এবারের কোপা আমেরিকার আসরে চিলিকে ‘বুড়োদের দল’ বললে বিশেষ ভুল হবে না। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল এবং উরুগুয়ের মতো দেশ চেষ্টা করেছে তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গঠন করতে। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের অধিকাংশই তরুণ, বয়স হয়তো ২৫ বছরের আশেপাশে। কিন্তু চিলির দলে এমন পরিবর্তন নেই। তরুণদের কোনো ছোঁয়াই নেই বর্তমান চিলিতে। কারণ রেইনালদো রুয়েদা রিভেরা যে দল ঘোষনা করেছেন, তাতে অধিকাংশ খেলোয়াড়দের বয়সই ত্রিশের কোঠায়।
২০১৫ সালে ইতিহাসে প্রথম কোপা আমেরিকা শিরোপা জেতে চিলি। সে বছর তাদের কোচ ছিলেন হোর্হে সাম্পাওলি। শতবর্ষ পূর্তী উপলক্ষ্যে আয়োজিত পরের বছরের কোপা আমেরিকাতেও হুয়ান আন্তোনিও পিজ্জির চিলি কোপা আমেরিকার ট্রফি তাদের কাছেই রেখে দেয়। এরপর থেকেই দলটির অধঃপতন। গত কয়েক বছর তাদের সময় প্রচন্ড খারাপ যাচ্ছে। এতটাই খারাপ যে, গত বছর বাছাইপর্ব উতরে তাদের রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হয়নি। এরপর কোচের দায়িত্ব থেকে বরখাস্ত হন হুয়ান আন্তোনিও পিজ্জি, নতুনভাবে কোচের আসনে বসেন রেইনালদো রুয়েদা রিভেরা।
যদিও কোচ পরিবর্তনে দলটির পারফরম্যান্সে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সাম্প্রতিক সময়ে চিলির ফুটবল ফেডারেশন তরুণ খেলোয়াড়দের মূল দলে খেলানোর মতো যোগ্যতাও তৈরি করে দিতে পারেনি। ফলে রিভেরাও তেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেননি দলটির ওপর। কোপা আমেরিকায় চিলির একমাত্র ভরসা দলের পুরনো সৈনিকদের অভিজ্ঞতা।
২০১৫ এবং ২০১৬ সালে টানা দুই কোপা আমেরিকা ফাইনালে টাইব্রেকারে চিলিকে জেতানোর পেছনে মূল কারিগর ছিলেন গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভো। দুই ফাইনালে টাইব্রেকারে একটি করে পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি পুরো ৯০ মিনিট গোলবার সামলে রেখেছিলেন আর্জেন্টিনার আক্রমণের বিপক্ষে। বার্সেলোনা ছেড়ে ম্যানচেস্টার সিটিতে পাড়ি জমানোর পর ব্রাভো নিজের ফর্ম হারিয়েছেন। আগের সেই ধারও আর নেই। পাশাপাশি এ বছর ইনজুরির জন্য নিয়মিত মাঠেই নামতে পারেননি। তাই কোপা আমেরিকা জেতানো এই গোলরক্ষককে পাচ্ছে না চিলি। এবারের আসরের জন্য ডাক পাওয়া তিনজন গোলরক্ষকের ভেতর কেউই সেভাবে পরীক্ষিত ও ভরসাযোগ্য নন। তাই গ্যাব্রিয়েল আরিয়াসকে গোলবারের তলায় রেখে নিশ্চিত থাকতে পারবেন না চিলির কোচ।
রক্ষণে খেলা মুখগুলো বেশ পরিচিত। বিগত দুই কোপার আসরে যারা ছিলেন, এবারও তারাই খেলবেন রিভেরার একাদশে। রাইটব্যাকে মৌরিসিও ইসলা, লেফটব্যাকে গঞ্জালো যারা এবং সেন্টারব্যাক হিসেবে গ্যারি মেদেল পূর্বপরিচিত। শুধু গ্যারি মেদেলের সাথে এবার জুটি বাঁধবেন গুইল্লেরমো মারিপান। এরা সবাই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ডিফেন্ডার, লাতিন অঞ্চলের ফুটবলের ধরনও অন্যদের থেকে ভালো বোঝেন। কিন্তু সমস্যা হলো, রক্ষণের প্রত্যেকের বয়স ৩০ বছরের বেশি। সাম্প্রতিক ফর্মও খুব ভালো যাচ্ছে না তাদের, বয়সের কারণে আগের সেই গতিও কমে গেছে। তাই আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের ঈর্ষা জাগানো আক্রমণভাগের সামনে, অথবা পেরু ও ভেনেজুয়েলার মতো হুট করে জ্বলে ওঠা দলের বিপক্ষে এই বুড়োদের রক্ষণ কতক্ষণ অটুট থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
মধ্যমাঠের অবস্থাও সেই রক্ষণের মতো। তরুণদের কোনো ছোঁয়া নেই। ভরসার পাত্র সেই পুরনো আর্তুরো ভিদাল ও চার্লেস আরানগুইজেরা। যদিও বর্তমান চিলি দলে এই ভিদালই একমাত্র ব্যতিক্রম। এ মৌসুমে জুভেন্টাস থেকে বার্সেলোনাতে এসেছেন এই চিলিয়ান মিডফিল্ডার। প্রথম মৌসুমে তার পারফরম্যান্স যথেষ্ট নজরকাড়া। তাই মধ্যমাঠে তার উপস্থিতি চিলির সমর্থকদের কিছুটা স্বস্তি দেবে। আর আছেন চার্লেস আরানগুইজ। বায়ার্ন লেভারকুসেনের হয়ে ভালো একটি মৌসুম কাটিয়েছেন। শেষবার কোপা আমেরিকায় চিলির মধ্যমাঠের সেরা খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন তিনি। তাই মধ্যমাঠ নিয়ন্ত্রণ করার মতো বড় দায়িত্ব থাকবে তাদের ঘাড়ে। ভিদাল ও আরানগুইজের পাশে খেলার জন্য আছেন এরিক পুলগার। ইতালিয়ার ক্লাব বোলোনিয়ার হয়ে দারুণ একটি মৌসুম পার করেছেন তিনি। ক্লাবের ফর্ম যদি কোপা আমেরিকায় ধরে রাখতে পারেন, চিলি মধ্যমমানের একটি মধ্যমাঠ হয়তো তৈরি করতে পারবে।
রক্ষণ এবং মধ্যমাঠের জন্য পর্যাপ্ত এবং সঠিক খেলোয়াড় তাদের নেই। কিন্তু টানা দুইবার কোপা আমেরিকার শিরোপা জেতা দলটির হতাশা অন্য জায়গায়। বর্তমান সময়ে তাদের সেরা তারকা খেলোয়াড়কে তারা পাবে ফর্মহীন ও ইনজুরিতে জর্জরিত হওয়া অবস্থায়। সম্প্রতি শেষ হওয়া মৌসুম যেভাবে শেষ হয়েছে আলেক্সিস সানচেজের, তাতে কোপাতে দুঃস্বপ্নের স্মৃতি নিয়ে খেলতে আসবেন তিনি। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত কোপা আমেরিকায় আলেক্সিস সানচেজ করেছিলেন তিন গোল। বাকি ম্যাচগুলোতে গোল না পেলেও মাঠে নজরকাড়া পারফরম্যান্স ছিল। কিন্তু গত বছর আর্সেনাল থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে পাড়ি জমানোর পর তার ফর্ম পড়তির দিকে। ক্লাবেও নিয়মিত নামেননি, দেশের হয়েও অনিয়মিত। ইনজুরি হানা দিয়েছে বারবার। ফলে ফর্মে ফিরে আসার জন্য অনুশীলনের সুযোগও আসেনি। সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, বর্তমান চিলি কোচ তাদের দলের সেরা খেলোয়াড়কে এখন ঠিকভাবে তার একাদশে ব্যবহার করতেই পারেননি। তাই সানচেজ দলে থাকলে ভালো খেলার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তবে ভালো খেলা থেকে বড় চিন্তা, রুয়েদা রিভেরার একাদশে তার জায়গা হবে কি না। যদিও কোপা আমেরিকার মতো প্রতিযোগিতায় দলের তারকা খেলোয়াড়কে উপেক্ষা করে একাদশ বানানোর ঝুঁকি রিভেরা নেবেন না।
সর্বশেষ চিলি যখন কোপা আমেরিকা জেতে, তখন পিজ্জির অধীনে চিলি ৪-৩-৩ ফর্মেশনে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতো। কিন্তু রুয়েদা রিভেরা চিলির খেলার ধরন অনেকটা বদলে দিয়েছেন। তার অধীনে দলটিকে ৪-৩-১-২ অথবা ৪-১-৩-২ ফর্মেশনে খেলতে দেখা গেছে। লক্ষ্যনীয় যে, রুয়েদা তার ট্যাকটিক্সে মধ্যমাঠকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করেন। কখনও তিনজন সেন্টার মিডফিল্ডার রেখে একজনকে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের দায়িত্ব দেন। আবার কখনও রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভুমিকায় একজনই থাকেন। এক্ষেত্রে, আর্তুরো ভিদালকে দেখা যেতে পারে মধ্যমাঠের রক্ষনভাগের মুল দায়িত্বে। বিপরীতে এদুয়ার্দো ভারগাসের পাশে আক্রমণের মুল ভুমিকায় থাকবেন অ্যালেক্সিস সানচেজ।
চিলির একমাত্র স্বস্তি ও ভরসার জায়গা স্ট্রাইকার পজিশনে, এদুয়ার্দো ভারগাসকে ঘিরে। ক্লাবের হয়ে তার পারফরম্যান্স মনে রাখার মতো নয়। ভ্যালেন্সিয়া, নাপোলি বা কুইনস পার্ক রেঞ্জার্সের মতো ইউরোপের দলে খেললেও কখনও থিতু হতে পারেননি। কিন্তু ২৯ বছর বয়সী এ স্ট্রাইকার চিলির জার্সিতে সবসময়ই উজ্বল। সর্বশেষ কোপা আমেরিকায় তিনি করেছিলেন সর্বোচ্চ ৬ গোল। বর্তমানে ভারগাস পাড়ি জমিয়েছেন মেক্সিকান ক্লাব টাইগ্রেসে। সেখানেও এ মৌসুমে নিয়মিত গোলধারা বজায় রেখেছেন। তাই ২০১৬ এর কোপা আমেরিকায় চিলির গোল করা নায়ক এবারও তাদের একমাত্র ভরসা।
চিলি যে টানা দুইবার কোপা আমেরিকায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সেখানে কিন্তু শুরুতে তারা ফেভারিট টিম ছিল না। অথচ তারাই আর্জেন্টিনার মতো দলকে হারিয়ে শিরোপা জিতে নিয়েছিল। এর কারণ, পিজ্জি ও সাম্পাওলি তাদের ফুটবল দর্শনের সাহায্যে চিলি দলের ভাবমূর্তি বদলে দিয়েছিলেন। সাধারণ একটি দল তাই হয়ে উঠেছিল অসামান্য। তাই তাদের বিদায়ের পর এবং দলের প্রধান খেলোয়াড়েরা ফর্ম হারিয়ে ফেললে দলটির অবনতির যাত্রা শুরু হয়। দুঃসময়ের আগে দলের তারকা ছিলেন ভারগাস, ভিদাল, আরানগুইজ ও সানচেজরা। চিলির হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে দলের হাল পুনরায় তাদেরই আবার ধরতে হবে। তবে ভিদাল বা সানচেজরা হতাশ করলে এবারের লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে চিলির প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়।
গ্রুপ সি’তে চিলি খেলবে উরুগুয়ে, জাপান ও ইকুয়েডরের বিপক্ষে। খালি চোখে গ্রুপ খুব সোজা মনে হলেও এ গ্রুপটি প্রত্যেকটি দলের জন্য যথেষ্ট কঠিন। বিশেষ আমন্ত্রণে খেলা জাপান এশিয়ার সেরা দল। উরুগুয়ে এবার সরাসরি টার্গেট করছে শিরোপাকে। আর লাতিন আমেরিকার দলগুলোও খুব সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। ভাগ্য ও পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে থাকলে ইকুয়েডরও চমক দেখাতে পারে। তাই শক্তিমত্তা থেকে বড় দলের তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও চিলিকে মূল পর্বে টিকে থাকতে হলে নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়েই চেষ্টা করতে হবে।