ফেব্রুয়ারি, ২০০৫।
২০০৪-০৫ মৌসুমের চ্যালেঞ্জার ট্রফি খেলতে মুম্বাইয়ের তাজ প্রেসিডেন্ট হোটেলে এসে উঠেছেন দুই ভারতীয় ক্রিকেটার। মহেন্দ্র সিং ধোনি বলে এক ক্রিকেটার দাঁড়িয়ে আছেন খানিক দূরেই, মাস দুয়েক আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে যার। এবং দুজনের আলোচনাটা ওই লম্বা-চুলো উইকেটরক্ষক-ব্যাটারকে নিয়েই। আলোচনা অবশ্য নয়। ‘ক্রিকেটে তো কোনো ধ্যানই নেই। খালি স্টাইলবাজি। ইশ, চুল দেখো না! ক্রিকেটার লাগে কোনোদিক দিয়ে!’ কথাগুলোকে তো ঠিক সমালোচনার কাতারেও ফেলা যায় না!
আকাশ চোপড়া ঠিক এই ভয়টাই করেছিলেন ধোনিকে নিয়ে। যত ভালো ক্রিকেটই খেলুন ধোনি, শেষ পর্যন্ত না লম্বা চুলটাই ধোনির পরিচয় হয়ে ওঠে। চরিত্রচিত্রণে মনুষ্যজাতি তো বরাবরই পারদর্শী, কাঁধ ছাড়ানো চুল দেখেই না নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে পড়ে তাকে নিয়ে! ধোনি জাতীয় দলে ঢোকার আগে একটা ত্রিদেশীয় সিরিজে রুমমেট হিসেবে পেয়েছিলেন আকাশকে। ততদিনে আকাশ টেস্ট খেলে ফেলেছেন ভারতের হয়ে, ধোনির জন্য তিনি বড় ভাইয়ের মতোই। তো সেই বড় ভাই হিসেবেই ধোনিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন চুল কেটে ফেলতে। অবশ্য, নিজের শঙ্কার কথা ধোনিকে জানানোর পর যে জবাব পেয়েছিলেন, তাতে আকাশ বুঝেছিলেন, কাঁধ ছাড়ানো চুল, কালো সানগ্লাসে ঢাকা চোখ আর সানস্ক্রিন ভরা মুখটা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আত্মবিশ্বাস। এর আগ পর্যন্ত ধোনির বিনয় আর শ্রদ্ধাশীলতা আকাশকে মুগ্ধই করেছিল। সেই প্রথম ধোনির গলায় কর্তৃত্ব টের পেলেন তিনি। ধোনি বলেছিলেন,
‘চুল তো কাটব না ভাই। বরং, এমন কিছু করব যে সবাই চুল বড় করতে শুরু করবে।’
– মহেন্দ্র সিং ধোনি
আত্মবিশ্বাসটা যে হাওয়াই মিঠাই নয়, এর প্রমাণ কয়েকদিন পরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪৮। এরও কিছুদিন পরের প্রমাণটা আরও বড়, জয়পুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে করলেন ১৮৩। ব্যস, সেলুনগুলোতে কাস্টমার কমতে শুরু করল পাইকারি হারে। ভারত-পাকিস্তানকে ঐকমত্যে পৌঁছাল তার চুলের আলোচনাতেই। শিশু থেকে কিশোর, সবাই চাইল লম্বা চুলে মহেন্দ্র সিং ধোনি হতে।
কবে থেকে ধোনি লম্বা চুল রাখতে শুরু করেছিলেন, এই প্রশ্নটাও করতে পারেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের সন্তানের চুল ছেঁটে ফেলে একটা আচার পালন করেন, মুণ্ডন বলা হয় যাকে, ধোনির ক্ষেত্রে এরকম কিছু হয়নি ছোটবেলায়। তার ক্ষেত্রে এই আচারটা পালন করা হয়েছিল ২০০২ সালে এসে। সেই চুল যখন বড় হতে শুরু করল, ধোনি আর হাত লাগালেন না। কেউ প্রশ্ন করলেই বলতেন, ‘চুলই তো। বড় হতে দাও!’
ধোনির সব বন্ধু-বান্ধবই তখন চেষ্টা করেছিলেন লম্বা চুল করার। কিন্তু, একমাত্র ধোনিই সফল হয়েছিলেন এই কাজে। কেন? প্রশ্ন করলে ধোনির সবচেয়ে কাছের বন্ধু সীমান্ত লোহানি বলেছিলেন,
‘আমার চেহারাটা লম্বা চুল রাখার মতো বড় নয়। গৌতমদাও চেষ্টা করে পারেনি। একমাত্র ধোনির মাথাতেই স্টাইলটা ভালো লেগেছিল।’
ধোনিকে কতটা ভালো লাগত কিংবা ধোনির চুল কতটা আলোড়ন তুলেছিল তখন, এর অজস্র প্রমাণ ইউটিউবে ঢুকলেক পাবেন আপনি। ২০০৬ সালে ভারত-পাকিস্তান সিরিজের পর পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ এসেছিলেন পুরস্কার বিতরণীতে। এসে ধোনির পারফরম্যান্সের প্রশংসা তো করেছিলেনই, একটু আগ বাড়িয়ে পরামর্শও দিয়েছিলেন, ‘চুলটা কেটো না। তোমাকে খুব সুন্দর লাগে এতে।’
ততদিনে জন আব্রাহামের দেখাদেখি চুলে ধরেছিল সোনালি রঙ। লম্বা চুল নিয়েই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়। সেই চুলটা যে কেন ছোট হয়ে গেল ২০০৮ সালে, আচমকাই, এর ব্যাখ্যা এখন অব্দি কেউ করতে পারেননি। এরপরে চুলের স্টাইল বদলেছে অনেক বার, তবে লম্বা চুল আর ফিরে আসেনি।
অধিনায়কত্ব ছাড়ার পর প্রথম যেই সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন ধোনি, সেখানে সাংবাদিক সুনানন্দ লেলে মজা করেই একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন ধোনির দিকে, ‘তিরুপাতিতে অনেক লোকই যায় ভগবানের কাছে চুল উৎসর্গ করে আসতে। তেমনি যবে থেকে আপনি ভারতের ক্যাপ্টেনসি নিয়েছেন, একটু একটু করে দেশের জন্য চুল উৎসর্গ করেছেন। এখন যেহেতু আর অধিনায়কত্বের ঝক্কি নেই, আবার কি লম্বা চুল ফেরত আসবে?’
ধোনি উত্তরটা স্বভাবসুলভ হাসি নিয়েই দিয়েছিলেন, যতদিন দেশের জন্য খেলছেন, নিখাদ ব্যাটসম্যান হিসেবেও, ততদিন আর চুল লম্বা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সুনানন্দ প্রশ্নটা যদিও মজা করেছিলেন, তবে দেশের জন্য ধোনির চুল বিসর্জনের কথাটা কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের পর ট্রফি হাতে মুম্বাই গেটের সামনে যখন দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, তখন তিনি ন্যাড়া মাথা। অথচ, এর আগের রাতে যখন ৯১ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেললেন, তখনও ধোনির মাথা-ভর্তি চুল। মাঝে কী হয়েছে, সেই গল্পই বহুদিন পরে বেরিয়েছে হরভজন সিংয়ের মুখ দিয়ে।
গল্পটা এমন: নিজের রুমে বসে ধোনি বিশ্বজয়ের গল্প করছিলেন সতীর্থ আর ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষজনের সঙ্গে। হঠাৎ করেই উঠে শৌচালয়ে গেলেন। আর গেলেন তো গেলেন, একদম যেন উধাও। দরজায় কড়া নেড়েও কোনো লাভ হলো না, প্রত্যাখ্যাতই হতে হলো বারবার৷ মিনিট পনেরো পর যখন বেরোলেন তিনি, তখনই দেখা গেল, মাথা কামিয়ে বেরিয়ছেন ধোনি।
ক্রিকবাজের অস্ট্রেলিয়া-প্রতিনিধি ভারত সুন্দরেসানের লেখা আপনি পড়ে থাকতেই পারেন। ভদ্রলোক দুটো বইও লিখেছেন এরই মধ্যে, যার প্রথমটা আবার ধোনিকে নিয়েই। দ্য ধোনি টাচ। ধোনির সঙ্গে তার সংযোগ শেষ নয় এখানেই। ভারতের চুলটাও তো দৈর্ঘ্যে ধোনির মতোই লম্বা।
ধোনি যে সব কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, সেটা বোঝাতে ভারত টেনে এনেছেন চুলকে। ভারত তো এর আগে থেকেই চেনেন, তবে ধোনির সামনে তিনি প্রথম দাঁড়াতে পেরেছিলেন ২০০৮ সালে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বেঙ্গালুরুর ওয়ানডে ম্যাচের আগের ওই সংবাদ সম্মেলনে দুজনের অবশ্য দেখাই হলো কেবল, কথা হলো না কোনো। কয়েক বছর পরে প্রথম কথা যেদিন হলো, ধোনিই আলাপ শুরু করলেন, ‘তোমার চুল একটু বেশিই বড় হয়ে গেছে।’ ভারতের তখন তাজ্জব হওয়ার যোগাড়। মাঝে এই যে এতদিন গেল, কোনো কথা না বলে ধোনি কেবল দেখেই গেছেন!
ভারত যেদিন ধোনিকে জানিয়েছিলেন, তিনি একটা বই লিখছেন, সেদিন থেকে ধোনি আবার নতুন খেল শুরু করেছিলেন তার সঙ্গে। ‘চুলটা কেটে ফেলো না!’ বলে বলে রীতিমতো অস্থির করে তুলেছিলেন ভারতকে। এক পর্যায়ে গিয়ে অবস্থা তো এমন দাঁড়িয়েছিল, ‘চুল কেটে ফেলো’ হয়ে গিয়েছিল ভারতকে ধোনির সম্ভাষণ জানানোর তরিকাই।
ভারতকে শুধু নিজে জ্বালিয়েই ক্ষান্তি দেননি রাঁচির রাজকুমার, টেনে এনেছিলেন গোটা পরিবারকে। মেয়ে জিভা সিং ধোনির বয়স তখন মাত্র ২, ধোনি প্রথমে চেষ্টা করিয়েছিলেন ওই কচি মুখ দিয়ে ভারতের জন্য ‘চুল কেটে ফেলো, চুল কেটে ফেলো’ বলাতে। এতে যখন লাভ হলো না, তখন ডাক পড়ল স্ত্রী সাক্ষী ধোনির। সাক্ষী তো দেখেই বললেন,
‘(ভারত) তোমার চুল কাটার জন্য আমার হাত নিশপিশ করছে। চলো, একটা ডেট ফিক্স করি। আমরা জ্যামাইকাতে তোমার চুল কাটব। মাহিকেও (মহেন্দ্র সিং ধোনি) পাশে রাখব। বেশ মজা হবে।’
– সাক্ষী ধোনি
সেই চুল কাটার দিন যখন এলো, ভারতীয় ক্রিকেট দলএর জন্য সময়টা একটু বিব্রতকরই। এর আগের দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে গেছে দল। কাঠগড়ায় ধোনিই উঠছেন সবার আগে। ১০৮ বল খেলে করেছেন ৫৮ রান, বাউন্ডারি মেরেছেন একটা। মাত্র ১৯০ রান তাড়া করতে গিয়েও যেহেতু ১১ রান কমে থেমেছে তারা, দেশে-সোশ্যাল মিডিয়ায় ধোনির মূণ্ডুপাত চলছে সমানে।
অ্যান্টিগা থেকে জ্যামাইকাতে যাওয়ার কথা এর পরদিনই। ভারত সুন্দরেসান যতক্ষণে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছেন, ভারতীয় ক্রিকেট দল এর আগেই সেখানে উপস্থিত। চেক-ইন কাউন্টারে ক্রিকেটাররা দাঁড়িয়ে গেলেই পড়তে হবে অবধারিত দীর্ঘসূত্রিতার সামনে, ভারত তাই প্রাণপণ লড়ছেন কাউন্টারে আগে ঢোকার। কিন্তু, সেখানে বাধার দেয়াল তুলে দাঁড়ালেন সাক্ষী। আর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ধোনি নিজেই, তার হাতের আঙুলগুলো ততক্ষণে রূপ নিয়েছে কাঁচির দুই ফলার। সাক্ষীর মুখের দুষ্টু হাসিতে ভারত বার্তাটা পড়তে পারছিলেন পরিষ্কার, ‘আজ ছাড়া পাওয়া মুশকিলই হবে।’
কোনো এক রকমে ভারত পার পেয়েছিলেন সেদিন। তবে, বাইরের চাপ-টাপ ধোনিকে ছোঁয় না, ধোনি ঠিক এই মুহূর্তে বাঁচেন – বুঝতে কি এর চেয়েও বড় উদাহরণ লাগবে!