১৯৮৩: ভারত। ১৯৮৭: অস্ট্রেলিয়া। ১৯৯২: পাকিস্তান।
২০১১: ভারত। ২০১৫: অস্ট্রেলিয়া। ২০১৯: ??
ক্রিকেট যদি অতটাই কাগজে-কলমের খেলা হয়, প্রশ্নবোধক চিহ্নের জায়গায় পাকিস্তানের নামটা বসা উচিত। কারণ, প্যাটার্ন তেমনটাই বলছে।
কিন্তু ক্রিকেটটা ব্যাটে-বলে খেলা হয়, কারা ব্যাট-বল হাতে মাঠে নামবেন, সেই ভাবনায় নির্বাচকদের ডুবে ডুবে হয়রান হতে হয়। পাকিস্তানের নির্বাচকমণ্ডলীর তাই এই মুহূর্তে একমাত্র কাজ, ১৫ জন ক্রিকেটার খুঁজে বের করা, দেশের হয়ে যারা খেলবেন দ্বাদশ বিশ্বকাপে।
মিকি আর্থার বলেছেন, প্রাথমিকভাবে ১৯ জনকে বিবেচনা করা হচ্ছে, যারা চড়তে পারেন বিশ্বকাপের বিমানে। পিএসএলের পারফরমেন্সের পরে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তেইশে।
বিগত দিনের পারফরমেন্স আর সম্ভাবনার নানা সূত্র মিলিয়ে এই তেইশের কোন পনেরো জন হতে পারেন পাকিস্তান বিশ্বকাপ স্কোয়াডের যাত্রী?
পজিশন: ওপেনার
আগুনের উত্তাপ আর বরফের শীতলতা, দুই বিপরীত মেরুকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তান ম্যানেজমেন্ট। ফখর জামান আর ইমাম-উল-হক জুটিটা জমেছিলোও বেশ। নিজেদের খেলা প্রথম সিরিজে তো রীতিমতো বিশ্ময় জাগিয়েছিলেন দু’জনে মিলে। জিম্বাবুয়ের বোলারদের নিয়ে ছেলেখেলায় মাতলেন। পাঁচ ম্যাচের সেই সিরিজে ৩য় ওয়ানডেতে জুটি ভেঙেছিলো শূন্য রানে, বাকি চার ম্যাচের স্কোর? ১১৩, ১১৯, ৩০৪, আর ১৬৮!
তাল কেটেছে এরপরই। একসাথে ব্যাটিংয়ে নামা পরবর্তী ১২ ইনিংসে নেই আর কোনো সেঞ্চুরি জুটি। ফখর জামান তো গত বছরের এশিয়া কাপটা ভুলেই যেতে চাইবেন! পাঁচ ম্যাচ খেলে করেছিলেন মোটে ৫৬। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কিছুটা ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিলেও দক্ষিণ আফ্রিকাতে গিয়ে আবারও ব্যর্থ। পিএসএলেও পারফরম্যান্স গড়পড়তা।
তুলনায় ইমাম-উল-হক অনেক বেশি ধারাবাহিক। তাসমানিয়া সাগরপাড়ের দেশগুলোকে বাদ দিলে বাদবাকি সবার সঙ্গেই গড়টা পঞ্চাশ ছাড়ানো। দারুণ ব্যাটিং টেকনিকে ব্যাটিং অর্ডার আস্থাও খুঁজে পায় তার ব্যাটেই।
পাকিস্তান ম্যানেজমেন্টও বোধহয় ওপেনার হিসেবে তাদের ওপরই ভরসা করবেন। না করেই বা উপায় কী? দুর্দান্ত পিএসএল কাটানো কামরান আকমল অথবা আহমেদ শেহজাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার সম্ভাবনা সীমিত। তাদের বদলে সুযোগ পাওয়া আবিদ আলী কিংবা শান মাসুদ, সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেননি দু’জনের কেউই। আবিদ আলী আর শান মাসুদকে ২৩ সদস্যের ক্যাম্পে জায়গা দিলেও বিশ্বকাপ খেলে ফেলার সম্ভাবনা কমই।
পজিশন: ওয়ান ডাউন
প্রথম উইকেট যখনই পড়ুক, ড্রেসিংরুম থেকে বাবর আজমই নামবেন।
২০১৫ সালে অভিষেক ম্যাচে সেই যে ৫৪ রান দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, এরপর আর ক্যারিয়ার গড় পঞ্চাশের নিচে নামেনি। তিন নাম্বার পজিশনকে যে বড্ড বেশি আপন মনে করেন, সে তো পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ওপেনিংয়ে যখন নেমেছেন, ১৩ গড়ে রান করেছেন। এক পিছিয়ে চারে যখন নেমেছেন, তখন গড়টা ৩৪.৮৫। আর এই দুইয়ের মাঝে, নাম্বার থ্রি’তে ব্যাটিং গড় ৫৮.২১।
বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, জো রুটদের মতো বাঘা বাঘা ওয়ান-ডাউন ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে পাল্লা দিতে এখন এক পাকিস্তানিও আছেন, বাবর আজম।
পজিশন: মিডল অর্ডার
একে তো নামের পাশে ১২১ ম্যাচে পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করার অভিজ্ঞতা, তার ওপরে সদ্যই পাকিস্তান কাপে ৯৯ আর অপরাজিত ১৩৬ রানের ইনিংস; বহুদিন বাদে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ দিয়ে দলে ফেরা উমর আকমল যদি টানা তিন বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখে ফেলেন, তবে তাকে খুব বেশি দোষ দেয়া যেত না। সে স্বপ্ন বোধহয় স্বপ্নই রয়ে গেলো, ক্যাম্পের জন্যে তাকে বিবেচনাতেই নিলেন না নির্বাচকেরা।
তাই বলে পাকিস্তান মিডল অর্ডারকে মোটেই কচিকাঁচার আসর ভাবা যাচ্ছে না। শোয়েব মালিককে দেখতে যতই সদ্য যৌবনে পা রাখা তরুণটি মনে হোক, ক্যারিয়ারের বয়স ঊনিশ পেরিয়েছে, খেলে ফেলেছেন ২৮২ ওয়ানডে, খেলতে যাচ্ছেন নিজের শেষ বিশ্বকাপ। সময়ের সাথে সাথে ব্যাটও হয়েছে পরিণত, পাকিস্তানের মিডল অর্ডারে হয়েছেন আস্থার অন্য নাম।
সাথে মোহাম্মদ হাফিজও তো আছেন। কিছুক্ষণ তার ব্যাটিং দেখলে মুখ দিয়ে বেরোয় ‘ধ্রুপদী ব্যাটিং’, কিন্তু পরিসংখ্যানে চোখ বোলালে বোঝা যায়, সেই ধ্রুপদী ব্যাটিং রান আনতে পারেনি। ক্যারিয়ারে ১৭টি বসন্ত পেরিয়ে এসেছেন, ২০৮ ম্যাচ খেলেছেন, তবুও গড় মাত্র ৩৩। ক্যারিয়ারের সেরা সময় হিসেবে চোখ বন্ধ করে তুলে আনতে পারবেন না কোনো নির্দিষ্ট বছরকেই। রান আর গড়ের দৈন্যদশা ক্যারিয়ারের পুরোটা জুড়েই। বিশ্বকাপ খেলার শেষ সুযোগ এবারই, বয়সটা যে আটত্রিশ ছাড়িয়েছে। শেষ সুযোগও বটে, নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় লিখবার।
এ বছর এখন অবধি খেলা ৫ ম্যাচে ৪৯.৬৭ গড়ে রান করা ব্যাটসম্যানকে পাকিস্তান ম্যানেজমেন্ট সে সুযোগ দেবে কি? বিকল্প হিসেবে হারিস সোহেল যে ভালোই করছেন। গত বছর ৪ ওয়ানডে খেলেছেন, রান করেছেন ১৮৬। বিশ্বকাপের বছর তো আরও ভালো, ৫ ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়ে রান তিনশ’ ছুঁইছুঁই, গড় ৭২.৭৫। স্রেফ বড় টুর্নামেন্ট খেলার অভিজ্ঞতা ব্যতীত যেকোনো বিবেচনায়ই হারিস সোহেলের চেয়ে মোহাম্মদ হাফিজ যোজন যোজন পিছিয়ে থাকবেন।
মিডল অর্ডারে দলের অধিনায়কও খেলেন। সরফরাজ আহমেদ, যার নেতৃত্বে পাকিস্তানের প্রথম চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতার স্মৃতিটা মাত্র মাস আঠারো পুরনো। সরফরাজ আহমেদের অবশ্য মনে হতেই পারে, ‘সে অনেক কাল আগের কথা!’
ব্যাটে রান নেই, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর থেকে খেলা ২৬ ম্যাচে রান করেছেন মোটে ২৯৮। তার ওপর দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দিলে পেখুয়ায়োকে বর্ণবাদী মন্তব্যের জেরে কপালে জুটিয়েছিলেন চার ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা, সময়টা বেশ কঠিনই যাচ্ছে সরফরাজের।
তবে দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্বটা যখন তার কাঁধে, তখন মোহাম্মদ রিজওয়ানের পরিণতি দ্বিতীয় পছন্দের উইকেটকিপার হওয়াই। তা তিনি যতই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাঁকান না কেন!
ইনিংসের শেষ দিকে ঝড় তুলবেন, এই ভরসায় পাকিস্তান ম্যানেজমেন্ট জাতীয় দলে ডেকেছিলো আসিফ আলীকে। জিম্বাবুয়ের সাথে ২২ বলে ৫০ রানের ইনিংসে আভাসও দিয়েছিলেন আস্থার প্রতিদান দেয়ার। কিন্তু এশিয়া কাপ আসতেই বিপত্তি, ব্যাটে আর ঝড় নেই, জাতীয় দলের মুখও দর্শন নেই এরপর। পিএসএলে ঝড় তুলে আবারও এসেছেন জাতীয় দলের ক্যাম্পে, বাদবাকিটা সময়ের হাতেই তোলা।
পজিশন: অলরাউন্ডার
ফাহিম আশরাফ, ইমাদ ওয়াসিম, মোহাম্মদ নওয়াজ তো বটেই, চাইলে শাদাব খানকেও মিনি অলরাউন্ডার তকমা দিয়ে দেয়া যায়। এরা সবাই ডাক পেয়েছেন পাকিস্তান জাতীয় দলের বিশ্বকাপ ক্যাম্পে।
খেলাটা যখন ইংল্যান্ডে, পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে ফাহিম আশরাফ বাড়তি কদর দাবি করছেন। তবে তার পারফরমেন্স মোটেই সে রকম দাবি করছে না, ব্যাটিং গড় মাত্র ১৩। তুলনায় পঞ্চম বোলারের দাবিটাই পূরণ করছেন ভালো। রান আটকে রাখার কাজটা করতে পারছেন বেশ, ৪.৫৭ ইকোনমি রেট সেটাই বলে।
সে হিসেবে ইমাদ ওয়াসিমও খুব একটা পিছিয়ে নেই। ৪.৬৫ ইকোনমি রেট, ব্যাটিং গড় ৪৭.৪০। পরিসংখ্যান তো চোটপ্রবণ এই ক্রিকেটারের দিকেই পক্ষপাতী হতে বলে, যে কারণে কপাল পুড়তে পারে মোহাম্মদ নওয়াজের। দু’জনই যে বাঁহাতি অলরাউন্ডার।
পজিশন: স্পিনার
শাদাব খান কিংবা ইয়াসির শাহ, বিশেষজ্ঞ স্পিনার হিসেবে স্কোয়াডে সুযোগ পেতে পারেন দু’জনই। দু’জনই লেগ স্পিনার।
টেস্টের ইয়াসির শাহ আর ওয়ানডের ইয়াসির শাহর মধ্যে পার্থক্য যেন আকাশ-পাতাল। টেস্টের বোলিং গড় যেখানে ২৮, সেখানে একদিনের ক্রিকেটে এক উইকেটের জন্যে খরচ করতে হয়েছে সাড়ে ৪৭ রান।
তুলনায় শাদাব খানের ওয়ানডে ক্যারিয়ারই বেশি উজ্জ্বল। উইকেট প্রাপ্তির হার ইয়াসির শাহ’র মতো হলেও বোলিং করেছেন অনেক মিতব্যয়িতার সঙ্গে। সাথে ব্যাটিং দিয়েও দলে রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। স্কোয়াডে যেকোনো একজনের জায়গা হলে সম্ভাবনাটা যে শাদাব খানেরই বেশি, সেটা এখনই বলা যায়।
পজিশন: পেসার
ওয়াসিম আকরামকে দেখে বড় হওয়া পাকিস্তানে আজ আর বাঁহাতে বোলিং করা পেসারের অভাব নেই। ক্যাম্পের জন্যে যে ২৩ সদস্য ডাক পেয়েছেন, তাদের মাঝে পেসার আছেন সাতজন। অদ্ভুত সাদৃশ্য এই যে, তাদের মধ্যে চারজনই বাঁহাতি!
যার হবার কথা এই বোলিং আক্রমণের নেতা, সেই মোহাম্মদ আমিরকে নিয়েই কোচ মিকি আর্থারের চিন্তাটা সবচেয়ে বড়। স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারির কারণে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর বাগিয়েছেন ৩৫ উইকেট। কিন্তু সেই পুরনো আমির আর ফেরত আসেননি। ২০১৮ সালে ৭০ ওভার বল করে উইকেট পেয়েছিলেন মাত্র তিনটি, এ বছরে পেয়েছেন মাত্র দুই উইকেট। এই পারফরমেন্স স্কোয়াডে জায়গা পাবার জন্যে যে মোটেই উপযুক্ত নয়, সেটা বুঝতে পারছেন আমির নিজেও। বিশেষ করে বাকি পেসারদের পারফরমেন্স যখন ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী।
জুনাইদ খান গত কয়েক বছর ধরেই আছেন স্কোয়াডের বিকল্প পেসার হয়ে। কারও চোট কিংবা পড়তি ফর্ম, যেকোনো বিকল্পে ডাক পড়েছে তার। শেষ দুই বছরে উইকেট নিয়েছেন ৩০টি। অবশ্য এ বছরে ইকোনমি রেটটা ছয়ের বেশি, বাকি সবকিছুই দলে জায়গা পাবার উপযোগী।
প্রতিযোগিতায় আছেন উসমান শিনওয়ারিও। ঘরোয়া লিস্ট-এ ম্যাচে ২১.৯ গড়ে ৭১ উইকেট নিয়ে পাকিস্তান দলে জায়গা পেয়েছেন। সেখানে ১৫ ম্যাচে ২৮ উইকেট নিয়ে প্রমাণ দিয়েছেন স্বীয় সামর্থ্যের। নতুন বল দ্রুত ভেতরে ঢোকানোর সামর্থ্যের কারণে নজরে আছেন খুব ভালোমতোই।
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে দলে জায়গা কুড়ানো শাহিন শাহ আফ্রিদিকেই বা অস্বীকার করার উপায় কোথায়! দীর্ঘকায় এই বাঁহাতি বোলারের অভিষেকটাই তো সবটুকু আলো কেড়ে নিয়ে। কায়েদ-এ-আজম ট্রফিতে ৩৯ রানে ৮ উইকেট, কিংবা পিএসএল ম্যাচে চার রানে পাঁচ উইকেট, সবই তো অমিত সম্ভাবনার আশ্বাস দেয়!
এত এত বাঁহাতি বোলারের ভিড়ে ডানহাতি বোলারদের উপায়টা কী!
অবশ্য পাকিস্তানি নির্বাচকদের উপায়ান্তর নেই। ডানহাতি ফাস্ট বোলার হাসান আলীকে তারা বাদ দেবেন কী করে! চ্যাম্পিয়নস ট্রফির টুর্নামেন্টসেরা বোলার, ইনিংসের মাঝপথে প্রতিপক্ষের রানের গতিকে থামিয়ে দেয়া, সব জায়গায় তো হাসান আলীই ভরসা।
তুলনায় মোহাম্মদ হাসনাইন আর মোহাম্মদ আব্বাসই যা একটু পিছিয়ে। একজন ১৯ বছর বয়সেই ১৫০ কি.মি ছাড়াচ্ছেন অবলীলায়, শেন ওয়াটসনের কাছ থেকে স্বীকৃতিও মিলেছে সবচেয়ে দ্রুতগতির টিনএজারের। অন্যজন ব্যর্থ হয়েছেন নিজের টেস্টের পারফরমেন্স একদিনের ক্রিকেটে প্রতিফলিত করতে।
অবশ্য গতির ঝড় তোলার জন্যে মোহাম্মদ হাসনাইনের সামনে পুরো ক্যারিয়ারটাই পড়ে আছে, মোহাম্মদ আব্বাসেরও সুযোগ আছে টেস্ট ক্রিকেটকে নিজের করে নেয়ার জন্যে। বাকি ২১ জনের কোন ১৫ জন বিশ্বকাপের বিমানে চড়ার সুযোগ পান, সেটাই এখন দেখার।