ডাররা তাদের সাইজ ও স্ট্রেন্থ দিয়ে ডিফেন্স সামলাতে পারবেন। তবে আলাদা করে হেডে স্পেশালিস্ট স্ট্রাইকারের চাহিদাও কম নয়। তারা বেশিরভাগ খেলায় সুপার সাব হিসেবে মাঠে নামে। এমনকি কাউন্টার অ্যাটাক থেকে তাদের দিয়েই গোল বেশি হয়। অলিভিয়ের জিরু, লুক ডি ইয়ং – এরা নিজেদের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন হেডের মাধ্যমেই।
তবে খেলার ধরনে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে। এবং এই পরিবর্তনটা হবে বিশাল। ম্যাচে অ্যাটাকিং কর্নার সম্পুর্ণ পরিবর্তন হয়ে যাবে। যেহেতু হেড দেয়া যাবে না, সেই হিসেবে যে কর্নার নিবে, সে চাবে গোলরক্ষকের এলাকা থেকে যত বাইরে বলটি ফালানো যায়। কারণ গোলরক্ষকের হাতে বল যাওয়া আটকানোর জন্য হেড করতে বলে অবশ্যই। নয়ত কিপারের জন্য বল ধরা কিংবা ঘুষি মেরে কাউন্টার অ্যাটাকে বল ফেলা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
২০১৮ সালে পল পাওয়ার, একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশ করেন। Mythbusting Set-Piece Myths in Soccer নামের সেই পেপারে তিনি দেখান যে আউটসুইং (৬.৫%) কর্নারের তুলনায় ইনসুইং (১০.৮%) কর্নার বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করে। ইনসুইং কর্নারে অনেকগুলো ইস্যুর মুখোমুখি হতে হয় গোলরক্ষকের। ইনসুইং কর্নারে বল যায় গোলরক্ষকের দিকে বল যায়। সেই সাথে বাকি খেলোয়াড়েরাও সেইদিকে দৌড় দেয়। তখন একই সাথে গোলরক্ষকের চিন্তা করতে হয় বল ধরা নিয়ে এবং শক্তিমত্তার লড়াইয়ে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের পরাস্ত করতে। সেই ছোট এলাকার মধ্যে গোলরক্ষকের উপর চাপ বেড়ে যায় বহুগুণ।
তাই যদি হেড ব্যান করে দেয়া হয় তবে গোলপোস্টের আশেপাশে যে বলগুলো ফেলা হবে সেগুলো ধরতে গোলরক্ষকের অনেক সহজ হবে। আর অন্যরা যেহেতু হেড দিবে না, তাই সে তার বল ধরার এরিয়া তার ছয় গজের বক্সের বাইরে এসেও করতে পারবে, সচরাচর হেডে হেরে যাওয়ার ভয়ে তারা এত এগোয় না।
সেই হিসেবে আউটসুইং কর্নার যেগুলো গোলপোস্ট থেকে দূরে গিয়ে পড়বে সেগুলো অনেক জনপ্রিয়তা পাবে। সরাসরি কর্নারের তুলনায় পাস দিয়ে ছোট কর্নার, ফ্ল্যাটার কিংবা মাটি কামড়ানো ক্রস – এগুলো বেশি ব্যবহৃত হবে। কারণ এগুলোতে গোলরক্ষকের এরিয়ার বাইরে তারা বল পাবে গোল করার জন্য। তবে ডিফেন্সিভ দল তখন এইগুলো ফেরানোর জন্য আলাদা টেকনিক উদ্ভাবনে মনোযোগ হবে। তার মধ্যে অন্যতম হবে বক্সের বাইরে বিপক্ষ দল বল পাওয়া মাত্রই স্লাইডিং ট্যাকেল করা, যার মধ্যে ৫% ভুল হলেও বেশ কিছু খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়বেন শুধু পা ভেঙে। এমন আরো কিছু নোংরা ট্যাকটিক্স বের হতে পারে শুধু গোল হওয়া আটকানোর জন্য।
এছাড়াও গুরুত্ব কমে যাবে লম্বা থ্রো-ইনের। যদিও আইনে আছে বলে লম্বা থ্রো করা কেউ আটকাতে পারবে না, তবুও এটি আর আগের মতো কার্যকর হবে না। লম্বা থ্রো-গুলো অনেকটা ইনসুইং কর্নারের মতো আসে। যেখানে মূল লক্ষ্যই থাকে বলে মাথা ছুঁইয়ে দিয়ে তার গতিপথ পরিবর্তন করে দেয়া। ফুটবলের নিয়ম অনুযায়ী লম্বা থ্রো থেকে কেউ সরাসরি গোল করতে পারবে না। তো যদি সেখানে ছোঁয়া লাগাতেই হয়, তবে হেড নিষিদ্ধ হওয়ায় টাচ করতে হলে বলকে মোটামুটি শরীরের লেভেলে আসতে হবে; যেটি আক্রমণকারী দলের চাইতে গোল রক্ষাকারী দলের জন্য সহজ হবে।
তবে কিছু কিছু জায়গায় এই নিয়মটি আক্রমণকারী দলের জন্য সহজ হবে। যেমন যেসব দল হাই-লাইন ডিফেন্স সিস্টেমে খেলে ঐসব ডিফেন্ডারদের পেছনে বল ফেলে দ্রুত দৌড়ানো সহজ হবে, কারণ এখানে ডিফেন্ডাররা হেড দিয়ে বল ক্লিয়ার করতে পারবে না। ফলে ডিফেন্ডাররা আরো নিচে নেমে গিয়ে তাদের ডিফেন্স লাইন সাজাবে। যে কারণে কিলিয়ান এমবাপে, কিংবা সন হিউয়েং-মিন এদের সাথে দৌড়ে পাল্লা দিতে পারবে এমন ডিফেন্ডারের প্রয়োজন হবে। এমনকি এসব ক্ষেত্রে তখন ক্রস ফেরানোও কঠিন হয়ে যাবে। মাথার উচ্চতার চেয়ে বেশি উপরে হাওয়ায় ভেসে আসা বল আটকানো ডিফেন্ডারদের জন্য হবে সম্পুর্ণ অসম্ভব। ব্লক করার সময় প্রচুর ভুল হবে। বল যেখানে পড়বে সেখানেই কেবল একে ধরা যাবে। এর আগে না ডিফেন্ডার না অ্যাটাকার, বল কারোর নয়।
যেহেতু খেলার ধরন পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, সেই হিসেবে তখন পরিবর্তিত হয়ে যাবে দলগুলোর পছন্দের খেলোয়াড়ের ধরনও। হেডের যে প্রয়োজনীয়তাটি ছিল, তা দলগুলো পোষাতে চাবে তাদের খেলোয়াড়দের স্পিড দিয়ে। দৌড়াতে পারলে তখন অন্য খেলোয়াড়ের চাইতে অনেক আগে সে বলের কাছে পৌছাতে পারবে। যে কারণে তখন হ্যারি কেইনের মতো দৃঢ় ঘাড়ের পেশিযুক্ত খেলোয়াড়ের চাইতে অবামেয়াংয়ের মতো লম্বা পায়ে দৌড়াতে পারা খেলোয়াড়ের কদর বেশি হবে।
তবে হেডগুলোর প্রয়োজনীয়তা আমরা মাঠের অন্যান্য জায়গার তুলনায় পেনাল্টি বক্সের ভেতরেই বেশি বুঝি। ফুটবলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মুহূর্ত হলো গোলের মুহূর্ত। এই গোল ফেরানোর হেড আর গোল করতে চাওয়ার হেডের মূল্য তাই বেশি হওয়া স্বাভাবিক। তবে এইজন্য যে মাঠের অন্য পজিশনগুলোয় হেড কমে যায় তা-ও কিন্তু না। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে ইউরোপের প্রধান ৫টি লিগের প্রতিটি খেলায় গড়ে প্রায় ৭৫টির মতো করে হেড হয়ে থাকে। এর মধ্যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ২৫% হেডই হয়ে থাকে পেনাল্টি বক্সের ভেতরে। হয়তো বা ইংল্যান্ডে ক্রসনির্ভর খেলার প্রবণতা বেশি এইজন্য বক্সে হেডের পরিমাণও বেশি থাকে।
বাকি ৭৫% হেডগুলো হয় মিডফিল্ডে গোল কিক ফেরানোর সময়, কিংবা অন্য খেলোয়াড়ের উপর দিয়ে পাস দেয়ার সময় কিংবা বলকে নিজের আয়ত্ত্বে আনতে। হেড ছাড়া খেলার যে স্বাভাবিক ফ্লো চলে, তা অবশ্যই নষ্ট হবে। হাত শরীরের অনেক বাইরে থাকে, সেই সাথে এর কাজ শরীরের ব্যালেন্স ঠিক রাখা। এইজন্য আমাদের হাত ব্যবহার না করলেও চলে। তাই হেড ব্যান করা হলে এর পরিবর্তে অন্য কিছু আনতে হবে খেলার ফ্লো ধরে রাখতে।
তবুও হেড ছাড়া আসলে ফুটবল বিশ্বের চেহারা যে কেমন হবে তা পুরোপুরি এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে এটি ফুটবল খেলার কৌশলগুলোয় কিছু নাটকীয় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এমনকি সেটি হতে পারে ফুটবলের ইতিহাসে একটি বড় রকমের বিপ্লব, যা হয়তো পাল্টে দিতে পারে ফুটবল বিশ্বের চেহারাই।