ক্রিকেটে রেকর্ড গড়া হয় ভাঙবার জন্য। তবে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে এমন কয়েকটি রেকর্ড আছে, যেগুলো কেউ কখনও টপকাতে পারবে না বলে তারা বিশ্বাস রাখে। এর মধ্যে অন্যতম হলো স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যানের ব্যাটিং গড়। আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে শূন্য রানে ফিরে না গিয়ে মাত্র চার রান করলেই ব্রাডম্যানের ব্যাটিং গড় হতো বরাবর একশো! টেস্ট ক্রিকেটে ডন ব্রাডম্যানের ৫২ টেস্টে ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড় এখনও সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় কার? এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে ক্রিকেট ভক্তদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে না। যদি একই প্রশ্ন কিছুটা ঘুরিয়ে বলা হয়, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় কোন ব্যাটসম্যানের? এই প্রশ্নের উত্তরেও বেশিরভাগ ক্রিকেট ভক্ত ডন ব্রাডম্যানের নাম বলবে। কিছুদিন আগপর্যন্তও তাদের উত্তর সঠিক ছিলো। ২৩৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৯৫.১৪ ব্যাটিং গড়ে ২৮,০৬৭ রান করেছেন ডন ব্রাডম্যান। এরকম আকাশছোঁয়া ব্যাটিং গড় টপকানোর সাধ্যি কার!
এই অসাধ্য সাধন করেছেন আফগানিস্তানের আঠারো বছর বয়সী ক্রিকেটার বাহির শাহ। মাত্র ১২ ইনিংসে ১২১.৭৭ ব্যাটিং গড়ে ১,০৯৬ রান করেছেন আফগানিস্তানের এই তরুণ ব্যাটসম্যান। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সহস্রাধিক রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় এখন বাহির শাহ’র। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলেন বাহির শাহ। স্পিন ঘার রিজেনের হয়ে অভিষেক ইনিংসে ৪১৭ বলে ৩৪টি চার এবং ১টি ছয়ের মারে অপরাজিত ২৫৬* রান করেন তিনি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস।
- অভিষেক ম্যাচে সর্বোচ্চ ২৬০ রান করেছেন আমুল মজুমদার। তিনি ১৯৯৪ সালে ১৮বছর ২৩৩দিন বয়সে এই ইনিংস খেলেন।
- প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মোট ১৭জন ক্রিকেটার তাদের অভিষেক ম্যাচেই দ্বিশতক হাঁকান। এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে দ্বিশতক পূর্ণ করেন বাহির শাহ।
- একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি বাহির। দুই ইনিংসে ৩৪ ও ১১ রান করে সাজঘরে ফিরেছেন।
- প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিজের তৃতীয় ম্যাচে জোড়া শতক হাঁকান তিনি। প্রথম ইনিংসে ১১১ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ১১৬ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেছিলেন।
- বাহির শাহ নিজের ষষ্ঠ প্রথম শ্রেণীর ইনিংসে প্রায় দুদিন ক্রিজে থেকে ৪৬৫ বলে ৩৬টি চার এবং একটি ছয়ের সাহায্যে অপরাজিত ৩০৩* রানের ইনিংস খেলেন। তার আগে বয়স উনিশ পেরানোর আগে দুটি দ্বিশতক হাঁকিয়েছিলেন শুধুমাত্র ইমরান ফারহাত।
- প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদের পর সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকান বাহির শাহ।
- জাভেদ মিয়াঁদাদ ১৭ বছর ৩১০দিন বয়সে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। বাহির শাহ ১৮ বছর ২৫১ দিন বয়সে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকান।
- সবচেয়ে কমবয়সী ট্রিপল সেঞ্চুরিয়ানদের মধ্যে পরের তিনজনই ভারতীয়। ১৯৯৬/৯৭ মৌসুমে মুম্বাইয়ের হয়ে ওয়াসিম জাফর করেছিলেন ১৮ বছর ২৬২ দিন বয়সে।
- ২০০৮/০৯ মৌসুমে তামিলনাড়ুর অভিনব মুকুন্দ ১৮ বছর ৩০২ দিন বয়সে এবং ২০১৬/১৭ মৌসুমে দিল্লীর রিশাব পান্ট ১৯ বছর ৯ দিন বয়সে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মাত্র ছয় ইনিংসে ৮৩১ রান করেছিলেন তিনি। নিজের পঞ্চম প্রথম শ্রেণীর ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ৬৯ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৯* রানে ব্যাট করার সময় বৃষ্টি আঘাত হানলে ম্যাচ সেখানেই শেষ হয়ে যায়। তা না হলে হয়তো বিল পন্সফোর্ডের সবচেয়ে কম ইনিংসে সহস্রাধিক রানের রেকর্ডটি নিজের করে নিতে পারতেন বাহির শাহ।
সবচেয়ে কম ইনিংসে সহস্রাধিক রান করতে না পারলেও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে প্রথম ছয় ইনিংসে ৮৩১ রান করে বিশ্বরেকর্ড গড়েন বাহির। এর আগে প্রথম ছয় ইনিংসে ৭৪১ রান করেছিলেন বিল পন্সফোর্ড। ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০০ সালে কুনারে জন্মগ্রহণ করেন সাঈদ বাহির শাহ মাহবুব। তার শৈশবের হিরো দক্ষিণ আফ্রিকার ডানহাতি ব্যাটসম্যান হাশিম আমলা। বাহির শাহ নিজেও ডানহাতে ব্যাট করেন। হাশিম আমলার মতো যেকোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে সামনে এগিয়ে যেতে চান তিনি। এখন পর্যন্ত ঠিক পথেই আছেন। একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকানো হাশিম আমলার মতো তিনিও আফগানিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে মাত্র ষষ্ঠ ইনিংসেই ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকান।
বর্তমানে বাহির শাহ আফগানিস্তানের হয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার জন্য নিউ জিল্যান্ডে অবস্থান করছেন। বিশ্বকাপ সামনে রেখে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতেও তিনি অসাধারণ ব্যাট করেছেন। বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে দলের বিপর্যয়ের মুখে ৪৪ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছেন তিনি। এই যুব বিশ্বকাপের মধ্য দিয়েই ক্রিকেট বিশ্বকে নিজের ব্যাটিং প্রতিভার ঝলক দেখানোর বড় সুযোগ পাবেন বাহির শাহ।
বাহির মাত্র সাতটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে পাঁচটি শতক এবং দুটি অর্ধশতকের সাহায্যে ১২১.৭৭ ব্যাটিং গড়ে ১,০৯৬ রান করেছেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড়ে রান করা ব্যাটসম্যান এখন তিনিই। এই তালিকায় বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও জায়গা করে নিয়েছেন। সাউথ জোনের হয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগের উদ্বোধনী ম্যাচে ২২৬ বলে ১১টি চার এবং চারটি ছয়ের মারে ১১০ রান করা মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত এখন পর্যন্ত ২৪টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে দশটি অর্ধশতক এবং আটটি শতকের সাহায্যে ৬৯.০৮ ব্যাটিং গড়ে ২,৪১৮ রান করেছেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড়ে রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় তিনি পঞ্চম স্থানে আছেন। তার উপরে আছেন বাহির শাহ, অস্ট্রেলিয়ার ডন ব্রাডম্যান, ভারতের বিজয় মার্চেন্ট এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের জর্জ হ্যাডলি।
স্যার ডন ব্রাডম্যান ৩৩৮ ইনিংসে ৯৫.১৪ ব্যাটিং গড়ে ২৮,০৬৭ রান করেছেন; শতক হাঁকিয়েছেন ১১৭টি এবং অর্ধশতক ৬৯টি। বিজয় মার্চেন্ট ২৩৪ ইনিংসে ৭১.৬৪ ব্যাটিং গড়ে ১৩,৪৭০ রান করেছেন, ৫২টি অর্ধশতকের বিপরীতে ৪৫টি শতক হাঁকিয়েছেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়ের তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকা জর্জ হ্যাডলি ১৬৪ ইনিংসে ৬৯.৮৬ ব্যাটিং গড়ে ৯,৯২১ রান করেছেন। তিনি শতক হাঁকিয়েছেন ৩৩টি এবং অর্ধশতক ৪৪টি।
ফিচার ইমেজ – realityistheheart, Twitter (edited)